বাংলাদেশের উন্নয়ন চেতনায় শিল্প ও সংস্কৃতি

স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন চেতনায় শিল্প ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে। আলোচকদের বক্ত্যব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

নসরুল হামিদ এমপি

প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়

নজরুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান

সামসুল ওয়ারেস

স্থপতি ও অধ্যাপক

সারা যাকের

নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

ডালিয়া নওশিন

কন্ঠশিল্পী ও মাজহারুল ইসলামের কন্যা

আদনান মোরশেদ

স্থপতি ও অধ্যাপক

লুভা নাহিদ চৌধুরী

স্থপতি ও নির্বাহী পরিচালক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

ইসতিয়াক জহির

স্থপতি ও সাধারণ সম্পাদক, মাজহারুল ইসলাম ফাউন্ডেশন

আনিসুল হক

সাহিত্যিক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

ইসতিয়াক জহির

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম মনেপ্রাণে একজন বাঙালি ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন বিশ্বমানব বা বিশ্বনাগরিক হিসেবে তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল একজন প্রকৌশলী হিসেবে। সেখান থেকে তিনি স্থাপত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য একটা আধুনিক স্থাপত্য কীভাবে হবে, তা আমাদের মধ্যে তুলে ধরেছেন।

জনগণকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক যে উন্নয়নের ধারণা, তিনি তা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ছড়িয়ে দেন। এই চিন্তাকে ধরে রাখার জন্যই মাজহারুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। আমরা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোচ্ছি। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের তত্ত্ব ও দর্শনকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

মাজহারুল ইসলাম স্যার সব সময় একটা কথা বলতেন, নিজের টেবিল থেকে শুরু করে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। স্যার বলতেন, শহরটাকে গোছাতে হবে। হাতিরঝিল প্রকল্প করার পর

আমরা সে আনন্দটা পাই যে হাতিরঝিলকে গোছানো সম্ভব হয়েছে। স্যার বলতেন, সারা বাংলাদেশকে গোছাতে হবে।

স্বাধীনতার পরপরই স্যার একবার কিছু তরুণ স্থপতি ও সমাজকর্মীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমাদের এখানে ‘মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্ল্যানিং’ নামে একটা মন্ত্রণালয় করা উচিত। এ মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা। আয়তনের হিসাবে বাংলাদেশ ছোট দেশ, একে পরিকল্পিতভাবে গোছানো সম্ভব। বর্তমান সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ, যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা হয়। জনগণকে এতে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় দুটি প্রতিষ্ঠান তৈরিতে কাজ করেছেন। দুই জায়গায় দুই ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, দুই ধরনের সংস্কৃতি। তাই নকশাও করেছেন দুই ধরনের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উঁচু পাহাড় ও ভ্যালির মধ্যে ভবন করেছেন। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হালকা উঁচু-নিচু ও পানিঘেরা জায়গায় তিনি এমন একটা ইউনিভার্সাল গ্রিড বসিয়েছেন, যা আধুনিক কিন্তু পরিবেশবান্ধব।

খোলা পরিসর তৈরিতে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অ্যাম্ফিথিয়েটার করেছেন, যা বাংলাদেশের প্রথম অ্যাম্ফিথিয়েটার। এরপর অ্যাম্ফিথিয়েটার হয়েছে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে, তারপর হাতিরঝিলে। স্যারের বড় একটি কীর্তি চারুকলা অনুষদের নকশা প্রণয়ন, যেটি নিয়ে বলবেন স্থপতি আদনান মোরশেদ।

আদনান মোরশেদ

স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জীবনবৃত্তান্তের পরিবর্তে তাঁর নকশা করা একটি ভবনের দৃষ্টিতে কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করতে চাই, কয়েকটি প্রশ্ন তুলতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের যে ভবন, ১৯৫৩ সালে তিনি এর নকশা করেন। ১৯৫২ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মাজহারুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছেন। দেশে এসে তিনি গণপূর্তের স্থাপত্য বিভাগে যোগদান করেন। যখন তাঁকে এ প্রকল্প করতে দেওয়া হয়, ভাষা আন্দোলন তখন তুঙ্গে।

