বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস: হেপাটাইটিস নির্মূলে আর বিলম্ব নয়

২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ উপলক্ষে হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা বাংলাদেশ, প্রথম আলো ও এবিসি রেডিওর আয়োজনে ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আর বিলম্ব নয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় ১৪ জুলাই ২০২১। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

অধ্যাপক মবিন খান

সভাপতি, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম

সাবেক উপাচার্য, বিএসএমএমইউ

অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম

সাধারণ সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশে; অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

মো. গোলাম আযম

বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক, হেপাটোলজি সোসাইটি, ঢাকা, বাংলাদেশ; সহযোগী অধ্যাপক, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

মহাসচিব, ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ও চিফ লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

অধ্যাপক, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ

অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, শিশু বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক

সাবেক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা

অধ্যাপক, হেপাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

মো. মোতাহার হোসেন

কনসালট্যান্ট, (লিভার ব্যাধি)

মো. সাইফুল ইসলাম এলিন

লিভার বিশেষজ্ঞ, লিভার বিভাগ, বিএসএমএমইউ

এস এম মাহমুদুল হক পল্লব

সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং), বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালক

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

হেপাটাইটিস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এক হিসাব অনুযায়ী হেপাটাইটিস ভাইরাসে বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে এটা নির্মূল করার কথা বলা হচ্ছে। আর নির্মূল করতে হলে কী কী করতে হবে, সে বিষয়গুলো আজ আলোচনা হবে। আমরা লিভার নিয়ে তেমন একটা ভাবি না। যখন অসুস্থ হয়ে যাই, তখনই উদ্বিগ্ন হই। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা আছেন। তাঁরা এ বিষয় আলোচনা করবেন। পরামর্শ দেবেন। এসব পরামর্শ আমাদের পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। এর মাধ্যমে ব্যাপক মানুষের কাছে এ তথ্য পৌঁছে যাবে ও মানুষ সচেতন হবে বলে আশা করি।

মো. গোলাম আযম

মো. গোলাম আযম

বিশ্বে যেসব রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়, চিকিৎসায় খরচও অনেক বেশি, সেসব রোগের জন্য বিশ্বে দিবস আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিশিয়াল কতগুলো দিবস আছে। যেমন বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস, টিকা দিবস, ম্যালেরিয়া দিবস, তামাকমুক্ত দিবসসহ অনেকগুলো দিবস আছে। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসও পালন করছে। হেপাটাইটিস একটি ভাইরাসজনিত রোগ। তাই হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের বিষয়ে আমরা জনসচেতনতায় কাজ করছি। বিশ্বে প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করে। ১৯৯৫ সালে চার্লস গোর নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তখন কোনো হেলথ গাইডলাইন ছিল না। তাই তিনি চিকিৎসায় কোনো সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না। নিজের টাকায় উচ্চ মূল্যের ওষুধ নিয়ে সুস্থ হন। তিনি প্রথম কয়েকজন রোগীকে নিয়ে হেপাটাইটিস সি ট্রাস্ট গঠন করেন। ২০০৪ সালে এই ব্রিটিশ নাগরিক প্রথম হেপাটাইটিস দিবস পালন শুরু করেন।

অধ্যাপক মবিন খানের নেতৃত্বে ২০০৫ সাল থেকে আমরাও হেপাটাইটিস সচেতনতা দিবস পালন শুরু করি। ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স গঠিত হয় এবং ১৯ মে থেকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস রোগী কল্যাণ সমিতির ব্যাপক প্রচারণার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালায় হেপাটাইটিস সির সঙ্গে হেপাটাইটিস বিকেও আনা হয়। হেপাটাইটিস বির আবিষ্কারক অধ্যাপক বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গের জন্মদিন ২৮ জুলাইকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তারিখকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ঘোষণা করে। অধ্যাপক বারুচ শুধু হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের আবিষ্কারকই নন, তিনি এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন। এ জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

বিভিন্ন বছর বিভিন্ন স্লোগানে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। হেপাটাইটিস বির অতি কার্যকর টিকা ও হেপাটাইটিস বি ও সির অতি নিরাময়যোগ্য ওষুধ আমাদের হাতের নাগালে। এ জন্য ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি ২০১৬ সালে একটি অতি উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে ২০২০ সালের মধ্যে সব সদস্যদেশকে নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলা হয় এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে হেপাটাইটিস নির্মূল করার উদ্যোগ নিতে বলা হয়। এ বছরের স্লোগান, ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আর বিলম্ব নয়’। সবাইকে ধন্যবাদ।

