বিশ্ব হার্ট দিবস: হৃদয় দিয়ে হৃদ্যন্ত্রের যত্ন নিন
বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব হার্ট দিবস: হৃদয় দিয়ে হৃদ্যন্ত্রের যত্ন নিন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১। এ গোলটেবিল আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক
জাতীয় অধ্যাপক। প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন
অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফি মজুমদার
মহাসচিব, বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি
সাবেক পরিচালক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন
পরিচালক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. সজল কে ব্যানার্জি
অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন
লাইন ডিরেক্টর, এনসিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
অধ্যাপক ডা. এন এ এম মোমেনুজ্জামান
বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগ, ইউনাইটেড হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী
অধ্যাপাক ও বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান
চেয়ারম্যান, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট
ডা. দিপল কৃষ্ণ অধিকারী
সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. ফাতেমা বেগম
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, কার্ডিওলজি বিভাগ, ইউনাইটেড হাসপাতাল
ডা. মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম
নির্বাহী পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়)
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
বিনয় দাস
নির্বাহী মহাব্যবস্থাপক (বিপণন), এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন
অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান
ইউনিট প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার শিরোনাম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে বলা হয়েছে, হৃদয় দিয়ে হৃদ্যন্ত্রের যত্ন নিন। আমরা যদি হৃদয় দিয়ে যত্ন নিই, তাহলে বুঝতে পারব কখন কী করা দরকার। আমাদের নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। সেটা সকাল, বিকেল—যেকোনো সময় হতে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমার হার্টের সমস্যা ছিল। সময়মতো চিকিৎসা নিয়ে বিশেষ সুফল পেয়েছি। নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে হার্টের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
আব্দুল মালিক
আজকের আলোচনা অত্যন্ত সময় উপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হয়। কোভিডের জন্য গত বছর পালন করা হয়নি। কোভিডে বিশ্বে এ পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষ। অথচ বছরে হৃদ্রোগে মারা যায় ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ। হৃদ্রোগ অনেক বড় মহামারি। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে হাসপাতাল করে এবং ওষুধ দিয়ে হবে না। এটা প্রতিরোধে একমাত্র উপায় সচেতনতা। প্রত্যেককে হৃদ্রোগ বিষয় জানতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে। পরিমিত জীবন যাপন করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস বদলাতে হবে। ধূমপানসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর দ্রব্য বাদ দিতে হবে।
সরকার একা এটা করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। সংক্রামক ব্যাধিতে হয় মারা যায়, না হলে ভালো হয়। অসংক্রামক ব্যাধিতে হয় মারা যাবে, না হলে সারা জীবন এ রোগ থেকে যাবে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
১৯৭৮ সালে হার্ট ফাউন্ডেশনের সূচনার সময় একটি পুস্তিকা করি। সেখানে লিখেছিলাম, হৃদ্রোগ আজকের শত্রু আগামী দিনের মহামারি। হৃদ্রোগ এখন বিশ্বব্যাপী মহামারি। এর চিকিৎসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। আমাদের এখনো অনেক পথ যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে দরকার দক্ষ জনশক্তি ও জনসচেতনতা। অনেকে সব জানার পরও মানে না। জীবনচর্চার নিয়মগুলো মানতে হবে। সবাইকে সচেতন করতে না পারলে এ রোগ থেকে আমরা মুক্তি পাব না। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি।
এস এম মোস্তফা জামান
ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বজুড়ে হৃদ্রোগ-সংক্রান্ত জনসচেতনতা গড়ে তোলা। বর্তমানে হৃদ্রোগকে বিশ্বের ১ নম্বর ঘাতক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২১-এ আমাদের লক্ষ্য, বিশ্বব্যাপী হৃদ্রোগের সচেতনতা, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করে ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার শক্তিকে কাজে লাগানো।
আধুনিক চিকিৎসা-সম্পর্কিত প্রযুক্তি ব্যবহারে সবাইকে সচেতন করতে হবে। অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে হৃদ্রোগই বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ। বিশ্বে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক ব্যাধি। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে হৃদ্রোগসহ অসংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বেশি।
বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বজুড়ে ৫২ কোটি হৃদ্রোগী আছে। কোভিডকালে এরা ঝুঁকিতে আছে। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগে ৩ কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির আধিক্য, সিগারেট ও তামাক-জাতীয় দ্রব্য, স্থূলতা, কায়িক পরিশ্রমহীনতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন কারণে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে হৃদ্রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট জগতের বাইরে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে অসংক্রামক ব্যাধির কারণে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অল্প বয়সে হৃদ্রোগ আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তামাক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হৃদ্রোগের জন্য দায়ী। একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের বিপরীতে জনসংখ্যা ১ হাজার ৪৮৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
পরিচালিত সরকারি হাসপাতালে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য বেড আছে ৩ দশমিক ৩টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য বেড আছে ৫ দশমিক ৫৩টি।
মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। এখন পর্যন্ত বাজেটে মোট স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ১১০ ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম প্রয়োজনের জন্য একটি দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। যদিও এ বছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সামান্য বাড়ানো হয়েছে।
হৃদ্রোগ নিয়ে কমিউনিটি, নীতিনির্ধারক, হাসপাতালসহ প্রায় সব পর্যায়ে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার বেশির ভাগ মানুষ হৃদ্রোগ সম্পর্কে তেমন জানে না। বেসিক লাইফ সাপোর্ট ও অ্যাডভান্সড কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্টের ধারণা নেই। অন্যদিকে জরুরি স্বাস্থ্য ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা অপ্রতুল। করোনারি ইউনিটের অপ্রতুলতা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
জেলা সদর হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা—ফার্মাকোইনভ্যাসভি/প্রাইমারি পিসিআইয়ের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তায় বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি হৃদ্রোগের আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেশে সুলভ, টেকসই ও মানসম্পন্ন করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যনীতিতে হৃদ্রোগের মতো বিশেষায়িত জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল লিপিবদ্ধ করতে হবে। দেশের সব মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এনে তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মেডিকেল যন্ত্র ও সামগ্রীর যথাযথ বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও জনবল তৈরির জন্য পর্যাপ্ত বাজেট অনুমোদন করা জরুরি।
বিশ্ব হার্ট ফেডারেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো, ২০২৫ সালের মধ্যে হৃদ্রোগজনিত মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা। বাংলাদেশে হৃদ্রোগে মৃত্যুর হার সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হৃদ্রোগ প্রতিরোধ। শুধু প্রতিকার করেই মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সবাই কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারলে হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সফলতা আসবে।
আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী
আজকের এই আলোচনা শুধু আলোচনাই থেকে যাবে, যদি যাদের জন্য এই আলোচনা, তাদের জন্য কিছু করতে না পারি। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। হৃদয় এমন একটা যন্ত্র, যার কোনো বিকল্প নেই। সারা দুনিয়াতেই এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল। মাত্র কয়েক মিনিট হৃদ্যন্ত্র বন্ধ থাকলে আপনার মৃত্যু হবে। সময় খুব কম, যা করার দ্রুত করতে হবে। হার্ট আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা আছে। কিন্তু আমি কি হাসপাতালে পৌঁছাতে পারব? পারব তো না। অ্যাডভান্স লাইফ সাপোর্ট বাদ দিলাম। বেসিক লাইফ সাপোর্ট কীভাবে দিতে হয়, সেটা তো আমাদের জানা নেই।
স্কুল-কলেজে কার্ডিয়াক তথ্য দিতে পারি না? মুখ দিয়ে কীভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস দিতে হয়, সেটা কি শেখাতে পারি না? স্কাউটে অনেক আগে এটা শেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে নিজের মা, বাবা, আত্মীয়স্বজনকে বাঁচানো সহজ হবে। কিছুদিন আগে একজন ব্যাংকার মারা গেলেন। তাঁকে সিপিআর (কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন) দিতে পারলে হয়তো বাঁচানো যেত। অথচ ফুটবল মাঠে একজন খেলোয়াড়কে সিপিআর দিয়ে বাঁচানো গেছে। আমাদের দেশেও এটা সম্ভব। যদি আমরা মানুষকে এটা জানাতে পারি।
আমাদের অভ্যাসগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু কথা বললে কোনো কাজ হবে না। আমি অনেক টাকা খরচ করে কেন অস্বাস্থ্যকর খাবার খাব। আমি কি আমার খাবারের ধরন বদলাতে পারি না। পারি তো। আবার একেবারেই বাদ দিতে বলছি না। পরিমাণমতো কমবেশি সব খাবারই খাওয়া যাবে। বার্ষিক হেলথ চেকআপ ঠিকভাবে করালে অনেক ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। কমিউনিটি ক্লিনিকে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ ফ্রি দেওয়া হয়। আমরা কজন সেটা জানি। সরকারি হাসপাতালে রোগীর অনেক চাপ। আমাদের চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কীভাবে আমরা সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনতে পারি, সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
দিপল কৃষ্ণ অধিকারী
একটা কথা শুনে থাকি যে প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর। হৃদ্রোগের চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। আমি যদি আগে থেকেই বুঝতে পারি রোগটা হলো কি না, তাহলে অনেকটাই প্রিভেনশন করা সম্ভব। নিয়মিত চেকআপের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ চেকআপের জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়।
শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ইতিহাসে দেখা যায়, আগে অনেক ধনী লোক নিজের টাকা দিয়ে হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতেন। এখন এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়ছে। রাষ্ট্রের ভূমিকা যদি আরও বাড়ে, মানুষের বেশি কল্যাণ হতে পারে। এই সেবা এখনো প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কিন্তু একেবারে কম না। তাহলে সমস্যা কোথায়। সমস্যা হচ্ছে, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি। যাঁরা এসব পরিচালনা করছেন, তাঁদের সেই প্রাচীন আমলাতন্ত্রের মানসিকতা। এসব থেকে মুক্ত হতে না পারলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি হবে না। আমাদের গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার দরকার। গণমুখী হলো যারা সার্ভিস প্রোভাইডার ও যারা স্টেকহোল্ডার, তাদের মধ্যে সেতুবন্ধ, ক্ষমতায়ন, অংশগ্রহণ—এই জায়গায় আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। সমবণ্টনের সেবার ওপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে অনেক আধুনিক চিকিৎসা আছে। কিন্তু কজন সেই সেবা নিতে পারছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে যেন সেবা পৌঁছে যায়, সে প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি।
বিনয় দাস
আমাদের প্রধান কাজ হলো মানসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুত করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
