বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম প্রতিরোধে প্রযুক্তির ভূমিকা

১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন উপলক্ষে ব্র্যাকের উদ্যোগে ‘বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম প্রতিরোধে প্রযুক্তির ভূমিকা’ শীর্ষক এক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে। সেই সংলাপের নির্বাচিত বক্তব্য এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

সম্মানিত আলোচক

জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক

প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ

আসিফ সালেহ

নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক

মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ

অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক, জাতীয় জরুরি সেবা, ডিএমপি

সৈয়দা মুনিরা সুলতানা

জাতীয় বিশেষজ্ঞ ও কর্মসূচি সমন্বয়ক, আইএলও বাংলাদেশ

মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ

সভাপতি (ঢাকা জেলা), বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতি

নোভা আহমেদ

সহযোগী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

তাকবির হুদা

অ্যাডভোকেসি লিড, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচি, ব্র্যাক

সঞ্চালনা

নবনীতা চৌধুরী

পরিচালক, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচি, ব্র্যাক

সুপারিশ

■ জন্মনিবন্ধন আধুনিকায়ন হওয়ায়, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম ঠেকাতে জন্মনিবন্ধনকেই বয়স যাচাইয়ের মূল নথি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

■ অনলাইন জন্মনিবন্ধন সিস্টেমে আরও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, যাতে কার্যকর প্রযুক্তি দ্বারা ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করা যায় এবং ডুপ্লিকেশন এড়ানো যায়।

■ বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধে জন্মনিবন্ধক, বিবাহ নিবন্ধক ও লেবার ইন্সপেক্টরদের কার্যকর প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত করতে হবে।

■ বিবাহ নিবন্ধন এবং লেবার ইন্সপেকশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রযুক্তি ব্যবহারবিষয়ক প্রশিক্ষণ জরুরি।

■ ই-ভেরিফাই (বিডিআরএস) ওয়েবসাইট দ্বারা জন্মনিবন্ধন যাচাই করার বিষয়ে সব কাজি ও লেবার ইন্সপেক্টরকে সচেতন করতে হবে।

■ স্কুল পাঠ্যক্রমে হেল্পলাইন নাম্বারসমূহ, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক ও এ বিষয়ে আইনি তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

■ বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

■ বিবাহ নিবন্ধনের প্রক্রিয়া কেন্দ্রীভূত ও আধুনিকায়ন করা দরকার।

■ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা আরও সহজ করা প্রয়োজন।

■ বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধে এ–সংক্রান্ত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় করা গুরুত্বপূর্ণ।

নবনীতা চৌধুরী

আলোচনা

নবনীতা চৌধুরী

শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ রোধে প্রযুক্তি কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, এবারের আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসে সে বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করতে চাই। এবারের দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য ‘আমরা কন্যাশিশু—প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হব, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব’। সে কারণেই এই আলোচনা তোলাটা জরুরিও মনে করেছি। গত বছর এই দিবসে আমরা মেয়েদের স্কুলে ফেরানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম। এরপরও প্রায় এক বছর কোভিডের কারণে স্কুল বন্ধ ছিল। স্কুল বন্ধ থাকার ফলে এ সময়ে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯–এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোভিডের আগেই বাংলাদেশে ১৮ বছর হওয়ার আগেই ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়েশিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। ২০১৩ সালের শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী সাড়ে ১৩ লাখ কন্যাশিশু শিশুশ্রমে জড়িত ছিল। খুব সম্প্রতি হাসেম ফুডস ফ্যাক্টরির কথা যদি মনে করি, সেখানে আমরা দেখেছি ১১টি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েশিশু সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করছিল এবং আগুনে পুড়ে মারা গেছে। অনেক বিষয়ে এনজিও ও সরকার কাজ করছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার সারা বাংলাদেশে কমিটি গঠন করে দিয়েছে। এনজিওগুলো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের কাজ দীর্ঘদিন ধরে করছে। এর পাশাপাশি জন্মসনদ ঠিক না থাকলে যেন বিয়ের প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করা না যায়, সে জায়গাটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধন ডিজিটাল করার কাজ শুরু হলেও এখনো বিয়ে বা কাজে নিয়োগের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ ডিজিটালি যাচাই করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বা বিয়ে রেজিস্ট্রেশনকে ডিজিটাল করার কোনো উদ্যোগ নেই। পুরো প্রক্রিয়াগুলোতে তাই এখনো সনদ জালিয়াতি বা ভুয়া দলিলপত্র দিয়ে কাজ সারার উপায় থেকে যাচ্ছে। এর ফলে, বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের কোনো পূর্ণ পরিসংখ্যানও থাকছে না। ১৩ বছরের মেয়েকে ১৮ লিখে বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, কাজেও নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়া থেকে আমাদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে জন্মনিবন্ধন সনদকে সম্পূর্ণত ডিজিটালকরণ এবং বিবাহনিবন্ধন ও কাজের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যাচাইকরণকেও ডিজিটাল পদ্ধতির আওতাভুক্ত করা।