মো. সাইফুল ইসলাম এলিন

মো. সাইফুল ইসলাম এলিন

যেকোনো বয়সের মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের ৩৫ শতাংশ, ক্রনিক হেপাটাইটিসের ৭৫ শতাংশ, লিভার সিরোসিসের ৬০ শতাংশ ও লিভার ক্যানসারের ৬৫ শতাংশের জন্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দায়ী। বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে ইপিআই তালিকায় হেপাটাইটিস বি ভাইরাস যুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল প্রায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

২০১৮ সালে অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলমের এক গবেষণায় দেখা যায়, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত জনসংখ্যা ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আক্রান্ত মানুষের মধ্যে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। গ্রাম থেকে শহরের মানুষ বেশি আক্রান্ত। জনবহুল বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাস। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ। নারীর সংখ্যা ২৮ লাখ ও শিশু রয়েছে ৪ লাখ। আক্রান্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। চাকরিপ্রার্থী ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের নাগরিকদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে চাকরির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে। এটা মোটেই যুক্তিসংগত নয়। ১৮ লাখ প্রজনন–সক্ষম নারী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত।

লিভারের জন্য আরেকটি ক্ষতিকর ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস সি। লিভার সিরোসিসের ৩০ শতাংশ ও লিভার ক্যানসারের জন্য ১৭ শতাংশ দায়ী হেপাটাইটিস সি ভাইরাস।

অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম

গর্ভবতী মায়েরা যদি হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে একই সঙ্গে মা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি মায়ের গর্ভের সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মায়ের অ্যাকিউট ইনফেকশন হলে এটা কখনো মারাত্মক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। প্রচণ্ড জন্ডিসসহ আরও অনেক সমস্যা হতে পারে। জন্ডিসে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। গর্ভের শিশু মারা যেতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা মা-ও মারা যেতে পারেন। গর্ভজটিলতা দেখা দিতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। লিভারের অবস্থা ভালো না থাকায় কিছু ওষুধ দিতে পারি না। সবকিছু মিলিয়ে গর্ভবতী মায়ের জন্ডিস বা হেপাটাইটিস বি একটা রেড অ্যালার্ট। এসব ক্ষেত্রে আমরা হেপাটোলজি বিশেষজ্ঞসহ সব বিভাগের বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাজ করি। অনেক সময় অপরিণত শিশু জন্ম নেয়। এই শিশু বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে থাকে। একপর্যায়ে মা লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের দিকে যেতে পারেন।

আমাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ হলো, এ রোগের ভ্যাকসিন আছে। এ ভ্যাকসিন খুব কার্যকর। দেশের সব শিশু-নারী-পুরুষের যদি ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে, তাহলে আমরা সুরক্ষিত। যেসব মা সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসেন, যিনি অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে আসেন, তাঁর ও তাঁর স্বামীর হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আছে কি না, পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সব গর্ভবতী মাকে টিকা দেওয়া যাবে না। গর্ভবতী মায়েদের কিছু পরিস্থিতি বিবেচনা করে টিকা দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মো. মোতাহার হোসেন

মো. মোতাহার হোসেন

এবারের স্লোগান হলো, ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আর বিলম্ব নয়’। হেপাটাইটিস আছে কি না, তা জেনে চিকিৎসা দিতে হবে। হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। আশার কথা, হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নির্মূলের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা আমাদের আছে। আমাদের লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই সেবা দিচ্ছেন। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো রোগটি নির্ণয় করা। এ কাজ অনেক সময় প্রাথমিক সেবাদাতা চিকিৎসকই করতে পারেন। তবে বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে অনেকগুলো পরীক্ষা করাতে হয়। সে ক্ষেত্রে লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়াই ভালো।

হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের রক্তের পরীক্ষাগুলো যেকোনো ল্যাবরেটরিতে সহজেই করানো যায়। প্রায় সব রোগীর পেটের আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হয়। কোনো কোনো রোগীর লিভার বায়োপসিও লাগে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর একটা বড় অংশ এমনিতেই ভাইরাসমুক্ত হয়ে যায়। তাই হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেই সাধারণত রোগীকে কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। তবে ছয় মাস পরেও ভাইরাসটি দেহে থেকে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে তখন ওষুধ দেওয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদি ভাইরাস বহনকারী রোগীদেরও সারা জীবনে কোনো সমস্যা না-ও হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ভাইরাস বহনকারী রোগীদের অন্তত ছয় মাস পরপর পরীক্ষা করিয়ে জেনে নিতে হয় তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো কি না।

