সিওপিডি রোগে ফুসফুসের যত্ন
এসকেএফ, ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার লিমিটেড ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব সিওপিডি দিবস: সিওপিডি রোগে ফুসফুসের যত্ন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৫ নভেম্বর ২০২১। এ গোলটেবিল আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হলো।
অংশগ্রহণকারী
অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হাসান
চেয়ারম্যান, ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার লি.
অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ
অধ্যাপক ডা. এইচ এ এম নাজমুল আহসান
অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, পপুলার মেডিকেল কলেজ
অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিনুল হক
অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ
অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম
অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন, অনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ
ডা. মো. জাকির হোসেন সরকার
সহযোগী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি, স্লিপ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ল্যাবএইড, সভাপতি, বিআইপিসিসিএসএস
ডা. মো. মাহমুদুর রহমান সিদ্দিকী
সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ
ডা. এস এম লুৎফর রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ডা. রুবায়াত শেখ গিয়াসউদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ
ডা. জালাল মোহ্সীন উদ্দীন
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট, হাসপাতাল, মহাখালী
ডা. মুহাম্মাদ মুরতাজা খায়ের
পরামর্শক, রেসপিরেটরি অ্যান্ড স্লিপ মেডিসিন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, সেক্রেটারি, বিআইপিসিসিএসএস
ডা. রওশন আরা খানম
পরামর্শক, রেসপিরেটরি মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি, ইউনাইটেড হাসপাতাল
ডা. ফাতেমা ইয়াসমিন
স্লিপ কনসালট্যান্ট, ইনজিনিয়াস পালমো ফিট
ডা. মো. মাহফুজুল ইসলাম
সদস্য, আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন, এমডি, ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার লি.
খালিদ মাহমুদ
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, মার্কেটিং, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
গোলাম হায়দার
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, সেলস, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
শ্বাসকষ্টের প্রধান একটি কারণ ধূমপান। আপনারা কেউ ধূমপান করবেন না। ধূমপানের কারণে সিওপিডি ছাড়া আরও অনেক রোগ হয়। ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যানসার থেকে মুক্তি পেতে হলে ধূমপান ছাড়তে হবে। একবার সিগারেটে আসক্ত হলে ছাড়া মুশকিল। সিওপিডির (ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোধক রোগ।) সাধারণ লক্ষণ, যেমন কাশি, নিশ্বাসে কষ্ট হয়, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিদিন কয়েকবার ফুসফুসের ব্যায়াম সিওপিডির তীব্রতা কিছুটা হলেও কমাতে পারে।
মো. রাশিদুল হাসান
আজকের গোলটেবিলের মাধ্যমে আমরা সিওপিডির (ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোধক রোগ) কঠিন কথাগুলো সহজভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। আসলে সিওপিডি একটা গুচ্ছ রোগ। এর সঙ্গে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, কাশি ও দীর্ঘস্থায়ী হাঁপানি থাকতে পারে। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস হলো কাশির সঙ্গে কফ ওঠা। এই গুচ্ছ রোগটাকে শনাক্ত করা এবং দেশের সব মানুষ যাতে সিওপিডি চিনতে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। হাঁপানি বললে অনেকে চিনতে পারে কিন্তু সিওপিডি বললে চিনতে পারে না। বয়স্ক মানুষের শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ হলো সিওপিডি। সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও সুস্থের কাছাকাছি ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারে। আমাদের সবার আজকের কথাগুলো শুনে সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই আজকের আলোচনা সার্থক হবে।
