বাতব্যাধি ও লুপাস: চাই বিশ্বমানের চিকিৎসা
লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি, রিউম্যাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ ও দৈনিক প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ইন্টারন্যাশনাল লিগ অব অ্যাসোসিয়েশন্স ফর রিউম্যাটোলজির সহযোগিতায় ‘বাতব্যাধি ও লুপাস: চাই বিশ্বমানের চিকিৎসা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৯ জুলাই ২০২৩। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশ হলো।
অংশগ্রহণকারী
অধ্যাপক ডা. মো.শারফুদ্দিন আহমেদ
উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক
প্রেসিডেন্ট, লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম
সেক্রেটারি জেনারেল, এশিয়া প্যাসিফিক লিগ অব অ্যাসোসিয়েশন্স ফর রিউম্যাটোলজি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী
চেয়ারম্যান, রিউম্যাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন
লাইন ডিরেক্টর (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক ডা. আবু শাহীন
ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. শাহানা আক্তার রহমান
নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি
অধ্যাপক ডা. রওশন আরা স্বপ্না
ট্রেজারার, বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি
অধ্যাপক ড. নাসরীন সুলতানা
পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. ফারহানা ফেরদৌস
সেক্রেটারি জেনারেল, লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
সৈয়দা মারিয়া আফেন্দি
লুপাস পেশেন্ট ও সদস্য, লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
বাতব্যাধি ও লুপাস নিয়ে আজকের আলোচনা। বাতের বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু লুপাস সম্পর্ক আমাদের ধারণা খুবই কম। এটা যে একটা বড় ধরনের রোগ, সেটাও হয়তো অনেকর জানা নেই। আমরা মনে করি, বাতব্যথা মানে পিঠ, হাঁটু ও গিরায় ব্যথা। সামান্য ওষুধ খেলে, চলাফেরা করলে সেরে যাবে। কিন্তু এর অনেক জটিল সমস্যা রয়েছে। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় আসবে বলে আশা করি।
সৈয়দ আতিকুল হক
রিউম্যাটিক ডিজঅর্ডার হলো বাতব্যাধি। বড় আঘাতজনিত ও ক্যানসারজনিত নয়, এমন রোগীর গিরা, মাংসপেশি, হাড়—এগুলো যদি ফুলে যায়, ব্যথা হয়, আড়ষ্ট হয়, তাহলে এটা বাতব্যাধি। চার ধরনের বাতব্যাধি রয়েছে—গিরাব্যথা বা গেঁটেবাত, মাংসপেশিতে ব্যথাজনিত বাত, হাড়ের বাত, মাল্টি সিস্টেম বাত। যখন কিডনি, ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ একসঙ্গে আক্রান্ত হয়, তখন তাকে মাল্টি সিস্টেম বাত বলে। সময়ের সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া, দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা, জন্মগত ও হরমোনজনিত সমস্যা, বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রদাহ হতে পারে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলেও বাতব্যাধি হতে পারে।
ক্রনিক রোগের ৪০ শতাংশ বাতব্যাধি। দীর্ঘমেয়াদি অক্ষমতার ৫৪ শতাংশ বাতব্যাধি। দিনে মানুষের যে পরিমাণ কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়, এর ২৪ শতাংশ হয় বাতব্যাধির কারণে। গবেষণায় বিভিন্ন রোগকে ১৯টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষমতা নষ্ট করে মানসিক রোগ। এরপরই বাতব্যাধির অবস্থান। মানসিক রোগ জীবনের প্রথম দিকে বেশি থাকে, শেষ দিকে কম। বাতব্যাধি ঠিক এর বিপরীত। অল্প বয়সে কম হয়, বয়স বাড়লে বেশি হয়। বাতব্যাধির সামাজিক অভিঘাত অনেক। মানুষ সব সময় ঘাতক ব্যাধি নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু যে মানুষ অক্ষমতা নিয়ে বেঁচে থাকেন, সারা জীবন তাঁকে কষ্ট করতে হয়।
২০০১ সালে বাতব্যাধি নিয়ে দেশের ছয়টি গ্রাম ও ঢাকা শহরের দুটি এলাকায় জরিপ করেছিলাম। এটা প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী অনেক আলোচনা হয়েছে। ২৬৪ বার এ প্রকাশনা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে এ ধরনের প্রকাশনা আছে ৬ হাজার ৪৬৭টি। নানা ধরনের বাছাইপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এখান থেকে ৩২৩টি প্রকাশনা নির্বাচিত হয়েছে। এর মধ্যে নম্বরের ভিত্তিতে ৭২টি প্রকাশনা চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়। আমাদের অবস্থান ৪ নম্বর। এটা আমার নামে প্রকাশিত হয়েছিল। এ প্রকাশনার তথ্যের ওপর নিশ্চিন্ত থাকা যায় যে এটা সঠিক উপাত্ত।
