গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নয়নে নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটির ভূমিকা

জার্মানভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নয়নে নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটির ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ প্রথম আলো কার্যালয়ে এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়ছবি: খালেদ সরকার

অংশগ্রহণকারীরা

শাহ গোলাম নবী

পরিচালক, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

নাজমা শাহীন

অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ

উপসচিব ও কম্পোনেন্ট ডিরেক্টর, এসএসিপি-ডিএএম, কৃষি মন্ত্রণালয়

আকরাম হোসেন চৌধুরী

প্রকল্প পরিচালক, পারিবারিক পুষ্টিবাগান প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

তানিয়া হক

অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নাসরীন সুলতানা

সিনিয়র প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট (হর্টিকালচার), সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টার

মহসীন আলী

সাধারণ সম্পাদক, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ

আনিসুজ্জামান

চেয়ারম্যান, আনন্দ

আবু জায়েদ মোহাম্মদ

সদস্য, নির্বাহী কমিটি, এফআইভিডিবি; ডিন, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সিটি বিশ্ববিদ্যালয়

পঙ্কজ কুমার

কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ), ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে

মামুনুর রশিদ

হেড অব প্রজেক্ট, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

মামুনুর রশিদ

মামুনুর রশিদ

হেড অব প্রজেক্ট, ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে

রিজিওনাল প্রোগ্রাম ফর স্কেলিং আপ দ্য মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ ফর নিউট্রিশন স্মার্ট ভিলেজেস ইন বাংলাদেশ, নেপাল অ্যান্ড ইন্ডিয়া (ফেইজ–২) প্রকল্পের অধীনে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশের তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ করেছে। এসব এলাকা হলো হাওর, চর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ ও খাদ্যনিরাপত্তাহীন পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে (SDG 2) অবদান রাখা। পদ্ধতিগত ও কার্যকর স্কেলিং আপের মাধ্যমে নির্বাচিত এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তীব্র অপুষ্টি হ্রাস করা।

প্রকল্পের আওতায় ১৮৮টি গ্রামের প্রায় ২১ হাজার ৫২৯টি পরিবারের প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার ৬৪৫ জন উপকার পেয়েছে। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রজননসক্ষম ১৯ হাজার ৮৩৩ নারীকে পুষ্টি কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করেছে। তাঁরা এ প্রকল্পের সাহায্যে পুষ্টি, খাদ্যবৈচিত্র্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ৬ মাস থেকে ৩৬ মাস বয়সী ৫ হাজার ৬০৫ শিশুর আচরণগত পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটাবে।

বৈশ্বিক পুষ্টির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশে কিছুটা অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এখনো বাংলাদেশে অপুষ্টি উচ্চমাত্রায় বিরাজমান। বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টির শিকার এবং ১২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত। ৫ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশু এখনো খর্বকায়। এটা এশিয়া অঞ্চলের গড় ২১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেশি। বাংলাদেশে এখনো ৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু কৃশকায়, যা এশিয়া অঞ্চলের গড় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেশি। ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নয়নে নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ‘নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটি’ প্রোগ্রামটি একটি মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ, যা সিস্টেমিক ইন্টারভেনশন গুলোকে যুক্ত করে বিভিন্ন স্তরে কাজ করে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধা ও অপুষ্টির অন্তর্নিহিত কারণগুলো অপসারণে সাহায্য করছে। নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটি প্রকল্পের চারটি অনুসরণীয় কৌশল হলো পারিবারিক পর্যায়ে আচরণগত পরিবর্তন, কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতার মাধ্যমে শক্তিশালীকরণ, কমিউনিটি পর্যায়ে পুষ্টিসম্পর্কিত সেবা সক্রিয় ও উন্নীতকরণ এবং খাদ্য ও পুষ্টির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য মাল্টিসেক্টরাল কমিউনিটিভিত্তিক বাস্তবায়িত মডেলের অ্যাডভোকেসি ও প্রচারকরণ।