এত দিন বলা হয়েছে, পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এ ধরনের ভবন আগে করা হয়নি। কিন্তু আমি এ বিতর্ক আরেকটু বাড়িয়ে বলতে চাই, দক্ষিণ এশিয়াতেও হয়নি। চারুকলা অনুষদের এ ভবন ভারতীয় উপমহাদেশের নান্দনিক আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। একে নিয়ে গবেষণা করতে হবে। এখানে কংক্রিট ও ইটের একটা সমন্বয় আছে। আমাদের বাংলাদেশের গ্রামীণ স্থাপত্যের যে শাশ্বত উঠান, তাকে ঘিরে এক ধরনের আধুনিক নান্দনিকতা এর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে দেখা যায়নি।

মাজহারুল ইসলামকে যখন চারুকলা অনুষদের ভবনটি নির্মাণের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন তিনি বিশেষ একটি অনুরোধ করেছিলেন। তিনি তাঁর দলকে শাহবাগ এলাকার একটা জরিপ করে দিতে বলেছিলেন, যাতে কোথায় কী কী গাছ রয়েছে তা জানা যায়। একটি গাছও না কেটে ভবনটি তৈরির জন্য জরিপটি করতে বলেছিলেন। এ ভবনে অন্দর ও সদরের একটা সমন্বয় আছে। এখানে ট্রপিক্যাল ক্লাইমেটের জন্য একধরনের আধুনিক কিন্তু স্বকীয় নকশা করা হয়েছে।

চারুকলা অনুষদ ভবনের সমসাময়িক ভবন হচ্ছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় তৈরি কার্জন হল ছিল ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যের প্রতীক। মাজহারুল ইসলাম ১৯৫৩ সালে যখন চারুকলা অনুষদ ভবনের নকশা করা শুরু করেন, তখন দুটি ধারা প্রচলিত ছিল। একটি ছিল ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, আরেকটি ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে গতানুগতিক করিডর-রুম, যেটি আমরা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে দেখতে পাই।

আমরা যখন পঞ্চাশের দশকের বৈশ্বিক স্থাপত্য নিয়ে আলাপ করি, তখন একটি বিষয় এড়িয়ে যাই। পৃথিবীর আধুনিক স্থাপত্যের যেসব আইকন, যেমন চণ্ডীগড়—তখনো চণ্ডীগড় হয়নি। ফরাসি-সুইস স্থপতি কর্বুসিয়ারের ফ্রান্সের বিখ্যাত স্থাপত্য রনচ্যাম্প, নটর ডেম চ্যাপল কিন্তু তখনো তৈরি হয়নি। মার্কিন স্থপতি ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের গুগেনহাইম মিউজিয়াম তখনো তৈরি হয়নি। আমি বলতে চাই, চারুকলা অনুষদ ভবন পৃথিবীর আধুনিকতার মানচিত্রে নতুন একটি ভবন, যেটা নিয়ে আমরা এখানে খুব একটা গবেষণা করিনি।

মাজহারুল ইসলামের মনোজগৎ আমাদের বুঝতে হবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার সময়েই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। চল্লিশের দশকে বামপন্থী রাজনীতিতে তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি মার্ক্স-লেনিন পড়েছেন, কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে এসেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিবপুর আইটিতে পড়েছেন। তিনি প্রবলভাবে রবীন্দ্র–অনুরাগী ছিলেন। সুতরাং তিনি যখন চারুকলা অনুষদের ভবনটি নকশা করেন, তখন তাঁর কাছে নান্দনিক আধুনিকতা শুধু পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকে আমদানি করার লক্ষ্য ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন স্থাপত্যের ভাষা ও স্থাপত্যের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিনির্ভর একধরনের বাঙালি আধুনিকতাকে অনুসন্ধান করতে।

মাজহারুল ইসলাম আজীবন রবীন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন। আমি তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ঘেঁটে দেখেছি, সেখানে রবীন্দ্রনাথের অনেক বই ছিল। রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে বাঙালি চরিত্রের অন্বেষণ করেছিলেন, মাজহারুল ইসলামও অনেকটা ওই অর্থেই করেছেন।

