দুর্ঘটনার আঘাত থেকে মস্তিষ্ক সুরক্ষায় সচেতনতা
বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘দুর্ঘটনার আঘাত থেকে মস্তিষ্ক সুরক্ষায় সচেতনতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০ মার্চ ২০২২। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
জাহিদ মালেক, সংসদ সদস্য
মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া
সভাপতি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল গনি মোল্লাহ
পরিচালক, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)
অধ্যাপক ডা. আখলাক হোসেন খান
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, নিউরোসার্জারি বিভাগ, বিএসএমএমইউ
অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুর রহমান
নির্বাহী পরিচালক, সিআইপিআরবি
অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার
বিভাগীয় প্রধান, নিউরোসার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল্লাহ আলমগীর
বিভাগীয় প্রধান, নিউরোট্রমা বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল
অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান
পরিচালক, অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বুয়েট
ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফী
চিফ, হেলথ ইনফরমেশন ইউনিট, এমআইএস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
ডা. কামরান-উল বাসেত
সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
ডা. তুনাজ্জিনা শাহরিন
ডেপুটি ম্যানেজার, ক্রিটিক্যাল কেয়ার সার্ভিস, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ
ডা. মো. জয়নুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অনেক সময় আমরা মাথায় আঘাত পাই। এর ফলে মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর বেঁচে থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্কের কারণে দেহের কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনেক সময় অচল হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। আবার নির্মাণকাজের সময়ও শ্রমিকদের অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হন।
বাস ও অন্যান্য যানবাহনের চালকদের দক্ষতা এবং নির্মাণকাজসহ সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শুধু যাত্রী ও চালক নন, পথচারী সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা জরুরি।
জাহিদ মালেক
আজ ২০ মার্চ। হেড ইনজুরি সচেতনতা দিবস ২০২২। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে। এর লক্ষ্য হলো মানুষকে মস্তিষ্কের আঘাত ও আঘাতজনিত সমস্যার বিষয়ে সচেতন করা। মস্তিষ্কে আঘাত একটি মারাত্মক সমস্যা। এ কারণে অনেকে শারীরিকভাবে অক্ষম হচ্ছেন। অনেকে মারা যাচ্ছেন। মস্তিষ্কে আঘাতজনিত সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ জন্য অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমাদের দেশেও মস্তিষ্কে আঘাতজনিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানবাহন, নগরায়ণ, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসংস্থান ইত্যাদি কারণে মস্তিষ্কে আঘাতজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন সারা বিশ্বে মস্তিষ্কে আঘাতের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। মস্তিষ্কে আঘাতজনিত ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে।
আক্রান্ত ব্যক্তিরা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। মস্তিষ্কে আঘাতের প্রধান কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা ও উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাওয়ার ফলে দুর্ঘটনা। গত কয়েক বছর আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা এখন একপ্রকার জাতীয় সমস্যা। প্রতিদিন গড়ে আটজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। ১৯৮২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ৪০০ শতাংশ। বিভিন্ন উৎসবের সময় দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। গত ২১ বছরে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৮৪ হাজার। এতে প্রাণহানি হয়েছে ৫৬ হাজার মানুষের। আহত হয়েছেন ৬৩ হাজার। ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ১১২টি। এতে ৪ হাজার ২৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৮ হাজার ৫৭২টি। প্রাণহানি হয়েছে ৩ হাজার ৪১২ জনের। এক বছরের ব্যবধানে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
