নারী দিবসের আয়োজন
নারীর অগ্রগতি: বাস্তবতা ও সমাধানের পথ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ইউএসএআইডি উজ্জীবন প্রকল্প ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নারীর অগ্রগতি: বাস্তবতা ও সমাধানের পথ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
ফরিদা পারভীন
মহাপরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
ডা. নুরুন নাহার বেগম
লাইন ডিরেক্টর (সিসিএসডিপি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
লিজা তালুকদার
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, ইউএসএআইডি
মাশফিকা জামান সাটিয়ার
জ্যেষ্ঠ পরামর্শক, এসআরএইচআর ও জেন্ডার, ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাস
ডা. ফয়সাল মাহমুদ
কান্ট্রি ডিরেক্টর, জনস হপকিনস সিসিপি এবং ইউএসএআইডি উজ্জ্বীবন প্রকল্পপ্রধান
নাহিদ শারমীন
জেন্ডার স্পেশালিস্ট, অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম
চৌধুরী মো. মোহায়মেন
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, ১০৯৮ শিশু হেল্পলাইন
আনোয়ার সাত্তার
পুলিশ পরিদর্শক, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯
আলী আসগর স্বপন
পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, ঢাকা
মুমিত আল রশিদ
সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদ; ফারসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফখরুল হক শাওন
অনুষ্ঠান প্রধান, রেডিও টুডে
হাজেরা বেগম
প্রেসিডেন্ট, শিশুদের জন্য আমরা
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজকের আলোচনা। নারীর জীবনে বাল্যবিবাহ এক বড় অভিশাপ। এটা রোধে আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের হার কমে আসছিল। তবে করোনার অনিশ্চিত পরিস্থিতির সময় বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি নারীর সহিংসতাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আমরা সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা অসম্ভব কিছু নয়। আমাদের অনেকগুলো জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর আছে। সবাই যেন নম্বরগুলো খেয়াল রাখেন। কারণ, এখান থেকে আমরা একটা প্রতিকার পেতে পারি। অন্তত প্রতিকারের পথ খুঁজে পেতে পারি। গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের প্রধান কাজ হলো মানুষকে সঠিক তথ্য জানানো। সচেতন করা।
লিজা তালুকদার
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে এই সংস্থা। ইউএসএআইডি বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবার মান উন্নয়ন ও অভিযোজন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অনুশাসনের প্রসার, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সুবিধাদির সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আমরা প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করি। দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নারী-পুরুষের সমতা বিধান করার জন্য এখনো অনেক কাজ বাকি। করোনাকালে দেখেছি, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে।
এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই আগামী দিনের জন্য লিঙ্গসমতাই অগ্রগণ্য’। এই টেকসই উন্নয়ন পেতে চাইলে আমাদের নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে জন্য জেন্ডারভিত্তিক বৈষ্যম্য দূর করা জরুরি। আমাদের মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার সময় যেন নিরাপত্তাভীতির শিকার না হয়, আমাদের নারীরা যেন তাদের কর্মস্থলে নিরাপদে, নির্ভয়ে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের যেন কোনো ধরনের আশঙ্কা নিয়ে সমাজে বা রাস্তায় বের হতে না হয়। লিঙ্গসমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বাল্যবিবাহ যে একটি বাধা, এটা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারব না। বাল্যবিবাহ দূরীকরণের জন্য ইউএসএআইডির একটি কর্মকৌশল আছে, যেটি ‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ অ্যান্ড মিটিং দ্য নিডস অব ম্যারিড চিলড্রেন দ্য ইউএসএআইডি ভিশন ফর অ্যাকশন’ নামে পরিচিত। এ কৌশল শুধু যারা বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, তাদের জন্যই নয়, বরং ইতিমধ্যে যারা বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে গেছে, তাদেরও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
