কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব
সুইডেন সিডার সহযোগিতায় আরএইচ স্টেপ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ঢাকার প্রথম আলোর কার্যালয়ে।
নাছির আহমদ
পরিচালক (এমসিএইচ—সার্ভিসেস), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
বাংলাদেশে জলবায়ুর প্রভাব এখন জীবনের সব ক্ষেত্রেই গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প—এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়লে মানুষের অর্থসম্পদ তখন কোনো কাজে আসে না; খাবার, আশ্রয় ও স্যানিটেশনই সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়ায়। এই বাস্তবতা কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্যের ওপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে। গত কয়েক বছরে আমরা বুঝেছি, মা ও শিশুস্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সেবাও অনেক সময় ঠিকভাবে দেওয়া যায়নি। সেই প্রেক্ষাপটে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য সেবা আরও পরে গুরুত্ব পেয়েছে। সরকারিভাবে বিষয়টি এসেছে দেরিতে, অনেকটা উন্নয়ন সহযোগীদের তাগিদে। কিন্তু পরিকল্পনার ওপরের স্তরে যদি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকে, তাহলে মাঠপর্যায়ে আমাদের সক্ষমতাও সীমিতই থেকে যায়। সীমিত সম্পদ নিয়ে সারা বাংলাদেশে একসঙ্গে কাজ করা বাস্তবসম্মত নয়। জলবায়ু ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। দুর্যোগের আগে, সময়ে ও পরে কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্যসেবা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সেটার প্রস্তুতি দরকার।
আমাদের অনেক পরিবার কল্যাণকেন্দ্র পুরোনো অবকাঠামোয় তৈরি। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সেগুলো উঁচু ও নিরাপদ করে তুললে সাইক্লোন শেল্টারের পাশাপাশি ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
ইকবাল কবির
পরিচালক—সিসিএইচপিইউ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
স্বাস্থ্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ইউনিট গঠনের এক দশক পেরিয়েছে, কিন্তু এখনো এটি রাজস্ব কাঠামোয় আসেনি। অংশীদারদের সহায়তায় আমরা গবেষণা, নীতিপত্র ও কিছু মডেল তৈরি করতে পেরেছি। সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ স্ট্র্যাটেজির মধ্যবর্তী আপডেটে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্য যুক্ত হয়েছে—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি এখনো কিশোর-কিশোরীদের ভাষায় ও বাস্তবতায় পৌঁছায়নি। ট্যাবু কিছুটা ভাঙলেও সেবার ঘাটতি রয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনকে আমরা প্রায়ই শুধু দুর্যোগের সঙ্গে দেখি। অথচ এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শুধু উপকূল বা নদীভাঙন এলাকা নয়, ঢাকা শহরের বিপুলসংখ্যক কিশোর-কিশোরীও ঝুঁকিতে আছে। কার্বন ডাই–অক্সাইড বৃদ্ধি, তাপমাত্রা, চরম আবহাওয়া—সবকিছুর প্রভাব সরাসরি তাদের শারীরিক ও মানসিক, এমনকি প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর পড়ে। এই বার্তা তাদের ভাষায় পৌঁছানো জরুরি।
গত ১০ বছরে তৈরি সফল মডেলগুলো—ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট পরিবার ও স্কুল—স্কেলআপ করার সময় এসেছে। পরিবার ও স্কুলকে জলবায়ু সহনশীল করা গেলে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এর আওতায় আসবে।
মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার
লাইন ডিরেক্টর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৈশোর ও প্রজননস্বাস্থ্যে নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। স্যালাইনিটির প্রভাবে বিশেষ করে প্রজননস্বাস্থ্যে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়, যা কিশোরী ও নারীদের ক্ষেত্রে আরও গুরুতর।