পাঁচটি ভালো অভ্যাস অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকল্পটি স্কেলিং আপ করেছে। পুষ্টি ক্যাম্প আয়োজনে, টেকসই সমন্বিত কৃষি খামার ব্যবস্থা ও পুষ্টিবাগান গড়ে তোলা, পুষ্টিনিরাপত্তায় কৃষি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে সংযুক্ত করা (LANN+), পুষ্টি সংবেদনশীল মাইক্রো পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন এবং কমিউনিটি অন্তর্ভুক্ত স্বনির্ভর দল/ গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা।

আমাদের প্রকল্পের অর্জন হলো প্রজননক্ষম ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ন্যূনতম খাদ্যবৈচিত্র্যের হার ৬৮ শতাংশে উন্নীতকরণ। ৭৩ শতাংশ পরিবারে পুষ্টিবাগান রয়েছে, যেখানে কমপক্ষে ছয় ধরনের ফুড গ্রুপ রয়েছে। শিশুদের বাড়িতে রান্না করা সুষম খাবার খাওয়ানোর হার ৩৫ শতাংশ। সরকারি সেবায় প্রবেশাধিকার রয়েছে, এমন পরিবারের হার ৭৪ শতাংশ।

দুর্গম এলাকা ও তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত পরিবারে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক পুষ্টি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে কিশোরীদের জন্য পুষ্টিসেবা ও প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি।

শাহ গোলাম নবী

শাহ গোলাম নবী

পরিচালক, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

আমাদের লক্ষ্য দুটি। এক. আমরা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিয়ে কাজ করতে চাই। দুই. সেখানে নিউট্রিশন ম্মার্ট কমিউনিটিকে যুক্ত করে করতে চাই।

অধিকাংশ সময় আমরা খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কথা বলি। পেট ভরে খেতে পারলাম কি না, আমাদের রসনা তৃপ্ত হলো কি না, সেটা নিয়েই বেশি কথা বলি। কিন্তু এখন আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার এক ধাপ ওপরে গিয়ে পুষ্টিনিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। অনেক সময় আমরা পুষ্টিগুণের কথা বিবেচনা করি না। সুষম পুষ্টিমান ছাড়া বেশি খাবার খেলেই সেটা আমাদের খুব বেশি কাজে আসবে না। এ জন্য খাবারে পুষ্টিমান আছে কি না, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

খাবারের স্বাদ কতটুকু, আমরা সেটা আগে চিন্তা করি। কিন্তু আমাদের খাবারের স্বাদ থেকে পুষ্টিগুণের কথা বেশি বিবেচনা করতে হবে। পুষ্টকর খাবার যদি কম স্বাদেরও হয় এবং সেটা যদি আমাদের স্বাস্থে্যর জন্য উপকারী হয়, তাহলে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য আপেল, আঙুরের বদলে পেয়ারা, টমেটোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, পেয়ারা ও টমেটোর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি আছে।

বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৭৪ সালে জনস্বাস্থ্য পুষ্টিপ্রতিষ্ঠান করেছেন। তিনি তখনই এ দেশের মানুষের পুষ্টির কথা ভেবেছেন। একই বছর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নিউট্রিশন কাউন্সিল গঠন করেন। দেশের মানুষকে পুষ্টির ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। মানুষ যদি খাদ্য গ্রহণে স্মার্ট হয়, তাহলে পুষ্টি গ্রহণেও স্মার্ট হবে। পুষ্টিসচেতন স্মার্ট কমিউনিটি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে।

আপনাদের এ কর্মসূচি ভালো। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে কোনো কর্মসূচি নিতে হলে তার অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে আপনাদের কর্মসূচি কতটুকু টেকসই হবে, সেটা ভাবতে হবে। তবে আপনাদের এ বিষয়টা নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। সরকার থেকে যেই কর্মসূচি নেওয়া হোক না কেন, সেটা টেকসই হতে হবে। আমাদের ১৭টি মন্ত্রণালয় নিউট্রিশন নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশ নিউট্রিশন কাউন্সিল এটা সমন্বয় করে। প্রতিবছর বিশাল পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয়। এটা হয় শুধু পরিবেশনের ত্রুটির জন্য। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে খাদ্য পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