আমাদের ইউএসএআইডিতে যারা আছি, তারা প্রত্যেকে বিশ্বাস করি, বাল্যবিবাহের মতো একটি প্রাচীন কিন্তু ক্ষতিকর প্রথা বদলানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি সবার সমন্বয় প্রয়োজন। পরিবারের মানুষের এবং সর্বোপরি আমাদের সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নারী ও শিশুরা তাদের নিজেদের বদলানোর জন্য, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কী চাইছে, কী ভাবছে, সেটার প্রতিফলন সিদ্ধান্তে না থাকলে সে সিদ্ধান্তগুলো যতই ভালো হোক, সেগুলো আমাদের দেশের জন্য সম্পূর্ণ সফলতা বয়ে নিয়ে আসতে পারবে না। তাই আমাদের অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে, যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তখন নারী ও শিশুদের অংশগ্রহণ যেন থাকে এবং তাদের কণ্ঠকে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাহলে মেয়েরা আরও বেশি দিন স্কুলে পড়ালেখা করবে, নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যাতে সে নিজে, তার পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থ থাকতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ বেড়ে যাবে। এই লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য ইউএসএআইডি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে।
ডা. ফয়সাল মাহমুদ
আমরা ইউএসএআইডির উজ্জীবন প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, ন্যাশনাল হেল্পলাইন, এটুআই, বিভিন্ন গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়—সবার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে কাজ করছি এবং করে যাব। তা ছাড়া একাডেমিয়া ও আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, মানবাধিকারকর্মী ও শিশু অধিকারকর্মী যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গেও আমরা একযোগে কাজ করে চলেছি। নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, সমতা—এসব নিয়ে এখনো অনেক কাজ করার আছে।
আমি বিশেষভাবে মনে করি, নারীর অগ্রগতিতে পুরুষদের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। সেবা প্রাপ্তি ও ঘরের কাজে পুরুষের সহায়তা প্রয়োজন—সবকিছুতে আমরা সহায়তা করতে পারি। যদি আমরা নারীদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে অবশ্যই নারীর অগ্রগতি, উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সর্বদা সম্ভব। ইউএসএআইডির উজ্জীবন প্রকল্প আর্থিকভাবে ও কারিগরি সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথ সুগম করে দেওয়ার জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেই সব বিষয়ে আমরা সরকারকে পাশে চাই। আমরা আমাদের কার্যক্রমের সব পর্যায়ে সরকারকে পাশে পেয়েছি এবং একসঙ্গে ভবিষ্যতেও পাব, আশা করছি। ইউএসএআইডির উজ্জীবন প্রকল্প শুধু বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করছে না; বরং মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কিশোর–কিশোরীদের স্বাস্থ্য এবং সার্বিকভাবে নারীর উন্নয়ন ও সমতা নিয়ে কাজ করছে। এ কাজের অংশ হিসেবে শিক্ষকদের সঙ্গেও আমরা বিভিন্নভাবে জড়িত। প্রথম আলো বন্ধুসভা আমাদের সঙ্গে সব সময়ই ছিল। তারা সহায়তা করেছে। তাদের আমরা ভবিষ্যতেও পাশে চাই। এ ছাড়া আজকের আয়োজনে উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তা যাঁরা আছেন, আমরা তাঁদের কাছ থেকে আরও বেশি সাহায্য কামনা করছি। এ ছাড়া গণমাধ্যমকেও আমরা পাশে চাই।
আলী আসগর স্বপন
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার আলাদা শিশু আইন করেছে। আগে এটা নারী আইনের মধ্যে ছিল। এখানে শিশুর সুরক্ষা আরও বেশি করা হয়েছে।
আইন অনুসারে ১৮ বছর না হলে কোনো মেয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। অনেক সময় এই আইনকে পাশ কাটিয়েই বিয়ে হয়। দেখা গেছে মেয়ের বয়স ১৮ হয়নি, কিন্তু একটি ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ দেখিয়ে তারা বিবাহ করেছে। এমনকি নোটারি পাবলিক করা হয় যে মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক। এগুলো করা হয় সাধারণত মামলা থেকে বেঁচে যাওয়ার জন্য। আমার মনে হয়, মহিলা অধিদপ্তরের এ বিষয়ে আরও যত্ন দেওয়া উচিত।