বাংলাদেশের বাস্তবতা সামনে রাখলে চিত্রটি আরও স্পষ্ট হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দারিদ্র্য বাড়ছে। জলবায়ুজনিত বাস্তুচ্যুতি, জীবিকা হারানো ও স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক আছে। এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যগুলো কোনো না কোনোভাবে পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। আমি বারবার বলি—জীবন বাঁচাতে, জীবন সাজাতে ও জীবন রাঙাতে পরিবার পরিকল্পনা সবচেয়ে কার্যকর বিনিয়োগ। পরিবার পরিকল্পনায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে দেশ ১৪ ডলার ফেরত পায়, মাতৃমৃত্যু ৩০ শতাংশ, নবজাতক মৃত্যু ২০ শতাংশ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ৬৬ শতাংশ এবং অনিরাপদ গর্ভপাত ৪৫ শতাংশ কমে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবার পরিকল্পনা নিরাপদ না হলে জনঘনত্ব, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক চাপ আরও বাড়বে। তাই জরুরি প্রস্তুতি, দেশীয় সম্পদ ব্যবহারে জোর, সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি, সামাজিক সুরক্ষা এবং আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়—সবকিছুর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
মো. জহিরুল ইসলাম
হেলথ অ্যাডভাইজার, ঢাকার সুইডেন দূতাবাস
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ পুরোপুরি ঝুঁকিতে। তাপমাত্রা বাড়লে এমনকি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেও সমস্যা হয়; আমরা ভাবি পরের দিন যাব। এতে কিশোর-কিশোরীদের সেবাগুলোই সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়। আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ ও অল্প বয়সে গর্ভধারণ বেশি হওয়ায় মাতৃস্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপপ্রবাহের সময় এন্টিনেটাল কেয়ার ব্যাহত হয়, গর্ভপাত, প্রিটার্ম জন্মের ঝুঁকি বাড়ে।
দুর্যোগে স্কুল বন্ধ হলে বা স্বাস্থ্যসেবায় চাপ এলে প্রথমেই বন্ধ হয়ে যায় অ্যাডোলেসেন্ট-ফ্রেন্ডলি হেলথ সার্ভিস। অথচ এই সেবাগুলো চলমান রাখা জরুরি। একই সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত থাকে। হিট স্ট্রেস ও ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি তাদের মধ্যে বাড়ছে। তারা শুধু ভুক্তভোগী নয়, এই সংকটে তারাই বৈশ্বিক ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়াজ তুলছে; নীতিনির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণ দরকার।
এখন সময় এসেছে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য ও জলবায়ু ইস্যুকে একসঙ্গে দেখার। জলবায়ু-সংবেদনশীল ও সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়তে আমাদের দেশীয় অর্থায়ন বাড়াতে হবে। এ জন্য এনজিও, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়াকে যুক্ত করে একটি শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু নীতিতে এসআরএইচআর যুক্ত হওয়ার এই অগ্রগতি ধরে রেখেই আমাদের এগোতে হবে।
ফারিহা হাসিন
অধ্যাপক, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিস বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকায় বস্তিতে বসবাসকারী জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোতে আমাদের করা গবেষণা দেখিয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। দক্ষিণের বা অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জেলা থেকে যেসব পরিবার ঢাকায় আসছে, তাদের কিশোরীরা স্কুল ছাড়ার দিকে ঝুঁকছে। পরিবারগুলো প্রায়ই বাল্যবিবাহকে ‘কোপিং স্ট্র্যাটেজি’ হিসেবে ব্যবহার করছে, যা দ্রুত গর্ভধারণের চাপ তৈরি করছে। নতুন পরিবেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরীদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ব্যবস্থাপনা, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণও কঠিন হয়ে পড়ছে; তাঁরা ঠিক কোথায়, কীভাবে সেবা পাবেন তা জানেন না।
গবেষণার অন্যতম সুপারিশ হলো—ক্লাইমেট-ভ্যারিয়েবল এলাকা থেকে ঢাকাসহ বড় শহরে আসা কিশোর-কিশোরীদের জীবনমান, প্রজননস্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও ডকুমেন্ট করা। লং-টার্ম স্টাডি অপরিহার্য, শুধু ক্রস-সেকশনাল ডেটা নয়। সমাধানগুলো কেবল এনজিও ফোরামেই নয়, একাডেমিয়া ফোরামেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোকে যুক্ত করা হবে।