২০২১ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভিযাত্রা আমরা দেখছি এবং গত কয়েক বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে আমরা দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়েছি। তাই আমরা বিশেষভাবে প্রত্যাশা করি যে এ কাজগুলো হবে। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম—এ দুটো সমস্যা মেয়েদের স্কুলে থাকা ও ভবিষ্যতের সব সুযোগ ও সম্ভাবনা নষ্ট করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ ভূমিকা পালন করছে। তাই এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে আইনের ফাঁকফোকর গলে এ দুটো ঘটনা ঘটে চলতে না পারে।

প্রথমেই বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বন্ধে আইনি সুরক্ষার যে কাঠামো আছে, সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে তাকবির হুদা প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।

তাকবির হুদা

তাকবির হুদা

বাল্যবিবাহও শিশুশ্রম ভিন্ন জিনিস। কীভাবে এ দুটি ভিন্ন বিষয় সংযুক্ত? প্রথমেই এ দুটি অন্যায় দ্বারা আইনের সর্বনিম্ন যে বয়স আছে, সেটা লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহে অভিভাবকের সম্মতি থাকে, যা এ বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। এ দুই অন্যায়ের ফলে অনেক শিশু স্কুল থেকে ঝরে যায়। ফলে তাদের শিক্ষার মৌলিক অধিকারটি লঙ্ঘিত হয়। এ দুই অন্যায় দারিদ্র্যের কারণে ঘটছে। করোনা মহামারির ফলে সে দারিদ্র্য আরও বেড়েই চলেছে। ফলে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমও বেড়েছে। আমাদের শিশু আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো ব্যক্তিকে বোঝায়। শ্রম আইনে ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হয়েছে। ফলে ১৪ বছর হলেই তাকে কাজে জড়ানো যাবে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দেওয়া যাবে না।

মহামারির আগেই বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি ছিল। ১৮ বছরের আগেই প্রায় ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। ১৪ বছরের নিচে সাড়ে সাত লাখ মেয়ে কাজে জড়িত ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুশ্রম ছেলেশিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমাদের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী সব শিশুশ্রমিকের মধ্যে মেয়েশিশু ছিল ৩৯ শতাংশ। এ জরিপে গৃহস্থালি কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু অনেক মেয়েশিশু গৃহস্থালি কাজেও জড়িত। গৃহস্থালি কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হলে এ সংখ্যা আরও বাড়ত।