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৈশোরে ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়ে এবং একসময় তারা অভিভাবককে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ নিয়ে মেয়ে বা ছেলের বাবা থানায় মামলা করেন। ছেলের মা–বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন অনেকের নামে মামলার ঘটনা আমরা পেয়ে থাকি। আমার মনে হয়, স্কুল, মাদ্রাসা বা কলেজেরশিক্ষার্থীদের আরও সচেতন করা উচিত। তাদের সচেতন করা উচিত। বুঝিয়ে বলতে হবে, ‘তোমরা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো অন্যায় কাজ বা পালিয়ে যাওয়ার মতো কিছু কোরো না।’ এসব দিক থেকে আমরা আরেকটু সচেতন হলে শিশু নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
হাজেরা বেগম
আমি নিজেই ছোটবেলা থেকে অনেক নির্যাতনের শিকার। যে মেয়ে আজ রাস্তায় ফুল বিক্রি করছে, সে–ও নির্যাতনের শিকার। এই নির্যাতনের কূল–কিনারা সহ্য করতে না পেরে আমি নিজেই একটি সংগঠন করেছি, নাম ‘শিশুদের জন্য আমরা’। প্রতিনিয়ত মেয়েরা বুঝে, না বুঝে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। বাল্যবিবাহ কমাতে হলে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি করে প্রচার চালাতে হবে। এ ছাড়া আইনের লোক যাঁরা আছেন, তাঁদের আরও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে ওই সব ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাঁদের আরও কঠোর হতে হবে। শুধু কাগজ–কলমে এসব ব্যাপার লিখলে চলবে না, আমাদেরই বরং আইনের লোক নিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কাজি বিয়ে পড়াতে গেছেন। মেয়ের মা–বাবা জানিয়ে দেন, মেয়ের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তিনি সেটাই বিশ্বাস করে বিয়ের কাজ শেষ করছেন। একটু জন্মনিবন্ধন সনদটা দেখলে কিন্তু এই সমস্যা হয় না। গ্রামের তুলনায় এখন শহরেও বাল্যবিবাহ অনেক হয়। আমাদের সবাইকে একত্র হয়ে ওই সব এলাকায় যেতে হবে। ওই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ধরতে হবে। তাঁদের সচেতন করতে হবে, প্রচার চালাতে হবে। আমাদের গ্রামে অনেক প্রচার চালানো হয়েছে এবং তাঁরা সচেতনও। শহর এলাকার জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে।
মাশফিকা জামান সাটিয়ার
সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা। নারীর অগ্রগতির জন্য আমরা ৫০ বছর ধরে কাজ করছি। আমাদের দেশের গ্রাম বা শহরের সব মানুষ কিন্তু জানে, কোনো মেয়েকে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে দেওয়া যাবে না। তারপরও জন্মসনদ পরিবর্তন করে ঠিকই বাল্যবিবাহ হচ্ছে। আমি আমাদের দুটি প্রকল্পের কথা আজ এখানে বলতে চাই। একটা ছিল বালিকা প্রজেক্ট। এখানে আমরা তিনটি বিভাগে কাজ করেছি। একটি বিভাগে দেওয়া হয়েছিল গণিত ও ইংরেজি। আরেকটিতে দেওয়া ছিল তাঁদের ইনকাম জেনারেশন অ্যাকটিভিটিজ এবং অন্যটিতে ছিল জেন্ডার বিষয়ে ইনফরমেশন শেয়ারিং। প্রচলিত ধারণা রয়েছে, মেয়েরা গণিতে ও ইংরেজিতে বেশি ফেল করে। তাই আমরা মেয়েদের জন্য এই প্রজেক্ট শুরু করি। ইনকাম জেনারেশনে মেয়েরা যদি ইনকাম করে পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে, তখন কিন্তু ওই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে পরিবার দুইবার ভেবে দেখে। বাসায় এমনি বসে থাকা মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু যে পড়াশোনা করছে বা আর্থিকভাবে সাহায্য করছে, তাঁকে কম বয়সে বিয়ে দেওয়া খুব সহজ নয়।
বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে বাবা ও ভাইকে সচেতন করতে হবে বেশি। এ ছাড়া যেসব কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাদের নিয়েও কিন্তু ভাবতে হবে। তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করতে হবে। সম্ভব হলে তাঁদের শিক্ষা ক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, বিবাহিত কিশোরীদের স্কুলে ভর্তি করাতে চান না শিক্ষকরা। তাঁরা মনে করেন, এতে অন্য মেয়েরা বিয়ে করতে প্রভাবিত হবে। এখানেও আমাদের কাজ করতে হবে। সব শেষে বলতে চাই, এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে তাদের আরো ভূমিকা রাখতে হবে।