আ ন ম মোস্তফা কামাল মজুমদার
উপপরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
আমাদের জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হলো কৈশোর, বিশেষ করে তাদের প্রজননস্বাস্থ্য। কিশোর-কিশোরীদের যে অধিকারগুলো আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রিপ্রোডাক্টিভ রাইট। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু প্রজননস্বাস্থ্যকেই নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্য, হিংসা এবং পুষ্টিও প্রভাবিত করে।
প্রথমত, এ ধরনের ফোরামে কিশোর-কিশোরীদের প্রতিনিধিদের প্রতিটি কর্মসূচিতে রাখা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ জেলা ও এলাকায় কিশোর-কিশোরীদের সেই ঝুঁকি মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ এবং নলেজ দিতে হবে। তৃতীয়ত, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা এবং মানসিক সহযোগিতাও দিতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছানো অপরিহার্য।
দুর্যোগপূর্ণ এলাকা বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবিত এলাকাগুলোর জন্য আলাদা পরিকল্পনা এবং সমাধান থাকা উচিত।
প্রতিটি সংশ্লিষ্ট সেক্টর, মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাকে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সম্প্রতি বরগুনা ও পটুয়াখালী পরিদর্শনে দেখা গেছে, বাস্তবে কমিউনিকেশন সমস্যা, সীমিত স্থাপনা এবং জনবলসংকট স্পষ্ট।
মো. মনজুর হোসেন
সহকারী পরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল, সেখানে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব গুরুতর। বাংলাদেশ গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্সে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে এবং দেশের প্রায় ২০ শতাংশ জনগণ বিশেষত উপকূল অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে। এই প্রেক্ষাপটে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, মানসিক অবস্থা, পুষ্টি এবং নিরাপত্তা সরাসরি প্রভাবিত হয়। বিশ্বজুড়ে ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২০২৩ সালে ডিজাস্টার-রিলেটেড ২৬.৪ মিলিয়ন মানুষের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত স্থানান্তর হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিট স্ট্রেস, বন্যা, সাইক্লোন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিশোরী ও মহিলাদের প্রজননস্বাস্থ্যে বড় প্রভাব ফেলেছে। ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফার্টিলিটি ৪–৫ শতাংশ হ্রাস, মিসক্যারেজ এবং লো বার্থ ওয়েটের ঝুঁকি বাড়ায়। পুরুষদের প্রজননক্ষমতাও কমছে, এবং হরমোনাল অস্বাভাবিকতার কারণে মেয়েদের মাসিক চক্রের অনিয়ম দেখা দিচ্ছে।
জলবায়ুর সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা, কমিউনিটি অংশগ্রহণ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্যকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
এলভিনা মোস্তারী
উপপরিচালক, আরএইচ স্টেপ
বাংলাদেশে কৈশোরের প্রজননস্বাস্থ্য ও জলবায়ুর প্রভাবকে কেন্দ্র করে সেক্সুয়াল ও রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ সার্ভিস, ট্রেনিং ও এডুকেশন প্রোগ্রাম সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। শুরুর চারটি পাঠশালার পর সিড ফান্ডে আরও ১০টি কেন্দ্র যুক্ত করা হয়েছে। মেনস্ট্রুয়াল হেলথ, হাইজিন, নিউট্রিশন ছাড়াও বিশেষত অ্যাবরশন ও মিসক্যারেজের সেবা ডিজাস্টার ও ক্লাইমেট প্রভাবিত এলাকায় অত্যন্ত জরুরি। প্রিভেনশন এবং প্রিসিশন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, আরএইচ স্টেপ মিলিতভাবে কাজ করছে।
প্রধান উদ্যোগ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ফ্যাসিলিটি কিট ও মোবাইল কিট, যা সহজে বহনযোগ্য এবং শেল্টার হোমে সরাসরি সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম। এই উদ্যোগটি নারীদের পোস্ট অ্যাবরশন কেয়ার এবং অন্যান্য এমপ্যাক্ট সার্ভিস নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি ১৫–৪৯ নারীদের বিস্তৃত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে।
তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে স্বাস্থ্য, মেন্টাল হেলথ এবং সেক্সুয়াল হেলথে সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বিভিন্ন ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সমন্বয়ে বাংলাদেশের কিশোরী ও তরুণীদের প্রজননস্বাস্থ্যকে জলবায়ুর প্রভাব থেকে রক্ষা এবং প্রিভেনটিভ সার্ভিস নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তৌফিক উল করিম চৌধুরী
ম্যানেজার (এম অ্যান্ড ই অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি), আরএইচ স্টেপ
আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও অ্যাডোলেসেন্ট রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ প্রোগ্রামে ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্সকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে জাতীয় পর্যায়ে এ ইস্যুকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেওয়া যায়। জলবায়ুঝুঁকিপূর্ণ জেলার জন্য বাজেট ও স্বাস্থ্যসেবা বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি, যাতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এসআরএসআর সিস্টেম কার্যকর করা সম্ভব হয়।
কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষণ ও কনটেন্টে বিশেষভাবে জলবায়ুবিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। দুর্যোগকালে মোবাইল ক্লিনিক চালু করা, এমএইচএম কিট ও ডিগনিটি কিট সরবরাহ করা, সাইকোসোশ্যাল ফার্স্ট এইড ও কনফিডেনশিয়াল কাউন্সেলিং নিশ্চিত করা জরুরি। পানির অপ্রতুলতা ও টয়লেট–ব্যবস্থার সমস্যা বিবেচনা করে নারী ও কিশোরীদের জন্য নিরাপদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া কমিউনিটি স্তরে শিক্ষা, সচেতনতা, জিরো টলারেন্স বাল্যবিবাহ নীতি, হেল্পলাইন ১০৯৩ এবং এসএমএস অ্যালার্ট কার্যকর করা গুরুত্বপূর্ণ। আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যক্রমের প্রভাব বাড়ানো যেতে পারে। এসব উদ্যোগ একত্রে কার্যকর করলে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স শক্তিশালী করা সম্ভব।
মো. মোফাজ্জল হোসেন
সহকারী পরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
বাংলাদেশে কৈশোরের প্রজননস্বাস্থ্য ও জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে বর্তমান প্রোগ্রামগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেও সিস্টেমেটিক পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ন্যাশনাল হেলথ স্ট্র্যাটেজিতে ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব পর্যাপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। বন্যা, সাইক্লোন ও অন্যান্য ডিজাস্টারে ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রগুলোতে সেবা পৌঁছানো এখনো চ্যালেঞ্জ। ২০২৪ সালের বন্যায় নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রামে দেখা গেছে যে শেল্টারগুলো ধ্বংসস্তূপের মতো এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচারের পুনর্বাসন ও আধুনিকায়নে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
অ্যাডোলেসেন্ট ও রিপ্রোডাক্টিভ হেলথের কার্যক্রম এমসিডব্লিউসি, এফডব্লিউসি ও সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ডিজাস্টারপ্রবণ এলাকায় এ কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত না হলে প্রয়োজনীয় সুবিধা, পোস্ট–অ্যাবরশন ও অ্যান্টিনেন্টাল কেয়ার সার্ভিস প্রদান সম্ভব নয়।
এ জন্য ইমার্জেন্সি কিট ও প্রোটোকল তৈরি করা হয়েছে। কর্মীর ঘাটতি প্রোগ্রামের কার্যকারিতা সীমিত করছে।
শরীফ ওয়াসিমা পারভীন
সহকারী পরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