দেশের কোনো প্রান্তিক মানুষ হোক বা অভিজাত মানুষ হোক আমরা শিশুদের চকলেট দিতে পছন্দ করি। কিন্তু এতে কী পুষ্টিগুণ আছে, সেটা কখনো চিন্তা করি না। প্রতিবছর ১৫ মিলিয়ন ডলারের চকলেট আমদানি করতে হয়। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে চকলেট আমদানি কমে যেতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তখন এ অর্থ আমরা পুষ্টির জন্য ব্যয় করতে পারব। আমাকে আজকের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে ও প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

নাজমা শাহীন

নাজমা শাহীন

অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দীর্ঘদিন পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞানে গবেষণা এবং পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা অর্জনে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি বিষয়ে উল্লেখ করতে চাই।

বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টির উন্নয়নের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৮১-৮২ সালের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের খর্বাকৃতির হার ৫০ শতাংশের বেশি ছিল। এখন ২৮ শতাংশ শিশু কম ওজনের। ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নয়নে প্রকল্প পরিচালনা করেছে এবং তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছে। আমি দুটি প্রকল্পের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছি ।

প্রথমত, কেয়ার বাংলাদেশ পরিচালিত সৌহার্দ্য প্রকল্প, যার প্রথম প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। দ্বিতীয় প্রকল্পটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচার এবং হেলথ বেজড ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম। যে প্রকল্পগুলোয় বহু খাতভিত্তিক ইন্টারভেনশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর আর্থিক এবং পুষ্টি অবস্থার উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কৃষি, মৎস্য ও পশুপালনের সঙ্গে পুষ্টিশিক্ষা, পুষ্টিকর রন্ধন প্রক্রিয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সেবামূলক কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার পর তার প্রভাব কতটুকু স্থায়ী হলো, তা দেখার চেষ্টা হয়নি এবং নতুন প্রকল্প গ্রহণের সময়ে পূর্ববর্তী প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয় না।

আমরা ২০১৭-১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখেছি যে বাংলাদেশে অভুক্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে এসেছে। যেসব জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩০ কেজি চাল ও বিভিন্ন সহায়ক কর্মসূচি চলমান আছে। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় আমাদের জনগোষ্ঠীর যে ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে এবং এর কত শতাংশ অপুষ্টিজনিত ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা নিরূপণ করা হয়। ১২টি অণুপুষ্টির পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বয়স, লিঙ্গ, অঞ্চলভেদে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো ৭টি অণুপুষ্টির ঘাটতিজনিত ঝুঁকির আশঙ্কা আছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে এবং তা অর্জনে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য খেতে হবে। আমাদের গবেষণায় আরও দেখেছি ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য কেনার সামর্থ্য নেই। দেশীয় খাদ্যের পুষ্টিমান ব্যবহার করে কম মূল্যে অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণের জন্য একটি পদ্ধতি নির্ণয় করেছি। এ পদ্ধতিতে অনুপুষ্টির ঘাটতি পূরণ হওয়া সম্ভব। এ ছাড়া সরকার ইউএন ফুড সামিট এবং এন ফর জির অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। পুষ্টিসম্পর্কিত নীতিগুলো হালনাগাদ করা হচ্ছে এবং কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করা হচ্ছে।

সর্বোপরি, অপুষ্টি ও অতিপুষ্টিসহ অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে ‘ফুড ইকুইটি’ আনয়ন করা অতি জরুরি।