২০২০ ও ২০২২ সালে কোভিডের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশ। তাই বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ। সাবইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমরা সচেতন হলেই মস্তিষ্কের আঘাত রোধ করতে পারি। (অনলাইনে দেওয়া বক্তৃতা)
মো. জয়নুল ইসলাম
আজ ২০ মার্চ। বিশ্ব মস্তিষ্ক আঘাতজনিত দিবস। প্রতিবছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য সচেতনতা বৃদ্ধি। আমরা শোভাযাত্রা ও আলোচনার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকি। এতে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা সৃষ্টি হয় না। অধিকাংশ সময় আমরা যদি মস্তিষ্কের আঘাত রোধ করতে পারি, তাহলে অনেক মৃত্যু কমে যাবে। তাই গণমাধ্যমের সাহায্যে এটা দেশের মানুষকে জানাতে পারি। এটাই আজকের গোলটেবিল আলোচনার প্রধান বিষয়। হেড ইনজুরির বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যথাযত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা উপস্থিত আছেন, তাঁদের কাছ থেকে এ বিষয়ে শুনব। গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও আমরা সবাই সমন্বিতভাবে এ দুর্ঘটনা থেকে মস্তিষ্ক সুরক্ষার বিষয়টি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। এ লক্ষ্যে আমরা ভবিষ্যতে সমন্বিতভাবে কাজ করার আশা ব্যক্ত করে শেষ করছি।
কামরান-উল বাসেত
২০১৬ সালে সিআরপি বাংলাদেশে তিন লাখ আহত ব্যক্তির হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি জরিপ করেছিল। সেখানে মস্তিষ্কে আঘাতের প্রধান কারণ ছিল গাড়ি দুর্ঘটনা। এটা প্রায় ৩০ শতাংশ। ২৫ শতাংশ ওপর থেকে পড়ে। আর সহিংসতা থেকে মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছে ১৫ শতাংশ। ২০২০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে হাসপাতালগুলোর ওপর একটি জরিপ করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত। সরকার ২০১৮ সালে রোড সেফটি অ্যাক্ট করেছে। সেখানে হেলমেটের মান ঠিক করা হয়নি। বলা হয়েছে, দুজনকেই হেলমেট পরতে হবে। কিন্তু মানসম্মত হেলমেট পরা থাকলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মস্তিষ্ক আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সম্প্রতি মানসম্মত হেলমেট নিয়ে কাজ হচ্ছে। মস্তিষ্কের আঘাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের মানসম্মত হেলমেট পরতে হবে। আবার আঘাত পেলে হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেক কাজ আছে। সে বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
শাহ আলী আকবর আশরাফী
শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে আঘাতের বিষয়টি আমাদের সামনে আসে। কিন্তু নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে যে মস্তিষ্কে আঘাত পেতে পারে, সেটিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই সব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তাহলে সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ জন্য মস্তিষ্কে আঘাতের কারণগুলো নির্ণয় করতে হবে।
মস্তিষ্কে আঘাত পেলে রোগীরা সাধারণত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস, পঙ্গু হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেলে বেশি যান। এসব জায়গায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুসারে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি এবং কী কারণে মস্তিষ্কে আঘাত পায়, সেটাও এখান থেকে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা দেশের ব্যক্তি খাতের হাসপাতালগুলোকেও মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ার কারণ নির্ণয় করার কথা বলেছি। মস্তিষ্কে আঘাতে মৃত্যু কত হচ্ছে, সেটাও ঠিকভাবে জানি না। এ বিষয়েও আমরা উদ্যোগ নেব।
