সরকারি পরিষেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা ও ন্যায্যতা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশে ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘সরকারি পরিষেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা ও ন্যায্যতা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।

‘সরকারি পরিষেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা ও ন্যায্যতা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরাছবি: তানভীর আহাম্মেদ
আলোচনা

হালিদা হানুম আখতার

সদস্য, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন

মোটাদাগে যারা অবহেলিত, নিজের সিদ্ধান্ত আদায় করে নিতে পারে না, নিজের সুবিধা–অসুবিধা বোঝে না, নিজেকে রক্ষা করার সামর্থ্য নেই, সমাজের সঙ্গে সে যুদ্ধ করতে পারে না, তারাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সেই অর্থে, আমাদের ঘরে যে নারী আছেন, যিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিনা পয়সায় কাজ করছেন, তিনিও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য। দলিত, আদিবাসী কিংবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যেও সবচেয়ে প্রান্তিক হচ্ছেন নারীরা।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নানান সমস্যা মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হয়। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবাসহ অন্যান্য ভাতা পেতে অনেক ভোগান্তির কথা শোনা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে যুক্ত হতে না পারার কারণে তাদের অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়। এমনকি যে পরিমাণ ভাতা দেওয়া হয়, সেটির পরিমাণও খুবই সামান্য, যা দিয়ে বর্তমান বাজার থেকে তেমন কিছুই কিনতে পাওয়া যায় না। এই ভাতাটুকু পেতেও একজন প্রান্তিক মানুষকে যে কষ্ট করতে হয়, যতজনের কাছে অবহেলার শিকার হতে হয়, এ ব্যবস্থাকে আমাদের সরাসরি প্রশ্ন করতে হবে। হেনস্তা করার কোনো সুযোগই যেন না থাকে, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

যাঁরা নীতিনির্ধারণ, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তত্ত্বাবধায়ন, পর্যবেক্ষণ করছেন বা একেবারে কাছে গিয়ে সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের সবাইকে সচেতন করতে হবে। আমাদের ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই হবে না, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হলে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সংস্কার কমিশনগুলোর পক্ষ থেকে স্বল্প মেয়াদে করণীয় বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কিছু সুপারিশ করব। দীর্ঘ মেয়াদে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সত্যিকার অর্থে আমরা কী স্বপ্ন দেখতে চাই, সেই সুপারিশ করব।

এ কে এম তারিকুল আলম

অতিরিক্ত সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপাত্তে সমস্যা রয়েছে। যেটির আশু সমাধান প্রয়োজন। উপাত্ত সংগ্রহে আমাদের আরও মনযোগী হওয়া উচিত। ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি স্থায়ীভাবে একজন উপাত্ত সংগ্রাহক রাখা যায়, তাহলে উপাত্ত সংগ্রহ খুবই সহজ হবে। পাশাপাশি উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়বে। উপাত্ত সংগ্রাহকেরা সরকারি পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের অধীন থাকতে পারেন। তাঁর কাজ হবে ওয়ার্ডের সব উপাত্ত সংগ্রহ করা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, প্রতিটি নাগরিকের সব ধরনের তথ্য সেখানে সংরক্ষিত থাকবে। এমনকি কে কতখানি লম্বা, সে তথ্যও সেখানে থাকতে পারে। ফলে উপাত্ত ব্যবহারে পরবর্তী সময় আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কোনো ওয়ার্ড বড় হলে সেখানে একাধিক লোক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে সারা দেশে ৫০ হাজারের মতো কর্মসংস্থানও সম্ভব বলে মনে করি আমি।

আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, যাঁর যা প্রয়োজন, তা তাঁর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ জন্য কেবল সরকারি নয়, বেসরকারি পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ জনগণ, সবাই কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের সামর্থ্য কতটুকু আছে, তা দেখতে হবে। যখন আমাদের মাথাপিছু আয় কম ছিল, কিংবা সংস্থান কম ছিল, তখন কিন্তু এত জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি। এখন বিষয়গুলো বেড়ে গেছে, আমরা চতুর্দিকে যাচ্ছি। এ জন্য প্রয়োজন আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে স্থানীয় সরকারকে যুক্ত রেখে কাজ করা গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। স্থানীয় সরকার অনেক বেশি বিস্তৃত, একেবারে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত তাদের জনবল আছে। এ রকম জনবল কোথাও পাওয়া যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হয়তো কিছু সমস্যা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা আবার এসে তাঁদের সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন।