মোহাম্মদ রাজু আহমেদ

মোহাম্মদ রাজু আহমেদ

উপসচিব ও কম্পোনেন্ট ডিরেক্টর, এসএসিপি-ডিএএম, কৃষি মন্ত্রণালয়

এ প্রকল্পে বিনিয়োগ কম। শুধু মানুষকে ভালোভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। পুষ্টি ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীরাই চাল-ডাল, মাছ, শাকসবজি, ডিম, দুধ নিয়ে আসছে। তারা নিজেরাই পুষ্টির বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে এটি আরও স্কিলআপ করতে হবে। তাহলে আরও বেশি মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে।

পুষ্টিবাগানের ধারণাটা খুবই ভালো। এটাকে আরও কীভাবে বিস্তৃত করা যায়, সেটা ভাবা প্রয়োজন। একবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় খাবার প্রতিযোগিতার মেলা দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এখন ৩০টি উপজেলায় ফুড ডেমোনস্ট্রেশন হচ্ছে। আমাদের একটা নিউট্রিমিক্স আছে, যেটা এত সুন্দর যে একেবারে হরলিকসের মতো। চাল, ডাল, গুড়, বাদাম দিয়ে তারা এটা তেরি করেছে। শিশুরা বড়রা সবাই এটা পছন্দ করছে।

আমাদের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে খুব ভালো কাজ করছেন। পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের নিয়ে আমরা শুরু করেছি। আমি চর, পাহাড় ও হাওরে কাজ করেছি। এর অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, এখন কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। পুষ্টির বিষয়ে তাদের খুব বেশি সচেতনতা নেই। অনেক কিশোরী সকালে নাশতা না করে স্কুলে আসে। ভবিষ্যতে এরাই মা হবে। তাই এদের পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের সচেতনতার কাজটা খুব ভালোভাবে করা যেতে পারে।

সন্তান হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন মায়েদের খাবারের ব্যাপারে অনেক এলাকায় কুসংস্কার আছে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা দরকার।

আমাদের উপজেলা ও জেলা নিউট্রিশন কো-অর্ডিনেটর কমিটি আছে। এখন ইউনিয়ন পর্যায়েও কমিটি হবে। তবে এসব কমিটি খুব বেশি কাজ করে না। মাঝেমধ্যে এনজিওদের মাধ্যমে তারা সচেতন হয়। এ কমিটিগুলো কার্যকর করা খুবই দরকার। কমিটি কার্যকর হলে কমিউনিটির মানুষ অনেক বেশি পুষ্টিসচেতন হবে।

আকরাম হোসেন চৌধুরী

আকরাম হোসেন চৌধুরী

প্রকল্প পরিচালক, পারিবারিক পুষ্টিবাগান প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সারা দেশের ইউনিয়নে ১০০টি করে পারিবারিক পুষ্টিবাগান তৈরির কাজ করছি। নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটি প্রকল্পের সঙ্গে আমাদের কাজের অনেক মিল রয়েছে। আমরা এই কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে গ্রামের প্রায় অধিকাংশ পরিবারে তাদের ঘরের পাশে কিছু ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে যদি তারা শাকসবজির চাষ করে, হাঁস-মুরগি পালন করে, তাহলে এখান থেকে যথেষ্ট পুষ্টির জোগান আসতে পারে।

এসব বিষয় ইউনিয়নের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমরা উঠান বৈঠক করি। এ বৈঠকের মাধ্যমে শাকসবজি, হাঁস-মুরগি পালনে উৎসাহ ও পরামর্শ দিই। আমরা পুষ্টি থালার মাধ্যমে দেখাই যে একটা থালাতে কী খাবার থাকলে সেটা পুষ্টিমান সম্পন্ন হবে। আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি কৃষকেরা পুষ্টিবাগান করেছেন। তাঁরা সে বাগানের শাকসবজি বিক্রি করে অন্য পুষ্টিকর খাবার যেমন ডিম, মাছ, দুধ কিনছেন। বন্যাসহ অনেক দুর্যোগের সময় পারিবারিক পুষ্টিবাগান তাঁদের পুষ্টির জোগান দিতে পারে। গৃহহীন প্রকল্পে অনেক দরিদ্র পরিবার ঘর পেয়েছে। তাদের ঘরের চারপাশ একেবারে ফাঁকা ছিল। সেখানে আমরা পুষ্টিবাগান করেছি। তারা নিজেরাও সবজি বাগান করছে। সবজি তারা বিক্রিও করছে। এসব পুষ্টিবাগান একদিকে তাদের পুষ্টির জোগান দিতে পারে, আবার আয়েরও উৎস হতে পারে।

এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিকাজ হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ভাত বেশি খায়। ফলে তারা কার্বোহাইড্রেট বেশি গ্রহণ করছে। এ জন্য শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলসের অভাব থেকে যায়। এ জন্য আমাদের শিশুরা অপুষ্টি নিয়ে বড় হচ্ছে। ফলে তারা অসুস্থতার ঝুঁকিতে পড়ছে।

গর্ভবতী ও শিশুদের জন্য পুষ্টি অত্যন্ত জরুরি। প্রথম এক হাজার দিনে শিশুর ব্রেনের প্রায় ৯৫ শতাংশ গঠিত হয়। সে সময় তার জন্য পুষ্টিকর খাবার অত্যন্ত জরুরি। পুষ্টির উন্নয়ন একক কোনো সংস্থার কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

তানিয়া হক

তানিয়া হক

অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আজকে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই মানুষগুলো পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন কি না, সেটা আগে দেখতে হবে। পুষ্টির সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত।

পুষ্টি শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষের পুষ্টির বিষয়টি বেশি ভাবতে হবে। কারণ, পুুষ্টির অভাবে এরা দ্রুত শারীরিক দুর্বলতায় আক্রান্ত হতে পারে।

সঠিক পুষ্টির অভাবে দেশের অনেক মানুষ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় ভুগছে। তারা যেন খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করে, সরকারের সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থার এগিয়ে আসা জরুরি।

সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি যে স্বাস্থ্যই সম্পদ। সঠিক পুষ্টির অভাবে অনেকে অসুস্থায় ভুগতে থাকে। তখন তাদের ওপর একটা অর্থনৈতিক চাপ আসে।

আমরা অনেক স্মার্ট প্রোগ্রাম করছি। কিন্তু এই প্রোগ্রাম যাদের জন্য করছি তারা কতখানি স্মার্ট সেটাও ভাবতে হবে। যেন এ প্রোগ্রাম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়।

রান্নাঘর খোলা জায়গায় রাখতে হবে। যেন সবাই রান্নার কাজে কমবেশি অংশগ্রহণ করে এবং রান্না ও খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হয়।

আমাদের শিক্ষা পর্যায়ে কাজ করতে হবে। পুষ্টি ও সুষম খাদ্যসম্পর্কিত শিক্ষা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে লেখা আছে৷ কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি স্কুলে রান্না শেখানোর কারণে অভিভাবকেরা এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। মা হিসেবে ঘরে আমরা অনেককে রান্না শেখাই, আবার শেখানো হয় না। অনেক সময় কেবল কন্যাশিশুকেই রান্না শেখানো হয়। আমরা রান্নার পুরো কাজটিই নারীর জন্য বরাদ্দ করেছি৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রান্নার শিক্ষা দেওয়া হলে লিঙ্গনির্বিশেষে সবাই এটি শেখে। বেঁচে থাকার জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, রান্না তার একটি। রান্না একটি শিল্প, দক্ষতা। জীবনমান উন্নয়নে রান্না শেখার বিষয়ে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া প্রয়োজন।

নাসরীন সুলতানা

নাসরীন সুলতানা

সিনিয়র প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট (হর্টিকালচার), সার্ক অ্যাগ্রিকালচার সেন্টার

নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটির মাধ্যমে কীভাবে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করতে পারি, সেটাই আজকের আলোচনা বিষয়। এ প্রকল্পে গ্রামের দরিদ্র মানুষের পুষ্টির জন্য যে পুষ্টিবাগানের কথা বলা হয়েছে, সেটা আমার পরামর্শে। এটা আমার জন্য খুব আনন্দের। কারণ, পুষ্টিবাগানের মাধ্যমের গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা পুষ্টির চাহিদা অনেকটা পূরণ করতে পারে। সারা দেশে কীভাবে পুষ্টিবাগানের ধারণা সম্প্রসারণ করা যায়, নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সেটা ভাবা প্রয়োজন।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশের পুষ্টির অবস্থা প্রায় একই। এসব দেশের নারী ও শিশুরা বেশি অপুষ্টিতে ভোগে। শুধু পেট ভরে খেলেই হবে না, এই খাওয়া কতটুকু উপকারী, সেটাও ভাবতে হবে। আমরা যখন গ্রামের নারীদের নিয়ে এই প্রকল্পে কাজ করি, তখন দেখেছি যে গ্রামের নারীদের মধ্যে অনেক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ প্রকল্পের চারটি বিষয়ের একটি হলো আচরণের পরিবর্তন। এটা অনেক বড় একটি বিষয়। ছোটবেলা থেকে আমাদের যে অভ্যাস তৈরি হয়, সেটা কিন্তু সহজে পরিবর্তন হয় না। আমরা প্রায় তিন বেলা ভাত খাই। অনেক সময় ভাতের পরিবর্তে অন্য কিছু খাওয়ার কথা বলা হলে সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। আমাদের ভাত ছাড়া অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এই পুুষ্টিকর খাবারগুলো মানু্ষ উৎপাদন করতে পারলে এর মাধ্যমে তারা পুষ্টির চহিদা পূরণ করতে পারে। পুষ্টির সঙ্গে কমিউনিটিকে যুক্ত করতে হবে। এটা অনেক বড় একটা বিষয়। কোনো একটি বিশেষ বিষয়ের সঙ্গে কোনো একটা জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করলে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। আগামী ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এরপর এ দায়িত্ব কারা নেবে, সেটা অনেক বড় প্রশ্ন। সরকার যদি এ প্রকল্পের কাজ অনুসরণ করে, তাহলে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী পুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

আমি মনে করি, এই প্রকল্পের আরও বিস্তার হওয়া জরুরি। প্রথম আলোর মতো গণমাধ্যম আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করি।

মহসীন আলী

মহসীন আলী

সাধারণ সম্পাদক, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ

আমরা খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ মাঠপর্যায়ে কাজ করি। এখন খাদ্যপণ্যের অনেক দাম। দরিদ্র মানুষের চাল, আটা কিনতেই কষ্ট হচ্ছে। সেখানে পুষ্টির বিষয়টি তারা কীভাবে ভাববে!

 জাতিসংঘের ম্যান্ডেট হলো মানুষভেদে খাদ্যতালিকায় কমপক্ষে মাছ, মাংস ও দুধ থাকতে হবে। এখন বাস্তবতা হলো দরিদ্র মানুষ তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পায় না। আমরা পর্যালোচনা করে পুষ্টির বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও পুষ্টি পরিষদে বিভিন্ন দাবি ধরে তুলেছি।

আমরা মনে করি, ধনী ও দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করতে হবে না। শুধু দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রয়োজন। আমরা বলেছিলাম যে দুর্নীতি বন্ধ হলে দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব। শেষ কথা হলো, খাদ্য অধিকার আইন এখনো হয়নি। স্বাস্থ্যের জায়গা থেকে এ আইনকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে খাদ্য অধিকার আইনের দায়িত্ব হলো শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। আবার স্থানীয় পর্যায়ে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত বাজেট নেই। এনজিওগুলো যখন কোনো উদ্যোগ নেয়, তখন কিছু কাজ হয়।