কোভিডকালে আমাদের উদ্যোগ ছিল বাংলাদেশে প্রথম রেমডেসিভির উৎপাদন করা। আমরা সেটা করেছি। এটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। কোভিডকালে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় রিভারক্সাবান। এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশে আমরাই প্রথম লঞ্চ করেছি। আমরা এটার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও করছি। আমরা প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, এবিসি রেডিওসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক মানুষকে হৃদ্রোগ সম্পর্কে সচেতন করছি। হাসপাতালগুলোয় খুবই সাশ্রয়ী মূল্যে হৃদ্রোগের ওষুধ সরবরাহ করছি। আরও অনেক আধুনিক ওষুধের জন্য কাজ করছি। এভাবে সবাই একসঙ্গে কাজ করলে বিশ্ব হার্ট দিবসের থিম সফল করতে পারব বলে আশা করি।
ফাতেমা বেগম
আগে ধারণা করা হতো, নারীদের হৃদ্রোগ কম হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীদেরও পুরুষের মতো হৃদ্রোগ হয়। নারীরা চিকিৎসকের কাছে কম যান। অনেক ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব দেন। ফলে দেখা যায়, তাঁরা যখন ডাক্তারের কাছে আসেন, তখন হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এ জন্য হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে নারীদের মৃত্যু বেশি হয়। নারীদের স্তন ক্যানসার নিয়ে বেশি প্রচারণা হয়। কিন্তু হৃদ্রোগে তাঁদের মৃত্যুহার অনেক বেশি। আগের তুলনায় নারীদের শারীরিক, মানসিক চাপ বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী নারী ধূমপায়ীর সংখ্যাও বেড়েছে। নারীদের ঝুঁকি হলো, অনেকের শারীরিক পরিশ্রম কম থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতা কম থাকে। বিশেষ করে গর্ভকালীন হার্টের ওপর অনেক চাপ পড়ে। জন্মনিরোধক বড়ির ব্যবহারসহ বিভিন্ন ঝুঁকি থাকে। নারীদের জন্য বলব যে জন্মনিরোধক বড়ি যতটা সম্ভব কম খাওয়া যায়।
নারীদের সাধারণত বুকে ব্যথাসহ শ্বাসকষ্ট, ঘাড় ও পিঠব্যথা ইত্যাদি হয়। এ জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অনেক দেরি হয়। আমার মনে হয়, নারীদের হৃদ্রোগ পরীক্ষার জন্য আলাদা প্রটোকল থাকা প্রয়োজন।
সাধারণত সমাজে যাঁরা আয় করেন, তাঁদের গুরুত্ব বেশি থাকে। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীই আয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকেন না। এ জন্য তাঁরা চিকিৎসার ব্যাপারে অতটা গুরুত্ব পান না।
এম এ রশীদ
পৃথিবীর মোট মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশ হয় কার্ডিওভাসকুলার রোগে। ৮০ শতাংশের বেশি হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করা যায়। আমরা যদি প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিই। আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সচেতন করা। অনেক রোগের কারণ হচ্ছে ডায়াবেটিস। এটা একটা ঘাতক ব্যাধি। এটা যদি প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে প্রায় ৮০ ভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারব। এসব বিষয় সচেতন করার জন্য গণমাধ্যম, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসার মাধ্যমে সচেতনতার উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা যদি বলেন—নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত, ধূমপান করা যাবে না, চর্বি-জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে—সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আমাদের ৫০ ভাগ মানুষ প্রযুক্তির বাইরে। তারা জানে না কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে। কোভিডের সময় অনেকে বাড়িতে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। আমাদের দেশের নারীরা সংসারের জন্য জীবন দেন। কিন্তু তাঁদের ঠিকমতো চিকিৎসা হয় না। সবকিছু মিলিয়ে প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
এন এ এম মোমেনুজ্জামান
গত ৩০ বছরে হৃদ্রোগের প্রকোপ বেড়েছে। এটা ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ শতাংশ হয়েছে। আবার মৃত্যুর হার ২০ শতাংশ থেকে কমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে এসেছে। হৃদ্রোগে মৃত্যুর হার কমেছে। এর বহুবিধ কারণ আছে। মানুষের বয়স বাড়ছে। বয়স বেশি হলে হৃদ্রোগের প্রকোপ বাড়ে। জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, কায়িক পরিশ্রম না করায় হৃদ্রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। দিন দিন উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতি আসছে। এটা সহজলভ্য হয়েছে। এ জন্য মৃত্যুহার কমছে। আমরা হৃদ্যন্ত্রের জন্য যা-ই করি না, শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় এর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। আমরা ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত, কিন্তু কোনোটাই হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ঊর্ধ্বে নয়। মানুষ ক্যানসার নিয়ে যত ভয় পায়, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া নিয়ে অত ভয় পায় না। কারণ, মানুষ এ ব্যাপারে এত সচেতন নয়।
হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে প্রধান কাজ হলো বন্ধ রক্তনালিকে খোলা। সেটা ওষুধ দিয়ে হোক, থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি দিয়ে হোক দ্রুত করতে হবে। একটি ফ্রিজ থাকলে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিনা মূলে্য এ সেবা দিতে পারি। এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা যাবে। এখানে যদি আমরা থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি দিতে পারি। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ শতাংশ রক্তনালি খুলে যায়। তারপর ৩ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম হৃদ্রোগ চিকিৎসাকেন্দ্রে নিতে পারি।
এনজিওগ্রাম করে ব্লক দেখা গেলে ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্নত বিশ্বে প্রথম চিকিৎসা হলো এনজিও প্লাস্টি। আমাদের দেশে এটা সম্ভব নয়। আমার একটা প্রধান পরামর্শ হলো, উপজেলা হাসপাতালে বুকের ব্যথা কর্নার করা প্রয়োজন। এখানে ইসিজি মেশিন থাকবে। টেকনিশিয়ান ইসিজি রিপোর্ট হোয়াটসঅ্যাপে কোনো একজন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন। সরকার ভর্তুকি দিয়ে থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি সহজলভ্য করে দিতে পারে।
মীর জামাল উদ্দিন
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট সারা দেশের জন্য একমাত্র টারশিয়ারি সরকারি হাসপাতাল। এই একটি সরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে দেশের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া ও ডাক্তার তৈরি কর সম্ভব নয়। এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক্তার তৈরি করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সরকার সারা দেশে হৃদ্রোগ বিশেজ্ঞ তৈরি করে সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সব ধরনের সেবা আছে। কিন্তু সবার পক্ষে এখানে চিকিৎসাসেবা সম্ভব না।
সরকার দেশের প্রতিটি মেডিকেল ও সদর হাসপাতালে কার্ডিওলজি বিভাগ খুলেছে। এসব জায়গা থেকে হৃদ্রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। গত পরশু দিন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ১ হাজার ২০৪ জন রোগী ভর্তি ছিল। আমাদের ৪১৪ বেডকে গত জানুয়ারিতে ১ হাজার ২৫০ বেডে উন্নীত করেছে। আগামী মাসেই আমরা এই বেডগুলো পেয়ে যাব। তখন সব রোগী বেডে যেতে পারবে।
আমাদের প্রতিষ্ঠানে হৃদ্রোগের সব ধরনের ওষুধ আছে। একটি রোগী হাসপাতালে এলে ১০ মিনিটের মধ্যে তাকে থ্রম্বোলাইটিক দিতে পারব। অন্য হাসপাতালও এটা দিতে পারবে। এসব বিষয় সবাইকে জানিয়ে সচেতন করতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ছাড়া কোনো দিন কোনো জাতির স্বাস্থ্য খাত উন্নত হতে পারে না। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে ১ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে থ্রম্বোলাইটিক দিতে হয়। ঢাকায় অনেক জ্যাম থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে এই ঝুঁকি থাকে না। সবাইকে সচেতন করতে পারলেই হৃদ্রোগের চিকিৎসায় আরও উন্নতি হবে।
ফজলুর রহমান
প্রতিবছর কেন আমরা হার্ট দিবস পালন করি। এর প্রধান কারণ হলো সচেতনতা। সাধারণ মানুষ, ডাক্তার, সরকার, নীতিনির্ধারক সবার জন্য সচেতনতা জরুরি। রোগের থেকে প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ, সেটা কিন্তু আমাদের ব্যক্তিজীবনে কার্যকর করতে পারিনি। ওষুধ দিয়েও যে হার্টের ব্লক ছোটানো যায়, সেটা অনেকেই জানে না।
সরকার আজ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রাম পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা নিয়ে গেছে। অনেক ধরনের ওষুধ বিনা মূল্যে কমিউনিটি ক্লিনিকে পাওয়া যায়। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলাসহ সব চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে যদি হৃদ্রোগের সচেতনতা বিষয় প্রচার চালানো যায়, তাহলে এ রোগের প্রকোপ কমে আসবে।
থ্রম্বোলাইটিক থেরাপির দাম বেশি না, সরকার যদি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে সব হাসপাতালে এটা দেয়, তাহলে অনেকের জীবন বেঁচে যাবে।
ডিজিটাল মাধ্যম এখন অনেক শক্তিশালী। এর মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে হৃদ্রোগ থেকে সচেতন থাকার বিষয়টি পৌঁছে দিতে হবে। প্রথম আলোয় একটা খবর দেখলাম, হৃদ্রোগের বিশ্বমানের চিকিৎসা বাংলাদেশেই আছে। এটি বিশাল প্রচার। আমিসহ দেশের লাখ লাখ মানুষ এ খবর জেনে যাবে। সবচেয়ে বড় কাজ হলো মানুষকে সচেতন করা।
সজল কে ব্যানার্জি
যেকোনো রোগের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হৃদ্রোগের অসুখ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, জাতিসংঘসহ সবাই একমত যে হার্টের অসুখ প্রতিরোধ করা যায়। আমাদের দেশে রিমেটিক বা বাতজ্বরজনিত হার্ট ডিজিজ সচেতনতার মাধ্যমে কমিয়ে আনতে পেরেছি। এটা আমাদের একটা বিশাল সাফল্য। ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের শিশুদের বাতজ্বরজনিত যে হৃদ্রোগ হয়, সেটির সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রায় প্রতিরোধ হয়েছে।
সবচেয়ে কঠিন হলো ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ। যে দেশের মানুষের আয়ু বেশি, তাদের মধ্যে হৃদ্রোগের প্রকোপ বেশি। তারপর রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বেশি ওজন, রক্তে চর্বি বেশি, না হাঁটা বা কায়িক পরিশ্রম না করা, ধূমপান করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে সচেতন না হলে হৃদ্রোগ থেকে মুক্ত থাকা কঠিন।
এ ক্ষেত্রে যত সচেতনতা বাড়ানো যাবে, তত এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যাবে। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন প্রতিবছর সাধারণ মানুষকে হৃদ্রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমরা যদি একে প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে হৃদ্রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসার হাত থেকে রক্ষা পাব। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ডাক্তার ও রোগী—এ সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় যত বেশি হবে, তত সফলভাবে হৃদ্রোগ মোকাবিলা করতে পারব।
আব্দুল্লাহ আল সাফি মজুমদার
১৯৯৮ সালে রিও ডি জেনিরোতে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন গঠিত হয়। এখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম।
তখন সিদ্ধান্ত ছিল, সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হবে। অনেক দিন এভাবে চলেছে। কয়েক বছর থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পালন করা হচ্ছে। সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রায় ১৩০০ শতাব্দী পর্যন্ত আরব ও পার্শিয়ানরা দাপটের সঙ্গে হৃদ্রোগের চিকিৎসা করেছে। এ বিষয়টি উপস্থাপনায় এলে ভালো হতো। এখান থেকেই পরবর্তী সময়ে ইউরোপে প্রসার ঘটেছে। জীবনব্যবস্থা এখন এমন হয়েছে যে সকাল-বিকেল সময় করে অনেকে হাঁটতে পারেন না। হাঁটাকে জীবনচর্চার মধ্যে আনতে হবে। আপনি যেখানে যান হেঁটে যান।
অফিসে লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। প্রথম কয়েক দিন সকাল-বিকেল উৎসাহ নিয়ে হাঁটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আর নিয়মিত হয় না।
আমাদের প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক থাকতে হবে। হৃদ্রোগ প্রতিরোধে তিন স্তরবিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। রোগ হওয়ার আগে ব্যবস্থাপনা, শুরুতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পুনর্বাসনের উদে্যাগ নেওয়া জরুরি। সবাইকে ধন্যবাদ।
রোবেদ আমিন
হৃদ্রোগ হলো বিশ্বব্যাপী কিলার ডিজিজ। ১ নম্বর কিলার নিয়ে আজকের আলোচনা। ১৯৬০ সালে প্রতি হাজারে ২০ জনের মৃত্যু হতো। ধীরে ধীরে মৃত্যুর পরিমাণ কমে আসছে। এখন প্রতি হাজারে মৃত্যুর সংখ্যা হলো ১১ দশমিক ১৬ জন। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৮৯ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যু হয় ১ লাখ ১২ হাজার। দেশে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা যায় হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। তিনটি পিলারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, ইক্যুইটি। ইক্যুইটি হলো নারী, পুরুষ, শিশু—সবাইকে সমতার মধ্যে আনা। দ্বিতীয়ত, প্রতিরোধ। প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। আজকের আলোচনায়ও এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে এসেছে। তৃতীয়ত, কমিউনিটি। কমিউনিটিকে