গোলটেবিল বৈঠক
পরিবার পরিকল্পনা হোক নারীর সিদ্ধান্তে
নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে। বাস্তবায়নে সরকারি–বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
দেশে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর কারণে সমাজে নারীর অবস্থান নিচে। ফলে সমাজে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বাড়ছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজননসেবার সম্পর্ক আছে। কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোনো তথ্য বা গবেষণা নেই। এদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণসহ প্রজননসেবা নিতে নারীর সিদ্ধান্তে পুরুষের প্রভাব বেশি। তবে এ সিদ্ধান্ত নারীকেই নিতে হবে।
‘নারীর প্রতি সহিংসতা: প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা। এই বৈঠকের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির সুখী জীবন প্রকল্প, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলো। গতকাল সোমবার ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ের সভাকক্ষে এই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০৩০ সালের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা কমাতে সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে। এটি বাস্তবায়নে সরকারি–বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে সমাজের সব স্তরে কাজ করতে হবে।
বৈঠকে মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, নারীর প্রজননস্বাস্থ্যের সঙ্গে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার যোগ রয়েছে। ঘুরেফিরে জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নারীর ওপর বর্তায়। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তাঁর থাকে না। এ সংস্কৃতি সমাজে এখনো বিদ্যমান। নারীর ব্যক্তিগত অধিকারের জায়গা থেকে বিষয়টি দেখতে হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) মো. আবদুস সালাম খান বলেন, নানান সমস্যা সত্ত্বেও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় দেশ অনেক এগিয়েছে। তবে নারীর নিজস্ব অধিকার বাস্তবায়নে প্রকল্প নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও এসব কাজের পাশে থাকা প্রয়োজন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ও লাইন ডিরেক্টর (এমসিআরএএইচ) মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রমগুলোর প্রচারও কম হয়। বাল্যবিবাহ বাড়া মানেই মাতৃমৃত্যু বাড়া, মাতৃমৃত্যু বাড়া মানেই শিশুর মৃত্যু বাড়া। একটার সঙ্গে একটা জড়িত। সমন্বিতভাবে কাজ করলে আরও ভালো করা সম্ভব।’
পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র কান্ট্রি ডিরেক্টর ও ইউএসএআইডি সুখী জীবনের প্রকল্প পরিচালক ক্যারোলিন ক্রসবি বলেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা, প্রজননসেবা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে সমাজের সব খাতের সব স্তরের মানুষকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এসব নিয়ে সরকারের অঙ্গীকার আছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও কাজ করছে। তবে এ কাজকে আরও গতিময় করতে হবে।’
পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে উল্লেখ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ফ্যামিলি প্ল্যানিং ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণকারীর বেশির ভাগ অংশই নারী। এখানে পুরুষের অংশগ্রহণ একদম কম।
পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে নারীর বলে বিবেচনা করা হয় মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, পুরুষের কর্মদক্ষতা কমে যাবে, পুরুষ উপার্জন করে—এটি বলে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো নারীর ওপর চাপানো হয়। দায়িত্বের বেলায় নারী, অধিকারের বেলায় নারী নেই।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর আইইএম ইউনিটের উপপরিচালক (বৈদেশিক সংগ্রহ) জাকিয়া আখতার বলেন, দেশে সহজলভ্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মাত্র দুটি পুরুষদের জন্য, বাকিগুলো নারীদের জন্য। পুরুষেরা সহযোগিতা করলে নারীর প্রজননস্বাস্থ্য ভালো হবে, নারীর প্রতি সহিংসতাও কমবে।
চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিবার পরিকল্পনার সেবা দেওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, নারী কখন বিয়ে করবে, কখন সন্তান নেবে, কখন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করবে—এসব বিষয়ে তাকে পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ইউএসএআইডি বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ (এসবিসিসি) লিজা তালুকদার বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার যে সংখ্যা পাওয়া যায়, প্রকৃত চিত্র আরও বেশি। সমাজে আচরণগত পরিবর্তনে জোর দেওয়া উচিত, যা পরিবর্তন খুবই কঠিন। এসব নিয়ে পরিবারেও কম আলাপ হয়।
বৈঠক থেকে বলা হয়, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, বিশ্বে ২১৪ মিলিয়ন নারী গর্ভধারণ প্রতিরোধ করতে চান, তবে জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতির অভাবে তাঁরা তা পারেন না। তাঁদের কাছে এসব পদ্ধতি পৌঁছায় না। প্রতিদিন ৮৩০ নারী মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য কারণে মারা যান। দিনে ৩৩ হাজার কিশোরী বাল্যবিবাহে বাধ্য হচ্ছে। প্রতি পাঁচজন নারীর একজন সঙ্গী দ্বারা সহিংসতায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন ইউএসএআইডির সুখী জীবন প্রকল্পের কিশোর-কিশোরী ও যুব বিশেষজ্ঞ ফাতেমা শবনম, ইউএসএআইডি বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ (এসবিসিসি) সামিনা চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের জেন্ডার ব্যবস্থাপক শামীমা পারভীন। সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।