আমাদের বিভিন্ন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা থাকে। প্রথমেই নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় প্রযুক্তির ভূমিকা সীমিত আকারে স্বীকৃতি পেয়েছে। এরপর বাল্যবিবাহ রোধে আমাদের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আছে। সেখানে আরও নির্দিষ্টভাবে প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন হেল্পলাইন ও একটি তথ্যভান্ডার তৈরির কথা বলা হয়েছে। এ তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে বাল্যবিবাহের ঝুঁকির মধ্যে থাকা কন্যাশিশুদের চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। আমাদের তৃতীয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনাটি শিশুশ্রম রোধে। শিশুশ্রমের ওপর নির্ভরশীল নিয়োগকর্তাদের নির্ভরশীলতা বিকল্প প্রযুক্তি দ্বারা দমনের কথা বলা হচ্ছে। প্রযুক্তি দিয়ে শ্রম/লেবার ইন্সপেকশন শক্তিশালী করার বিষয়টি এখানে আসেনি। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম দমনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের সুরক্ষা দিতে হলে জন্মনিবন্ধন দিয়েই শুরু করতে হবে। আইন অনুযায়ী ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ২০১৯ সালের তথ্যানুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব হয়নি। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের হার বেশি দেখা যাচ্ছে, যার পরিমাণ ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৯ সালে সরকার জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়াটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। আধুনিকায়নের ফলে জন্মনিবন্ধনের হার অনেক বেড়েছে এবং জন্মনিবন্ধন করলে একটি ১৭ অঙ্কের জন্মনিবন্ধন নম্বর দেওয়া হয়। এ নম্বরটি দিয়ে যে কেউ জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করতে পারে ই-ভেরিফাই (বিডিআরএস) ওয়েবসাইটে। এই সুযোগ থাকার ফলে অন্তত নকল জন্মনিবন্ধন ঠেকানোর এক সহজ উপায় রয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে নিবন্ধন হার বেড়েছে এবং তা যাচাই করার ব্যবস্থা হয়েছে।

২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যেসব দেশে জন্মনিবন্ধনের হার বাড়ছে, সেসব দেশে বাল্যবিবাহের হার কমছে। আমাদের দেশে অনেক জাতীয় হেল্পলাইন রয়েছে। ২০২০ সালে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ প্রায় ৩ হাজার ৬৮৫টি বাল্যবিবাহ থামিয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে জাতীয় তথ্যসেবা ৩৩৩ প্রায় ৪ হাজার ৮০০ বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ হেল্পলাইন আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের অধীনে কুড়িগ্রামে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ২০১৮ সালে পরীক্ষামূলক অ্যাপ তৈরি করা হয়েছিল৷ এ অ্যাপ দ্বারা ৬ মাসের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ বাল্যবিবাহ থামানো গেছে। আমাদের শ্রম মন্ত্রণালয়ের ‘লিমা’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করেছে, যা দিয়ে তারা তাদের পরিদর্শন প্রক্রিয়াটি আধুনিকায়ন করছে।

ডিআইএফইয়ের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভিন্ন কারখানায় প্রায় ১ হাজার ১৪২ জন শিশুশ্রমিক পাওয়া গেছে। এসব শিশুশ্রমিককে বের করে আনা হয়েছে। এসব উদ্যোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ দমনে ভূমিকা পালন করছে। জন্মনিবন্ধন আধুনিকায়ন হওয়ায় জন্মনিবন্ধনকেই বয়স যাচাইয়ের মূল নথি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে ই-ভেরিফাই (বিডিআরএস) ওয়েবসাইট দ্বারা বয়স যাচাইয়ের এই বিদ্যমান ব্যবস্থা শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ রোধে কাজে লাগানো যাবে। তাই এ জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়াটি আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধে প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবহার করে আইনি সুরক্ষা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো বিবাহ নিবন্ধক ও লেবার ইন্সপেক্টর। কারণ, আইনগতভাবে বয়স যাচাই করার দায়িত্ব তাদের ওপরই। ফলে প্রযুক্তিগত কোনো সমাধান তৈরি করার ক্ষেত্রে তাদের সামনে রেখেই সমাধানের পরিকল্পনা করতে হবে। স্কুল পাঠ্যক্রমে হেল্পলাইন নাম্বারসমূহ, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক ও এ বিষয়ে আইনি তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। যেন শিশুরাও তাদের অধিকার ও অধিকার লঙ্ঘন হলে কীভাবে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা পেতে পারে, তা জানতে পারে ।

নবনীতা চৌধুরী

বিবাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করার প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে বাল্যবিবাহ রোধ করা যাবে, সে বিষয়ে বলবেন মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ।

মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ

মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ

একটা অনুষ্ঠানে এর আগেও আমি ইউনিক আইডির কথা বলেছিলাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইউনিক আইডি বা অদ্বিতীয় শনাক্তকরণ নম্বরের কথা চিন্তা করছে, যা এখনো প্রক্রিয়াধীন। জন্মনিবন্ধন সনদকেই যেন অদ্বিতীয় আইডি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে শিশু জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা আইডি দেওয়া হবে। সেখানে জন্মসাল ও পোস্টকোডও থাকবে। এ অদ্বিতীয় আইডিই তার সারা জীবনের আইডি হবে। সেটা হতে পারে এসএসসি বা দাখিল পরীক্ষার নিবন্ধন আইডি, এনআইডি নম্বর বা পাসপোর্ট নম্বর। তার সারা জীবন একই আইডিতে চলবে। পরবর্তী সময়ে বিবাহ নিবন্ধনের সময় এ অদ্বিতীয় আইডি যাচাই করে নিবন্ধন করলে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু বিবাহ নিবন্ধনের সময় জন্মনিবন্ধন সনদের নম্বর বসানোর বা তা যাচাই করারই কোনো সুযোগ নেই। নিবন্ধন বইয়ে বর ও কনের জন্মনিবন্ধন সনদ নম্বর বসানোর সুযোগ থাকলে বাল্যবিবাহ শতভাগ রোধ করা সম্ভব। বিবাহ নিবন্ধনের সময় কনে বিবাহিত না অবিবাহিত, তা যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? আজকে যদি এ অদ্বিতীয় আইডি চালু হয়, তবু তা কার্যকর হতে ১৮ বছর সময় লাগবে। তাহলে এখন কী করব? বর্তমান সময়ে সুরক্ষা অ্যাপসের মাধ্যমে করোনা টিকার নিবন্ধন হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সব তথ্য দেওয়া হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখান থেকে টিকা দেওয়ার কোনো কার্ড পাচ্ছি না। যদি এ রকম কোনো অ্যাপ তৈরি করা যেত।

জাতীয় সংসদে ম্যারিজ ভেরিফাই সার্টিফিকেটের প্রস্তাবনা এসেছে। এ জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বর ও কনে দুজনেই বিবাহের জন্য আবেদন জানাবে। আবেদন জানানোর পর সনদ আসবে। এই সনদ দিয়ে যেকোনো কাজি অফিসে নিবন্ধন করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে কাজি সাহেবরাও নিরাপদে থাকবেন। একটা উপজেলায় একজন সাবরেজিস্ট্রার থাকেন। উপজেলার সব এলাকার জমি রেজিস্ট্রি এক স্থানে হয়। তার একটা কেন্দ্রবিন্দু থাকে। আমাদের কাজগুলো জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশে সাধারণত শুক্রবারে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো বেশি হয়। ফলে একই সময়ে একাধিক বিয়ে থাকে। তখন একই সঙ্গে দুই স্থানে উপস্থিত থাকা যায় না। তাই একটি কেন্দ্রবিন্দুতে নিবন্ধন হলে আমাদের মাঝে সুশৃঙ্খল অবস্থা থাকত। সে ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহও হতো না। বিবাহ নিবন্ধন করার প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উপকরণের ব্যবস্থা করা জরুরি। পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

নবনীতা চৌধুরী

খাতা–কলমের সঙ্গে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার দূরত্বের বিষয়টি আবদুল ওয়াহেদ ভাইয়ের কথায় খুব সুন্দরভাবে এসেছে। এখন বক্তব্য দিতে অনুরোধ জানাব সৈয়দা মুনিরা সুলতানাকে। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে শিশুশ্রম প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ ও সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে বলবেন।