প্রাইভেট হাসপাতালকে আমাদের এমআইএসের (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। তাদের কাছ থেকেও তথ্য পাব। প্রাইভেট হাসপাতালকেও অনুরোধ করব, তারাও যেন তথ্য আদান-প্রদানে আন্তরিক থাকে। সবার সহযোগিতা থাকলে আমরা এ বিষয়ে আরও বেশি উন্নতি করতে পারব।
অসিত চন্দ্র সরকার
হেড ইনজুরির প্রচলিত কারণের বাইরেও ঢাকা মেডিকেলে কিছু ব্যতিক্রম হেড ইনজুরি আসে। রিকশা বা এ ধরনের যানবাহনে চলার সময় অনেকে গলায় জড়ানো ওড়না গাড়ির চাকার সঙ্গে পেঁচিয়ে রাস্তায় পড়ে যান। তঁারা মূলত স্পাইনাল ইনজুরি নিয়ে আসেন। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয় হেড ইনজুরি। ঢাকা মেডিকেলে এখনো এ ধরনের কয়েকজন রোগী আছেন। গলার সঙ্গে ওড়না না পেঁচিয়ে যদি হালকাভাবে আমরা রাখতে পারি, তা হলে এ ধরনের ইনজুরি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ঢাকা মেডিকেল একটি টারশিয়ারি হাসপাতাল। এখানে কোনো রোগীকেই ফেরত দেওয়া হয় না। হেড ইনজুরির জন্য আমাদের ৩০০ শয্যা আছে। কিন্তু রোগী থাকে ৪০০ থেকে ৫০০। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে মেঝে ও সিঁড়িতে রেখেও চিকিৎসা দিতে হয়। এটা মানবিক দিক থেকে ঠিক নয়। কিন্তু রোগীকে সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের এটা করতে হয়।
হাসপাতালে আগের চেয়ে অনেক সুযোগ বেড়েছে। এরপরও রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়। অনেক রোগী নির্ভরশীল ও আংশিক নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অন্তত ৩০টি আইসিইউ শয্যা থাকার কথা। কিন্তু একটিও নেই। এ জন্য হেড ইনজুরি রোগীদের আইসিইউ শয্যা পেতে অনেক সমস্যা হয়। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তঁারা বাইরে চলে যান। কিন্তু গরিব রোগীরা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকে তঁাদের অবস্থা খারাপ হয়। আশা করছি, ভবিষ্যতে এই সমস্যা থাকবে না।
আখলাক হোসেন খান
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে আমাদের হাসপাতালে হেড ইনজুরি চিকিৎসা শুরু হয়। এখনো ইমার্জেন্সি বিভাগ চালু আছে। গত এক মাসে তিনজন হেড ইনজুরি রোগী ভর্তি হয়েছেন। তঁাদের একজনের বয়স ১৬ বছর। সে হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল। তার সমস্যা গুরুতর। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছে। তার মা–বাবা সাধারণ কৃষক। এ পর্যন্ত চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
সাতক্ষীরায় একজনের হেড ইনজুরি হয়েছে। তাঁর বয়স ২৫ বছর। খুলনায় তাঁর মাথায় অপারেশন হয়েছে। এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। হেড ইনজুরিসহ তাঁর আরও ইনজুরি আছে। তিনি পঙ্গু হয়েছেন। আরেকজনের বয়স ৬০ বছর। তাঁর মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাঁর অপারেশন হয়েছে। আমাদের বিভাগে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ভর্তি করি। দ্রুত ভর্তি করে চিকিৎসা না দিলে বাঁচানো সম্ভব হতো না। একধরনের রোগী তো দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। যঁারা বেঁচে যান, তঁাদের অধিকাংশের খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়। এ ক্ষেত্রে সবাই সবার অবস্থান থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি। আমি বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে আমার শিক্ষার্থীদের সচেতন করেছি। বাইরে পোস্টার লাগিয়ে, শোভাযাত্রা করে সচেতন করেছি। এভাবে যদি সচেতনতার কাজ করি, তাহলে হেড ইনজুরি রোধ করতে পারব। সবার মধ্যে সচেতনতার বার্তা নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বিশ্ব হেড ইনজুরি দিবস সার্থক হবে বলে আশা করি।