আগে দরিদ্র মানুষেরা বাড়ির পাশে শাকসবজির চাষ করত। ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন করত। এখন দরিদ্র মানুষ ডিমও খেতে পারে না। ফার্মের মুরগির খামার করা এত স্পর্শকাতর যে দরিদ্র মানুষ ও অল্প মূলধনের মানুষ এটা করতে পারে না।

তবে দরিদ্র মানুষেরা যদি বাড়ির পাশে শাকসবজি ও ছাগল পালন ও হাঁস–মুরগির চাষ করে, তাহলে এসব তাদের জন্য একটা পুষ্টির উৎস হতে পারে। তাহলে তাদের আর অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগতে হবে না।

খাদ্য অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আবু জায়েদ মোহাম্মদ

আবু জায়েদ মোহাম্মদ

সদস্য, নির্বাহী কমিটি, এফআইভিডিবি

ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের এ প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রান্তিক অঞ্চল যেমন চর, হাওর ও পার্বত্য এলাকায় এ কাজ হয়েছে। হাওরে যে কাজ হয়েছিল, আমরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।

আমরা মায়েদের মধে্য কিছু অভ্যাস ও আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ করেছি। তাঁরা আগের থেকে বেশি সচেতন হয়েছেন। পুষ্টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। বিভিন্ন সংকটে পুষ্টিবাগান যে পরিবারের একটা আয়ের উৎস হতে পারে, সেটা বোঝা গেছে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ পর্যায়ও সরকারের বিভিন্ন কমিটি রয়েছে। এ প্রকল্পের কাজের মধ্য দিয়ে কমিটির মধে্য সচেতনতা এসেছে। এ কাজ আরও বিস্তৃত করতে হবে, যেন আরও মানুষ এর উপকারভোগী হতে পারে। সরকারের কাছে এ প্রকল্প নিয়ে যেতে হবে যেন তারা এটা মূলধারায় নিয়ে আসে। কোনো প্রকল্প সরকারের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত না হলে দেশের মানুষ এর সুফল পায় না। সরকার এ প্রকল্প গ্রহণ করলে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী পুষ্টি গ্রহণের সুযোগ পাবে।

খাদ্য অধিকার আইন হলে পুষ্টির বিষয়টি আরও বেশি নিশ্চিত হতো। আমাদের দেশের বয়স ৫০ বছরের বেশি। খাদ্য অধিকার একটি মৌলিক আইন। এখন আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার যুক্ত হওয়া উচিত। এ আইন একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা। এটা চর্চা করতে করতে এমন একটা অবস্থায় আসবে, তখন খাদ্য অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারব।

এখন বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টির ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। খাদ্যপুষ্টির নীতি প্রণয়নে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এটা সব সময় লক্ষ রাখতে হবে যে কোথায় কাদের পুষ্টির অভাব হচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান

চেয়ারম্যান, আনন্দ

আমরা এ প্রকল্পের অধীনে পাহাড়ি এলাকায় কাজ করি। এখানকার ৪৫টি গ্রামে ১০ হাজার ১৫৯টি পরিবার আছে। এসব পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পুষ্টির বিষয়ে সচেতন হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ থেকে ৪৯ বছরের নারী আছেন ৯ হাজার ১৫৪ জন। শিশু ২ হাজার ৯৯১ জন।

এখন দীঘিনালা, ফটিকছড়ি ও চন্দনাইশ উপজেলার ৩০টি গ্রামে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

আমরা ক্ষুধা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ওপর জোর দিচ্ছি। সঠিক জীবনযাপনও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পেট ভরে খাওয়া নয়, খাবারে বৈচিত্র্য আছে কি না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেক সময় এক-দুইটা খাবার খেয়েই পেট ভরে ফেলি। এখন জানতে পারছি যে এক–দুইটা খাবার খেলে হবে না। বিভিন্ন প্রকার খাবার খেতে হবে। শিশুর প্রথম ১ হাজার দিনের পরিচর্যার বিষয়ে এলাকাবাসীকে সচেতন করছি। এ ছাড়া কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, ওয়াশ, জীবিকা, শিক্ষা সব বিষয়ে তাদের সচেতন করছি।

একই ধরনের খাবার খেলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে না। ধীরে ধীরে শরীর দুর্বল হবে। এ জন্য খাবারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমাদের কর্ম এলাকার মানুষদের কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, ওয়াশ, জীবিকা ও শিক্ষার সঙ্গে পুষ্টির যোগসূত্র বোঝানোর কাজ করেছি। আমরা সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের কথা বলছি। কারণ, টয়লেট থেকে জীবাণু ছাড়ায়। এ জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের গুরুত্ব সবাইকে বোঝাতে হবে। গ্রামের দরিদ্র মানুষদের আমরা পুষ্টিনিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন করছি। যাদের পুষ্টির অভাব আছে, তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সবাই যেন তাদের প্রয়োজনের বেশি শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। তাহলে তারা উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করে পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারবে। এভাবে তাদের পুষ্টির অভাব পূরণ হবে।

পঙ্কজ কুমার

পঙ্কজ কুমার

কান্ট্রি ডিরেক্টর (বাংলাদেশ), ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে

আমি সবাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আমরা দেখেছি, ক্ষুধা নিবারণে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে। বিশেষ করে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ভালো করেছে। এ জন্য বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করা যেতে পারে। আলোচনায় এসেছে, আগে অনেক বেশি খর্বকায় শিশু জন্ম নিত, এখন সেটা অনেক কমে এসেছে। আফ্রিকাসহ অনেক দেশে দেখেছি, খর্বকায় শিশুর সংখ্যা কমানো কত কঠিন।

বহুমুখী উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক ভালো করেছে। এর মধ্যে আছে খাদ্যনিরাপত্তা, জেন্ডারবৈষম্য হ্রাস, বিভিন্ন খাতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন, ইকোলজিক্যাল সেফ ফার্মিং, সরকারের সঙ্গে সমন্বয় ইত্যাদি। আমার ইচ্ছে ছিল, এ ধরনের একটি উদ্যোগের আয়োজন করা। কারণ, আপনাদের সবার কথা শুনতে চেয়েছি। আমরা বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতে এ প্রোগ্রামের বিস্তার করতে চাই। এ অঞ্চলে নিউট্রিশন স্মার্ট ভিলেজ তৈরি করতে আমাদের নানামুখী উদ্যোগ আছে। আমরা জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা-২–এর আলোকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে মাল্টিসেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন শক্তিশালী করে পুষ্টিসহায়তা জোরদার করতে চাই।

জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ এবং জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা–২–এর সঙ্গে সমন্বয়ের কাজ করছি। কমিউনিটির অংশীদারত্বকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করে সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, প্রাইভেট সেক্টর ও অন্য সেক্টরগুলোকে এক হয়ে কাজ করা প্রয়োজন। তাহলে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাবে।

আমরা যেন আমাদের অন্য প্রকল্পে আপনাদের ধারণা কাজে লাগাতে পারি। জার্মান উন্নয়ন সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে এসব বিষয় নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ভবিষ্যেতে কাজ করবে।

সুপারিশ

  • তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত পরিবার এবং হার্ড টু রিচ এলাকাগুলোয় কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক পুষ্টি কার্যক্রম জোরদার করা দরকার।

  • কিশোরীদের জন্য পুষ্টিসেবা ও প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি ।

  • জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা-২ (NPAN-2) –এর আলোকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে মাল্টিসেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে পুষ্টিসহায়তা জোরদার করা।

  • জাতীয় কৃষিনীতি-২০১৮ ও জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা-২–এর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা।

  • কমিউনিটির অংশীদারত্বকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করে সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, প্রাইভেট সেক্টর ও অন্য সেক্টরগুলোকে এক হয়ে কাজ করা, যার ফলে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়।