সৈয়দা মুনিরা সুলতানা

সৈয়দা মুনিরা সুলতানা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী ১৭ লাখ শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১২ লাখ শিশু নিয়জিত আছে। আমাদের দেশে লাখো শ্রমিক গৃহকর্মে নিয়োজিত। কিন্তু এসব মানুষ শ্রম আইনের আওতার বাইরে। এ বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। গত মাসে আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে নতুন শিশুশ্রম জরিপের কাজ শুরু করেছি। গৃহস্থালি কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মেয়েশিশু। পৃথিবীতে এখন প্রযুক্তির আওতার বাইরে কোনো বিষয় নেই। তাহলে এ ১৭ লাখ শিশুকে কেন প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারব না। লেবার ইন্সপেকশনের আওতা খুব ছোট। শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিশু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। খুব অল্প কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত শ্রম আইনের আওতাভুক্ত। কাজেই এখানে পরিদর্শন পদ্ধতিকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুযায়ী কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স সাধারণত ১৫ বছর। উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা ১৪ বছর, যা ইতিমধ্যে আমাদের আইনে আছে। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অনেকগুলো দিক আমরা দেখি না। যেমন পর্নোগ্রাফিসহ অনেক অনৈতিক কাজ আছে। সেগুলো আমাদের শ্রম আইনের আওতাবহির্ভূত। সম্প্রতি সরকার ছয়টি খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করেছে। ২০২১ সাল জাতিসংঘ ঘোষিত শিশুশ্রম নিরসনের বছর। আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় বিভিন্ন ধরনের প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। শিশুশ্রম নিরসনে আইন শক্ত করতে হবে। একটি শিশুকে কাজে নিয়োগের জরিমানা মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। এমনকি সেটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হলেও। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার বয়স ও কাজের ন্যূনতম বয়সের মধ্যে একটা সমতা থাকতে হবে। আইএলও কনভেনশন ১৩৮ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকার চিন্তাভাবনা করছে। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা খাত অনেক আছে। কিন্তু কীভাবে যেন শিশু শ্রমিকেরা এখান থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। তাই এ সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় শিশুদের জন্য বিশেষায়িত কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।

নবনীতা চৌধুরী

প্রযুক্তির বাইরে থাকা মানে ডেটাবেইসের বাইরে থাকা। কন্যাশিশু ও নারীরাই সবচেয়ে বেশি পরিসংখ্যানের বাইরে থাকেন। সে ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কী ধরনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করে লিঙ্গভিত্তিক (জেন্ডার বেজড) সহিংসতা কমানো যাবে, সেটা শুনব ড. নোভা আহমেদের কাছে।

নোভা আহমেদ

নোভা আহমেদ

আমি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করি। কোন জিনিসটা আমাদের জন্য কাজ করবে, তা আমাদেরকেই গবেষণা করে বের করতে হবে। কারণ, বিদেশি সমাধান আমাদের জন্য কাজ করবে না। যেমন জরিমানা দিয়ে আমরা শিশুশ্রম আটকাতে পারব না। হয়তো পুরস্কার দিয়ে পারব। পোশাকশিল্পে কমপ্লায়েন্সের কারণে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। যাঁরা কমপ্লায়েন্স গার্মেন্টসে কাজ করেন, তাঁরা ভীষণ গর্বিত। তাঁদের পানি এনে দেওয়ার মানুষ আছে, তাঁরা ছুটি নিতে পারেন। এ কমপ্লায়েন্স বিদেশিরা আমাদের জন্য করে দিল, কেন, আমরা কি নিজস্ব কমপ্লায়েন্স অবকাঠামো তৈরি করতে পারি না? কেন আমরা আমাদের নীতিকাঠামোগুলো তৈরি করতে পারি না? ছিটমহলের একটা মেয়ের শক্তিশালী কণ্ঠ আমি শুনেছি। সেখানকার একটি শিশু আমাকে জানাল যে তার মা–বাবা তাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল। তখন সে তাদের বলল, ‘তুমি আর একবার বিয়ের কথা বলো, দেখো আমি কোথায় কল করি।’ তখন সেখানকার পুরো কমিউনিটি ওর পাশে ছিল।