মো. আবদুল্লাহ আলমগীর
হেড ইনজুরি থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারি, এই একটা জায়গায় আমাদের ফোকাস করতে হবে। তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। রাস্তা ও চালকদের মধ্যে শৃঙ্খলা আসতে পারে। যাত্রী, চিকিৎসক, নাগরিক সমাজের মধ্যে সচেতনতা আসতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, আজ এই গোলটেবিল আলোচনার পর হেড ইনজুরি রোধের কার্যক্রম চলমান রাখব এবং আমরা সফল হব। সেটা কীভাবে সম্ভব। আশি ও নব্বইয়ের দশকে অ্যাসিড মারার প্রবণতা ছিল অনেক বেশি। সেটা প্রতিরোধ করতে পেরেছি।
শুধু চিকিৎসা করলে হবে না, বিষয়টিকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আইন আমাকে বলে দেবে অন্যায়টা করা যাবে না। মোটরসাইকেলে অবশ্যই হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। হেলমেট না থাকলে পেট্রলপাম্প তেল দেবে না। হেড ইনজুরির কারণ তো আমরা তৈরি করছি। এটি প্রতিরোধ করতে পারি। এ জন্য মূল করণীয় হলো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আজকের গোলটেবিল আলোচনার মতো আমরা যদি স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমন আলোচনা করতে পারি, তাহলে এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাবে। পাঠ্যপুস্তকে যদি নিয়ে আসতে পারি যে হেড ইনজুরি প্রতিরোধযোগ্য, তাহলে অনেকটা সফল হতে পারব। আবার শুধু ঢাকাকে নিয়ে চিন্তা করলে হবে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথাও ভাবতে হবে।
দেশে যে হারে দুর্ঘটনা বাড়ছে, সেভাবে হাসপাতাল, চিকিৎসক ও সেবার সুযোগ বাড়েনি। একটি নির্দিষ্ট টাইমফ্রেমের মধ্যে আমাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। হেড ইনজুরি মানে হলো দ্রুত ব্যবস্থাপনা। কোনো রকম দেরি করার সুযোগ নেই। সবশেষে হলো পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া। স্বাভাবিক চিকিৎসার পর সবাই ঠিক হবে না। অনেক রোগীকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে এখনো আমরা সফলভাবে পুনর্বাসনব্যবস্থা চালু করতে পারিনি। তাই এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে।
মো. হাদিউজ্জামান
২০০২ সাল থেকে আমরা দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছি। বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনা কতটা ঊর্ধ্বমুখী গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির তথ্য দেখলে বোঝা যাবে। এই দুই মাসে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। এর ভয়াবহতা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এক গবেষণায় দেখেছি, ঢাকা শহরে প্রায় শতভাগ মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী হেলমেট পরছেন। কিন্তু হেলমেটের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিএসটিআই একটি মান ঠিক করে দিয়েছে, কিন্তু সেটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এর মধ্যে অনেকে একধরনের প্লাস্টিকের বাটি পরছেন। তাঁরা জানেনই না যে হেলমেট আসলে কী? অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৬৭ শতাংশ দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে, যদি হেলমেট ঠিক থাকে। ১১১ দফা সুপারিশ তৈরিতে আমরা যুক্ত ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে মানসম্মত হেলমেটের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যারা হেলমেট তৈরি করছে বা বিদেশ থেকে আমদানি করছে, তারা এ বিষয়ে সচেতন নয়। তাদের বোঝাতে হবে, তারা যদি মানহীন হেলমেট বিক্রি করে, তাহলে সেটা দুর্ঘটনা রোধ করবে না।