সচেতন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শুধু সচেতন করলেই হবে না। কমিউনিটির ক্ষমতায়নও করতে হবে। কিন্তু আমরা এখনো সচেতনই করতে পারিনি। আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সচেতন করা। সেটা আপনারা করছেন। সরকার থেকেও ২৮ তারিখ সারা দেশে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করা হবে। একজন হৃদ্রোগীর যেমন অর্থ ব্যয় হয়, তেমনি তার মৃত্যুর জন্য একটা পরিবার বিশাল ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তিনটি বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। ধূমপান, হাইপার টেনশন ও অতিরিক্ত চর্বি। সরকার অসংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, গোদ রোগ, লেপ্রোসি— এগুলো কেন আমরা দূর করতে পেরেছি। কারণ, এর প্রতিটির জন্য বিশেষ কর্মকৌশল ছিল। হৃদ্রোগ নিয়ে কি কোনো কর্মকৌশল আছে? নেই। কোনো ব্যয় পরিকল্পনা আছে? নেই। সরকার এখন হাইপার টেনশন ও ডায়াবেটিসের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সব সরকারি হাসপাতালে পাঁচটি ড্রাগ বিনা মূল্যে দিচ্ছে। একটি উপজেলায় ১২ থেকে ১৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। একটি উপজেলায় যদি ১৫ থেকে ২০ হাজার হাইপার টেনশন রোগী থাকে, তারা যদি ৬ থেকে ১০ টাকার একটি ডায়াবেটিসের ওষুধ খায়, তাহলে ব্যয় কত হবে। আমাদের এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৭ কোটি টাকা লাগে একটি উপজেলায়। দেশের ৪৯০টি উপজেলায় এক বছরে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ওষুধ লাগে। এত বিশাল ব্যয় কীভাবে আসবে। এখানে ইনস্যুরেন্স কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝা যায়। কারও নিজের টাকা খরচ হোক, সেটা আমরা চাই না। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যয়ের একটা পদ্ধতি থাকতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় আমাদের একটি এনসিডি কর্নার আছে। এখানে বুকব্যথার পরীক্ষা করতে পারি।
মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম
আজকের আলোচনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে মনে করি। প্রায় সবার আলোচনায় চারটি বিষয় এসেছে। এ বিষয়গুলো হলো খাবারের অভ্যাস পরিবর্তন, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপানমুক্ত থাকা ও নিয়মিত চেকআপ করা। আজকের আলোচনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আরও বলেছেন, হৃদ্রোগ থেকে মুক্ত থাকার মূল কাজ হলো সচেতন হওয়া। দেশের অনেক মানুষ এ আলোচনা শুনেছেন ও দেখেছেন।
কোভিডের মতো বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের আশা হলো ডিজিটালাইজেশন। কোভিডের আগে ডিজিটালি আমরা এই পর্যায়ে যুক্ত ছিলাম না। আজকের এই আলোচনা লাখো মানুষ শুনবে। সরকারিভাবে ২৮ তারিখ থেকে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি চলবে। একটা মোবাইল আপের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষকে যুক্ত করা যায়। একটা ইসিজি করে ওয়াটসঅ্যাপে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ও হৃদ্রোগের চিকিৎসা করা যায়।
গতকাল প্রথম আলোর খবর ছিল, বাংলাদেশে বিশ্বমানের হৃদ্রোগের চিকিৎসা আছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যারা বিশ্বে প্রথম জেনেরিক রেমডেসিভির লঞ্চ করেছে। আজকের এই আলোচনার পর হৃদ্রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে বলে আশা করি।
ফিরোজ চৌধুরী
আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সুপারিশ
৪০ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত চেকআপ জরুরি।
নিয়মিত ব্যায়াম, ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে হার্টের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারি।
আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হার্টের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো শেখানো প্রয়োজন।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ ও ডাক্তারের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে অল্প বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে । এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির আধিক্য, সিগারেট ও তামাকজাতীয় দ্রব্য, স্থূলতা, কায়িক পরিশ্রমহীনতা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা জরুরি
নারীদের বুকে ব্যথাসহ শ্বাসকষ্ট, ঘাড়ে, পিঠে ব্যথা ইত্যাদি হয়। তাদের জন্য আলাদা প্রটোকল থাকা প্রয়োজন।