কোভিডের পর আমরা গবেষণায় দেখেছি মানুষ ভীষণ দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে গেছে। বিশেষ করে শহর এলাকার মানুষ খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। গ্রামে একজন আরেকজনের খেয়াল রেখেছে। কিন্তু শহরের গরিব মানুষেরা একদম ছিটকে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবহার করে সাহায্য করতে পারি। যারা সারা দিন শ্রমের কাজ করছে, তারা কল করবে কখন? মোবাইল ব্যবহার করা শিখবে কখন? তাদের ছুটির দিন শুক্রবারে বেশির ভাগ সেবামূলক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। একটি মেয়ে জানাল সে বিকাশে টাকা পাঠানোর নিয়ম বারবার শিখে আর ভুলে যায়। এখন আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি। তাই সমাধান করা অসম্ভব না। আমাদের অনেক দুর্বলতা যেমন আছে, তেমনি অনেক সক্ষমতাও আছে। যেমন আমাদের দেশে শিশুদের টিকা প্রদানের হার খুব বেশি। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। তাহলে কেন প্রথম টিকার দিন আমরা জন্মনিবন্ধন করতে পারব না?

এ করোনার সময়ে অল্প বয়সী মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চিকিৎসকদের কাছে এসেছেন। নথিপত্রে তাঁদের বয়স ঠিকই ১৮ বছরের ওপরে। অথচ সেবা প্রয়োজন ১৩ বছরের মেয়ের মতো। তাহলে সে সঠিক সেবা কীভাবে পাবে? আমার নিজের দুটি মেয়ে আছে। আমার দেশটা এমন হোক যেন আমার শিশুর মতো প্রত্যেক শিশুই আদর–যত্ন পায়।

নবনীতা চৌধুরী

শুধু প্রযুক্তিগত সমাধানের কথা ভাবলেই হবে না। প্রযুক্তিগত সমাধান যেন সবাই ব্যবহারও করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করাও জরুরি। এখন বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ জানাতে চাই মোহাম্মদ তবারক উল্লাহকে। তিনি বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধে জাতীয় হেল্পলাইনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে বলবেন।

মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ

মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ

প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ যাত্রা শুরু করে। এর আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ প্রতিষ্ঠানটি কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে ১০ মাসের মতো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারপর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রথম ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস থেকে বাংলাদেশ পুলিশ তা পরিচালনা করে আসছে। ১২ ডিসেম্বর জাতীয় জরুরি সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আমরা বাল্যবিবাহের ঘটনা প্রতিরোধ করতে পেরেছি। সেটি ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৩ বছর বয়সের এক কিশোরী। সে থেকে ৯ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ প্রায় ১১ হাজার ৬৬৮টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছে। এখন শহর থেকে গ্রামে আমাদের কন্যারা সাহস করেই ৯৯৯–এর নাম উচ্চারণ করে। বল প্রয়োগ ও জুলুম–জবরদস্তি করা হলে তারা ৯৯৯–এ কল দেওয়ার কথা বলে।

গত মাসে শেরপুরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশের মাধ্যমে আমরা সফলভাবে একটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়গণ প্রতিমুহূর্তে পুলিশের সহায়তা নেন। কেননা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের দায়িত্ব এখনো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর রয়েছে। যে কারণে আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে রাতের বেলা। ৯৯৯ ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি অংশ। এটি প্রযুক্তিরই উন্নয়ন। এ প্রযুক্তির সহায়তা না পেলে হয়তো আরও অনেকগুলো বাল্যবিবাহসহ জরুরি কাজে নিজেদের নিয়োগ করা যেত না। যত দিন যাবে, এটির তত প্রচার-প্রসার হবে। এখনো ৯৯৯ কল করা ব্যক্তিদের সিংহভাগই পুরুষ। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ শতাংশ নারীর কল আমরা পেয়েছি। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা আরও সহজ করা প্রয়োজন। তাহলে পুলিশের পক্ষে কাজ করা সহজ হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত আরও সহজ করা হলে এর সুফল আরও বেশি পাব।

নবনীতা চৌধুরী

নানা রকম তৎপরতায় যখন একটি এলাকার সচেতন মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেন, তখনো অনেক সময় দেখা যায়, ওই বিয়েটি পরে নৌকার ওপর কাজি সাহেবকে ডেকে পড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিই সমাধান দিতে পারে। এখন বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করব আসিফ সালেহ ভাইকে।