মাজহারুল ইসলাম বলতেন, বাঙালি হতে গেলে বিশ্বমানব হতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতোই মাজহারুল ইসলাম চেয়েছিলেন বাঙালি শুধু বাঙালিত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

মাজহারুল ইসলাম বাঙালি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঙালিত্বের সীমানা অতিক্রম করে গেছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা যে চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয়, এটা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। এটি আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের যে যাত্রা, তাকে প্রতীকায়িত করে।

গবেষণায়, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে মাজহারুল ইসলাম এখনো অনুপস্থিত। কীর্তিমান বাঙালিদের আমরা সিংহাসনে বসিয়ে গবেষণার আওতায় আনি না। আমি যুক্তরাষ্ট্রে যখন ইতিহাস পড়াই, তখন সেখানকার শিক্ষার্থীদের মাজহারুল ইসলাম সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করি। এ বিষয়গুলো আমাদের নিজেদের শিক্ষা কারিকুলামেও থাকা উচিত। এ গল্পগুলো আমাদেরই বলতে হবে।

আনিসুল হক

আমি মনে করি, আমাদের উন্নয়ন ভাবনার মধ্যে দেশ, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি যুক্ত থাকা উচিত। বলা হয় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, দর্শকের সঙ্গে মঞ্চের সম্পর্কের মতো নয় যে মানুষ দর্শক, আর প্রকৃতি মঞ্চ; বরং আমরা প্রকৃতিরই অংশ। আমাদের উন্নয়ন–ভাবনায়, আমাদের স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে এই চিন্তাগুলো আমাদের মাথায় থাকা উচিত যে মানুষগুলো কোথায় যাবে, এর বর্জ্য কোথায় যাবে, বিদ্যুৎ–সংযোগ কেমন হবে, অতিরিক্ত কোনো যানজট হবে কি না।

একটা গাছ না কেটেও কীভাবে স্থাপনা করা যায়, মাজহারুল ইসলাম তা দেখিয়ে গেছেন। আমাদের নদী, জলের কথা ভাবতে হবে। প্রায় প্রতিদিনই দেখি, আমাদের ঢাকা শহরের বাতাস পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ে ভাবতে হবে। নদী নষ্ট না করে, গাছ নষ্ট না করে, পানি নষ্ট না করে উন্নয়ন–ভাবনা করতে হবে। এতে মানুষের অংশগ্রহণও জরুরি। আলোচনায় গণতান্ত্রিক স্থাপত্যের কথা এসেছে। এটি নিশ্চিত করতে হবে। চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ষাটের দশকে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করা, ছায়ানট গঠন করা—পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে মাজহারুল ইসলাম যুক্ত ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে অনুশীলন হতো। ষাটের দশকে তিনি এসবের প্রধান প্রশ্রয়-আশ্রয় ছিলেন। অনেক পরে চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হওয়া তারই একটি প্রতিফলন।

মাজহারুল ইসলাম স্যার ছিলেন সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর যে ভবনগুলোর উদাহরণ আমরা পড়ি, তা থেকে এটি বোঝা সহজ হয়।

এ বছর প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা একটি ক্রোড়পত্র বের করেছি। সেখানে আমরা বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের ২৫ জন প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে লেখা প্রকাশ করেছি। সেখানে মাজহারুল ইসলাম স্যারের নাম ছিল। দেশে-বিদেশে মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেছে। এ ধারাবাহিকতা আমরা যদি ধরে না রাখতে পারি এবং আমাদের পরবর্তী কার্যক্রমসমূহে তাঁর দর্শন ধারণ না করতে পারলে তো হবে না। সে জন্য এ রকম আলোচনা জরুরি।

সারা যাকের

স্থাপত্য-আচার্য মাজহারুল ইসলামের চিন্তাচেতনা সামনে রেখে আগামী ৫০ বছরের স্থাপত্য ভাবনা কেমন হতে পারে, তা নিয়েই এই আলোচনা।