লিভারের প্রদাহ শুরু হলে বা রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। যারা নেগেটিভ, তাদের টিকা দিতে হবে। যারা পজিটিভ, তাদের চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে এইচসিভিআরএনএ পাওয়া গেলে দ্রুত খাওয়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে সিরোসিসসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের চিকিৎসা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কারও কারও লিভার সিরোসিস ও ক্যানসার হয়ে যেতে পারে। একমাত্র লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের মাধ্যমেই এর চিকিৎসা সম্ভব। এটা একটা জটিল অপারেশন। বাংলাদেশে সম্প্রতি এটা শুরু হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়ের থেকেও বড় সমস্যা হলো সচেতনতার অভাব। বড় সমস্যা হলো সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা ও চিকিৎসা শুরু করা। এ বিষয়ে সবাই সচেতন হলে হেপাটাইটিস ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব।

অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম

অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম

ভাইরাল হেপাটাইটিসের ইতিহাস বেশ লম্বা। গ্রিক চিকিৎসক ও দার্শনিক হিপোক্রেটিস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে প্রথম দুই ধরনের জন্ডিসের কথা বলেন। একধরনের জন্ডিস ছোঁয়াচে। আরেক ধরনের ছোঁয়াচে নয়। এরপর আর তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। হঠাৎ সৈন্যশিবিরসহ বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ছোঁয়াচে জন্ডিস দেখা গেছে। দূষিত পানিই ছিল এর অন্যতম কারণ। এর স্থায়িত্ব সাধারণত ৩০ দিন। সিরিঞ্জ, রক্ত পরিসঞ্চালনসহ বিভিন্ন কারণে আরেক ধরনের জন্ডিস হয়। এর স্থায়িত্ব ১২০ দিনও হতে পারে। ১৮৮৩ সালে জার্মানের শিপইয়ার্ডের কর্মচারীদের স্মল পক্সের টিকা দেওয়া হয়। তখন গোয়ালাদের কাউ পক্সের ভ্যাসিকুলার ফ্লুইড পক্সের টিকা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১ হাজার ২৮৯ জনকে এক গোয়ালার টিকা দেওয়া হলো। তাদের মধ্যে ১৯১ জনের মধ্যে এক থেকে সাত মাস পর জন্ডিস দেখা দিল। অন্য একজন গোয়ালার ভ্যাসিকুলার ফ্লুইড ৫০০ জনকে দেওয়া হলো, তাদের কারও জন্ডিস হয়নি। ধারণা করা হয়, প্রথম গোয়ালার ভ্যাসিকুলার ফ্লুইডে কোনো জীবাণু ছিল। সেটা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯২০–এর দশকে একই ধরনের ওষুধের সিরিঞ্জ দিয়ে অনেককে ইনজেকশন দেওয়ার ফলে ইউরোপে সিফিলিসের মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। এদের জন্ডিস হয়েছে। কিন্তু এদের বাসার কারও হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের সৈনিকদের ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিন দেওয়া হতো। পরে দেখা গেল, সৈন্যদের জন্ডিস হচ্ছে। তখন ধারণা করা হলো, ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিনে যে হিউম্যান সেরাম মেশানো হয়, সেখানে ব্যাকটেরিয়া থেকে ছোট কোনো জীবাণু ছিল। রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে অনেকের জন্ডিস হতো। অনেক পরে ভাইরাসের দুটি কারণ শনাক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ইউরোপীয় কমিশনে ড. ম্যাককালাম প্রস্তাব করলেন, দুই ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাসের ফলে এটা হচ্ছে। সৈন্য, স্কুলের ডরমিটরিসহ এসব ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়। আর রক্ত পরিসঞ্চালনসহ বিভিন্নভাবে যে সংক্রমণ হয়, তাকে তিনি বললেন হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। পরবর্তীকালে হেপাটাইটিস এ ও বি ভাইরাসের বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় হেপাটাইটিস এ, বি, সি ও ই ভাইরাস প্রতিষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা

অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা

হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সাধারণত অনিরাপদ রক্ত, সুই, সিরিঞ্জ, দৈহিক মিলন ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। যারা মাদকাসক্ত, একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে ইনজেকশন ড্রাগ ব্যবহার করে, তাদের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। অনিরাপদ আকুপাংচারের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। টুথব্রাশ ও শেভিং উপকরণের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। মা থেকে নবজাতকের শরীরে ছড়াতে পারে।

আমাদের আরও জেনে রাখা ভালো, করমর্দন, কোলাকুলি ও পোশাকের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ছড়ায় না। এমনকি থালাবাসন ও চামচের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ছড়ায় না।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের পরিণতি নির্ভর করে একজন মানুষ কোন বয়সে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। শিশু বয়সে যারা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাদের ৯৫ শতাংশের দীর্ঘ মেয়াদে ইনফেকশন হয়, ৫ শতাংশ ভালো হতে পারে। প্রাপ্ত বয়সে আক্রান্ত হলে এর ঠিক উল্টো হয়। অর্থাৎ তাদের ৯৫ শতাংশ ভালো হয়। মাত্র ৫ শতাংশের দীর্ঘমেয়াদি ইনফেকশন হয়। যাদের দীর্ঘমেয়াদি ইনফেকশন হয়, তাদের ১৫ থেকে ৪০ শতাংশের লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে লিভার প্রদাহ হয়। এদের ১৫ শতাংশ ভালো হয়ে যায়, বাকি ৪৫ শতাংশের দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহে আক্রান্ত হয়। যারা দীর্ঘ মেয়াদে লিভার প্রদাহে আক্রান্ত হয়, তাদের ২০ শতাংশ রোগী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। ১ থেকে ৪ শতাংশ প্রতিবছরই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। লিভার সিরোসিস ও ক্যানসার প্রাণঘাতী রোগ। এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার জন্য অনুরোধ করি।

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক

বিভিন্ন দেশের মতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। সেটা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস ভাইরাস নির্মূল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হেপাটোলজি সোসাইটিকে যুক্ত করে সরকার এটা করতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হলে হেপাটোলজি সোসাইটিকে এটা দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। হেপাটাইটিসের ঠিকা ব্যয়বহুল। সরকারকে এটা বিনা মূলে্য দেওয়া শুরু করতে হবে।

উপজেলা পর্যায়ে হেপাটাইটিস পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত করা জরুরি। হেপাটাইটিস রোগীকে সম্পৃক্ত করে উপজেলা পর্যায় থেকে সচেতনতার কাজ করতে হবে। আরেকটি বড় কাজ হলো, কারা আক্রান্ত এবং কারা এটা অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে, এটা চিহ্নিত করতে হবে। সরকারের পরিকল্পনায় যদি হেপাটাইটিস নির্মূল করার বিষয়টা থাকে, তাহলে অবশ্যই হেপাটাইটিস প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রুত রোগী শনাক্ত ও তাদের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন গ্রামেও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা আছে। এটিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এসব বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মূল করা সম্ভব হবে বলে আশা করি।

অধ্যাপক মবিন খান

অধ্যাপক মবিন খান

আমরা একটি খুবই কঠিন সময় পার করছি। কোভিডের ভয়াল থাবা মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। প্রতিবছর হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। পৃথিবীব্যাপী ৩০ কোটির বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু বি ভাইরাসে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ রোগী ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী তাদের রোগ সম্পর্কে জানে না। শিশুদের ক্ষেত্রে বি ভাইরাসের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। কারণ, আক্রান্ত শিশুদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ তৈরি করে। প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে। অথচ মাত্র ৪৩ শতাংশ শিশু জন্মপরবর্তী বি ভাইরাস ভ্যাকসিন পাচ্ছে।

পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৩ লাখ রোগী একই সঙ্গে এইচআইভি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত। ২৭ লাখ রোগী এইচআইভি ও বি ভাইরাসে আক্রান্ত। ৭ শতাংশ টিবি রোগীর সঙ্গে সি ভাইরাস আছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে শিশুদের এ ও ই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। জীবাণুমুক্ত না করে অস্ত্রোপচারে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। অথচ সারা বিশ্বে মাত্র ১ শতাংশের কম বি ভাইরাসের রোগী ও ১ দশমিক ৫ শতাংশ সি ভাইরাসের রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা গেছে। সুতরাং হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য প্রতিরোধ করাই সর্বোচ্চ উপায়। প্রতিরোধের প্রধান উপায়গুলো হচ্ছে বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রদান। মায়ের থেকে সন্তানের বি ভাইরাসের প্রবেশ প্রতিরোধ। ইনজেকশন ও অস্ত্রোপচারে সাবধানতা অবলম্বন ও ক্রনিক হেপাটাইটিস রোগীদের চিকিৎসা।

বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সব ওষুধ এখন পাওয়া যায় এবং ওষুধের দামও কমে আসছে। হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ঠিকমতো চিকিৎসা নিলে এ ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা

অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা

মানবদেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ ও লিভারে তার আগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার যত পথ আছে, সেগুলোর মধ্যে জন্মের সময় মা থেকে শিশুর শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া আরও বিভিন্নভাবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমিত হয়। আলোচনায় সেসব এসেছে। এটা প্রতিরোধের জন্য ২০০৩ সালে ১২ এপ্রিল হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুর দেড় মাস, আড়াই মাস ও সাড়ে তিন মাস বয়সে টিকা দেওয়া হয়। টিকাদান কর্মসূচিকে নিশ্ছিদ্র করার জন্য শিশু জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা দেওয়ার সুপারিশ থাকলেও সেটা এখনো কার্যকর হয়নি।

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের টিকা দেওয়ার ফলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বাংলাদেশে ২০০২ সালে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা কার্যক্রম শুরু করার আগে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণের হার ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু টিকা কার্যক্রম শুরু করার পর ২০০৬ সালে এটা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে এটা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। ইপিআই কার্যক্রমের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের যে কার্যক্রম চলছিল, যেকোনো মূল্যে সেটা চালিয়ে যেতে হবে।

অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম

অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হেপাটাইটিস ভাইরাসের আলোচনা অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ। আসলেই কি আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি? আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত। আমরা যদি এদের চিকিৎসার আওতায় নিয়ে না আসি, তাহলে আজ থেকে ১৫ বছর পর লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের এক বিশাল ভার বহন করতে হবে। অথচ দেশে এখনো লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সুবিধা সেভাবে নেই। আবার যারা আক্রান্ত, তাদের ৯০ শতাংশই জানে না যে তারা বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত। তাহলে এই মানুষগুলোর রোগনির্ণয়ে কি আমরা আর দেরি করতে পারি? না, এমনিতে সময় অনেক চলে গেছে, আর পারি না। এরা শুধু নিজেদের জন্য বিপজ্জনক নয়, সমাজ ও পরিবারের জন্যও বিপজ্জনক। এসব মানুষই হতে পারে বি ও সি ভাইরাস ছড়ানোর উৎস।

আমরা মনে করি, এখনই সবাইকে রোগনির্ণয়ের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। মাত্র ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা হলেই হেপাটাইটিস ভাইরাস নির্ণয়ের এই বিশাল কাজ করা সম্ভব। হাসপাতালগুলোকে সনদ নেওয়ার সময় ২৫ শতাংশ গরিবদের সেবা দেওয়ার সুযোগ রাখতে হয়। হেপাটাইটিসের ভাইরাস নির্ণয়ের একটা দায়িত্বও তাদের দেওয়া যেতে পারে।

আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে কম মূল্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের চিকিৎসা সম্ভব। তারপরও অনেক মানুষ অর্থের অভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তাহলে কি আমরা আরও দেরি করব? হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নির্মূলে নীতিনির্ধারকদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। এ জন্য বাজেট বরাদ্দ করা জরুরি। দেশে চার লাখ শিশু হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এই চার লাখ শিশুকে কি আমরা চিকিৎসার আওতার বাইরে রাখতে পারি? এদের এখনই চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ২০১৮ সালের সবশেষ জরিপে দেখেছি, দেশের ১৮ লাখ প্রজনন উপযোগী নারী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত।

আমাদের ইপিআই কর্মসূচি অত্যন্ত সার্থক। নতুন প্রজন্মের শিশুদের প্রায় ৯৫ শতাংশ হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই এক কোটি মানুষকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী

প্রত্যেক চিকিৎসকের উচিত রোগীকে চিকিৎসার পাশাপাশি সেই রোগ প্রতিরোধে রোগীকে পরামর্শ দেওয়া। এটাই হবে সামাজিক দায়িত্ববোধ। বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মানুষ ও প্রতি ৩০ সেকেন্ডে ১ জন হেপাটাইটিস বি ও সি—এই দুই ভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করে।