লায়লা জেসমিন বানু

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আমাদের দেশে অনেক নীতিমালা আছে। কিন্তু নীতিমালার প্রয়োগ আমরা সব ক্ষেত্রে দেখছি না। আবার কিছু কিছু বিষয়ে নীতিমালাই হয়নি। তাই অনেক কাজ করতে গেলেও নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকারি পরিষেবা সহজলভ্য করে তোলা। বর্তমানে অনেক সেবাই অনলাইন করা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকে বিভিন্ন পরিষেবার জন্য আবেদন করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। এর মধ্যে রয়েছে ঠিকমতো পড়তে না পারা, ইন্টারনেট–সুবিধার অপ্রতুলতা, সম্পদের অভাব তো রয়েছেই। যেটুকু আছে, তার বণ্টন সঠিক হলে আমরা বলতে পারি যে আমাদের কাজ হচ্ছে।

সম্প্রতি প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে আমি প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে নারীরা এখন অনেক সচেতন, তাঁরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পরিষেবা নেওয়ার জন্য লড়াই করেন। এটা কিন্তু একটা ইতিবাচক লক্ষণ যে আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু এটি সারা দেশের চিত্র নয়। সচেতনতা বাড়াতে আমাদের আরও বেশি কাজ করতে হবে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধিতে নাগরিক সমাজের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের আরও কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি বিভিন্ন পরিষেবা পাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, এ বার্তাটির মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষকে এগিয়ে নিতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রশাসনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আরও সংবেদনশীল হতে হবে।

ইলিরা দেওয়ান

মানবাধিকারকর্মী, সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

আমরা সব সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলে আসছি। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে আদিবাসী, দলিত কিংবা প্রতিবন্ধীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আমরা কাউকেই পিছিয়ে রাখতে চাই না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ সমতলের আদিবাসী। বাংলাদেশে সংখ্যার বিচারে সমতলে আদিবাসীদের জনপ্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ কম। কিন্তু বাংলাদেশকে বহুজাতি ও সংস্কৃতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করলে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে সমতলের আদিবাসীদের স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ রাখতে হবে। তাদেরকে জাতিভেদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ তৈরি করেছে। প্রথাগত ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করছে, সেগুলোকে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে পারলে কাজে সমন্বয় করা সম্ভব হবে। সমন্বয়হীনতার কারণে উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় ওভারল্যাপিং হয়। কেউ হয়তো উভয় দিক থেকে সুবিধা পাচ্ছে, আবার কেউ উভয় দিক থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এ সমস্যায় জর্জরিত। সেখানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে সরকারি পরিষেবা নিতে গেলে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। আদিবাসীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সরকারি সেবাপ্রাপ্তি সহজ করতে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

ফজলে ছিদ্দীক মো. ইয়াহিয়া

পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে ১২ রকমের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে অটিজম, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাক্প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা। আমরা এসব নিয়ে কাজ করি। সুরক্ষা আইনের পর ফাউন্ডেশন আইন হয়েছে ২০২৩ সালে।

এই আইন হওয়ার পর আমরা বিধি-প্রবিধির কাজ শুরু করেছি। আমাদের ১০৩টি কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা দিয়ে থাকি। আমাদের ৪৫টি মোবাইল ভ্যান থেরাপি আছে, যার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে বিনা মূল্যে সেবা প্রদান করবে। আমাদের সঙ্গে ৭৪টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় আছে। সরকারি অর্থায়নে আমরা এটি করছি। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের খেলার মাঠের জন্য জায়গা বরাদ্দ রয়েছে। সাভারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। ব্রেইল শিক্ষণ নির্দেশিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কাজ করতে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক সক্ষমতা আমাদের নেই। উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কোনো কার্যালয় না থাকায় আমরা প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানের কাজটি করতে পারি না। অথচ আমরা ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারিনি। আশা করছি, বিধিমালা প্রণয়নের পর আমাদের সক্ষমতা আসবে, জনবল কাঠামো হবে। তখন আমরা সব শ্রেণির প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করতে পারব।