বিএসটিআই শুধু একটা মান নির্ধারণ করে দিলে হবে না, তাদের এটা তদারক করতে হবে। তারা খুব কম ব্যয়ে হেলমেট পরীক্ষার ল্যাব করতে পারে। বিদেশ থেকে যে হেলমেট আসে, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পারে, ঠিক আছে কি না। আমরা ১৬৫ সিসি মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে যে বাংলাদেশে ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালানো যাবে। জাপান গত ১০ বছরে বেশি সিসির ২৫ লাখ মোটরসাইকেল সড়কে থেকে তুলে নিয়েছে। এতে দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমেছে। জাপানে ১০০ সিসি মোটরসাইকেল জনপ্রিয়। তারা বাংলাদেশে বেশি সিসির মোটরসাইকেল বিক্রির ক্ষেত্র মনে করছে। এ কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। মন্ত্রণালয়েকে এ বিষয় বিবেচনা করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইনের ক্ষেত্রে মানবতার কিছু নেই। কঠোরভাবে এ আইন প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এ আইন দুষ্টচক্রের হাতে পড়ে গেছে। এ চক্র ভাঙতে হবে।
এ কে এম ফজলুর রহমান
ব্রেন ইনজুরির (মস্তিষ্কে আঘাত) অন্যতম কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৬৫৯ জন মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত রোগী নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। এর ৬৫ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। গত কয়েক বছরে বাইসাইকেলের জায়গা মোটরসাইকেল দখল করেছে। অধিকাংশ স্থানীয় শহরগুলোয় রিকশার পরিবর্তে ইজিবাইক চলছে। এ জন্য দুর্ঘটনাও বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো, কত দিন পর্যন্ত এটা বাড়তে থাকবে? মনে করা হচ্ছে, যত দিন পর্যন্ত উন্নয়ন বাড়বে, তত দিন দুর্ঘটনাও বাড়বে।
এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, যখন মাথাপিছু আয় পাঁচ হাজার ডলার অতিক্রম করবে, তখন এটা কমতে পারে। সে সময় অধিকাংশ বিষয় একটি নিয়মের মধ্যে চলে আসবে। তাহলে কি আমরা ধরেই নেব, দুর্ঘটনা এত দিন পর্যন্ত ঘটতে থাকবে? এটা তো হতে পারে না। একটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য বিষয়কে যদি আমরা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিই, তাহলে তা চলতেই থাকবে। এ ক্ষেত্রে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হবে না। সবাইকে ভাবতে হবে, দুর্ঘটনার বদলে আমরা কী শব্দ ব্যবহার করতে পারি।
অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে কোনো বিষয়ের গুরুত্ব কমে যায়। ধরা যাক, কোনো তথ্যে দেখা গেল বছরে তিন হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন মনে হতে পারে, এটা আর এমনকি। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো ২০ থেকে ২৫ হাজার। আমরা মনে করি, সড়কে নিরাপত্তার জন্য এখন একটা কমিশন করতে হবে। আমাদের সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে। যেমন হেলমেট না হলে মোটরসাইকেলের তেল পাবে না বলে সবাই হেলমেট পরে। ক্যান্টনমেন্টে সবাই নিয়ম মানে। এভাবে প্রয়োজনীয় সবকিছুতে বাধ্য করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা
আজকের আলোচনার তিনটি বিষয়—দুর্ঘটনা রোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন। স্বাস্থ্য বিভাগ সবকিছু করতে পারবে না। অনেক বেশি সিসির গাড়ি এখানে চলবে কি চলবে না, এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ তেমন কিছু করতে পারবে না। মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে মানুষ তেমন হেলমেট পরত না, সিটবেল্ট পরত না। কিন্তু এখন এটা মেনে চলছে। আজকের আলোচনায় মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়িকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। এ দেশের মানুষ বেশি বাসে চড়ে। বাসচালক এবং এর যাত্রীদের বিষয়টি আলোচনায় আনা প্রয়োজন।
বাধ্য না করলে সাধারণত আমাদের দেশের মানুষ আইন মানে না। চালকেরা অনেক সময় গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলেন, যা দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। সারা বিশ্বে যত দুর্ঘটনা হয়, এর অর্ধেকের বেশি হলো সড়ক দুর্ঘটনার। মোটরসাইকেল নিয়ে যে বেশি আলোচনা হয়েছে, এটা ছিল যুক্তিযুক্ত। মোটরসাইকেলের জন্য অন্য গাড়ি ঠিকমতো চলতে পারে না। সে তেমন নিয়ম মানে না। উল্টো, সদর, ফুটপাত—সবদিক দিয়ে চলতে থাকে। মোটরসাইকেল প্রায়ই রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