এ প্রকাশনার একটা উপাত্ত ছিল যে তৎক্ষণাৎ কতজন মানুষ বাতব্যাধিতে আক্রান্ত। গড় হলো ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২১ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ, ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী। সারা জীবন বাতব্যাধিতে আক্রান্তের মধ্যে নারী প্রায় ৩৭ শতাংশ, পুরুষ ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আরেকটু স্থায়ী বাতব্যাধি (রিউম্যাটিক ডিজিজ) নারীদের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ, পুরুষের ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
২০১৯ সালে আমাদের আরেকটা জরিপ প্রকাশিত হয়েছে, এটা ছিল দেশব্যাপী। এ জরিপে সহযোগিতা দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখানে বাতব্যাধির প্রাদুর্ভাব ছিল ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। নারী ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ, পুরুষ ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অক্ষমতা ছিল—নারী ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ, পুরুষ ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। কাজ বন্ধ ছিল—নারী ২২ দশমিক ৬ শতাংশ, পুরুষ ২৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এবার লুপাস নিয়ে একটু বলতে চাই। আমরা ইন্টারন্যাশনাল লিগ অব অ্যাসোসিয়েশন্স ফর রিউম্যাটোলজি সংস্থার সহযোগিতায় আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। লুপাস একটি অটো ইমিউন রোগ। শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) এ ক্ষেত্রে কাজ করে না।
এর লক্ষণ হলো গিরায় ব্যথা, জ্বর, চামড়ায় লাল চাকা হওয়া, পা ফুলে যাওয়া, অস্থিরতা, অমনোযোগী হওয়া ইত্যাদি। এটা অল্প বয়সী নারীদের বেশি হয়। এতে কিডনি ও রক্তের কণিকা আক্রান্ত হয়। চোখ, হার্ট, মেরুদণ্ড আক্রান্ত হতে পারে। আমাদের জরিপ অনুসারে, এখন বাংলাদেশে দুই লাখের বেশি নারী এ জটিলতায় আক্রান্ত। এসব রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠান্ডা বরফ দেওয়া হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিছু জটিলতা আছে সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। একসময় পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাতজ্বর ও গাউট বারবার আক্রমণ করে। আবার ভালো হয়।
পঞ্চাশের দশকে এ রোগের তেমন কোনো ওষুধ ছিল না। এখন অত্যন্ত কার্যকর ভালো ওষুধ এসেছে। কিন্তু ওষুধগুলো দীর্ঘদিন নিয়মিত খেতে হয়। এখন এসব রোগীর সক্ষমতা ও আয়ু বেড়েছে। এ রোগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ওজন কমানো, সুষম খাদ্য ইত্যাদি জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ সেবন ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই বাতব্যাধি ও লুপাস থেকে সুরক্ষার উপায়।
বাতব্যাধির চিকিৎসায় জনবলের সংকট ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। মডেল অব কেয়ার অর্থাৎ কোথায় সঠিক চিকিৎসা আছে, কার কাছে যাবেন এ সম্পর্কে রোগীর ও তাঁর পরিবারের ধারণা কম। আউট অব পকেট খরচ অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও লুপাস ফাউন্ডেশনের এক আনুমানিক হিসেবে দেখা যায়, লুপাস রোগীদের ৯০ শতাংশকে নিজেদের পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। এখানে কোনো ধরনের অর্থ সহযোগিতা আসে না। সঠিক প্রশিক্ষণ, তদারকি ও প্রণোদনার অভাবে মানসম্মত চিকিৎসার নিশ্চয়তা নেই। আবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসচেতনতার অংশ হিসেবে বাতব্যাধির বিষয়টি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
পাঁচ বছরের মধ্যে সব সরকারি মেডিকেল কলেজে এবং ১৫ বছরের মধ্যে সব জেলা সদর হাসপাতালে বাতব্যাধি বিশেষজ্ঞের নিয়োগ করা দরকার। বাত রোগনির্ণয়ের প্রযুক্তি ও ওষুধ আমদানি সহজলভ্য করতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিলে বাতব্যাধি ও লুপাস রোগীরা সুরক্ষা পাবেন।
মিনহাজ রহিম চৌধুরী
আমাদের দেশে বাতব্যাধি বা রিউম্যাটিক রোগ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন এগুলো বয়স্ক মানুষের অসুখ, আবার অনেকের ধারণা, বাত রোগ মানেই রিউমেটিক ফিভার বা বাতজ্বর। বিশেষ করে শিশু ও কিশোর বয়সে গিঁটব্যথা বা ফুলে গেলে বাবা-মা প্রায়ই এএসও নামে একটি পরীক্ষা করে আসেন এবং জানতে চান রোগটি বাত জ্বর বা রিউমেটিক ফিভার কি না?