প্রতি ১০ জন আক্রান্তের মধ্যে ৯ জনই জানে না যে তাদের শরীরে এই ভাইরাস আছে। আশার কথা, এই দুই নীরব প্রাণঘাতী ভাইরাস প্রতিরোধযোগ্য। আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ এই দুই ভাইরাসে আক্রান্ত। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে আত্মনিয়োগ করা। ইপিআই শিডিউলে বার্থডোজ সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তাদের হেপাটাইটিস বি ও সি সম্বন্ধে ধারণা নেই বললেই চলে। তৃণমূলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার আওতার বাইরে রেখে কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হবে না। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি চিকিৎসা শহরকেন্দ্রিক, বিশেষায়িত চিকিৎসা কয়েকটি কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ। অনেক সময় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যায়।

হেপটাইটিস বি ভ্যাকসিন, হেপাটাইটিস বি ইমিউনোগ্লোবিউলিন, বিশেষায়িত পরীক্ষাসমূহ সহজলভ্য করা জরুরি। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হয়। অনেকেই এর ব্যয় বহন করতে পারে না। হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। আশার কথা, হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের আরোগ্য লাভকারী ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। সব রকম অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ সহজলভ্য করা জরুরি। সুবিধাবঞ্চিতদের বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা উচিত।

করোনা মহামারির মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সির প্রতিরোধ চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রে বাধাপ্রপ্ত হয়েছে। তা ছাড়া যাদের হেপাটাইটিস বি ও সি আছে, তাদের আক্রান্ত হওয়া, জটিলতা ও মৃত্যুর হার সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। হেপাটাইটিস বি অথবা সিতে আক্রান্ত অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রন্ত হলে চিকিৎসাও বেশ জটিল। তাই হেপাটাইটিস বি ও সি আক্রান্তদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে ভিডিও কনসালটেশনের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা পরামর্শ দিতে হবে।

আসুন আমরা হেপাটাইটিস বি ও সি নিয়ন্ত্রণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করি। ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। এটাই হোক বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।

এস এম মাহমুদুল হক পল্লব

এস এম মাহমুদুল হক পল্লব

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সবাইকে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাই।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য সহজলভ্য ও মানসম্পন্ন হেপাটাইটিস ওষুধ নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এ কথা না বললেই নয় যে বাংলাদেশ সরকার হেপাটাইটিস সির ওষুধ ও হেপাটাইটিস বির ভ্যাকসিনের ওপর শুল্ক মওকুফ করেছে। কিন্তু একটি বিশাল জনগোষ্ঠী হেপাটাইটিস বির চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের জন্য হেপাটাইটিস বির মুখে খাওয়ার ওষুধের ওপর যে শুল্ক আরোপ করা রয়েছে, এটা মওকুফ করা গেলে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় ১৬ শতাংশের মতো সাশ্রয় হবে। আরও দ্রুত হেপাটাইটিস নির্মূলের মাধ্যমে এসডিজি অর্জন করা সম্ভব হবে। হেপাটাইটিস চিকিৎসায় বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো আধুনিক দেশের মতোই উন্নত। শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের উৎপাদিত হেপাটাইটিস বি ও সির ওষুধ দেশের বাইরেও রপ্তানি করার মাধ্যমে শিল্পোন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখছে।

ফিরোজ চৌধুরী

অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হলো। প্রায় সবার আলোচনায় একটা বিষয় এসেছে, ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আর বিলম্ব নয়’। আমরাও আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।


সুপারিশ

■ দেশে এক কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। এর মধ্যে চার লাখ শিশু হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস ভাইরাস নির্মূলে সমন্বিতভাবে কাজ করা জরুরি।

■ টিকাদান কর্মসূচিকে নিশ্ছিদ্র করার জন্য শিশুর জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টিকা দেওয়ার সুপারিশ থাকলেও সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। এটা জরুরিভাবে বিবেচনা করতে হবে।

■ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেককে চাকরির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চাকরি করতে কোনো অসুবিধা নেই। তাই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ দরকার।

■ গর্ভবতী মা যেন কোনোভাবে জন্ডিস বা হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত না হন, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

■ যেসব মা সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসেন ও অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে আসেন, তাঁদের ও তাঁদের স্বামীদের হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আছে কি না, পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

■ ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও অর্থ বরাদ্দ জরুরি।