খালিদ মাহমুদ
এসকেএফের কাজ মানসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুত করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এসকেএফ বিশ্বাস করে, মানের সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। এসকেএফের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কারখানা যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি এবং টিজিএ অস্ট্রেলিয়া থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। নিখুঁত মান ঠিক রাখার মাধ্যমে এসকেএফ দেশে ও বিদেশে ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। অ্যাজমা ও সিওপিডির সব ওষুধ, যেমন লুমনা, ডেফকর্ট, অ্যারোটাইড ইনহেলার এবং রেসপিক্যাপ, ফবুনিড রেসপিক্যাপ আমরা আন্তর্জাতিক সব মান বজায় রেখে বাংলাদেশের বাজারে দিচ্ছি। এবারের বিশ্ব সিওপিডি দিবসের থিম ‘সুস্থ ফুসফুস এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’। আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের ফুসফুসের যত্ন নিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।
জালাল মোহ্সীন উদ্দীন
বিশ্বে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান করণ হলো সিওপিডি। সুতরাং আমাদের মানুষকে সচেতন করতে হবে। কারণ, বাঁচতে হলে জানতে হবে। সিওপিডি কথাটির অর্থ হলো ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। বাংলায় একটু সহজ করে বললে ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোধক রোগ। ফুসফুসের দুটি অংশ হলো শ্বাসনালি ও বায়ুথলি। শ্বাসনালির মাধ্যমে বাতাস থেকে অক্সিজেন বায়ুথলিতে পৌঁছায়। সিওপিডির সমস্যা হলো এতে ফুসফুসের এই প্রধান দুটি অংশই আক্রান্ত হয়ে থাকে। শ্বাসনালি বেশি আক্রান্ত হলে এটাকে আমরা ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস বলি। এখানে ক্রমাগত ধূমপান বা বায়ুদূষণের কারণে একধরনের প্রদাহ তৈরি হয় এবং শ্বাসনালির পথটা সরু হয়ে আসে, যা বাতাস চলাচলে বাধা দেয়। অন্যদিকে বায়ুথলিতেও একধরনের স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে থাকে। ফলে বায়ুথলি অকার্যকর হয়ে ওঠে এবং অক্সিজেন সহজে রোগীর রক্তে যেতে পারে না। এই ধরনের রোগকে আমরা বলি এমফাইসিমা। সিওপিডি রোগে এই দুটি সমস্যা হয়ে থাকে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই রোগটা প্রতিরোধযোগ্য। মানুষ একটু সচেতন হলেই এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু রোগটা একবার হয়ে গেলে বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে। এই রোগে মানুষ এক সময় শয্যাশায়ী হয়ে যায়। সিওপিডি অ্যাজমার চেয়েও মারাত্মক রোগ। অ্যাজমা হলেও মানুষ চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে এবং লক্ষণগুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু সিওপিডি রোগীর ক্ষেত্রে যতই আমরা চিকিৎসা করি না কেন, কিছু সমস্যা থেকেই যায় এবং ধীরে ধীরে খারাপ পরিস্থিতির দিকে চলে যায়। এটা শুধু ফুসফুসের রোগ নয়। সিওপিডি হলে অন্য অর্গানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন আমাদের মাংসপেশিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাদের হাড় ও হৃদয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানুষের সারা শরীরে পানি চলে আসে। সিওপিডি হওয়ার মূল কারণ ধূমপান। বলা হয়ে থাকে, মানুষ যদি প্রতি দিন ২০টি সিগারেট খেয়ে থাকে এবং এভাবে ১০ বছর যাবৎ খায়, তাহলে তার সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আগে আমরা মনে