আসিফ সালেহ

আসিফ সালেহ

আমাদের প্রথমত, বাল্যবিবাহ উৎসে কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আইন প্রয়োগ তো পরে, আগে নিজে থেকেই মেয়েদের বোঝা না ভেবে সম্পদ হিসেবে ভাবতে হবে। গত ৫০ বছরে এ জায়গায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক পথ যাওয়া বাকি। কন্যাশিশু ও ছেলেশিশুর মধ্যে তফাত পুরোটাই সমাজের তৈরি। এ জায়গায় প্রযুক্তি দিয়ে হবে না। এখানে সবচেয়ে বড় হচ্ছে আমাদের মনমানসিকতা। সেখানে সামাজিক সংগঠনসহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আরেকটা দিক হলো আইনগত। সাংঘর্ষিক কিছু আইন আছে। ভালো সংবাদ হলো আইন রয়েছে। তৃতীয়ত, আইনের প্রয়োগ। প্রযুক্তি যতটা সম্ভব প্রয়োগকারীদের হাতে তুলে দিতে হবে। মহামারিতে দুটো প্রযুক্তিগত সাফল্য মানুষের জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। একটা হলো সুরক্ষা ওয়েবসাইট ও অন্যটি জাতীয় ৯৯৯ হেল্পলাইন। এখন প্রতিটি মানুষ এগুলোর কথা জানে। যেটা করতে আগে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো, প্রযুক্তি সেটাকে হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে। ছিটমহলের মেয়েটা বলছে যে আমি একটা কল করেই বাল্যবিবাহ থামিয়ে দিতে পারি। ফোনের ব্যাপার না থাকলে তাকে পুলিশ খুঁজে বের করতে হতো।

ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশনটা কখনো প্রযুক্তির ভিশন ছিল না। এটা ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানের ভিশন। একটা উন্নয়নের রূপকল্প। যেহেতু আমরা এখনো পুরোপুরি প্রযুক্তিগত উন্নয়নে যেতে পারিনি, সে জায়গায় প্রযুক্তি ও নির্দেশিকার একটা সমন্বয় দরকার আছে। গবেষণায় এসেছে পোশাকশিল্প থাকা এলাকায় বাল্যবিবাহের হার অনেক কম। কারণ, সেখানে অভিভাবকেরা তাঁদের কন্যাশিশুকে সম্পদ হিসেবে দেখেন। দিন শেষে কিছু বাস্তবিক কারণে অভিভাবকেরা বাল্যবিবাহের সিদ্ধান্ত নেন। এ সমস্যার সমাধানে সে বাস্তবিক কারণগুলো দেখতে হবে। প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার নিয়ে আমরা যথেষ্ট কথা বলি না। অনেক বাড়িতেই পরিবারের সবার শেষে কন্যাশিশু ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। কোভিডের আগে নারীদের ইন্টারনেট ও ডিভাইস ব্যবহারের হার ছিল পুরুষের অর্ধেক। প্রযুক্তির সম্ভাবনা আমরা সবার জন্য দেখছি। যেখানে আগামী দিনগুলোতে অনেক জীবিকার সম্ভাবনা আছে। প্রযুক্তিতে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে বড় রকমের কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাক থেকে আমরা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করব। এ পুরো সমস্যায় ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা দরকার। সে জায়গায় সরকারকে আমরা সহযোগিতা করব।

নবনীতা চৌধুরী

অর্থাৎ প্রাযুক্তিক সমাধানগুলো সমাজের ব্যবহারোপযোগী ও তার প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করতে হবে। এখন বক্তব্য রাখবেন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক।

জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক

জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক

আমাদের চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন না হলে কোনো প্রযুক্তি ও প্রকল্প কাজে আসবে না। এখন ৭০ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যসেবাকর্মী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করছে। কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এ দুটো সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করলেই নারী সমাজের সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে। তখন কন্যাশিশুকে সমাজ ও পরিবার বোঝা না, সম্পদ মনে করবে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশের বেশি নারী শিক্ষকেরা মায়ের মমতা নিয়ে শিশুদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। এখন ৮ হাজার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার মেয়ে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সিদ্ধান্তের ফলে এটা হয়েছে। করোনার সময়ে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। আমরা ডিজিটাল ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট তৈরি করেছিলাম। এটি ২০১৬ সালের কথা বলছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আড়াই কোটি ছাত্রছাত্রী তা ব্যবহার করেছে। উচ্চবিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজের সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী অনলাইনে ৭০ শতাংশ ক্লাস করেছে। বাকিরা সংসদ টেলিভিশনে দেখেছে।

১৯৩৭ সালে ব্রিটেনে ৯৯৯ জাতীয় জরুরি সেবা চালু করেছিল। আমেরিকায় ৪৯ বছর আগে ১৯৬৮ সালে ৯১১ জাতীয় জরুরি সেবা চালু করেছিল। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশবাসীকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ উপহার দেওয়া হয়। ৪ কোটি মানুষ সেবা নিয়েছে। প্রায় ১১ হাজার বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে বাল্যবিবাহ , সুদ, ঘুষ দুর্নীতি, অনিয়ম দূর করার জন্য ৩৩৩ চালু করা হলো। সেখানে বিগত চার বছরে ৭ কোটি কল এসেছে। কন্যাশিশুদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে একটা সহজ সমাধান বন্ধন ডট জিওবি ডট বিডি নকশা করেছি। বিবাহ নিবন্ধন খাতার সংশোধনে কিছু সুপারিশ এসেছে। সেগুলো ইতিমধ্যে আমাদের ডিজিটাল আর্কিটেকচারে আছে। এর ফলে আমাদের অনলাইন বিবাহ নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা দূর হবে। বয়স লুকানো ও বাল্যবিবাহ দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সুরক্ষা ওয়েবসাইটের মতো তথ্যগুলো দিতে হবে। বন্ধন নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

প্রথমত, দরকার নারী–পুরুষ সবাইকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করতে সচেতনতা তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ না পাওয়ার মতো এমন প্রযুক্তিগত কাঠামো তৈরি করা। ই-কমার্স, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, হাইটেক পার্কে আরও বেশি করে নারীর ক্ষমতায়নে প্রাধান্য দিচ্ছি। ই-কমার্সে ৫০ শতাংশের বেশি নারী যুক্ত রয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে প্রযুক্তি খাতে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সে জন্য আমরা কাজ করছি। প্রযুক্তির মাধ্যমেই সব কটি সমাধান করা সম্ভব। যত দ্রুত সম্ভব অনলাইন বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিবন্ধনের জন্য বন্ধন চালু করব। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবার সামর্থ্য সমান না। সে জন্য ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র করা হয়েছে। ব্যক্তিগত কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট না থাকা শিক্ষার্থীরা শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে গিয়ে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি আবশ্যিক করা হয়েছে। এখন ৩৫ হাজার স্কুল ও কলেজে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব করা হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে ঢাকার আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ডিজিটাল শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলেছি। স্কুল অব ফিউচার নামে এটি শুরু করা হচ্ছে। এখানে আমাদের ছেলে ও মেয়েশিশু সবারই প্রবেশাধিকার থাকছে। যেন গ্রামে থাকার কারণে তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব থেকে দূরে না থাকে। তারা যেন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারকে আমরা ষষ্ঠ মৌলিক চাহিদা হিসেবে বিবেচনা করছি। ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার থাকলে একজন ফ্রিল্যান্সার গ্রামে বসে কাজ করতে পারে। কন্যাশিশুরা জ্ঞানার্জন করে ই-কমার্স উদ্যোক্তা হতে পারে। আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস একটা ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ করতে যাচ্ছি। আমরা শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করব।

নবনীতা চৌধুরী

সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। এ গোলটেবিল সংলাপই প্রমাণ করে যে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ। আবারও ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ডাইভারসিটি কর্মসূচির পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই।