সহিংসতার ভয় দূর করতে বরাদ্দ চাই

‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কেমন বাজেট চাই’ শিরোনামে বৈঠকটির আয়োজন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সিপিডি ও প্রথম আলো।

আরমা দত্ত

নারীদের মধ্যে সহিংসতার শিকার হওয়ার ভয় দূর করতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আলাদাভাবে বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন। কারণ, সহিংসতার এই ভয় নারীর এগিয়ে চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করে। সহিংসতার ভয়ের বিষয়টিকে কখনো সেভাবে শনাক্ত করে কোনো মন্ত্রণালয় বাজেট তৈরি করেনি।

‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কেমন বাজেট চাই’ শিরোনামে গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। যৌথভাবে বৈঠকটির আয়োজন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও প্রথম আলো।

অনুষ্ঠানে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় বাড়ানো ও সমন্বিত উপাত্তভিত্তিক পর্যালোচনার ওপর জোর দেন বক্তারা। তাঁরা বলেন, অনেক নারী সহিংসতার শিকার হওয়ার ভয়ে কোনো কিছুতে যুক্ত হতে চান না। অনেক অভিভাবক মেয়েকে স্কুলের অনুষ্ঠান, পিকনিক বা ঘুরতে যেতে দিতে ভয় পান। এসব ভয় দূর করার ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ করে আইন বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, নারী এখন উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। জেন্ডার বাজেটের প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। তবে কোভিড–১৯–এর কারণে বাজেট বরাদ্দ এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। এটাকে প্রবণতা বলা যাবে না। তিনি বলেন, সহিংসতার ভয়ের বিরুদ্ধে নারীকে জয়ী হতেই হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বছর শেষে জেন্ডার বাজেট থেকে কোথায়, কতখানি, কীভাবে অর্থ খরচ হয়েছে, সে তথ্য স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। এ অস্পষ্টতা দূর করে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নীতিনির্ধারকদের বাজেটের আগে নারীদের মতো বড় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যায় না। তিনি বলেন, কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত নারী উদ্যোক্তাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো দরকার।

কাশফিয়া ফিরোজ

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা হয়ে যাওয়ার পর প্রতিকারের ব্যবস্থা নিয়ে জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়। প্ল্যানের গবেষণায় উঠে এসেছে, সহিংসতার ভয়ে ৩৫ শতাংশ মা–বাবা মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়ে দেন। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ রাখতে দেখা যায় না।

সমান সুযোগের ক্ষেত্রে সহিংসতার ভয় নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে উল্লেখ করেন ব্র্যাকের পরিচালক (জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি) নবনীতা চৌধুরী।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, রাষ্ট্রীয় বাজেটের মতো পরিবারের বাজেটেও মেয়েদের জন্য বরাদ্দ কম রাখা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, আদালতের নতুন নির্দেশনায় কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর মনোনীত (নমিনি) ব্যক্তি নয়, উত্তরাধিকারেরা ওই ব্যক্তির অর্থের ওপর অধিকার পাবে। সে ক্ষেত্রে মালিকানার বৈষম্য পর্যবেক্ষণে আসন্ন বাজেটে কমিশন গঠন করা দরকার।

নবনীতা চৌধুরী

নরসিংদীর রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে তরুণী হেনস্তার ঘটনা উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, সমাজের অভ্যন্তরে এসব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কেন দেখা যাচ্ছে, তা শনাক্ত করা দরকার।

নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফজিলা বানু লিলি বলেন, নারীর জন্য ভীতির পরিবেশ দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অনলাইন মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা ভয়াবহভাবে ছড়ায় উল্লেখ করে এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেন বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডব্লিউআইটি) সহসভাপতি কানিজ ফাতেমা।

ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের (ভ্রমণকন্যা) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানসী সাহা বলেন, নিরাপত্তার ইস্যুতে বেশির ভাগ অভিভাবক পরিবারের সদস্য ছাড়া মেয়েকে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেন না। তৃণমূল পর্যায়ে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করলে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন ব্রতী সমাজকল্যাণ সংস্থার উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ‘বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক অ্যানালাইসিস অন চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির কর্মসূচি সহযোগী নাদিয়া নওরিন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের দুই যুব প্রতিনিধি ফারজানা আক্তার ও রাফসান জানি।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।