করতাম, আমাদের দেশের নারীরা যেহেতু ধূমপান করেন না, সেহেতু তাঁদের সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের নারীদের একটা বড় অংশ সিওপিডিতে আক্রান্ত। এটার মূল কারণ লাকড়ি দিয়ে রান্না করা। লাকড়ি দিয়ে রান্না করলে যে ধোঁয়া বের হয়। সেই ধোঁয়া থেকে আমাদের গ্রামের মা-বোনেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। সুতরাং তাঁরা যদি পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করেন, যেন ঘরে ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে, তাহলে তাঁরা সিওপিডি থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
এইচ এ এম নাজমুল আহসান
যেকোনো অসুখের একটা বোধগম্য নাম দিতে পারলেই ভালো। ব্রঙ্কাইটিস খুব প্রচলিত শব্দ। আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জন্য বলতাম, সিগারেট ছাড়া ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস হয় না। অর্থাৎ ধূমপান না করলে এই রোগ হবে না। এটা শুধু বলার জন্য। প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের সিওপিডি হয় ধূমপানের কারণে। ২০ থেকে ৩০ বছর ধূমপান করলেই কিন্তু ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস হয়। সিওপিডির আরেকটা কারণ হলো এমফাইসিমা। সিওপিডি শুরু হয় শ্বাসকষ্ট দিয়ে। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে আগে হয় কাশি, পরে হয় শ্বাসকষ্ট। কিন্তু এমফাইসিমায় প্রথম থেকেই শ্বাসকষ্ট হয়। এরপর হয় কাশি। এমফাইসিমা কিছুটা জেনেটিক বা অন্য কারণেও হয়। আর এই ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস ও এমফাইসিমা মিলেই আমরা একে সিওপিডি বলি। সুতরাং মানুষকে সচেতন করতে হবে, যেন সিওপিডি না হয়। সিগারেট ছাড়লে শুধু সিওপিডি নয়, বরং ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও স্ট্রোকের মতো অনেক রোগ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। আবার অনেক মানুষের দেখা গেছে সে ধূমপায়ী নন, কিন্তু তাঁর সিওপিডি আছে। আমাদের দেশের গ্রামের নারীরাও কিন্তু সিওপিডিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এর কারণ গ্রামের অনেক মানুষ ধূমপায়ী এবং নারীরা কাঠ দিয়ে রান্না করেন। ফলে ধোঁয়া থেকে তাঁরা সিওপিডিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। গরুর গোবর থেকে যে জ্বালানি তৈরি করা হয়, সেগুলো থেকেও কিন্তু সিওপিডিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আরেকটা গ্রুপকে আমরা টার্গেট করতে পারি। যাঁরা ধূমপান করেন না, তাঁরা পরোক্ষ ধূমপায়ী হন। যেমন অনেকে বাইরে থেকে ধূমপান করে রুমে ঢুকলেন। তিনি তাঁর শ্বাসের সঙ্গে সিগারেটের ক্ষতিকর নিকোটিন দিয়ে আমাদেরও সংক্রমিত করছেন। আমরা ২০০৭ সালে একটা গবেষণা করেছিলাম। সেখানে দেখেছি, বাংলাদেশে অন্তত ৬৫ লাখ মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত। মূলত এই রোগ ৪০ বছরের পর প্রকাশ পায়। তাঁদের মধ্যে ২২ শতাংশ সিওপিডিতে আক্রান্ত। তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ ও ৩৮ শতাংশ নারী। এ ছাড়া সিওপিডিতে আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মানুষ গরিব। এটা একটা বড় সমস্যা। কারণ, তাঁদের আমরা চিকিৎসা করার কথা বললেও তাঁরা টাকার অভাবে সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না।
এস এম লুৎফর রহমান
