মৎস্য খাতে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ

ওয়ার্ল্ডফিশ ও প্রথম আলোর উদ্যোগে মৎস্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক।

সাইনার আলম

দেশের প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এই খাতের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পিত অর্থায়ন দরকার। গতকাল রোববার ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘মৎস্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির সহযোগিতায় ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড নিউট্রিশন অ্যাকটিভিটি (ওয়ার্ল্ডফিশ) ও প্রথম আলোর উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বক্তারা সরকারের কৃষি ঋণ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতের বিনিয়োগে মৎস্য খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান।

মনজুরুল করিম

বৈঠকে ওয়ার্ল্ডফিশ, বাংলাদেশের অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড নিউট্রিশন অ্যাকটিভিটির চিফ অব পার্টি মনজুরুল করিম তাঁদের কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেশের মৎস্য খাতে কী ধরনের সমস্যা আছে, তা তুলে ধরতে আমরা একটি জরিপ করি। তাতে সমস্যা হিসেবে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। মৎস্য খাতে উৎপাদন বেড়ে যাওয়াসহ অনেক সাফল্য এলেও এই খাতে এখনো প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আসেনি। চাষিরা কীভাবে ঋণ পাবেন, তা নিয়েও ধারণার যথেষ্ট অভাব আছে। যে কারণে এখনো অনেক চাষি উচ্চ সুদে দাদন বা ঋণ নেন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে।’

মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক সাইনার আলম বলেন, এ বছর দেশে মোট ৪৬ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হবে। যার মধ্যে ২৫ লাখ টন স্বাদুপানি থেকে আসবে। তিনি বলেন, এই খাতে এত দিন যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ হয়নি। তবে বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকার তিনটি মাছকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো পাঙাশ, তেলাপিয়া ও কই মাছ। এই মাছগুলোর রং, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে তা রপ্তানিযোগ্য করা যায়।

এম এ হাকিম

সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এ হাকিম বলেন, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ দিতে অভ্যস্ত এবং ঋণ আদায়ের যে সংস্কৃতি তা মৎস্য খাতবান্ধব নয়। তারা মনে করে, মৎস্য খাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংক খাতের বাইরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই খাতে ঋণ দিতে চায় না। তাই এই সংস্কৃতি থেকে আর্থিক খাতকে বেরিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছের রপ্তানির অভিজ্ঞতা কম। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এর গুণগত মান বাড়াতে হবে। একসময় দেশ থেকে ব্যাঙ ও সাপ রপ্তানি হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণে সরকার তা বন্ধ করে দেয়। তবে এখন কুঁচে ও কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। দেশের অন্যান্য সাদা মাছের উৎপাদনও মানসম্পন্নভাবে করা গেলে তা রপ্তানি করা যাবে। ফলে এই খাতে বিনিয়োগও টেকসই হবে।

মাকসুদা আক্তার

সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মাকসুদা আক্তার বলেন, দেশের অনেক তরুণ চাকরি ছেড়ে দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। এসব শিক্ষিত তরুণের পেছনে সরকারি ব্যাংকগুলো অর্থায়নে এগিয়ে আসছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রাধানিয়া মৎস্য খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার বিষয়গুলো অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে একজন জেলে ঋণ চেয়েছেন। আর ঋণের জন্য দেখানো পুকুরের মালিক হচ্ছেন তাঁর দাদা। আর দাদার ১৫ জন নাতি, এঁদের একজন ঋণ চেয়েছেন। বাকিরা এ বিষয়ে কিছুটা জানেন না। ফলে এ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।

মূল ধারণাপত্র তুলে ধরেন ওয়ার্ল্ডফিশের সিনিয়র মার্কেট সিস্টেম স্পেশালিস্ট মো. ইমতিয়াজ হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বছরে প্রায় ২৩ কেজি মাছ খায়। দেশের ১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দেশের তৃতীয় রপ্তানি খাত হচ্ছে মাছ আর জিডিপির ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। সম্প্রতি মাছের খাবারের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে এই খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা ট্রিবিউন-এর নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, দেশের মৎস্য খাত কৃষি ও জাতীয় উন্নয়নে যতটুকু ভূমিকা রাখে, ততটুকু আলোচিত হয় না। দেশের পুকুর ছাড়াও সমুদ্রে মৎস্য চাষের আরও সম্ভাবনা আছে। তা কাজে লাগাতে আরও বিনিয়োগ দরকার।

ব্যাংক এশিয়ার ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রুমানা আক্তার বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক থেকে মৎস্য খাতে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তারা ওই ঋণ নিয়ে মৎস্য খাতে ব্যবহার করছেন কি না, তা-ও আমরা তদারকি করছি। আমরা ঋণ আদায়ে বেশ সাফল্য পাচ্ছি।’

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য খাতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একে কাজে লাগাতে হবে।

প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরীর সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ-এর হেড অব অ্যালায়েন্স কে এম আইরীন আজিজ, ওয়ার্ল্ডফিশের সিনিয়র মার্কেট সিস্টেম স্পেশালিস্ট মাজেদ হোসেন মাহিন ও সুশীলনের সহকারী পরিচালক শাহিনা পারভীন।