বর্তমানে কিশোরীদের প্রতি যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়, কিশোর ছেলেরা সেদিক থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ২১ বছরের আগেই বিবাহিত হওয়া ছেলেরা কন্ট্রাসেপশন, মেনস্ট্রিয়াল হাইজিন, এসটিআই ও আরটিআই বিষয়ে অজ্ঞ।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিবাহিত বয়সে প্রবেশকারী তরুণদের জন্য কার্যকর সেবা জরুরি। কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব ও সামাজিক বাস্তবতা গুরুতর।
সরকারি সেন্টারের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও কর্মিসংকট আছে। ৩২৯০ ইউএনএমডব্লিউসি, ২৮৩ এমসিডব্লিউসি এবং ১২৫৩ অ্যাডোলেসেন্ট-ফ্রেন্ডলি হেলথ কর্নার থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সার্ভিস প্রোভাইডার নেই, ফলে কাউন্সেলিং কার্যকরভাবে দেওয়া যাচ্ছে না।
সমস্যা সমাধানে সরকার ও এনজিওদের যৌথ কোলাবোরেশন প্রয়োজন। বিশেষ করে ডিজাস্টারপ্রবণ এলাকায় এবং প্রজননস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিশেষ কাউন্সেলর পাঠানো হলে সেবা পৌঁছানো এবং কৈশোরের স্বাস্থ্য রক্ষা সম্ভব হবে।
বেলাল উদ্দিন আহমেদ
সহকারী পরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাববিষয়ক কর্মসূচিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কার্যকর সেবা নিশ্চিত করা। বর্তমানে তথ্য সংগ্রহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হওয়ায় পরিকল্পনা কার্যকরভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। এমএস ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম থাকলেও দুর্যোগকালীন তথ্যের একীকরণ ও নিয়মিত আপডেটের অভাব রয়েছে। এতে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় কমিটি, স্কুল, ধর্মীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে যৌথ ব্যবস্থা গঠন করা অপরিহার্য। সার্ভিস প্রোভাইডার কম থাকায় নিকটবর্তী অঞ্চলের লোকদের প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান ভাগাভাগি করে কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। মেন্টাল হেলথে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া জরুরি, কারণ উদ্বেগ, ডিপ্রেশন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো সমস্যা প্রকট। এ জন্য নির্দিষ্ট পর্যায়ে কাউন্সেলর স্থাপন ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। সমন্বিত তথ্য, প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর ও উন্নত ফ্যাসিলিটি ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা সম্ভাব্য নয়।
নিশাত তাসনিম
চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমসিএইচ সেবা), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
বিদ্যমান ইমার্জেন্সি রেসপন্স কমিটিগুলো কার্যকরভাবে কাজ করতে পারলে দুর্যোগের সময় দ্রুত সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এ জন্য এলাকার সিচুয়েশন ম্যাপিং, নিড অ্যাসেসমেন্ট এবং ফ্যাসিলিটি রেডি রাখা অপরিহার্য। বিশেষ করে প্রান্তিক ও পিপল স্পেশাল কিশোরদের প্রতি ফোকাস বৃদ্ধি করতে হবে। কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি হলো নেটওয়ার্কিং ও প্রি-প্ল্যানিং।
সেবা প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধি না হলে প্রাপ্যদের অনেকেই ফ্যাসিলিটি থেকে সেবা নিতে পারবে না। তাই অ্যাডোলেসেন্টদের সেন্টার থেকে সেবা গ্রহণের উপায় জানানো ও প্রচারণা চালানো জরুরি। এ ছাড়া ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে কমোডিস সাপ্লাই চেইন স্থিতিশীল রাখা এবং পর্যাপ্ত ফান্ডিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
শুধু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা নয়, দুর্যোগের পরে আফটার ইফেক্ট মোকাবিলা করে পুনরায় নরমাল সিচুয়েশনে ফেরা এবং কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এঞ্জেলিকা দিবা পিউরিফিকেশন
চিকিৎসা কর্মকর্তা, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
জলবায়ুর প্রভাবে ফসলের ক্ষতি কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিহীনতা ও রক্তস্বল্পতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের মেন্টাল হেলথে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং এই সময়ে সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশনও বেড়ে যেতে পারে। দরিদ্র পিতা–মাতারা সন্তানের নিরাপত্তার জন্য তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ায় আর্লি ম্যারেজ এবং অ্যাডোলেসেন্ট প্রেগন্যান্সির হার বাড়ে।