সাধারণ মানুষ যদি না বোঝেন যে তাঁদের সমস্যা ফুসফুসে, তাহলে তাঁরা কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পাবেন না এবং তাঁদের রোগের তীব্রতাও বেড়ে যাবে। অনেক সময় রোগী নিজেই বুঝতে চান না তাঁর সমস্যা কোথায়? আমরা রোগীকে বোঝাতে পারি না যে শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফুসফুস। ফুসফুস না চললে তো আপনি বাঁচবেন না। আমাদের বুঝতে হবে ফুসফুস আমাদের জীবনের প্রধান চালিকা শক্তি। আবার যদি কারও বুকে ব্যথা হয় বা চলতে গেলে বুকে ব্যথা লাগে, এটার বিশেষ কারণ ফুসফুস। মানুষ ফুসফুস বাদ দিয়ে শুধু হার্ট নিয়েই চিন্তা করে। এটা একটা ভুল ধারণা। আমাদের এই ধারণা দূর করতে হবে। এই সমস্যা আমাদের দেশের অনেক চিকিৎসকেরও আছে। কোনো রোগী বুকে ব্যথা নিয়ে এলে সরাসরি ইসিজি করা হয়। অনেক সময় এক্স-রে করা হয় না। সিওপিডি পরীক্ষা করার একটা সাধারণ পরীক্ষা আছে। সেটা হলো স্পাইরোমেট্রি (ফুঁ দিয়ে শ্বাসনালির পরীক্ষা)। চিকিৎসকেরা এটা করেন না। অনেক চিকিৎসক এটার প্র্যাকটিস করেন না। সিওপিডি এক দিনে হয় না। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের রোগ। অনেক দিন ধূমপান করার ফলে তাঁর শ্বাসনালি চিকন হয়ে যায়। ধোঁয়া শ্বাসনালি থেকে বায়ুথলিতে যায় এবং বায়ুথলি বেলুনের মতো বড় হয়ে যায়। একে এমফাইসিমা বলে। ফলে বায়ুথলি থেকে রক্তে অক্সিজেন যেতে বাধাগ্রস্ত হয়। বাতাস থেকে যে অক্সিজেন নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি, সেটা শরীরে ঢুকতে পারে না আবার রক্তে যে দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, সেটাও শরীরে ফিরে আসতে পারে না। এই দুটিই সমস্যা। শুরুতেই হয়তো কাশি হচ্ছে। এরপর কফ বের হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। ভাবছে হয়তো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ধূমপানের কারণে। শীতকালে একটু বেশি কাশি ও কফ বের হচ্ছে। রোগী ভাবছে শীতকালে এটা হতেই পারে। রোগী হয়তো আগে পাঁচতলায় উঠতে পারত কিন্তু এখন দোতলায় উঠতেই কষ্ট হচ্ছে। এরপর একতলায় উঠতেই কষ্ট হয়। তারপর ধীরে ধীরে নড়াচড়া করতেই কষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ রোগ এমনভাবে বেড়ে গেছে যে নিয়ন্ত্রণ করাই সম্ভব হচ্ছে না। শরীরে পানি এসে গেছে। হার্টের ওপরে চাপ পড়ছে। এভাবে সম্পূর্ণ শরীর দুর্বল করে দিচ্ছে। সুতরাং এটা থেকে বাঁচার উপায় কী? ধূমপানমুক্ত বিশুদ্ধ পরিবেশ দরকার এবং পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে ব্যায়াম করা দরকার।
রুবায়াত শেখ গিয়াসউদ্দিন
সিওপিডি বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে। আমি সিওপিডির দুটি সমস্যা নিয়ে কথা বলব। একটা বায়ুদূষণ, অন্যটি অতিরিক্ত তাপমাত্রা। ডিজেল, অকটেন দহন ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। বায়ুদূষণের ফলে সিওপিডি রোগীদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। সিওপিডির লক্ষণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ফুসফুসে ইনফেকশন। ধূলিকণা ফুসফুসে ঢুকলে অনেক জীবাণু এর সঙ্গে ঢুকে পড়ে। তখন সিওপিডির লক্ষণগুলো ঘন ঘন বৃদ্ধি পায়। বায়ু দূষণের কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় এবং ধারণা করা হয়, জীবাণুগুলো আটকে থাকে শ্বাসনালিতে। বিদেশে অনেক গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে বায়ু দূষণের কারণে সিওপিডির তীব্রতা বেড়ে যায়।
একটি ইউরোপিয়ান প্রজেক্ট গবেষণায় ইউরোপের ছয়টি শহরে বায়ুদূষণের মাত্রায় দেখা গেছে সিওপিডি রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পেছনে কয়েকটি নির্দিষ্ট কেমিক্যালের সম্পর্ক একটু বেশি। যেমন নাইট্রাস ডাই–অক্সাইড, ওজন, সালফার ডাই–অক্সাইড ও কার্বনের সূক্ষ্ম ধূলিকণা। আরেকটি বিষয় হলো অতিরিক্ত তাপমাত্রা। অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত ঠান্ডা সিওপিডিতে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে যথেষ্ট সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় শহরে আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হঠাৎ গরম বাড়লে এর প্রভাবে সিওপিডিতে মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
নিউইয়র্কে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সিওপিডি রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এ কে এম আমিনুল হক