মোশাররফ হোসেন

পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা), সমাজসেবা অধিদপ্তর

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবা প্রদানের প্রচার-প্রচারণা এখনো অনেক কম। এখনো বেশির ভাগ প্রান্তিক মানুষ জানেনই না, কী ধরনের সেবা তিনি পেতে পারেন সরকারের কাছ থেকে। এর কারণ তাঁর কাছে তথ্য পৌঁছাচ্ছে না। আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে চেষ্টা করছি, এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর। সব রকম সেবা এক ছাদের নিচে এনে কীভাবে প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায়, সে প্রচেষ্টা আমাদের রয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই আমরা ভালো কোনো ফলাফল নিয়ে আসতে পারব।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেদে, চা–শ্রমিক, প্রতিবন্ধী ও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছি আমরা। তাদের সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই আমরা এ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ সরকারি সেবা নিতে কোথায় গিয়ে আবেদন করবেন বা কীভাবে তিনি সেটি গ্রহণ করবেন, সে সম্পর্কে জানেন না। আমরা নতুন সফটওয়্যার চালু করেছি, যার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা তাঁর কাজটি কোন পর্যায়ে আছে, সেটি দেখতে পারবেন। বর্তমানে আমাদের ডেটাবেজ উন্মুক্ত করা আছে। যে কেউ এখানে যেকোনো সময় আবেদন করতে পারেন। আবেদনে কোনো সমস্যা হলে তিনি আগের মতো চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্যদের সঙ্গে কথা বললে তাঁর সমাধান করারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আমাদের সমাজসেবা অধিদপ্তর এ বছর ৩ লাখ ৩৪ হাজার অতিরিক্ত ভাতা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু প্রচারের অভাবে পর্যাপ্ত আবেদনই জমা পড়েনি। এ সমস্যা সমাধানে আমরা প্রচার-প্রচারণার বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। এই বিষয় নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।

শাহীন আনাম

নির্বাহী প্রধান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

আমরা এখন ‘পিছিয়ে পড়া’ জনগোষ্ঠীর পরিবর্তে ‘পিছিয়ে রাখা’ জনগোষ্ঠী প্রত্যয় ব্যবহার করতে চাই। কেননা, যখন আমরা বলি পিছিয়ে পড়া, তখন মনে হয়, তাদের কোনো দোষে তারা পিছিয়ে পড়েছে। এটি ঠিক নয়। কারণ, প্রান্তিকতা কতগুলো ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। আমরা যাদের প্রান্তিক মানুষ বলছি, তারা কিন্তু একই শ্রেণিভুক্ত নয়।

প্রতিটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আলাদা প্রয়োজন আছে, তাদের বঞ্চনা আলাদা, তাদের চ্যালেঞ্জ আলাদা। কোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

আমরা হয়তো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থিক সুবিধা নিয়ে অনেক কাজ করছি, কিন্তু সরকারি পরিষেবায় যদি তাদের অভিগম্যতাই না থাকে, তাহলে সেটি ফলপ্রসূ হবে না। অন্যদিকে দলিত জনগোষ্ঠী ও যৌনকর্মীদের প্রয়োজন সম্পূর্ণ আলাদা। সুতরাং প্রত্যেকের চাহিদা অনুসারে তাদের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

আমরা নাগরিক সমাজ থেকে যত কথাই বলি না কেন, নীতিনির্ধারকেরা যদি আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে পরিবর্তন আনা কঠিন। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে সবাইকেই আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে।

জিনাত আরা হক

প্রধান নির্বাহী, আমরাই পারি

সরকারি অনেক সেবা সম্পর্কে মানুষ ঠিকমতো জানে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। প্রতিবন্ধীরা তো আরও নানা রকমের সমস্যার মুখোমুখি হন। দেখা যায়, একজন প্রতিবন্ধী নারী যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তিনি আদালত পর্যন্ত যেতে না পারার কারণে তাঁর মামলা খারিজ হয়ে গেছে। আমাদের আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। এই সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে আরও কাজ করতে হবে।