নাহিদ শারমীন
বাল্যবিবাহের জন্য তিনটি শ্রেণি জড়িত। যাকে বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়, সে নিজে। তার পরিবার ও তার সমাজ। বেশির ভাগ কিশোরী পরিবারের চাপে বাল্যবিবাহের শিকার হয়। আবার অনেক সময় পরিবার আগ্রহী থাকে না, বরং তাদের সমাজ থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। আমরা যদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই তিনটি শ্রেণিতেই সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে পারি, তাহলে দ্রুতই এর সুফল ভোগ করতে পারব।
এ ছাড়া আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, বাল্যবিবাহ বললেই আমাদের মাথায় আসে মেয়েদের বাল্যবিবাহ। ছেলেদের বাল্যবিবাহের কথা কিন্তু আমরা ভাবিও না। যদিও ছেলেদের বাল্যবিবাহ তুলনামূলক অনেক কম। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আমরা এমন একটি অ্যাপ ডেভেলপ করতে পারি, যার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে তোলা যায়। সুরক্ষা অ্যাপ কোভিডের সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের আমরা অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বার্তা দিতে পারি। যেমন, বাল্যবিবাহ হলে তাঁদের কী কী ক্ষতি হতে পারে বা বিয়েটা আপাতত না হলে তারা কী কী সুফল পেতে পারে। ভবিষ্যতে তাদের জীবন আরও সুন্দর হতে পারে—এ ধরনের মেসেজ তাদের মাথায় দিতে পারি।
এ ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ নম্বরে কল করার সুবিধা তো রয়েছেই। বাল্যবিবাহ রোধ করার ক্ষেত্রে আমরা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ভূমিকা রাখতে পারি। ২০১৮-২০২১ সালের ৯৯৯ কলগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৮ সালে মাত্র ১০ শতাংশ নারী কল দিয়েছিল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য। বাকি ৯০ শতাংশ কিন্তু পুরুষ কল দিয়েছে। ২০১৯ সালেও নারীর কল ছিল ১০ শতাংশ, ২০২০ সালে বেড়ে ২১ শতাংশ এবং ২০২১ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। সুতরাং নারীদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ছে।
একটি পরিবার কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়? এর দুটি কারণ আছে। একটি দরিদ্রতা, অন্যটি নিরাপত্তাহীনতা। তারা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে বাঁচতে চায়। এ ছাড়া অনেক সময় মেয়েরা রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বখাটে ছেলেদের হাত থেকে বাঁচার জন্যও অনেক সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং বাল্যবিবাহ এবং শিশু নির্যাতন কমাতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মুমিত আল রশিদ
সারা বাংলাদেশে আমাদের ১২৭টি বন্ধুসভা রয়েছে। বিদেশেও ৪টি বন্ধুসভা রয়েছে। আমরা করোনার সময় দেখেছি, বাল্যবিবাহের জন্য দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা ছাড়াও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও মা-বাবার লোভের কারণে বাল্যবিবাহ হয়। বিশেষ করে যাঁরা প্রবাসী, তাঁরা চায়, দেশে একটা বিয়ে করবেন। তখন তাঁরা দেশের অষ্টম বা নবম শ্রেণির মেয়েদের খুঁজতে থাকেন। বিয়ে করে তাঁরা বিদেশে চলে যান। এতে মেয়েরা অনেক সময় একধরনের মানসিক রোগীতে পরিণত হয়।
আমরা একসময় বিভিন্ন এলাকার ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলাম। প্রথমেই আমরা কক্সবাজারের ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দিলাম। এখানে মাঠপর্যায়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা কাজ করে। এ ধরনের সামাজিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি বিয়ের আগেই পরিবারকে বোঝাতে পারি, আপনার মেয়ে আপনার পরিবারের একটি মূল্যবান সম্পদ, তাহলেই কেবল আমরা বাল্যবিবাহ ঠেকাতে পারব। তাঁদের মূল স্রোতের সঙ্গে মেলাতে হবে। এখানে আমাদের বন্ধুসভার ছেলেমেয়েরা কাজ করে। এ ক্ষেত্রে আমরা নারী বন্ধুদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