সিওপিডি সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রথমে ফুসফুসকে বুঝতে হবে। শ্বাসনালি থেকে কিছু বের হওয়ার রাস্তা নেই। ধুলাবালু বা সিগারেটের ধোঁয়া শ্বাসনালিতে চলে গেলে আর বের হতে পারে না। এটা ধীরে ধীরে ফুসফুসে জমা হয়। এর কারণ, ফুসফুস ইলাস্টিকের মতো সংকুচিত–প্রসারিত হতে পারে। এভাবেই বাতাস ফুসফুসের ভেতরে যায়, অক্সিজেন ও কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাসের আদান-প্রদান হয়। কিন্তু বায়ুদূষণ বা ধূমপানের কারণে ইলাস্টিক ফাইবার নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রোগী পূর্ণ শ্বাস নিতে বা ছাড়তে পারে না। মাঝামাঝি একটা স্থানে বাতাস যেন আটকা পড়ে যায়। ফলে তাঁর ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।
এটা দিন দিন বেড়ে যায়। আমরা যে কারণগুলো দেখি এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী ধূমপান। ধূমপান বিভিন্ন ধরনের হয়। শুধু সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান হয়, তা নয়। যারা পাইপ টানে বা হুক্কা টানে, এর ফলেও সিওপিডি হয়। আবার ইনডোর পলিউশনের কারণে অনেকেই আক্রান্ত হয়। পরিবেশদূষণও দায়ী সিওপিডির জন্য। ধুলাবালুর ক্ষুদ্র কণার সঙ্গে জীবাণু ঢোকে। আবার আমাদের শরীরেরও কিছু বিষয় আছে। যেমন ছোটবেলায় কারও বারবার ইনফেকশন হলে, বড় হলে কিন্তু তার শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শ্বাসকষ্টের যেমন অনেক কারণ আছে, তেমনি এর চিকিৎসাও আছে। সুতরাং চিকিৎসা নিতে হবে।
মুহাম্মাদ মুরতাজা খায়ের
৪০ বছর বয়সে যখন একজন রোগী শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে, তখন তার হিস্ট্রি জানতে হবে। সে ধূমপান করে কি না বা যেখানে কাজ করে সেখানে কোনো দূষণ আছে কি না। এরপর তাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, তার অবস্থা এখন কেমন। এরপর প্রথমে রক্তের সাধারণ সিবিসি করতে হবে। এখান থেকে আমরা অনেক তথ্য পাই যে তার রক্তে পলিসাইথেমিয়া (ঘন ও বেশি হিমোগ্লোবিনসমৃদ্ধ রক্ত) বা রক্তশূন্যতা আছে কি না। রোগীর হিমোগ্লোবিন বেড়ে বা কমে গেছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। এরপর পারলে একটা এক্স-রে করতে হবে। এটা গ্রামেও করা যায়। সর্বশেষ ফুসফুসের পরীক্ষা ও স্পাইরোমেট্রি করতে হবে।
স্পাইরোমেট্রি আমরা পরে শিখেছি। কিন্তু এটা এখন ডাক্তারির শুরু থেকে শেখানো উচিত। ইসিজির মতো এটাও সবার করা উচিত। অন্তত যাদের শ্বাসকষ্ট আছে, তাদের স্পাইরোমেট্রিটা করানো উচিত। এটা করলে আমরা বুঝতে পারব রোগীর অ্যাজমা বা সিওপিডি জাতীয় অসুখ আছে কি না।
ফাতেমা ইয়াসমিন
সিওপিডি রোগীরা সাধারণত কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগে। প্রায় ৭০ শতাংশ রোগীর ঘুমের সমস্যা হয়। বিশেষ করে ঘুম আসতে দেরি হয় এবং ঘুমের গতি ঠিক থাকে না। বারবার এদের ঘুম ভেঙে যায়। তাদের ঘুমের সময় কমে যায় এবং ঘুমের কোয়ালিটিও খুব খারাপ হয়ে যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়া ঘুমজনিত–শ্বাসজনিত শ্বাস বন্ধ হওয়া রোগ। স্লিপ অ্যাপনিয়া একটি সাধারণ রোগ। ২ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে ভোগে। যারা নাক ডাকে বা যাদের অতিরিক্ত ওজন, তারা এই রোগে ভোগে। যারা নাক ডাকে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীদের চিকিৎসা করাতে না পারলে ৩০ শতাংশ রোগী ঘুমের মধ্যে মারা যায়। ৯০ শতাংশ স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীর স্ট্রোক হয় এবং উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। তারা দিনের বেলায় বসে বসে ঝিমায়। তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ সিওপিডি রোগীর স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। যেসব রোগীর সিওডিপি ও অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকে, নিজের অজান্তে তারা জেগে ওঠে। এ রকম বারবার জেগে ওঠার জন্য তার ঘুমের ধারাবাহিকতা ঠিক