আমরা আওয়াজ তুলতে পারব, কিন্তু ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। এখন আমাদের বড় একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর মনোভাব ইতিবাচক। একসময় তাঁদের অনেকেই এসব নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন।

আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের ব্যবস্থাটা পরিবর্তন হলো কি না। সেবা না পেলে অভিযোগ জানানোর জায়গা থাকতে হবে। যাঁরা সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। পুরো সেবাকে অরাজনৈতিক করতে হবে। অর্থাৎ সরকার পরিবর্তন হলেও যাঁরা সেবা দেন, তাঁরা বদলাবেন না। এ জন্য তাঁদের রাজনীতির বাইরে থাকতে হবে।

খন্দকার জহুরুল আলম

নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর সার্ভিসেস ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি

২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ অনুমোদন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) অনুসমর্থন করে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশে দুটি আইন প্রণয়ন করা হয়—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ও নিউরো ডেভলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন। আইন দুটি বাস্তবায়নে ২০১৯ সালে একটি কর্মপরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখন পর্যন্ত এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করা হয়নি। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ পর্যবেক্ষণের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি থাকলেও ২০১৭ সালের পর থেকে সেই কমিটিরও আর কোনো খোঁজ নেই।

২০১৯ সালের কর্মপরিকল্পনায় যুগান্তকারী একটি বিষয় ছিল। ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কী কী কাজ করতে পারবে। সেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ টি কার্যক্রম দে৶য়া ছিল। এটি বাস্তবায়িত হলেও ৩৫টি মন্ত্রণালয়ে অন্তত বাজেট হতো, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এসবের কিছুই হয়নি। এমনকি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত এ নিয়ে ভাবেনি।

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা

সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হলে আগের সরকারের প্রায় সব কাজই বাতিল করা হয়। এ ধরনের মন্দ রাজনৈতিক চর্চা প্রান্তিকতাকে জিইয়ে রাখে। সংখ্যা দিয়ে প্রান্তিকতা নির্ধারণ করাও বড় সমস্যা তৈরি করে। বাংলাদেশের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, নারীর সংখ্যা পুরুষের থেকে সামান্য বেশি। কিন্তু অধিকার বা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে নারী নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই মানুষ যে তার অধিকার আদায় করতে পারে, ব্যাপারটি এমন নয়। ক্ষমতাকাঠামোতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও মৌলিক অধিকারে অভিগম্যতা থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে অনেক পরিকল্পিত নগরায়ণ হলেও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি সচিবালয়ের কিছু ভবনে এখনো নারীদের জন্য আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইলপদ্ধতি চালু হয়নি। স্কুলপর্যায়ে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ চালু করার কথা, সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি।

এসব পলিসি নেওয়ার জন্য কোনো রাজনৈতিক মতামতের প্রয়োজন হয় না, মানুষ হওয়া লাগে ও স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করা লাগে। এই চিন্তা না করতে পারলে জাতি হিসেবে আমরা বারবারই পিছিয়ে যেতে থাকব।

নাসরিন জাহান

নির্বাহী প্রধান, ডিজ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। দলিত, আদিবাসীদের মধ্যেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে। তার প্রান্তিকতা তো অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় যুক্ত করার যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অব্যবস্থাপনার চিত্র ভয়াবহ। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। সবার মতো আমরাও সেই সব সুযোগ-সুবিধা পেতে পারি। আমাদের ক্ষেত্রে এত বাধা আসবে কেন? প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হলে একটা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের এগিয়ে আনতে হয়।

কোটাব্যবস্থা বাতিলের পর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটা বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল, তা–ও বাস্তবায়িত হয়নি। এটা নিয়ে তেমন কেউ ভাবছেও না।

বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, প্রতিবন্ধীদের কোনো প্রতিনিধি সেখানে নেই। তাহলে আমাদের কথাগুলো কীভাবে উনারা শুনবেন ও বাস্তবায়ন করবেন? এ কারণে প্রতিটি সংস্কার কমিশনের আলাদা করে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বসে তাদের সমস্যা শুনে সে অনুযায়ী সমাধান করার চেষ্টা করা উচিত।