প্রথম আলো বন্ধুসভা পুরোপুরি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বন্ধুসভার সদস্যদের আমরা বন্ধু বলি। সারা দেশে আমাদের প্রায় ৮৮ হাজার বন্ধু রয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা কাজ করে আমাদের সঙ্গে। বন্ধুসভার পাশাপাশি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও আমরা যুক্ত করতে পারি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে। আমরা এখানে শুধু কথা বলেই শেষ করতে চাই না, আমরা দুর্গম এলাকায়ও যেতে চাই। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে চাই আমাদের বন্ধুদের নিয়ে। আমরা চাই আরও তরুণ-তরুণীকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে। প্রথম আলো ও প্রথম আলো বন্ধুসভা অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে। এটা পুরো বাংলাদেশে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাজ হয়েছিল। ফলে অ্যাসিড-সন্ত্রাস প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। মাদক নিয়েও আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছি। এখন বাল্যবিবাহ নিয়েও আমরা সবাই মিলে একটি জাগরণ সৃষ্টি করতে চাই। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সম্ভব।
ফখরুল হক শাওন
বিগত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিকে তাকালে দেখি, মিডিয়া দিনটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মিডিয়া যেহেতু সমাজের জন্য একটি আয়না হিসেবে কাজ করে, সুতরাং তাদের কোন কাজ কতটা প্রভাব রাখবে, সেগুলো নিয়ে আরও ভেবে দেখা উচিত। বাল্যবিবাহের একটি প্রধান কারণ হলো, ছেলেদের মনে করা হয় সংসারের একমাত্র ভরসা। ছেলেই শুধু পরিবার চালাতে পারে, এ ক্ষেত্রে মেয়েদের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু আজকের এই গোলটেবিলের বৈঠকও যদি দেখি, তাহলে দেখছি, এখানে উপস্থিত নারীরা প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো ও বড় অবস্থানে আছেন। সুতরাং যাঁরা এই অবস্থানে কাজ করছেন, তাঁদেরও অনেক বড় ভূমিকা আছে এটা প্রতিষ্ঠা করায় যে আমরা যদি এই অবস্থানে কাজ করতে পারি, তাহলে সমাজের অন্য মেয়েরা কেন করতে পারবে না? এ ছাড়া পুরুষেরও ভূমিকা আছে নারীর অগ্রগতিতে। এ জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। ছেলের মতো করে মেয়েও যে একটি প্রতিষ্ঠান বা পরিবারের সম্পদ—এটা সবাইকে বোঝতে হবে। তাহলেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
চৌধুরী মো. মোহায়মেন
আমি প্রথমে বলতে চাই, আমাদের দাদা-দাদি বা নানা–নানি কিন্তু সবাই বাল্যবিবাহের শিকার। তখন ৯৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ হতো। এখন কিন্তু সেই হার কমেছে। সুতরাং আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমাদের কাছে থাকা তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ সাল থেকে বাল্যবিবাহ কমতে শুরু করে। কিন্তু করোনাকালে ২০২০ সালে এ হার ৩২ শতাংশ বেড়ে গেল।
আমরা দেখেছি, বাল্যবিবাহের সবচেয়ে বড় কারণ অসচেতনতা। আমরা যে শুধু বাল্যবিবাহ রোধ করি, তা-ই নয়, বরং আমরা তাঁদের সচেতন করি, পড়ালেখার বিষয়টি দেখি বা অর্থনৈতিক দিকও দেখে থাকি। আমরা নিশ্চিত করি, ওই বাল্যবিবাহ ভেঙে যাওয়া শিশুটিকে ১৮ বছর হওয়ার আগে কোনোভাবে বিয়ে দেওয়া যাবে না, কোনো শ্রম করানো যাবে না বা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা যাবে না।
১০৯৮ হেল্পলাইন অনেকগুলো ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। তার মধ্যে একটা হলো বাল্যবিবাহ। শুধু মেয়েশিশু নয়, বরং এখানে ছেলে-মেয়ে উভয়ের কথাই বলব। কারণ, ২০১৭ সালে আমরা ১৭ ছেলেশিশুর বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হই। ২০২০ সালে ৩২ ছেলেশিশু ও ২০২১ সালে ১৯ ছেলেশিশুর বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। সুতরাং বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে এই শিশুদের কেয়ার করতে হবে। ভবিষ্যতে নারীকে সচেতন হিসেবে পেতে হলে এখনকার শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে।