থাকে না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যায়। এদের চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে না পারলে পালমোনারি হাইপারটেনশন, হার্ট ফেইলিউর, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগ হতে পারে।
মো. মাহমুদুর রহমান সিদ্দিকী
সিওপিডির সঙ্গে যেসব অসুখ হচ্ছে এমন হতে পারে ওই বয়সে ও রকম অসুখ এমনিতেই হয়। অথবা এমন হতে পারে যে সিওপিডির জন্য ওই অসুখ হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। কারও সিওপিডি থাকলে তার হার্ট ও রক্তনালির অসুখ হওয়ার আশঙ্কা ৩০ শতাংশ বেশি থাকে। আমরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত থাকি হার্ট অ্যাটাক নিয়ে। এ ছাড়া হার্ট ফেইলিউর হতে পারে বা হার্টবিটের ছন্দপতন হতে পারে। সিওপিডির সঙ্গে যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে দুটোরই একসঙ্গে চিকিৎসা চলবে। তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
একজন অধূমপায়ী ব্যক্তির চেয়ে ধূমপায়ী ব্যক্তির সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা অনেক গুণ বেশি। কারণ, তার ফুসফুস ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের হাড়ের অস্থিমজ্জাগুলো নরম হয়ে যায়। সাধারণত মহিলাদের একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর হাড়ের অস্থিমজ্জাগুলো নরম হতে থাকে। কিন্তু সিওপিডি আক্রান্ত পুরুষের হাড়ের অস্থিমজ্জাও নরম হয়ে যেতে পারে কিছু কারণে। তাদের কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। সামান্য কাজ করলেও তারা হাঁপিয়ে ওঠে। ঘর থেকে বের হতে চায় না। ফলে হাঁটাচলা না করায় তার হাড়ের অস্থিমজ্জা নরম হতে থাকে।
আবার অনেক সময় ডাক্তার হয়তো রোগীকে ওষুধ দিয়েছেন কিছুদিনের জন্য। রোগী ভালো বোধ করছে। এরপর কিছুদিন পরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আর ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেই সেই ওষুধ কিনে খাওয়া শুরু করে। এতে সাময়িকভাবে সুস্থ হলেও ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সুতরাং কেউ সিওপিডিতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
মো. রফিকুল ইসলাম
রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা উত্তম। কোভিডের মতো সিওপিডির নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন নেই। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার দুটি ভ্যাকসিন যদি আমরা নিতে পারি, তাহলে সিওপিডিতে ইনফেকশনের আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়। সিওপিডি রোগীর ক্ষেত্রে ফ্লু হলেই নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য প্রতে৵ক সিওপিডি রোগীকে এই দুটি ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি। এখানে একটু বলে রাখি, নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন অনেক ব্যয়বহুল। একটা নিউমোকক্কাস ভ্যাকসিনের দাম প্রায় ছয় হাজার টাকা। এটা অনেকেই কিনতে পারেন না। এর অন্যতম কারণ, এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না। আমি এসকেএফকে অনুরোধ করব এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে উৎপাদনের জন্য। তাহলে আমাদের দরিদ্র রোগীরা কম দামে এই ওষুধ কিনতে পারবেন।
ইতিমধ্যে জেনেছি, দেশের সিওপিডি রোগীর প্রায় ৮০ শতাংশ গরিব। আমি অনেক রোগীকে এই ভ্যাকসিন দিয়েছি। তাঁরা পরে এসে জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিন তাঁদের অনেক উপকার করেছে। সর্বশেষ একটা কথা বলে শেষ করতে চাই। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি সময় দিয়ে এই ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি নিই, তাহলে আমরা প্রায় ৭০ ভাগ ডায়াগনসিস করতে পারি।
মো. জাকির হোসেন সরকার