এম এম মাহমুদুল্লাহ

অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা শাখা), সমাজসেবা অধিদপ্তর

২০১৩ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্প ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে রাজস্ব খাতের কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। এই নীতিমালায় যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাঁদের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পেতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। তাই এসব প্রকল্প এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছি আমরা।

সরকারি পরিষেবা বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত কৌশল অনুসরণ করেই সরকারের প্রতিনিধিদের কাজ করতে হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আমরা ডিজঅ্যাবিলিটি ডিটেকশন ইনফরমেশন সিস্টেম বা ডিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করি। আমাদের এই ব্যবস্থা সার্বক্ষণিকভাবে উন্মুক্ত। এখানে তালিকাভুক্তদের সেবার আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রতিবন্ধী শনাক্ত হওয়ার পরপরই তাঁরা সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পান। পাশাপাশি তাঁদের বিদ্যালয়গামী সন্তান থাকলে তাদের উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকার এটি সর্বজনীন করেছে। এসব সুবিধা নিয়ে আমাদের প্রচার-প্রচারণাও রয়েছে। তবে সচেতনতার কাজটি আরও বেশি করতে হবে।

মিলন দাস

নির্বাহী পরিচালক, পরিত্রাণ

দলিত জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক পরিচয় প্রয়োজন। অনেক সময় দলিত ও প্রান্তিক—দুটি ধারণাকে এক করে দেখার কারণে দলিতরা বঞ্চিত হন। দলিতসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর করতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে দলিতদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। দলিত সমাজের মানুষেরা তো ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশই করতে পারেন না। তাহলে আমাদের সমস্যাগুলো কীভাবে জানাবে? এটি আমাদের জন্য খুবই তিক্ত একটি বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে জাতীয় বাজেটের বড় একটা অংশ বরাদ্দ থাকলেও দলিতদের জন্য সুবিধা খুবই নগণ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের সন্তানেরা ভর্তি হতেই পারত না। কিছু এনজিওর ভূমিকার কারণে এখন সে অসুবিধা কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ জন্য সরকারের কাছে আমরা দলিত সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য যৌক্তিক পরিমাণে বৃত্তি দেওয়ার দাবি জানাই।

নরেশ চন্দ্র ওঁরাও

প্রেসিডেন্ট, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, নাটোর শাখা

আমরা সমতলের আদিবাসীরা জমির রেকর্ড থাকার পরও আমাদের জমি বিক্রি করতে পারি না। জমি বিক্রি করতে গেলে জেলা প্রশাসকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, যা পেতে আমাদের অনেক ঝক্কিঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ রকম অনেক জমি আছে। আমরা আদিবাসীরা এ জমি ফেরত চাই।

এ বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। পেশিশক্তির কাছে প্রশাসন জিম্মি হয়ে আছে। স্বাধীনতার অর্ধশতক পার হলেও আমরা জমিসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান পাইনি। পাশাপাশি আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি রক্ষার্থে রাষ্ট্রের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমরা যে ধরনের সরকারি পরিষেবা পাই, তা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা মনে করি, আমাদের আরও অনেক বেশি সেবা পাওয়া উচিত।

লিনিয়া শাম্মী

প্রেসিডেন্ট, জীবন গঠন উন্নয়ন সংস্থা

আমরা হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। ভোটার হতে গেলে ছেলে বা মেয়ে কাউকেই তাঁর লিঙ্গপরিচয়ের জন্য কোনো সনদ প্রদর্শন করতে হয় না। কিন্তু আমাদের কেন সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে সনদ নিতে হবে?

একটা সময় আমাদের লিঙ্গপরিচয়ের জন্য মেডিকেল পরীক্ষা করার ব্যবস্থা ছিল, যা খুবই অপমানজনক ও মানহানিকর। ২০২৫ সালেও আবার আমাদের সে পথে যেতে হচ্ছে। আমরা এটি একেবারেই চাই না।

ভোটার আইডি কার্ডের জন্য আমাদের শিক্ষা গ্রহণে সমস্যা হচ্ছে। আমাদের টেকসই কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। আমরা চাই, কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি পোশাক খাতসহ প্রতিটি খাতে হিজড়াদের নিয়ে একটা নীতিমালা করতে হবে। এটি খুবই জরুরি। নীতিমালা না থাকায় আমরা হিজড়া জনগোষ্ঠী আমাদের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে চাকরির তেমন কোনো সুযোগ পাই না।