স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে ডিসপোজালের সমস্যা থাকায় মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য রিইউজেবল প্যাড বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ সরবরাহ এবং আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড দেওয়া জরুরি। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নও অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ দুর্যোগকালে হেলথ সেন্টারগুলোর কার্যক্রম অপ্রতুল থাকে। এ ছাড়া দুর্যোগ-সহনশীল স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা, কিশোর-কিশোরীদের জন্য পুষ্টি ও হাইজিন কাউন্সেলিং নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এক সুষম ব্যবস্থা থাকলে এ সময় প্রজননস্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা সম্ভব হবে এবং জলবায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট ঝুঁকি কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।
সামিয়া আফরিন
প্রজেক্ট ডিরেক্টর, উইমেন হেলথ অ্যান্ড রাইটস, নারীপক্ষ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কিশোর-কিশোরী ও নারীর স্বাস্থ্য গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে শুধু প্রজননস্বাস্থ্য নয়, অর্থনৈতিক সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষা, বন্যা ও ডিসপ্লেসমেন্টের ফলে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে নারী ও কিশোরদের ক্ষেত্রে।
কিশোর-কিশোরীরা নিজেই বিভিন্ন উপায়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। বর্ষাকালে তারা ফ্যামিলি প্ল্যানিং ওষুধ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ভাগ করে নিচ্ছে। তবে মিঠাপানির অভাব, লবণাক্ত পানির সমস্যা ও দীর্ঘ পথ অতিক্রমের কারণে শারীরিক অসুস্থতা বাড়ছে, যা নারীদের ওপর বেশি বোঝা তৈরি করছে।
ছোট ছোট অর্গানাইজেশন স্থানীয় পর্যায়ে স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তবে জাতীয় পরিকল্পনায় কিশোরদের প্রয়োজন ও দুর্যোগ-সহনশীল ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় স্যানিটারি সুবিধা নেই, যা মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে।
মাহবুবুল আলম
কান্ট্রি ডিরেক্টর ইন বাংলাদেশ, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল
বন্যা, সাইক্লোন বা বর্ষার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের সময় ফ্যাসিলিটি বন্ধ থাকায় ম্যাটারনাল ও অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ সেবা বাধাগ্রস্ত হয়। মেনস্ট্রুয়াল হেলথ ম্যানেজমেন্ট প্রোডাক্ট যেমন প্যাড বিতরণ হলেও, জলবায়ু-প্রভাবিত এলাকায় তা যথাযথভাবে পৌঁছায় না এবং পরিবেশদূষণের ঝুঁকিও থাকে। প্রেগন্যান্ট ও কিশোরী মেয়েদের মেন্টাল হেলথ, স্যানিটেশন, পুষ্টি ও সেক্সুয়াল হেলথের অতিরিক্ত চাহিদা দেখা দেয়।
অ্যাডাপ্টিভ ইন্টারভেনশন অপরিহার্য—দুর্যোগ-সহনশীল স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ফ্যাসিলিটি রেডিনেস বৃদ্ধি, রিইউজেবল প্যাড বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ বিতরণ এবং স্পেসিফিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন। সার্ভিস প্রোভাইডারের জলবায়ু সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি করা জরুরি। কেবল প্রোডাক্ট বিতরণ নয়, বরং দুর্যোগের পর সেবা পুনরায় চালু করা এবং স্থানীয় প্রয়োজন অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা করতে হবে। এভাবেই কিশোর প্রজননস্বাস্থ্য রক্ষা ও জলবায়ু ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব।
মো. নুরুল ইসলাম খান
প্রোগ্রাম অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ
শুধু কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সীমাবদ্ধ নয়; এটি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা ও সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব নিয়ে আমাদের ধারণা কম থাকায় বিভিন্ন পাবলিকেশন ও ডেটাবেজ ব্যবহার করে সঠিক তথ্য জানা জরুরি। বয়লিং ফ্রক সিনড্রোমের মতো পরিস্থিতিতে কিশোর-কিশোরীরা অল্প অস্বস্তিতেই বিপদে পড়ে, যা জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির সঙ্গে তুলনীয়।
দ্বিতীয়ত, কার্যকর পার্টনারশিপ অপরিহার্য। পাবলিক ও প্রাইভেট, মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ছাড়া হেলথ সেবা কার্যকরভাবে পৌঁছায় না। ক্লাইমেট চেঞ্জ হেলথ প্রমোশন ইউনিটের সঙ্গে প্রথমে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সমন্বয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, টেকনিক্যাল সাপোর্ট গ্রহণ ও ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। ডব্লিউএইচও–সহ বিভিন্ন উৎস থেকে প্রযুক্তিগত ও নলেজ সাপোর্ট নিয়ে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করলে কিশোর প্রজননস্বাস্থ্য সংরক্ষণে জলবায়ুর ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।
এ এন এম এহতেশাম কবির
কনসালট্যান্ট (বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য), ইউনিসেফ বাংলাদেশ
ইউনিসেফ দীর্ঘদিন ধরে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। জাতীয় পর্যায়ে এবং আটটি জেলায় সরাসরি কাজের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করছে। জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা কিশোর-কিশোরীরা সবচেয়ে ভালনারেবল, তাই তাদের জন্য বিশেষ ফোকাস প্রয়োজন।
একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা জরুরি; উত্তরবঙ্গের নদীভাঙন, দক্ষিণবঙ্গের লবণাক্ততা, রাজশাহীর হিট ওয়েভ এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের এডসেন্ট হেলথ কো–অর্ডিনেশন কমিটি সক্রিয় করলে স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয় আরও কার্যকর হবে। স্কুলশিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্ট দিয়ে জলবায়ু-প্রভাবিত কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য রক্ষা করা হচ্ছে। নিরাপদ পানি, ফ্যাসিলিটি হেলথ কর্নার উন্নয়ন ও সেবার মান বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সৈয়দ মো. নুরুউদ্দিন
অ্যাডভাইজার, এসআরএইচআর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
সম্প্রতি কিশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের করা গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু-প্রভাবিত এলাকায় অ্যাডোলেসেন্টদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি, তবে কমিউনিটি অংশগ্রহণ সীমিত—মোট ২৮ থেকে ৪৮ শতাংশ মানুষ প্রিপারেশন বা অ্যাডাপ্টেশন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ থাকলেও প্রিপারেশন ও রিসোর্স সীমিত। ফলে বন্যা বা দুর্যোগে হেলথ সার্ভিস কার্যকর হয় না। বিশেষ করে ছেলেরা ফোকাসে অনুপস্থিত থাকায় যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য পূর্ণাঙ্গভাবে সুরক্ষিত হয় না।
মিনিম্যাল হেলথ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম ও কমিউনিটি পার্টিসিপেশন বাড়ানো জরুরি। ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট এবং পরিবারভিত্তিক সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কৈশোরের ছেলেমেয়েরা বাল্যবিয়ে ও প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যায় সুরক্ষিত থাকে। সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রিপারেশন, ও রেসপন্স কার্যক্রমকে সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে এলে কিশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা সম্ভব।
মো. মাসুদুর রহমান
ন্যাশনাল কো–অর্ডিনেটর, ব্র্যাক
মোংলাতে গ্রাম পরিদর্শনে দেখা গেছে, জলবায়ু-প্রভাবিত এলাকায় কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্যে ঝুঁকিতে রয়েছে। লবণাক্ত পানি, অর্থনৈতিক চাপ ও পারিবারিক শঙ্কার কারণে অনেক মেয়েকে কম বয়সে বিয়ৈ দেওয়া হয়। ১৪–১৫ বছর বয়সে প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্য ও সামাজিক জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলে। কমিউনিটিতে সচেতনতা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ থাকলেও প্রিপারেশন ও রিসোর্স অপর্যাপ্ত।