আমার মনে হয়, দেশের একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ধূমপান করছেন। এর দায়ভার আসলে কে নেবেন? সমাজ, শিক্ষক, চিকিৎসক, বাবা–মা নাকি মিডিয়া? স্থান–কাল–পাত্রভেদে শতকরা ৮ ভাগ মানুষ সিওপিডিতে ভোগে। কেউ জানে আবার কেউ জানে না। আমাদের দেশের একটা সমীক্ষায় দেখে গেছে, দেশের ৪০ বছরের ওপরের শতকরা ২২ দশমিক ৫ ভাগ লোক সিওপিডিতে ভোগে। তবে সিওপিডি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। এখন সিওপিডির দিকে যদি আমরা নজর দিতেই চাই, তাহলে মাতৃগর্ভ থেকে দিতে হবে।
শিশু যখন মায়ের পেটে আসে, তখন থেকেই জানতে হবে ওই শিশু সিওপিডিতে ভুগবে কি না। সিওপিডিতে না ভোগার যে সতর্কতা, সেখান থেকে শুরু করতে হবে। এতকিছুর পরেও যখন কেউ আক্রান্ত হয়ে যান, তাঁকে তো চিকিৎসা দিতে হবে। রোগীকে রোগের প্যাথলজি বা জ্ঞানগর্ভ কথা বলে লাভ নেই। তাদের ওষুধ দিয়ে সুস্থ করতে হবে। ওষুধ দিয়ে আমি তাঁকে কীভাবে সুরক্ষা দেব? রোগী প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, ‘ডাক্তার সাহেব আমি ভালো হয়ে যাব তো?’ আমরা তখন তাঁকে হ্যাঁ বা না কোনোটাই বলতে পারি না। কারণ, সিওপিডি প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। কিন্তু সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। আমাদের উদ্দেশ্য রোগীর কষ্ট কমানো, তাঁর এক্সারসাইজ টলারেন্স বাড়নো এবং রোগীর স্বাস্থ্য অবস্থার উন্নতি করা।
রওশন আরা খানম
সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর থেকে মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত হয়। ফলে তার কাজের দক্ষতা ও ফুসফুসের সক্ষমতা কমে যায়। এসব বিবেচনা করে রোগীর জীবন কীভাবে আরও সুন্দর করা যায়, সে জন্য আমরা রোগীকে হাই প্রোটিন ডায়েটের পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া তাদের ব্যায়াম করতে হবে। যেহেতু সিওপিডি রোগীরা অল্প কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠেন, তাই তাঁদের ব্যায়াম করা জরুরি।
রোগীকে আমরা কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে দিই, যাতে সে তার আগের অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা ফিজিওথেরাপিস্টদের সাহায্য নিতে পারি। রোগীকে এই রোগ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার পরে মাঝে মধ্যে তাঁদের আমরা তদারক করতে পারি। পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন যে মানুষকে ভালো রাখতে পারে এটা মানুষকে বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম আলোসহ গণমাধ্যম সাহায্য করতে পারে।
মো. মাহফুজুল ইসলাম
বাংলাদেশকে এসডিজি অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে নন–কমিউনিকেবল ডিজিজেস হিসেবে সিওপিডির মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনতে হবে। এটা আমাদের ও সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণ করার উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসানের নেতৃত্বে ইনজিনিয়াস পালমোফিটের যাত্রা শুরু হয়। আমাদের প্রথম কাজ ছিল রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত জনগণ তৈরি করা। এ জন্য কিছু চিকিৎসককে দেশের বাইরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশের সিওপিডি চিকিৎসায় দক্ষ চিকিৎসক এনে আমাদের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল নিয়ে আমরা একটা দল গঠন করে কাজ শুরু করি।
৫০ শতাংশ সিওপিডি রোগীর স্টেরয়েড ইনহেলার দীর্ঘমেয়াদে প্রয়োজন হয় না। দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড ইনহেলার কখনো কখনো সিওপিডিতে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ায়, তাই সিওপিডি চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদে স্টেরয়েড ইনহেলার সঠিক কি না, তা পরীক্ষার লক্ষ্যে ফেনো টেস্টের প্রবর্তন করেন। ফেনো টেস্টের পর ফুসফুস ও হার্টের কার্যক্ষমতা দেখার জন্য বডি বক্স, ডিএলসিও এবং সিপিইটি ইত্যাদি পরীক্ষা চালু করেন রাশিদুল হাসান। সিপিইটি খেলোয়াড়দের হার্ট ও ফুসফুসের রোগীদের ফিটনেসের জন্য খুব জরুরি পরীক্ষা। ফুসফুসের সংরক্ষণ ও পুনর্গঠনের জন্য