পপুলেশন কাউন্সিলের একটি গবেষণা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশে যুবসম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি। ৫০ বছর পর ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটবে। ৫০ বছর পর ৫০ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। তা ছাড়া শহর ও গ্রামের চিত্র একইভাবে পাল্টে যাবে। তখন বেশি আয়তন জুড়ে থাকবে শহর আর তুলনায় কম জায়গায় থাকবে গ্রাম। বাংলাদেশের ৫০ বছর পরের এ চিত্র আমাকে ভাবিয়েছে। সেখানেই আমি স্থাপত্য-আচার্য মাজহারুল ইসলামের কথা ভেবেছি এবং তাঁকে মনে করেছি।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যে আমরা দেখেছি, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি গৃহবাসীদের তিনি নিয়ে এসেছেন। বৃষ্টির ছাট বা সূর্যের রোদ গায়ে এসে লাগবে। আমরা করিডর বা বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে সেই ছাট পাব, সূর্যের রোদটা পাব। এমনিভাবে নির্মিত হবে আমাদের বাড়িগুলো। মানুষ গৃহের ভেতরে বন্দী থেকেও প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারবে।

বলে রাখা ভালো, আমি যখন ছোট, সে অল্প বয়সেই মাজহারুল ইসলামের নকশা করা বাড়িতে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার বাবা যখন বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তিনি তাঁর বন্ধু, আমাদের মজু চাচাকে (মাজহারুল ইসলাম) বলেছিলেন যেন বাড়ির নকশাটা করে দেন এবং মজু চাচা সে নকশা করে দিয়েছিলেন।

আমরা বাংলাদেশে নগরায়ণকে এখন পর্যন্ত খুব ভালোভাবে ধারণ করতে পারিনি। আমরা যত নগরায়ণের দিকে যাচ্ছি, আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই, আবাসনের স্থানগুলো খুবই আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্মিত হচ্ছে। কমিউনিটি স্পেসের গুরুত্ব কমছে। উন্মুক্ত স্থান গুরুত্ব হারাচ্ছে।

আজ থেকে ৫০ বছর পর; অর্থাৎ ২০৭৪ সালে পুরো বিশ্ব ও বাংলাদেশ অনেক অনেক বদলে যাবে। এই জায়গা থেকে আমি বলতে চাই, আমাদের মনে রাখতে হবে, মাজহারুল ইসলামের মহান ব্যক্তিকে, যিনি চিন্তাভাবনা করে তাঁর নকশায়, তাঁর স্পেস ডেফিনেশনে প্রকৃতিকে এনেছেন। তিনি এমনভাবে স্থাপনাগুলো তৈরি করেছেন, মানুষ যেন মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। আগামী ৫০ বছরে যে ভয়াবহ চিত্রটা হতে পারে, আমরা ভীষণভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রভাবিত হব, গেজেট দ্বারা প্রভাবিত হব। মানুষ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে।

এই গ্যাপ পূরণ করার মতো উদাহরণ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম রেখে গেছেন আজ থেকে অনেক আগে। সুতরাং আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের এ কাজ করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের মাথায় রাখতে হবে যে স্কুলে খেলার মাঠ থাকবে। আর পাড়ায়ও একটা খেলার মাঠ থাকবে। থাকবে লাইব্রেরি। অবশ্যই নাটকের জন্য একটা মঞ্চ থাকবে। খোলা মঞ্চের পাশাপাশি মিলনায়তনও যেন থাকে। আগামী ৫০ বছরের মাথায় আমরা যেন সে রকম সুন্দর একটা বাংলাদেশ গড়তে পারি।

লুভা নাহিদ চৌধুরী

আমরা যদি মাজহারুল ইসলামকে কেবল একজন স্থপতি হিসেবেই দেখি, তাহলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। একটা সামগ্রিক রূপ যে স্থাপত্যচিন্তার বিষয় হতে পারে, এ কথা বোধ হয় মাজহারুল ইসলামই প্রথম বলেছিলেন। অনেকের ধারণা, স্থাপত্যচর্চা একটা কারিগরি ও কৌশলগত অনুশীলনমাত্র। কিন্তু এর যে একটা দর্শন আছে এবং এই দর্শনের যে একটা বিরাট ভিত্তিভূমি আছে, তা আগে কেউ আমাদের এমন করে বলেননি।

একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে মাজহারুল ইসলাম আমাদের আত্মপরিচয়ের জায়গাটা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। আমার নিজের আধুনিকতা আমাকেই নির্মাণ করতে হবে। পশ্চিমা আধুনিকতার ভোক্তা বা সেবক না হয়ে আমাকে আমার মতো করেই এর সংজ্ঞায়ন করতে হবে। এটি একটি চলমান ও বিবর্তনশীল প্রক্রিয়া, তা এক দিনে হওয়ার নয়। মাজহারুল ইসলাম চেয়েছিলেন, দেশের স্থপতিরা যেন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে গর্ববোধ করেন। স্থপতির রাজনৈতিক দায় আছে। মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে নানাজনের কথোপকথন থেকে জানতে পারা যায় যে তিনি মনে করতেন, রাজনৈতিক দায় ও সামাজিক চিন্তা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে স্থপতিদের চিন্তাপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে।

আমাদের সংস্কৃতিতে কাব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গানও কাব্যগীতি বলে পরিচিত। আমি মনে করি, আচার্য মাজহারুল ইসলামের বড় অবদান যে তিনি স্থাপত্যচর্চায় নতুন দিকনির্দেশনার পাশাপাশি কাব্যিক অনুভূতি যুক্ত করেছেন, একটা ‘পোয়েটিক সেন্স’ দান করেছেন। মাজহারুল ইসলামের নকশাকৃত চারুকলার যে স্থাপত্যরীতি, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে। সেই ভবনে নির্দিষ্ট কোনো প্রবেশদ্বার নেই। তা সবার জন্য উন্মুক্ত। এখনকার সরকারি ভবনগুলোয় উঁচু বেষ্টনী ও ফটক থাকে। সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার এবং সহজগম্যতার ধারণা থেকে আমরা বহু দূর সরে এসেছি। আমরা চাই স্থাপত্যচর্চায় গণতান্ত্রিক ভাষা প্রতিষ্ঠা পাক। আমাদের আগামীর পথ যেন গঠনমূলক সমালোচনা, উন্নত দর্শন এবং স্বতন্ত্র স্থাপত্যভাষার অন্বেষায় প্রসারিত হয়।

সব শেষে, মাজহারুল ইসলামের নকশাকৃত সব স্থাপনাকে মূল্যবান ঐতিহ্যসংলগ্ন সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সামসুল ওয়ারেস

মাজহারুল ইসলামের করা অনেকগুলো ভবন আছে বাংলাদেশে, যেগুলোর প্রতিটিই স্থাপত্যশিল্পে একেকটি রত্ন। তিনি ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৫২ সালে অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ছয় মাস তিনি সেখানে ঘুরেছেন এবং সেখানকার নামকরা ক্ল্যাসিক ও আধুনিক স্থাপনাগুলো দেখেছেন। পরে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) ভবনের নকশা করেন। পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে তিনি একা পুরো নকশা অঙ্কন করেন।

৭০ বছর আগে করা মাজহারুল ইসলামের চারুকলা ভবনের দিকে তাকালে এখনো আমার মনে হয়, আমরা একে অতিক্রম করতে পারিনি। আমরা এখন ভবন তৈরি করলে নিরাপত্তার কারণে বাসাকে জেলখানা বানিয়ে ফেলি। অথচ মাজহারুল ইসলামের করা এ ভবনে কোনো দরজা নেই। বাইরে থেকে কখন যে ভবনের ভেতরে চলে আসা হয়, তা টেরই পাওয়া যায় না। কারও কাছে যেতে কোনো অনুমতি লাগছে না। তিনি স্থাপত্যের সঙ্গে চিত্রকলার সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন।

মাজহারুল ইসলাম এশিয়ার মধ্যে আধুনিকতা নিয়ে এসে এ কাজ করলেন। শুরুতে তিনি মোগল স্থাপত্য বাদ দিলেন। ব্রিটিশ স্থাপত্যও তিনি অনুসরণ করলেন না। তিনি বাংলাদেশের জন্য নতুন সংস্কৃতি তৈরি করতে আগ্রহী হলেন। ঔপনিবেশিক যে একটা গোলামি ছিল, তা নিয়ে তিনি কাজ করতে চাননি। স্থাপত্য ছিল একটা মাধ্যমমাত্র, মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশ গড়া। দেশ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে তিনি স্থাপত্যকে ব্যবহার করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, পুরো বেঙ্গল রেনেসাঁই মাজহারুল ইসলামের আত্মস্থ ছিল। ভবনের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক থাকতে হবে, এটা ছিল রবীন্দ্রনাথের দর্শন, যা আমরা দেখি শান্তিনিকেতনে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মাজহারুল ইসলামের অনবদ্য সৃষ্টি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা করার সময় তিনি খোলামেলা পরিবেশে আধুনিকায়ন করতে চেয়েছিলেন। ভবন নির্মাণে তিনি কোনো দামি মার্বেল ব্যবহার করেননি। তিনি চেয়েছিলেন সাশ্রয়ী মূল্যে ভবন করতে, কিন্তু এর মান হবে সর্বোচ্চ মাপের। আইডিয়া যদি সুন্দর হয়, তাহলে সাধারণ জিনিস দিয়েও যে অসাধারণ ভবন নির্মাণ সম্ভব, তা মাজহারুল ইসলাম দেখিয়ে গেছেন। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের মতো মানের কোনো প্ল্যান পৃথিবীতে দেখিনি। যদিও এটি পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। কয়েকটি ভবন নির্মাণের পর একে আর মানা হয়নি। তিনি যে লেকগুলো করেছেন এবং লেকের সঙ্গে ভবনের যে সম্পর্ক করতে হয়, তার প্রমাণও আছে। এখনো একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই অতিথি পাখি আসে, আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আসে না। সুতরাং এ থেকে বোঝা যায়, তিনি খুব দূরদর্শিতার সঙ্গে ভবন ও ইকোলজির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পেরেছিলেন।

আমি যখন মাজহারুল ইসলামের কাজ দেখি, তখন আমি বুঝতে পারি তিনি আধুনিকতা, সাম্যবাদ, উন্মুক্ততা, সংস্কৃতি বিবেচনায় রেখে কীভাবে কাজ করতে হয়, সেটা তিনি যতটা পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলেন, তা সে সময় কোনো এশীয় স্থপতি পারেননি। এই অঞ্চলে প্রথমে আধুনিকতা এনেছেন মাজহারুল ইসলাম। বাংলাদেশে বসে এ কথা বলা সহজ। কিন্তু একে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা অন্য বিষয়, অনেক কঠিন। যেকোনো সংলাপে গেলে আমরা এটি প্রমাণ করতে পারব, তবে আমাদের আরেকটু ম্যাটেরিয়াল নিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে অনেক গবেষণা করা দরকার, যা আমরা করিনি। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করবেন, এমন কিছু মানুষ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।

নজরুল ইসলাম

স্থাপত্যের যাঁরা মাজহারুল ইসলামকে চিনতেন, তাঁরা সৌভাগ্যবান। আমি তো স্থাপত্য জগতের মানুষ নই, তবু একবার তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে আমরা দুজন জাকার্তায় একটি সেমিনারে একসঙ্গে গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে চার দিন থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি এত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, এত বিনয়ী ছিলেন! আমি বয়সে তাঁর ছোট; কিন্তু তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যেন আমি তাঁর সমবয়সী। সেখানে প্রিন্স করিম আগা খান এবং বেগম আগা খান প্রতিদিন মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে নাশতার টেবিলে বসতেন। আমার দেশের একজন স্থপতি এ পর্যায়ে কী সম্মান পাচ্ছেন, দেখে আমার গর্ব হতো। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক ভবনের নকশা করেছেন; যেগুলো আদর্শ স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত।

মাজহারুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্ল্যানিং করার সুপারিশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শহীদ না হলে সেটি এত দিনে হয়ে যেত বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর এ প্রস্তাবের খসড়া ডকুমেন্ট কারও কাছে আছে কি না খুঁজে দেখা দরকার।

১৯৭৩ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে সুপারিশ করা হয়েছিল ফিজিক্যাল প্ল্যানিং ডিভিশন করার। ১৯৯১ সালে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে ২৯টি ট্রাস্কফোর্স গঠিত হয়, যার একটির আহ্বায়ক ছিলাম আমি। নগরায়ণ নিয়ে করা সে টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে আমরা সুপারিশ করেছিলাম ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যানিং কাউন্সিল করার। ১৯৯৭-৯৮ সালে আইইউসিএনের জন্য কাজ করার সময় আমি মিনিস্ট্রি অব হিউম্যান সেটেলমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট করার সুপারিশ করেছিলাম।

২০১১ সালে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ‘স্পেশাল ডাইমেনশন অব গ্রোথ’ নামের নতুন একটি ধারণা নিয়ে আসা হয়। এতে শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আলোকপাত করা হয়। নগরায়ণ যে হচ্ছে, এটি আমরা সবাই জানি। আমাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৪৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শহর হয়ে যাবে। বর্তমান সরকার বলছে, ২০৪১ সালের মধ্যেই হয়ে যাবে।

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম যখন ফিজিক্যাল প্ল্যানিং মিনিস্ট্রির কথা বলছেন, তারও আগে ১৯৬৯ থেকে বুয়েটে ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্যাল প্ল্যানিং এবং আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং পড়ানো হয়। এ ডিগ্রির নাম হচ্ছে মাস্টার্স ইন ফিজিক্যাল প্ল্যানিং। সুতরাং ধারণা কিন্তু নতুন নয়। ধারণা ষাটের দশক থেকে চলে আসছে। আমি সুপারিশ করছি, উৎসাহী ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনগুলো বা ব্যক্তি একসঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন, ঐকমত্যে আসুন। বিআইপি, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ, মাজহারুল ইসলাম ফাউন্ডেশন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে বসুক, সবার চিন্তা একত্রিত করুক। প্রয়োজনে মাজহারুল ইসলামের সময় থেকে শুরু করুন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অগ্রসর চিন্তা করেন, তাঁকে বোঝাতে পারলে বিষয়টি সহজ হবে।

নসরুল হামিদ

মাজহারুল ইসলাম স্যার ও আমাদের বাসা ছিল পাশাপাশি। তাঁকে দেখেই আমার বেড়ে ওঠা। কিন্তু বোঝার বয়স হওয়ার পর স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে অন্যভাবে চেনার-দেখার সুযোগ হয়েছে। মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যের দর্শনে গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ, বাঙালি সংস্কৃতি ও পরিবেশ। একটি স্থাপনা দিয়ে কীভাবে গণতন্ত্রের ভাষা বোঝানো যায়, তার পথিকৃৎ মাজহারুল ইসলাম।

ঔপনিবেশিক স্থাপত্য কার্জন হল একরকমভাবে তৈরি করেছে ব্রিটিশরা তাদের শক্তি বা ক্ষমতা দেখানোর জন্য। আভিজাত্য দেখানোর জন্য আর্ট ডেকো করা হয়েছিল। কিন্তু মাজহারুল ইসলাম দেখাতে চেয়েছেন আমরা বাঙালি, আমাদের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক, গাছের সঙ্গে সম্পর্ক ও সবুজের সঙ্গে সম্পর্ক।

আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ হব, বিশ্বের কাছে আমরা আরও বড় হব। কিন্তু আমাদের পরিচিতি কীভাবে করব! তার মানে কি আমরা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছি? আমরা যখনই অন্যদের সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র অনুসরণ করতে গেছি, আমাদের মধ্যে একধরনের বিপর্যয় এসেছে। আমরা এটি খেয়াল করি না। সব ক্ষেত্রে কাচের ভবন হবে, ভেতরে শীতাতপনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকবে—এটাই কি আধুনিক? ঢাকার অনেক উঁচু ভবনে দেখতে পাই পশ্চিম দিকে বড় গ্লাস, রোদ আসছে। সিঁড়ি পর্যন্ত এসি করা। এক থেকে দেড় হাজার টন এসি! আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, এটা তো একজন স্থপতিরই করা।