রাবেয়া আক্তার

সদস্য, নারী মৈত্রী

আমরা গৃহকর্মীরা নানা সমস্যার মধ্যে আছি। কর্মক্ষেত্রে আমরা ঠিকমতো ছুটি পাই না। এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটিও নেই। একটা কাজের কথা বলে আমাদের দিয়ে কয়েক রকম কাজ করিয়ে নেওয়া হয়৷ সময়মতো বেতনও দেওয়া হয় না। গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাও কম নয় বর্তমানে।

টাকার অভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারে না। আমাদের চাওয়া হচ্ছে, আমরা যেন প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে বেতন পাই। আমাদের জন্য সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোয় ঠিকমতো চিকিৎসা পাই না। দালালকে টাকা দিলে কিছুটা পাই। কিন্তু এটা কেন করতে হবে?

আমরাও তো এ দেশেরই নাগরিক। গৃহকর্মী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আমরা সরকারের কাছে আইন পাস করার দাবি জানাই। আমাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন যেন হয়, এটাই আমাদের চাওয়া।

রওনক আরা হক

সদস্য, পল্লীশ্রী, দিনাজপুর

স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সেবা গ্রহণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী কর্মসূচিতে নানা রকমের ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। এই সুবিধাগুলোর অধিকাংশই অনলাইন করায় অনেক সহজ হলেও কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। আগে বয়স্ক ভাতা বা বিধবা ভাতার জন্য লিখিত আবেদনে কোনো সমস্যা হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় দ্রুতই সমাধান মিলত। কিন্তু এটি এখন কঠিন।

অনলাইন হওয়ার কারণে সেবাগ্রহীতার নিজস্ব মুঠোফোন ও নিজস্ব নম্বর থাকতে হয়। এই সেবাগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশেরই নিজস্ব মুঠোফোন নেই। ফলে ভাতার অর্থ যাচ্ছে তাঁর ছেলে, মেয়ে বা অন্য কারও কাছে। এসব ক্ষেত্রে অর্থের অপব্যবহার হওয়ার বড় একটা আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সরকারের সেবাগুলো যার পাওয়ার কথা, সে-ই পাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সরকারিভাবে পর্যবেক্ষণ থাকলে যোগ্য ব্যক্তিরাই সেবা পেতেন।

মোসফিকুর রহমান

প্রকল্প ব্যবস্থাপক, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ

বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যদের মধ্যে রয়েছে দলিত, সমতলের আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, চা–শ্রমিক, বেদে সম্প্রদায়, যৌনকর্মী, হিজড়া জনগোষ্ঠী ও গৃহকর্মে নিয়োজিত নারী। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা প্রায় চার কোটি। কিছু গোষ্ঠী প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরেই অবহেলার শিকার হয়ে আসছেন।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের চিত্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশাজনক। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক বঞ্চনারও শিকার। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা এ জনগোষ্ঠীর জন্য অপ্রতুল। জন্মনিবন্ধন গ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম। জন্মনিবন্ধন করতে আনুষঙ্গিক যেসব কাগজপত্র জমা দিতে হয়, তা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক সেবা নিশ্চিতে জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে।

সুপারিশ:

  • সমতলের আদিবাসীদের ভূমি–সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

  • বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসী–অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে হবে।

  • প্রতিবন্ধী মানুষের সরকারি চাকরির নিয়োগের কোটা পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ৫% পর্যন্ত কোটা বরাদ্দ রাখা।

  • বিদ্যালয়, আদালতসহ সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে বাংলা ইশারা ভাষার দোভাষী সেবা নিশ্চিত করা।

  • প্রান্তিক দলিতদের পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং দলিতবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদগুলোয় স্বাক্ষর নিশ্চিত করা। জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাকাঠামোয় দলিতদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

  • লিঙ্গ বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

  • ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ সংশোধন করে গৃহশ্রমিকদের স্বীকৃতি প্রদান। গৃহশ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা ও পেনশনের সুবিধা প্রদান।