শিশুকে সেবা দেওয়ার জন্য ১০৯৮ হেল্পলাইনের মাধ্যমে টেলিফোনে তো সাহায্য করছি। এ ছাড়া আমরা সশরীর গিয়েও তাদের সাহায্য করে থাকি। আপনারা যেকোনো সমস্যার বিষয়ে বিনা পয়সায় ১০৯৮ নম্বরে কল করুন। আমরা আপনাদের কথা শুনতে চাই, শিশুদের কথা জানতে চাই। আমাদের আকুতিটা তাদের কাছে পৌঁছে দেন। তাদের সমস্যা আমরা সমাধান করব। যেখানে পুলিশ পাঠানো দরকার, শুধু সেখানেই পুলিশ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু যেখানে পরিবার নার্সিং করা দরকার, সেখানে কিন্তু পুলিশ না গিয়ে সমাজকর্মী যাচ্ছেন। আমরা ২৪ ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলছি। খুব দ্রুত আমরা নার্সিং করার চেষ্টা করে থাকি। সুতরাং আপনাদের কথা আমাদের ১০৯৮ নম্বরে ফোন করে জানান, আমরা আপনাদের পাশে আছি।
আনোয়ার সাত্তার
মূলত জরুরি সেবা ৯৯৯ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তিনটি সেবা দেওয়ার জন্য। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স। ৯৯৯ দেশে কাজ করছে প্রায় ৪ বছর ধরে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি কল এসেছে আমাদের কাছে। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশ পুলিশ সার্ভিস চেয়ে ফোন করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা চেয়ে ফোন করেছেন ৯.৫১ শতাংশ। বাকি ১১.৫২ শতাংশ ফোন এসেছে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। শুধু বাল্যবিবাহের জন্য ২০১৯ সালে ২ হাজার ৪৯০টি কল পেয়েছি এবং এগুলো প্রতিহত করেছি। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৪৮০টি, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৬৫৮টি বাল্যবিবাহ প্রতিহত করেছি। এ জন্য আমরা স্থানীয় থানা ও উপজেলার সহায়তা নিয়েছি। নারী সহিংসতা কিছু কল আমরা পেয়েছি। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৫৬১টি নারী সহিংসতাবিষয়ক বিভিন্ন রকম কল পেয়েছি। এর মধ্যে ভায়োলেন্স বাই হাসবেন্ড, ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেনস, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স, ভায়োলেন্স অ্যাট হোম, ব্রেভ, অ্যাটেমট টু রেপ, থ্রেট টু রেপ ও ট্রাফিকিং। এগুলোকে আমরা সমাধান করেছি, মানে সেবা দিয়েছি।
২০২০ সালে এই বিষয়গুলোতে আমরা সেবা দিয়েছি ৪ হাজার ৯৪টি। ২০২১ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৬১। আমি মনে করি, অনেক বেশি সেবা নম্বর তৈরি না করে যেগুলো এখন আছে, সেগুলোকে ভালোভাবে তদারক করতে হবে।
ডা. নুরুন নাহার বেগম
পরিবার পরিকল্পনায় আমরা নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে থাকি। একটি উন্নত দেশ হতে হলে মা ও শিশুমৃত্যু কম হতে হবে। সমাজ বা পরিবার সুন্দর হতে হবে। একটি ব্যাপার খেয়াল করুন। একজন মেয়ে সারা দিন চিকিৎসকের পেশায় কাজ করেও কিন্তু তাঁর বাসায় গিয়ে ঘর সামলাতে হচ্ছে। সুতরাং আমাদের নারীদের এগিয়ে নিতে হলে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যদি শুধু ফ্যামিলি প্লানিং আমাদের মায়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে ৩০ শতাংশ মাতৃমৃত্যু ও ২০ শতাংশ শিশুমৃত্যু কমানো সম্ভব। আমরা কিন্তু অনেক বাল্যবিবাহ ভেঙেছি, কিন্তু পরে দেখা যায়, বয়স পরিবর্তন বা এলাকা পরিবর্তন করে রাতের আঁধারে ঠিকই বিয়ে হচ্ছে। আমরা যদি মেয়েটিকে মানসিকভাবে বোঝাতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের বিয়ে ভাঙতে হয় না, মেয়েটির মন ভাঙতে হয় না। বাবা ও অভিভাবকেরা এ ব্যাপারে সচেতন হলে বাল্যবিবাহ আরও কমে আসবে। সুতরাং আমাদের ওই সচেতনতার জায়গায় কাজ করতে হবে। আবার এখন টাকার অভাবে কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ হচ্ছে না। সরকার পড়াশোনা ফ্রি করে দিয়েছে। আমরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে যাচ্ছি, আন্দোলন করতে যাচ্ছি, কিন্তু এ অপরাধে কী শাস্তি হতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলছি না। আমাদের জানাতে হবে, ১৮ বছরের কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিলে কাজি, ইমাম, মা-বাবা—সবারই শাস্তি হবে। সেই সঙ্গে বিশেষ আইনে অনুমতি নিতে হবে।
ফরিদা পারভীন