পৃথিবীতে সব রোগের শ্রেণিবিন্যাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাস্বীকৃত একটি পদ্ধতি আছে, যার সর্বশেষ দশম রিভিশন অনুযায়ী ৬৯৩ রকম বাতব্যাধির কন্ডিশন আছে এবং প্রায় দুই শ রকম রোগ আছে।
বাত রোগ যেকোনো বয়সে শুরু হতে পারে। এর বেশ কিছু কঠিন ও জটিল রোগ আছে, যা কম বয়সে শুরু হয়। এর মধ্যে লুপাস বা এসএলই, রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস, স্পনডাইলোআর্থ্রাইটিস, সিসটেমিক স্ক্লেরোসিস, ভাসকুলাইটিস উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের রোগগুলো মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে। এসব রোগনির্ণয়ে এবং চিকিৎসা দেরিতে শুরু করলে নানা জটিলতা তৈরি হয়, এমনকি জীবনের ওপর আঘাত আসতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু হওয়া জরুরি।
বাত রোগীদের চিকিৎসায় মূলত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়—কিছু ব্যথা কমানোর, যেগুলো অল্প দিনের জন্য; আর কিছু ওষুধ ভেতর থেকে রোগটিকে বাধা দেবে। আর এগুলোই হচ্ছে আসল ওষুধ।
বাংলাদেশে এখন সব ধরনের উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব, যার মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে ভালো ওষুধের মূল্য বেশি হওয়ায় অনেক রোগী এই ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
মো. নজরুল ইসলাম
২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রিউমাটোলজি বিভাগ চালু হয়। বর্তমানে দেশে এই বিষয়ে চিকিৎসকের সংখ্যা ৭৩। দেশের ১৭ কোটি মানুষের চিকিৎসার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন ৭৩ জন বিশেষজ্ঞ।
আমি ৩০ বছরের এক যুবকের কথা জানি। তাঁর একটি সন্তান আছে। মা-বাবাসহ পরিবারে আটজন সদস্য। তাঁর ত্বকে চলটার মতো চামড়া ওঠে, মাথায় খুশকি। একসময় এর সঙ্গে যোগ হয় কোমর, গিরা ও হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা—এ নিয়ে কোনো রকম চলছিল। এরপর দেখা গেল, তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিতে ও শরীরে খারাপ চর্বি জমা হয়েছে। এ জন্য তাঁর চাকরি চলে যায়। তিনি তাঁর চিকিৎসা খরচ বহন করতে পারছেন না। অনেক কষ্টে জীবন কাটাতে হচ্ছে।
বাতব্যাধিতে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় না, কিন্তু অক্ষম হয়, গরিব হয়। এই বিষয়ের রোগ অন্যান্য রোগকে বাড়িয়ে দেয়। একজন রোগী হয়তো ডায়াবেটিস বা বিষণ্নতার জন্য চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন কিন্তু এটা যে রিউম্যাটোলজি রোগের জন্য হতে পারে, সেটা তিনি ভাবছেন না। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
বর্তমানে প্রায় কয়েক কোটি মানুষ চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে দরিদ্র হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্যাক্টশিটে রিউম্যাটোলজির ১৫০টি রোগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের গড় আয়ু ৭৩ দশমিক ৫৭ বছর। আমাদের নারীরা একটু বেশি বাঁচেন, তাঁদের গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ১ বছর। ৫০ বছরের বেশি বয়সের প্রতি ৩ জন নারীর একজন ও প্রতি ৫ জন পুরুষের একজন হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছেন। এখন প্রায় ৩৫ লাখ নারী ও ২৫ লাখ পুরুষ হাড়ক্ষয় রোগের আশঙ্কায় আছেন। কীভাবে এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
আবু শাহীন
সাধারণত গিরা, গিরার পাশের লিগামেন্ট, মাংসপেশি, রক্তনালির ব্যথাকে বাতব্যথার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর্থ্রাইটিসের একটি হলো প্রদাহজনিত ব্যথা। এ রোগ বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হয়। এটা তীব্র আকার ধারণ করে। এ রোগের চিকিৎসা না হলে রোগী পঙ্গু হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুও হতে পারে। হঠাৎ গিরা ফুলে লাল হয়ে অনেক ব্যথা হয়। দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কিছুটা বেশি বয়সের মানুষের হয়। স্পনডাইলোআর্থ্রাইটিস হলো মূলত কোমরে ব্যথা। সকালে ঘুম থেকে উঠলে এটা বেশি হয়। এর সঙ্গে অন্য গিরাও ফুলে যায়। প্রদাহজনিত রোগ যদি সঠিক সময়, সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় এবং সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে রোগীদের বড় অংশকে পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা করতে পারব।
ক্ষয়জনিত বাতের সমস্যা অনেক বেশি। এটা চোখে দেখা যায় না। তীব্র ব্যথা হয় না, ফুলে যায় না, হাড়ক্ষয় হতেই থাকে। এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। অনেকের ধারণা, কেবল গিরায় বাত হয়। কিন্তু মাংসপেশিতেও বাত হতে পারে। এরও জরুরি চিকিৎসা না করালে পঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইউরিক অ্যাসিডকে অনেকে বাতব্যথা মনে করেন। এটি একটি ভুল ধারণা। অনেকে না জেনেই জীবনভর ক্যালসিয়াম ও ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ খেয়ে থাকেন, এটাও ঠিক নয়। বাতব্যাধির সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ব্যাপক হারে রিউম্যাটোলজিস্ট প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ প্রয়োজন।
শাহানা আক্তার রহমান
২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু রিউম্যাটিক ফিভারের কাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালে এ নিয়ে আমাদের একটি গবেষণাপত্র বের হয়। শিশুদের বাত রোগের ক্ষেত্রে প্রথমে আসে জেআইএ (জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস)। পৃথিবীর ৭০ শতাংশ রোগ হলো জেআইএ। বড়দের থেকে এর পার্থক্য আছে। সাত ধরনের জেআইএ আছে। এদের চিকিৎসাপদ্ধতিও ভিন্ন। জেআইএর প্রায় ৬৫ শতাংশ ভুল পরীক্ষা হয়েছে। আমাদের শেষ গবেষণামতে ভুল ডায়াগনসিসের পরিমাণ কমেছে। এর অর্থ মানুষ সচেতন হয়েছেন।
সারা বিশ্বে বাতজনিত রোগীর ১০ শতাংশ লুপাস রোগী। শিশুদের লুপাস প্রচণ্ড তীব্র হয়। এদের দ্রুত অ্যাগ্রেসিভ থেরাপি শুরু করতে হয়। এ ছাড়া আছে রক্তনালির প্রদাহ। কাওয়াসাকি (জ্বরসহ অনেকগুলো লক্ষণের সমষ্টি) নামে একটি রোগ আছে। ২৫ শতাংশের বেশি শিশু কাওয়াসাকি রোগে আক্রান্ত হলে তাদের হার্টে অ্যানিউরিজম ও মায়োকার্ডাইটিস হতে পারে।
আমরা এখন অনেক কাওয়াসাকি রোগী পাচ্ছি। আমাদের কাছে অনেক শিশু ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে আসছে। এর কারণ হলো তারা বেশি ওজনের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়। একজন শিশু তার ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজন বহন করতে পারবে না। আমদের দেশে রিউম্যাটিক ফিভার অনেক কমে এসেছে। এসব রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসার সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা জরুরি।
রওশন আরা স্বপ্না
গত কয়েক দশকে বাতব্যাধির চিকিৎসায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এ রোগের উপসর্গ সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাতব্যাধির পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়বহুল। এ বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলোর অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। আরেকটি বিষয় হলো ওষুধের কার্যকারিতা অথবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা–নিরীক্ষা নেই।
বাতব্যাধির চিকিৎসার জন্য জাতীয় নির্দেশিকা প্রয়োজন। দ্রুত একটি নির্দেশিকার ব্যাপারে কাজ করা দরকার। চিকিৎসকের স্বল্পতার জন্য যে ধরনের তদারক দরকার, সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোগীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। কোন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, সে ব্যাপারে ধারণা কম। এখনো রেফারেল ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। চিকিৎসার খরচ এত বেশি যে অনেকে চিকিৎসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাত রোগ চিকিৎসায় নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় রোগীরা কোথায় যাবেন, সেটা অনেক সময় বুঝতে পারেন না।
সৈয়দা মারিয়া আফেন্দি
আমার জীবন একজন সুস্থ সাধারণ মানুষের মতোই ছিল। স্কুল-কলেজে স্পোর্টস চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। পড়াশোনায় কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হইনি। কিন্তু ২০১২ সালে আমার লুপাস ধরা পড়ে। এ সময় এলএলবি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। লুপাসের কারণে তীব্র জ্বর, গিরায় গিরায় ব্যথা আর মুখে ঘা হলো, চুলও পড়ে গেল। হঠাৎ প্রায় থেমে গেল আমার দুরন্ত জীবন। লুপাস এমন একটি রোগ, যেটা বোঝা খুবই কঠিন। যেকোনো সময় শরীরের যেকোনো অঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। এর চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল আর সারা জীবন ওষুধের ওপর থাকতে হয়। এখন আমার চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়।
যেদিন জানলাম আমার লুপাস, এর পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করছি। নিয়মিত ওষুধ সেবন করি, ব্যায়াম করি। লুপাস ফাউন্ডেশন আমাকে ভালো থাকতে সহযোগিতা করছে।
ফারহানা ফেরদৌস
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাতব্যাধি ও লুপাস রোগের ব্যাপকতা বাড়ছে। এ জন্য মানুষের কর্মক্ষমতায় বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশ্বব্যাপী ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি। বাংলাদেশের অবস্থাও একই রকম।
২০২২ সালের আদমশুমারি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫-ঊর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৮ লাখ। এর মধ্যে বাতব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ। সময়ের সঙ্গে এ সংখ্যা বাড়ছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। বাতব্যাধি ও লুপাসের চিকিৎসা চলে প্রায় জীবনব্যাপী। আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় এই রোগের চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে অধিকাংশ রোগীকে দুঃসহ কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়। চিকিৎসাব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ায় খরচ হয়। চিকিৎসা ব্যয় কমাতে সরকারের আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন।
কিছু রিউমেটিক ব্যাধিতে প্রধানত নারীরাই আক্রান্ত হন। লুপাস রোগীর প্রায় ৯৫ শতাংশ নারী। তাঁদের ক্ষেত্রে অসচেতনতা, কুসংস্কার, পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তার অভাব, অর্থকষ্ট ইত্যাদি জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
লুপাস ফাউন্ডেশন বর্তমানে প্রধানত লুপাস রোগী ও তাঁদের পরিবারগুলোর মধ্যে নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম, পেশেন্ট এডুকেশন, সীমিত আকারে চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানে সহায়তা প্রদান করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ রিউম্যাটোলজি সোসাইটি, রিউম্যাটোলজি বিভাগ ও আমাদের প্রিয় রিউম্যাটোলজি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি। এ ছাড়া জটিল লুপাস রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে স্বল্প পরিসরে সাশ্রয়ী খরচে চিকিৎসাসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আরও ব্যাপকভাবে এই সেবার দেশব্যাপী প্রসার দরকার। লুপাস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সম্মানিত আলোচকদের অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
নাসরীন সুলতানা
একসময় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই রোগের ব্যাপকতা ও মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল সংক্রামক রোগ। স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়ার ফলে বর্তমানে সংক্রামক রোগে মৃত্যুহার অনেক কমেছে। কিন্তু এখন বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের প্রকোপ ও মৃত্যুর হার বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক রোগ। দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত খরচের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ খরচ হয় ওষুধের জন্য। এ জন্য দেশের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়।
বাতব্যাধি ও লুপাসে মৃত্যু কম হলেও এটি মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে অক্ষম করে দেয়। ল্যানসেট–এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বাতব্যাধির ডিজিজ বার্ডেন অনেক বেশি। রোগের অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য স্বাস্থ্যসেবার সরাসরি খরচ এবং অপ্রত্যক্ষ খরচ—দুটিই বিবেচনায় নিতে হয়। যেহেতু বাতব্যাধি দীর্ঘ মেয়াদে মানুষকে অক্ষম করে তোলে, তাই এই রোগের অপ্রত্যক্ষ খরচ অনেক বেশি এবং এটি মানুষের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। কাজেই বাতব্যাধি ও লুপাসকে গুরুত্ব দিতে হবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে।
জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমকে নাগরিক সচেতনতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বাতব্যাধির জন্য সরকারের বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ রোগের চিকিৎসার খরচ কত এবং অসুস্থ হলে রোগীরা কোথায় গিয়ে চিকিৎসা নেন—এসবের গবেষণা দরকার। তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এ রোগের প্রকোপ কিছুটা কমানো যেতে পারে।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
আজ সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে ঋদ্ধ হলাম। আয়োজকদের ধন্যবাদ যে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন। ছোটবেলায় রিউমেটিক ফিভারের কথা শুনেছি। তখন এটা খুব পরিচিত রোগ ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন ধারণা ছিল না। শুধু জানতাম যে এটা হলে গিঁটে ব্যথা হয়।
লুপাস নামে যে একটা রোগ আছে, এটাও জানা ছিল না। আলোচনা থেকে জানা গেল, এটা একটা কঠিন রোগ। এর চিকিৎসা খরচ অনেক বেশি। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এটা বিশেষভাবে মানুষকে জানানো দরকার। প্রত্যেককে এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। কী কারণে এই রোগ হয়, সেটা যদি মানুষকে জানানো যায়, তাহলে তাঁরা সেসব কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন।
ব্যাপক প্রচারের ফলে ডেঙ্গু, করোনা সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন, ইউটিউব সহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা জরুরি। সচেতনতা শুধু শহরে নয়, গ্রামের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত মানুষকে সচেতন করা দরকার।
মোহাম্মদ রোবেদ আমিন
২০১৫ সালে ডিজিজ স্পেসিফিক অ্যাকাউন্ট বলে একটা গবেষণা হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে এটা প্রকাশিত হয়। এ গবেষণায় এসেছিল, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় বছরে ৩৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এ ক্ষেত্রে অর্থ খরচের ২১টি খাত নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা গেল, মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ খরচ হচ্ছে ছয়টি খাতে। ছয়টি খাত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারীদের বাতের ব্যথায় এক বছরে খরচ হয় ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল রেসপিরেটরি ডিজিজ। এর খরচ ১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এখানে ৬৫০ কোটি টাকার বেশি পার্থক্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চিকিৎসাসেবার যে খাতে সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে, সে সেবা সরকারের কোনো কর্মসূচিতে নেই।
আমাদের এখন সেক্টর প্রোগ্রাম চলছে। আমি এনসিডিসি (অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ) কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করি। এখানে ১৮টি কম্পোনেন্টের মধ্যে বাত রোগের বিষয়টি নেই। এটা যদি সরকারের কোনো কর্মসূচিতে না থাকে, তাহলে কখনো সামনে আসবে না। সরকার গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই ম্যালেরিয়া দূর হয়েছিল। একটা ভালো খবর হলো, গতকাল স্বাস্থ্য খাতের পঞ্চম সেক্টর ইমপ্লিমেন্টেশন সভা ছিল। সেখানে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন। এ সভায় আমি বাতব্যাধির বিশাল ব্যয় স্বাস্থ্য খাতে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। সবাই এটা গ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্য খাতের পঞ্চম সেক্টরে বাতব্যাধি কর্মসূচিতে গুরুত্ব পাবে। লুপাস ফাউন্ডেশন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারবে।
দেশের মানুষের স্বাস্থ্যশিক্ষা (হেলথ লিটারেসি) কম। মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে। চিকিৎসাসেবার একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন দরকার। গাইডলাইন মেনে যাঁরা ডেঙ্গু চিকিৎসা করেছেন, তাঁদের খরচ কম হয়েছে। কমন রিউমেটিক ডিজিজের ম্যানেজমেন্ট কীভাবে হবে, তার জন্য একটা গাইডলাইন তৈরি করেছি। আমরা চিকিৎসাসেবার ব্যয় কমানোর জন্য কাজ করছি। রিউম্যাটোলজি রোগের জন্য নীতিমালা করব। সরকার রিউম্যাটোলজি রোগের বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা আপনাদের নিয়ে বাতব্যাধি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেব।
মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
রিউম্যাটোলজি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পথিকৃৎ। অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হকসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিউম্যাটোলজি চিকিৎসার যাত্রা শুরু করেন। এ চিকিৎসার মাত্র ৭৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। তাঁদের মাধ্যমে সারা দেশে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আটটি বিভাগীয় সরকারি হাসপাতালে রিউম্যাটোলজি বিভাগ আছে। যে রোগে মৃত্যু হয়, সেটা নিয়ে অনেক বেশি কথা হয়। কিন্তু যেসব রোগ পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর কারণ ঘটায়, সেটা নিয়ে এখনো কার্যকর ব্যবস্থার অভাব আছে।
বাতব্যথার রোগীদের ওষুধের জন্য একটা বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। তাহলে রিউম্যাটোলজি বিভাগ ও লুপাস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বিনা মূল্যে না হলেও কম মূল্যে তাঁদের ওষুধ দেওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটি জেনারেল রিউম্যাটোলজি ও একটি ইমিউনো রিউম্যাটোলজি বিভাগ খুলেছি। এখানে রিউম্যাটোলজি ও লুপাস ক্লিনিকসহ কয়েকটি ক্লিনিকও খোলা হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রিউম্যাটোলজি নিয়ে শিক্ষার্থীরা গবেষণা করছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত এ বিষয়ে আমাদের প্রায় ২৮০টি প্রকাশনা রয়েছে।
মানুষের চোখও কিন্তু রিউম্যাটোলজি রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। প্রথমত, মানুষকে সচেতন করতে হবে। এটা প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের আরও গবেষণা দরকার। সরকারের কিছু পরিকল্পনা প্রয়োজন। এখন এটি সরকারের নন–কমিউনিকেবল ডিডিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। ওষুধের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা দরকার।
ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যদি ওষুধ কিনতে না পারে, তাহলে পকেট খরচ কমবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড কেনা যাবে না। এর সঙ্গে ব্যথার ওষুধও যুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেকে বলেন যে স্বাস্থ্য খাত অর্থ খরচ করতে পারে না। তবে যেসব খাত খরচ করতে পারে না, সেটা বন্ধ করে যেসব খাতে আরও অর্থের প্রয়োজন, সে খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে একটা সুস্থ জাতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে এলে রোগীরা রিউম্যাটিক রোগ থেকে সুরক্ষা পাবেন। এ অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণের জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
ফিরোজ চৌধুরী
আজকের আলোচনায় বাতব্যাধি ও লুপাস নিয়ে অনেক অজানা তথ্য এসেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
সুপারিশ
● রিউম্যাটিক ডিজিজ ও লুপাসকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার মহাপরিকল্পনা ও রোডম্যাপ তৈরি করা প্রয়োজন।
● বাতব্যাধি ও লুপাস চিকিৎসায় জাতীয় গাইডলাইন জরুরি।
● জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে বাতব্যাধি ও লুপাসের চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য রূপরেখা থাকা প্রয়োজন।
● নিয়ন্ত্রিত জীবন ও সুষম খাদ্য গ্রহণে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
● বাতব্যাধি ও লুপাসের অত্যধিক চিকিৎসা ব্যয় হ্রাসে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
● জরুরি ভিত্তিতে রিউম্যাটোলজিস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সব জেলা হাসপাতালে নিয়োগ দিতে হবে।
● সব বাতজ্বর রিউম্যাটিক ফিভার নয়। বাতব্যাধির বিষয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
● বাতব্যাধির চিকিৎসা ও প্রভাব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
● না জেনে জীবনভর ইউরিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়ামের ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়।
● শুধু বাতব্যাধির জন্য একটা জাতীয় হাসপাতাল হওয়া জরুরি।