টেকসই উন্নয়নে চাই পরিবেশবান্ধব সেবা

‘এসডিজি ১২: অনলাইনে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে ইউএনডিপি, ইউএন এনভায়রনমেন্ট ও প্রথম আলো।

বজলুল হক খন্দকার, নাজনীন আহমেদ, এম এ রাজ্জাক, মাহফুজুল ইসলাম

দেশে অনলাইন সেবাভিত্তিক বাজার বড় হচ্ছে। এর সঙ্গে বড় হচ্ছে ভোক্তাশ্রেণি। অনলাইনভিত্তিক সেবার ক্ষেত্রে ফরমাশ অনুযায়ী গন্তব্যে খাবার পৌঁছে দেওয়া (ফুড ডেলিভারি) বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এতে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রচুর। বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে হলে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও পরিবেশসচেতন ভোক্তা তৈরিতে নজর দিতে হবে। এর জন্য সব পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন।

গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘এসডিজি ১২: অনলাইনে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ অভিমত দেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ইউএন এনভায়রনমেন্ট ও প্রথম আলো ওই বৈঠকের আয়োজন করে।

জাতিসংঘের এসডিজির ১২ নম্বর অভীষ্ট হচ্ছে—‘পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন ধরন নিশ্চিত করা’। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় এ অভীষ্টকে মাথায় রেখে ফুড ডেলিভারিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

প্রবন্ধে বলা হয়, অনলাইন সেবার কারণে সবকিছু ইতিবাচক মনে হচ্ছে। বেশি উৎপাদন হচ্ছে, ভোক্তা বাড়ছে, সহজেই পেমেন্ট হচ্ছে। জীবন অনেক সহজ করে দিচ্ছে এসব সেবা। কিন্তু এর সঙ্গে পরিবেশগত প্রভাব কী, সেটা ভাবতে হবে। এখানে একটা সম্ভাব্য ‘পুশ ডিমান্ড’ দেখা যাচ্ছে। হয়তো কোনো একটা সেবা বা পণ্যের প্রয়োজন নেই, কিন্তু অনলাইনে দেখে মনে হচ্ছে কেনা যায়। এটা সব সময় ইতিবাচক নয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা ভাবতে হবে। কারণ, ধীরে ধীরে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। মানুষ যা যা ভোগ করছে বা কিনছে, তার আসলেই প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা ভাবা প্রয়োজন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেন, দেশের অনলাইনভিত্তিক সেবার বাজার এখনো ততটা বড় নয়, কিন্তু এ বাজার বাড়বে। তখন পরিবেশগত বিষয়ে সমস্যাও বাড়বে। এখনই যদি এ বিষয়ে নীতি প্রণয়ন না করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মোড়কজাতকরণ, সরবরাহ পদ্ধতি কী হতে পারে, সেসব নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেক, কিন্তু সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান হচ্ছে না উল্লেখ করে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) চেয়ারপারসন এম এ রাজ্জাক বলেন, কর্মসংস্থান যখন যথেষ্ট তৈরি করা যায় না, তখন সেবাভিত্তিক খাতের কথা ভাবা হয়। অনলাইন সেবা যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের অবদান এখন ভালো করে চিন্তা করতে হবে। এই খাত বড় হচ্ছে।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) উপমহাব্যবস্থাপক মাহফুজুল ইসলাম বলেন, অপচয় কমিয়ে সুষম বণ্টন কীভাবে করা যায়, তা মাথায় রাখতে হবে। ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, খাবার ফরমাশের ক্ষেত্রে ভোক্তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার নিচ্ছেন কি না, এমন কোনো অপশন বা বিকল্প রাখা যায় কি না, যাতে পরিমিতিবোধের বিষয় ভোক্তার মাথায় থাকে—এমনটা ভাবা যেতে পারে।

উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে একটু মনোযোগী হলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তা কমে আসবে বলে মনে করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা ফকরুল আহসান। তিনি বলেন, কাগজবিহীন ব্যবস্থা যদি গড়ে ওঠে, তাহলে দেশের জন্যই ভালো হবে।

ফুড ডেলিভারির ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন ফুডপান্ডা বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বারীন রেজা। তিনি বলেন, খাবারের ক্ষেত্রে মোড়কজাতকরণ বেশি কঠিন। তবে ফুডপান্ডা এটা নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া খাবার যাতে অপচয় না হয়, সে জন্য রেস্তোরাঁর সঙ্গে মিলে কাজ করা হচ্ছে হলে বলেও জানান তিনি।

অনলাইন সেবা ও ব্যবসা পরিবেশবান্ধব করতে লজিস্টিক সেবা যাঁরা দেন, তাঁরা ভাগাভাগি করে গুদাম, গাড়ির ব্যবহার করতে পারেন বলে মত দেন ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব ঘোষ।

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি নাছিমা আক্তার মোড়কজাতকরণ থেকে শুরু করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে কীভাবে ব্যবসা করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

মাম্মিস পিকল থেকে কেনা আচারের বোতল কেউ ফেরত দিলে তাঁকে ১২ টাকা ছাড় দেওয়া হয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও

শৈলীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা খান। তিনি বলেন, এতে তাদের ৬০ শতাংশ বোতল ফেরত আসে। এতে কিছুটা লোকসান হলেও কিছু স্থায়ী ক্রেতা তৈরি হয়।

হার ই-ট্রেডের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ারেসা খানম জানান, তাঁদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। যেখানে পরিবেশকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এসডিজি মাথায় রেখে জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান হিসেবে সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে জানান বিকাশ লিমিটেডের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাহফুজ সাদিক।

নগদ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, পরিবেশবান্ধব বিষয় নিয়ে যারা কাজ করবে, নগদ তাদের সুবিধা দেবে।

গোলটেবিল আয়োজনে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এবং সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।