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও আমাদের বাল্যবিবাহ নিয়ে কথা বলতে হবে, এটা আমরা আর চাই না। গার্ল সামিটে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা দেশ থেকে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণভাবে দূর করব। সে লক্ষ্যেই আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বয়স লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব নাগরিকের ইউনিক আইডি হলে এ রকম বাল্যবিবাহ দেওয়া সম্ভব হবে না। কাজির বিয়ের রেজিস্ট্রেশন অনলাইনে করতে পারলে আমরা বাল্যবিবাহ অনেকাংশে কমাতে পারব।
এখানে একজন বলেছেন, দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিবাহ হতে পারে। তবে দারিদ্র্যের কারণে যাতে বাল্যবিবাহ না হয়, সে জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বিশাল একটা অংশকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। একজন নারী সন্তান নেবেন কি না বা কখন নেবেন, সেটা কিন্তু তাঁর ওপর নির্ভর করা উচিত, স্বামী বা পরিবারের নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত নয়। নারীকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারলে, তিনি সংসারে আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারবেন। এতে তিনি নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সে জন্য আমরা নারীদের কম্পিউটারের বেসিক থেকে শুরু করে সেলাই করা পর্যন্ত শেখাচ্ছি বিনা মূল্যে। এসএসসি পাস করলেই তাঁদের কম্পিউটার শেখাচ্ছি এবং তাঁদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম করে দিচ্ছি। উদ্যোক্তা হলে সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান দিচ্ছি। অর্থাৎ নারীরা যাতে লক্ষ্য থেকে দূরে সরে না যান, সে রকম সব ব্যবস্থা কিন্তু আমরা করে দিচ্ছি। নারীদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে তাঁরা আর সমাজে বোঝা হয়ে থাকবেন না। এতে বাল্যবিবাহের হার কমবে।
আমাদের দেশে চার হাজারের বেশি কিশোর-কিশোরী ক্লাব রয়েছে। তাদের ছোটবেলা থেকেই এসব বিষয়ে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। অনলাইনে যাতে নারীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সেবা দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাও কিন্তু আমরা করেছি। সুতরাং বাল্যবিবাহ ঠেকাতে আমরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সবাই মিলে একসঙ্গে যদি কাজ করতে পারি, নারী ও তাঁর পরিবারকে সচেতন করতে পারি, তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যেই আমরা সম্পূর্ণভাবে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারব। অসংখ্য ধন্যবাদ ইউএসএআইডি, উজ্জীবন প্রকল্প, প্রথম আলো ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
ফিরোজ চৌধুরী
আমরা প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করি। দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে নারী-পুরুষ সমতাবিধানের জন্য এখনো অনেক কাজ বাকি। আজকের গোলটেবিল আলোচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও বাল্যবিবাহ নিরসনে অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা এসেছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে আশা করি। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
.....................
এ ছাড়া এই গোলটেবিল বৈঠকে অনলাইনে অংশ নেন সিলেটের লাকাতুরা চা-বাগান থেকে শিক্ষার্থী সীমা চন্দ, কক্সবাজার বন্ধুসভার সভাপতি রুহুল আমিন ও সিলেট বন্ধুুসভার কার্যকরী সদস্য তামান্না ইসলাম।
সুপারিশ
বাল্যবিবাহ কমাতে হলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি করে প্রচার চালাতে হবে।
বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে বাবা ও ভাইকে সচেতন করা খুব দরকার।
নারীরা যেন তাঁদের কর্মস্থলে নিরাপদে, নির্ভয়ে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে একটি অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে তোলা যায়।
ছেলের মতো করে মেয়েও যে একটি প্রতিষ্ঠান বা পরিবারের সম্পদ—এটা সবাইকে বোঝতে হবে।
বাবা ও অভিভাবকদের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, যাতে করে তাঁরা বাল্যবিবাহ আয়োজনে নিরুৎসাহিত হন।
দারিদ্র্যের কারণে যাতে বাল্যবিবাহ না হয়, সে জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।
বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ১০৯৮ অথবা ৯৯৯ নম্বরে কল করে সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।