নির্মাণকাজের সময় ও এর ত্রুটির জন্য মানুষের যে ইনজুরি হয়, এ জন্য রিহ্যাবকে সচেতন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা ঝুঁকিতে থাকেন। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বেশ কটি দিবস পালন করি। আমি মনে করি, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস উপজেলা পর্যায় আমাদের অধিদপ্তর থেকে পালন করা উচিত। মস্তিষ্কে আঘাত প্রতিরোধ করার জন্য উপজেলা পর্যন্ত গোল্ডেন আওয়ার নিশ্চিত করতে হবে। মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীর জন্য আরও শয্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। দুর্ঘটনাকবলিত রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিআরপি ছাড়া আর কোথাও দেওয়া হয় বলে জানা নেই। এ ক্ষেত্রে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, কিন্তু তাতে যদি আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে একদিন আমাদের মধ্য থেকে হয়তো কেউ থাকব না। মস্তিষ্কে আঘাতকে ওয়ান হেলথের মধ্যে এনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
তুনাজ্জিনা শাহরিন
আমি গত নভেম্বরে একটি দুর্ঘটনার শিকার হই। অফিস থেকে মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে সিগন্যাল পড়ে। সিগন্যাল ছেড়ে দিলে চালক খুব জোরে টান দিলেন। আমি ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তের পর দুদিন আমার আর কিছু মনে ছিল না। আমাকে প্রথমে নেওয়া হয়েছিল একটি বেসরকারি হাসপাতালে। পরে নিউরোসায়েন্সে রেফার করা হয়। আরও চার দিন যে হাসপাতালে ছিলাম, সেটা একটু মনে আছে। আমার হেমাটমা (রক্ত জমাট বাঁধা) হয়েছিল। চিকিৎসকেরা এর কিছু অংশ বের করতে পারেন। বাকিটা ওষুধের মাধ্যমে ঠিক করে দেন। কিন্তু আমার এই দুর্ঘটনা যদি দূরে কোথায় হতো বা হাসপাতালে আসতে যদি এক থেকে দুই ঘণ্টা দেরি হতো, তাহলে অনেক ভুগতে হতো।
মো. আবদুল গনি মোল্লাহ
হেড ইনজুরির বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আমাদের হাসপাতালে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী লং বোন, চেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের আঘাত, পলিটোমা, হেড ইনজুরি ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আসেন। এর ব্যবস্থাপনা অনেক চ্যালেঞ্জিং। প্রতি মাসে যদি পাঁচ হাজার রোগী আসে, সেটা বিশাল চাপ তৈরি করে। হেড ইনজুরির জন্য সিটি স্ক্যান করি। রোগীর বমি, অবচেতনসহ জটিলতা দেখা দিলে রেফার করি। জটিল রোগীকে দ্রুত অপারেশন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সবকিছু হয়তো আমরা করতে পারব না। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যখন আসে, তখন তাঁরা যেন দ্রুত তার অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। কিছু চিকিৎসক সেই দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করেন না। হেড ইনজুরি রোগীর জন্য আইসিইউ অত্যন্ত জরুরি। আজ জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) যদি আইসিইউ না থাকে, তাহলে আমাদের অবস্থা কী, তা সহজেই বোঝা যায়।
কিছুদিন আগে একজন বয়স্ক ব্যক্তি হেড ইনজুরি নিয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন। দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁর অপারেশন হয়েছে। তিনি ভালো হয়ে গেছেন। এই কাজ যদি আমরা সরকারি হাসপাতাল করতে পারতাম, তাহলে অনেক উন্নতি হতো। যে চালক ক্যান্টনমেন্টে আইন মানেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আইন মানেন না। এটা কেন? ক্যান্টনমেন্টে গাড়ি চালানোর সময় চালকেরা যে নিয়ম মানেন, সেটা সারা দেশে কেন প্রয়োগ করতে পারছি না? অধিকাংশ নারী যেভাবে মোটরসাইকেলে বসেন, তাতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে। পরিশেষে বলতে চাই, সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারা দেশের সড়কগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। যদি নতুন করে নকশা করতে হয়, সেটাও করতে হবে।
কনক কান্তি বড়ুয়া
বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস ও প্রথম আলোকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার আয়োজনের জন্য। দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে সার্বিক বিষয় যদি ঠিক না থাকে, তাহলে হবে না। আমাদের দেখতে হবে চলাচলের সড়ক ঠিক আছে কি না। যিনি গাড়ি চালান, তিনি ঠিক আছেন কি না। গাড়িচালক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কি না—সেটাও দেখতে হবে। অ্যালকোহল ও ড্রাগস নিয়ে যেন কেউ গাড়ি না চালান, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ট্রাফিক আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যা করণীয়, সেটা করতে হবে।
খেলাধুলার সময়ও অনেক ইনজুরি হয়। ঢাকার ক্রিকেট মাঠে খেলতে গিয়ে ভারতের রমণ লাম্বা হেড ইনজুরিতে মারা গিয়েছিলেন। তিনি হেলমেট ছাড়া ছিলেন। ব্রেন খুব স্পর্শকাতর অঙ্গ। একটা ছোট আঘাতেও শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে। ব্রেনের প্রতি মিলিমিটারকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। ব্রেনের যেন সেকেন্ডারি ইনজুরি না হয়, সেটাও চিকিৎসকদের দেখার দায়িত্ব।
ব্রেন ইনজুরির ক্ষেত্রে গোল্ডেন আওয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিটি স্ক্যান করলেই বুঝতে পারি কী করতে হবে। আমাকে অনেক সময় বিভিন্ন জেলা থেকে ফোন করে রোগী ঢাকায় আনার কথা বলেন। তঁাদের বলি যে ঢাকায় আনতে আনতে রোগী মারা যেতে পারে। স্থানীয় সার্জনের কাছে প্রাইমারি চিকিৎসা করাতে হবে। একসময় বাংলাদেশে চারজন নিউরোসার্জন ছিলেন। এখন ২০১ জন পেশাদার নিউরোসার্জন আছেন। নিউরোসার্জনের সংখ্যা আরও বাড়বে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জনের প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এর ৯০ শতাংশ নিউরোসার্জন ঢাকায়।
দেশে ৩৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে। নিউরোসার্জনদের সুযোগ-সুবিধা ও কাজের পরিবেশ তৈরি করে এসব জায়গায় পাঠানো দরকার। তাহলে অনেক জীবন বাঁচানো যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে হেড ইনজুরির জন্য কংগ্রেস ও রিপাবলিকের সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে কমিটি আছে। তারা প্রতিবছর এটা রিভিউ করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। আমরাও এমন কিছু করতে পারি কি না, এটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
ফিরোজ চৌধুরী
হেড ইনজুরি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা। রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। আজকের আলোচনায় অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা মেনে চলবে বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সুপারিশ
হেড ইনজুরি রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তা না হলে জীবন বাঁচানো কঠিন হতে পারে।
সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলে। এ ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।
সবার মধ্যে সচেতনতার বার্তা নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বিশ্ব হেড ইনজুরি দিবস সার্থক হবে।
হেড ইনজুরি হলে দ্রুত হাসপাতালে এনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানসম্মত হেলমেট পরতে হবে।
মানসম্মত হেলমেট ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তা বিএসটিআই–কে তদারক করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে এ ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
হেড ইনজুরি প্রতিরোধের জন্য উপজেলা পর্যন্ত গোল্ডেন আওয়ার নিশ্চিত করা জরুরি।
হেড ইনজুরিকে ওয়ান হেলথের মধ্যে এনে কর্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
নিউরোসার্জনদের কাজের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জেলা-উপজেলার হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
হেড ইনজুরির বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।