রিজেনারেটিভ মেডিসিন হিসেবে পিআরপি এবং সিওপিডি, আইএলডি, লং-কোভিডে স্টেমসেল চালু করেন। রোগীর প্লাজমা থেকে পিএ-পিআরপি নেবুলাইজেশনের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। নষ্ট হওয়া কোষকে পুনর্জীবিত করতে আমরা কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন হিসেবে ওজন থেরাপির ব্যবস্থা করেছি। ইনজিনিয়াস পালমোফিটে সুন্দরভাবে স্লিপ ল্যাবের ব্যবস্থা করেছি। সামগ্রিক বিবেচনায় ইনজিনিয়াস পালমোফিট গত চার বছরে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে দেশে একটা অনুকরণীয় সিওপিডি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার তৈরি করতে পেরেছে।
মো. রাশিদুল হাসান
সিওপিডিতে ঝুঁকি বলতে আমরা ছয়টি প্রধান বিষয় বুঝি। এটা মনে রাখার সহজ পদ্ধতি হলো এবিজিপিটিও। এ-অ্যাজমা, বি-ব্রঙ্কিএকট্যাসিস, জি-গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, পি-এয়ার পলিউশন বা বায়ুদূষণ, টি-তাপমাত্রা পরিবর্তন, ও-অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া সিনড্রোম বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হওয়া। এই ছয়টি বিষয় নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে সিওপিডি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। সিওপিডি চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সঠিক ব্যবস্থাপনা। এ জন্য সাতটি বিষয় মনে রাখতে হবে। এক. ধোঁয়া ও ধূমপানমুক্ত পরিবেশ। দুই. সময়মতো ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার টিকা গ্রহণ। তিন. প্রতে৵ক রোগীর পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশনে অংশগ্রহণ। চার. আধুনিক ওষুধ গ্রহণ করে শ্বাসনালিকে সুরক্ষিত করা। পাঁচ. হঠাৎ ইনফেকশনে অসুস্থ্ হলে এবিসিও অর্থাৎ এ-অ্যান্টিবায়োটিক, বি-শ্বাসনালিতে ব্রঙ্কোডাইলেটর জাতীয় ওষুধ শ্বাসে প্রয়োগ, সি-পরিমিত করটিকোস্টেরয়েডস, ও-অক্সিজেন দিয়ে রোগীকে সুস্থ হতে সাহায্য করা। ছয়. সিওপিডির পাশাপাশি অন্য সব রোগের চিকিৎসা করা। সাত. যাদের শরীরে অক্সিজেনের অভাব আছে, তাদের দৈনিক ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন দিওয়া। যাদের শরীরে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে যায়, তাদের বাইপ্যাপ মেশিন দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রোগীর শিক্ষা কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই।
গোলাম হায়দার
এসকেএফ নিখুঁত মান বজায়ের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে এসকেএফ। আমাদের ডেডিকেটেড প্ল্যান্ট থেকে লুমনা ও অ্যারোটাইডসহ অন্যান্য রেসপিরেটরি ওষুধ তৈরি হচ্ছে। সিওপিডির চিকিৎসাসংক্রান্ত সব পদক্ষেপে এসকেএফ আপনাদের সঙ্গে থাকতে চায়। যেকোনো সচেতনতামূলক প্রোগ্রামে আমরা কাজ করতে চাই।
ফিরোজ চৌধুরী
ফুসফুসের রোগকে অবহেলা করা যাবে না। এ বিষয়ে সবার সচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকেরা কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সুপারিশ
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে
বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে
লাকড়ির চুলার ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করা উচিত
নিয়মিত ব্যায়াম করা প্রয়োজন
মুঠোফোনের ব্যবহার যথাসম্ভব কম করতে হবে
তাপমাত্রা অতিরিক্ত বাড়া বা কমার কারণে সিওপিডি হতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে
প্রতিদিন জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া ও শ্বাসের ব্যায়াম করা প্রয়োজন
গরুর গোবরের তৈরি জ্বালানির ব্যবহার পরিহার করা দরকার
ঘুমের সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
দেশে নিউমোনিয়ার টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা উচিত
প্রতিটি সিওপিডি রোগীর ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া জরুরি