মাজহারুল ইসলাম বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানকে নিয়ে এসেছিলেন। সংসদ ভবনের নকশা করেছেন। লুই আই কানের প্রকল্প দেখলে খুব শক্তিশালী মনে হয়। মাজহারুল ইসলাম স্যার নম্র ছিলেন, মহৎ ছিলেন। তাঁর স্থাপত্য দেখলেও তেমন মনে হয়। আমাদের দেশ কী রকম হবে, সে বিষয়ে কিন্তু তিনি আমাদের একটা ভাবনার মধ্যে রেখেছেন। ভবনের নকশা কেমন হবে, যা আমরা ষাটের দশকে করে এসেছি, এখন তার পুনরাবৃত্তি করা দরকার।

কয়েক বছর আগে একটা বিষয় এসেছিল যে আমরা কীভাবে বিদেশে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করব। তখন আমার প্রস্তাব ছিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ ইতিহাস, আমাদের সাহসের কথা ব্র্যান্ডিং করব, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কথা বলব, সংস্কৃতির কথা বলব। এসব হবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং।

এখানে বিজ্ঞ শিক্ষকেরা আছেন, আপনাদের শিক্ষার্থীরা কিন্তু এখন বাংলাদেশ বানাচ্ছে। কিন্তু আমরা কেন তাদের মধ্যে মাজহারুল ইসলাম স্যারের প্রতিফলন দেখি না? আমার মনে হয়, এ জায়গায় চিন্তা করতে হবে। আমাদের হাতে কিছু নেই এমনটি নয়। হতাশ হলে চলবে না। মাজহারুল ইসলাম স্যাররা আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন। সেই পথ ধরে আমরা বাংলাদেশ তৈরি করতে পারি।

ডালিয়া নওশিন

আমি স্থপতি মাজহারুল ইসলামের কন্যা। বাবাকে নিয়ে আমরা যখনই আলোচনা করেছি, সবাই গবেষণা করে আনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন৷ আমি চাই বাবার চিন্তা ও কাজ আমজনতার মধ্যে নিয়ে যেতে। তার যে দর্শন তাকে আরেকটু সহজ করে দেখতে হবে৷ তা নাহলে সকল মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে না হয়ত। বাবা সবসময় বলতেন নতুন প্রজন্মসহ সকলকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার কথা। আর একটা দেশকে উন্নত করতে গেলে আমাদের বয়সী যারা আছেন বা বাবার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তাদের দরকার নতুন যারা আসছে তাদের সঙ্গে সংযোগ করা। বাবা সমসময় বলতেন, শিক্ষাটা অনেক বড় একটি বিষয়। আমি আমার দেশকে ভালোবাসব, দেশের কথা যদি আমি না জানতে পারি তাহলে দেশ কখনো উন্নত হতে পারে না। সেজন্য তিনি সবসময় সংস্কৃতিকে বিবেচনায় রেখেছেন।

বাবার আলোচনাকে মাঠপর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে যাতে আমজনতা বুঝতে পারে৷ বাবা চারুকলার বকুলতলা পছন্দ করতেন। সেরকম জায়গায় তাকে নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। শুধু ভবন নিয়ে করতে হবে এমন নয়, অন্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে। নতুন প্রজন্মকে কঠিন কঠিন ভাষা দিয়ে বোঝানো যাবে না। শিশুদের-তরুণদের নিয়ে তাদের মতো কথা বলে বাবাকে তাদের আরো কাছে নিতে পারব বলে প্রত্যাশা করছি।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আলোচকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • ‘মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্ল্যানিং’ নামে একটা মন্ত্রণালয় করতে হবে।

  • নগর পরিকল্পনায় খেলার মাঠ থাকবে। থাকবে লাইব্রেরি ও নাটকের মঞ্চ।

  • মাজহারুল ইসলামের নকশা করা সব স্থাপনাকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

  • উন্নয়ন ভাবনার মধ্যে দেশ, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি যুক্ত থাকা উচিত।

  • মাজহারুল ইসলাম ও তাঁর স্থাপত্য নিয়ে অনেক গবেষণা করা দরকার।

  • আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে মাজহারুল ইসলামের কাজকে যুক্ত করতে হবে।