স্থানীয় কমিউনিটি ও এনজিওগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি–বেজড সংগঠনকে যুক্ত করা এবং যুবক-যুবতীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। নির্দিষ্ট গবেষণা ও সায়েন্টিফিক অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধান গ্রহণ করা প্রয়োজন। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ সম্প্রসারণ এবং সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা সম্ভব।
আবুল বরকত
ডেপুটি ডিরেক্টর, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)
আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে খুব বিস্তৃতভাবে দেখেছি, কিন্তু কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের দিকে সরাসরি নজর দেওয়া হয়নি। যার ফলে আমরা সচেতন হওয়ার আগেই অনেক ক্ষতিই হয়ে গেছে। আমার তিনটি পরামর্শ আছে। প্রথমত, রিসার্চ বাড়ানো জরুরি, যা পাবলিক হেলথ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফার্টিলিটি ও অন্যান্য প্রভাব চিহ্নিত করবে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি প্ল্যান অব অ্যাকশনে ক্লাইমেট চেঞ্জ ও প্রজননস্বাস্থ্যকে স্পেসিফিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। তৃতীয়ত, এটি একক সমস্যা নয়; তাই জিও, এনজিও এবং ডেভেলপমেন্ট সংস্থা মিলিতভাবে সহযোগিতা ও পার্টনারশিপ নিশ্চিত করা জরুরি।
শুধু গবেষণা নয়, নীতি ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা করতে পারব।
অংশগ্রহণকারী:
নাছির আহমদ,পরিচালক (এমসিএইচ—সার্ভিসেস), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; ইকবাল কবির, পরিচালক—সিসিএইচপিইউ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়; মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার, লাইন ডিরেক্টর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; মো. জহিরুল ইসলাম, হেলথ অ্যাডভাইজার, ঢাকার সুইডেন দূতাবাস; ফারিহা হাসিন, অধ্যাপক, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিস বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়; আ ন ম মোস্তফা কামাল মজুমদার, উপপরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; মো. মনজুর হোসেন, সহকারী পরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; এলভিনা মোস্তারী, উপপরিচালক, আরএইচ স্টেপ; তৌফিক উল করিম চৌধুরী, ম্যানেজার (এম অ্যান্ড ই অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি), আরএইচ স্টেপ; মো. মোফাজ্জল হোসেন, সহকারী পরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; শরীফ ওয়াসিমা পারভীন, সহকারী পরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; বেলাল উদ্দিন আহমেদ, সহকারী পরিচালক (এমসিএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; নিশাত তাসনিম, চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমসিএইচ সেবা), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; এঞ্জেলিকা দিবা পিউরিফিকেশন, চিকিৎসা কর্মকর্তা, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর; সামিয়া আফরিন, প্রজেক্ট ডিরেক্টর, উইমেন হেলথ অ্যান্ড রাইটস, নারীপক্ষ; মাহবুবুল আলম, কান্ট্রি ডিরেক্টর ইন বাংলাদেশ, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল; মো. নুরুল ইসলাম খান, প্রোগ্রাম অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ; এ এন এম এহতেশাম কবির, কনসালট্যান্ট (বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য), ইউনিসেফ বাংলাদেশ; সৈয়দ মো. নুরুউদ্দিন, অ্যাডভাইজার, এসআরএইচআর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ; মো. মাসুদুর রহমান, ন্যাশনাল কো–অর্ডিনেটর, ব্র্যাক; আবুল বরকত, ডেপুটি ডিরেক্টর, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো