২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল: আমরা কোথায়?

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল: আমরা কোথায়?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১ ডিসেম্বর ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে। এতে সায়েন্টিফিক পার্টনার ছিল পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি।

‘২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল: আমরা কোথায়?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১ ডিসেম্বর ২০২৫, ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

আলোচনা

 ডা. মির্জা মো. আসাদুজ্জামান

কনসালট্যান্ট, গাইনি অনকোলজি ইউনিট ঢাকা মেডিকেল কলেজ

বর্তমানে জরায়ুমুখ ক্যানসার একটি বার্নিং ইস্যু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে এটিকে নির্মূল করা। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের আইএআরসির হিসাব অনুযায়ী, বছরে ৯ হাজার ৬০০ জন নতুন আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ৫ হাজার ৮০০ জন মৃত্যুবরণ করছেন। প্রতিদিন গড়ে ২৬ জন জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ১৪ জন মারা যাচ্ছেন। অথচ আমরা চাইলেই এই ক্যানসারকে প্রতিরোধ করতে পারি।

সাধারণত ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের নারীরা এবং মেনোপজাল বয়সে ৬০ থেকে ৬৯ বছরের নারীরা জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। সাধারণ উপসর্গগুলো হলো সহবাসের পর রক্তপাত, মাসিকের বাইরে অস্বাভাবিক রক্তপাত অথবা মাসিক বন্ধ হওয়ার পর রক্তপাত, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব এবং তলপেটে বা কোমরে ব্যথা। অল্প বয়সে যাঁদের বিয়ে হয়, যাঁদের একাধিক যৌনসঙ্গী আছেন, অরক্ষিত যৌন অভ্যাস, ধূমপান ও দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা পিল খাচ্ছেন, তাঁরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে ১৯৪টি দেশ ঐকমত্যে এসেছে যে এটিকে বিশ্ব থেকে নির্মূল করতে হবে। তারা একটি

কনসেপ্ট পেপার তৈরি করেছে, যেটিকে আমরা বলি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল করা হবে। বিশ্বের জন্য তারা ৯০-৭০-৯০ একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সেই হিসাবে,

৯০ শতাংশ ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বাচ্চাদের এইচপিভি টিকার আওতায় আনা, ৭০ শতাংশ মানুষকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। নিদেনপক্ষে ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে বছরে দুবার অন্তত হাই পারফরম্যান্স টেস্ট এইচপিভি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যানসারের স্ক্রিনিং করতে হবে। ৯০ শতাংশ নারীকে প্রি-ইনভেসিভ ডিজিজ, অর্থাৎ ক্যানসারের পূর্বলক্ষণ অবস্থায় চিকিৎসা এবং ক্যানসারের চিকিৎসা দিতে হবে।

সেই হিসাবে বাংলাদেশে ২০২৩ সালে জরায়ুমুখ ক্যানসারের টিকার পাইলটিং শুরু হয়। স্ক্রিনিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে পাইলট ১৬টি ডিস্ট্রিক্টে ভায়া দিয়ে জরায়ুমুখ ক্যানসারের স্ক্রিনিং চালু করেছিল এবং বর্তমানে ৭০১টি ভায়াকেন্দ্র রয়েছে স্ক্রিনিংয়ের জন্য।

অধ্যাপক ডা. ফারহাত হোসেন

প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ভায়া পদ্ধতির মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং চালু করে ধাপে ধাপে তা বিস্তৃত করেছে। তবে বিশ্লেষণ বলছে, গত ১৫ বছরে এ পদ্ধতিতে স্ক্রিনিং কাভারেজ মাত্র ২১ শতাংশ, যা স্পষ্টভাবে কম। একই বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এইচপিভি টিকাদানে ৯৩ শতাংশ কাভারেজ দেখিয়েছে। ফলে স্ক্রিনিং কম হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ জরুরি।

বহু নারী জানেন না জরায়ুমুখ কোথায়, কেন ক্যানসার হয়, ঝুঁকি কী, উপসর্গ বা স্ক্রিনিংয়ের উপকারিতা কী। এই জ্ঞানের অভাবই তাঁদের ভায়া সেন্টারে যেতে নিরুৎসাহিত করে। পাশাপাশি রয়েছে ভীতি ও ভুল ধারণা। অনেকেই স্বামী বা পরিবারের মুরব্বিদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল, ফলে সামাজিক বাধাও বড় ভূমিকা রাখছে।

এই বাধা দূর করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বামী, পরিবারপ্রধান, কমিউনিটির লিডার, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা আরও জোরদার করতে হবে। তাঁদের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য এবং স্ক্রিনিং ও ভ্যাকসিন একসঙ্গে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্মিলিত উদ্যোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ৭০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এ না হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই অর্জন সম্ভব।

এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট ডব্লিউএইচও স্বীকৃত একটি স্ট্যান্ডার্ড স্ক্রিনিং পদ্ধতি, যার সেন্সিটিভিটি ও নেগেটিভ প্রেডিক্টিভ ভ্যালু অত্যন্ত উচ্চ। ফলে এটি ভায়ার চেয়ে নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য। বিশেষ করে পোস্ট-মেনোপজাল নারীদের ক্ষেত্রে ভায়া যথাযথ নয়, কিন্তু এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট তাদের সুরক্ষার আওতায় আনতে সক্ষম। বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ইতিমধ্যে পিসিআর মেশিন রয়েছে। সরকার চাইলে শুধু রিএজেন্ট এবং টেস্টিং প্রোগ্রামিং নিশ্চিত করে এই মেশিনগুলো ব্যবহার করে সহজেই এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট চালু করতে পারেন। ভায়ার পাশাপাশি এই টেস্টকে জাতীয় স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করাও সম্ভব।

ডব্লিউএইচওর অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, একজন নারীর জীবনে দুবার এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট করাই যথেষ্ট—  ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে। এ নির্দেশনা জাতীয় স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে সরকারি পর্যায়ে এই টেস্ট চালু করা আরও বাস্তবসম্মত হবে।

অধ্যাপক ডা. রোকেয়া আনোয়ার

বিভাগীয় প্রধান, গাইনি অনকোলজি বিভাগ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল—এনআইসিআরএইচ

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনেশনে ৯৩ শতাংশ কভারেজ অর্জন করেছে—এটি প্রথম স্তরের বড় সাফল্য। ভ্যাকসিন নেওয়া মেয়েদের ফলোআপে এনে তাদের অভিভাবকদের বোঝানো যেতে পারে যে শুধু ভ্যাকসিন যথেষ্ট নয়, জীবনে অন্তত একবার হলেও এইচপিভি টেস্ট জরুরি। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত ‘ভ্যাকসিনেশন ফর ডটারস, স্ক্রিনিং ফর মাদারস’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জন্য মানানসই করে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।

কোভিড ভ্যাকসিনের সময় তৈরি জাতীয় রেজিস্ট্রেশন প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগিয়ে ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সী নারীদের টেস্টে আনলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। প্রায় দেড় কোটি নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে স্ক্রিনিং কভারেজ দ্রুত বাড়বে। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মতো গর্ভাবস্থার চেকআপে বা শিশুকে টিকা দিতে আসার সময় এইচআইভি ও এইচপিভি টেস্ট করার সুযোগ তৈরি করলে ৪০ শতাংশ নারীকেও সহজে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।

স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি প্রি-ক্যানসারাস লেসনের চিকিৎসা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সহজলভ্য। সিজারিয়ান যেহেতু করা যায়, সেহেতু ডায়াথার্মি মেশিন দিয়ে সহজেই এলইইপি করা সম্ভব। থার্মোঅ্যাবলেশনও স্বাস্থ্যকর্মীরা দিতে পারেন। এ জন্য দেশজুড়ে ক্যাম্প, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো জরুরি। সাধারণ বায়োপসি উপজেলায় স্থানীয় অ্যানেসথেসিয়াতেই করা সম্ভব—ভয়ই এখানে প্রধান বাধা।

প্রতিরোধমূলক অনকোলজি নিয়ে আলাদা কোর্স চালু হলে বিসিএস পাস চিকিৎসকেরা গ্রাম পর্যায়ে স্ক্রিনিংয়ে যুক্ত হতে পারবেন। সফল স্ক্রিনিং রোগীর সংখ্যা কমাবে, রেডিওথেরাপির ব্যয়ও কমাবে। জরায়ু ও স্তন ক্যানসারের রোগীরা চিকিৎসায় বহু বছর বেঁচে থাকেন, তাই বিভাগীয় পর্যায়ে তাঁদের জন্য আলাদা রেডিওথেরাপি মেশিন বরাদ্দের দাবি জানানো হয়।

এইচপিভিকে ‘ভ্যাজাইনাল কোল্ড’ বলা হয়, এটি সাধারণত আসে ও চলে যায়। মাত্র ১ শতাংশের কম ক্ষেত্রে ক্যানসার হয়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনেক ঝুঁকি কমায়। ভয় নয়, সঠিক নির্ণয়ই মূল।

পরিবেশদূষণ, পানির মান, নোংরা পরিবেশ ও ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণের প্রভাবে কিছু জনগোষ্ঠী বেশি ঝুঁকিতে থাকে—এসব মাথায় রেখেই সচেতনতা, স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা জোরদার করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. মুসাররাত সুলতানা

মহাসচিব, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

আমাদের দেশে বেশির ভাগ নারীই গ্রামে থাকেন। তাঁদের শিক্ষার হারও অনেক কম। সে জন্য তাঁদের মধ্যে স্ক্রিনিংয়ের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, মিডিয়া বড় মাধ্যম হতে পারে। এখন সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও আমরা বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম বা স্লোগান দিয়ে আমরা তাঁদের মধ্যে একটা আগ্রহ তৈরি করতে পারি। তাঁদের জানাতে পারি কীভাবে জরায়ুর মুখ ক্যানসার হয় আর কীভাবেই বা এ থেকে ভালো থাকা যায়।

স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা—এসব প্রতিষ্ঠানও বড় জনগোষ্ঠীকে ছুঁতে পারে। স্কুলের নিয়মিত স্বাস্থ্যবিষয়ক ক্লাস বা প্রোগ্রামের সঙ্গে জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের বিষয়টি যুক্ত করা যেতে পারে। এখন প্রতিটি জেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকা অবস্থায় তাঁদের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক সেশন আয়োজন করা সম্ভব। আবার বছরের বিভিন্ন সময় যখন জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা মাস পালিত হয়, তখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষ আয়োজন, প্রচার ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার।

পত্রিকাগুলোর ভূমিকা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম আলোসহ প্রধান পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি সচেতনতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রভাবও এখন ব্যাপক—শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। যেভাবে তাঁরা খাবার বা ফ্যাশন নিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করেন, সেভাবে জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং সম্পর্কেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। টিভি ও মিডিয়ার পরিচিত ব্যক্তিরাও এ বিষয়ে সমাজকে যুক্ত করতে পারেন। এটি তাঁদের কমিউনিটি ইনভলভমেন্ট হিসেবেও দেখা উচিত।

কর্মজীবী নারীদের জন্য বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতের নারী শ্রমিকদের জন্য। সেখানে বিশাল নারী কর্মশক্তি কাজ করেন—তাই গার্মেন্টসে সচেতনতা কার্যক্রম, স্ক্রিনিং আয়োজন বা হেলথ ক্যাম্প চালু করা অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। হেলথ ক্যাম্প সাধারণত বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, এ কারণে এটিও স্ক্রিনিং বিস্তারের একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে।

অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম

সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

আমরা অনেক দিন ধরে ভায়া টেস্ট করে আসছি। কিন্তু ভায়া টেস্টের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সেটার মধ্যে একটা হচ্ছে, যখন আমরা ভায়া করি, এটির স্পেসিফিসিটি অনেক কম। সে জন্য দেখা যায় যে ফলস পজিটিভ অনেক বেশি আসে। এখন যদি একটা ফলস পজিটিভ আসে, তখন তো সবাই ভয় পেয়ে যায়। মানে এত দুশ্চিন্তা করে, তারপর আমরা তাঁদের আলাদাভাবে কল্পোস্কপির জন্য রেফার করি, যা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যায়। সেই কারণে ভায়ার এটা একটা সীমাবদ্ধতা আছে। ভায়া টেস্ট করলে পরে পজিটিভ হলে পজিটিভ আসে, কিন্তু তা নয়।

দ্বিতীয়ত, ভায়া টেস্ট যে করে, যে পর্যবেক্ষক ওটা দেখে, তার প্রশিক্ষণ কেমন আছে, সে কতটুকু ঠিকমতো বুঝতে পারল বাস্তবে—সেটাও আমার একটা জানার দরকার আছে। কাজেই সেই হিসেবে ভায়ার রিপোর্ট কিন্তু দু-তিনজনের দু-তিন রকমের হতে পারে। কাজেই এটার ওপর আমরা ওইভাবে নির্ভরও করতে পারি না।

তৃতীয়ত, ভায়া টেস্ট কিন্তু সব সময় করা যাবে না। পোস্ট-মেনোপজাল নারীদের ভায়া টেস্ট করা যাবে না। কারণ, তখন তাঁদের ওই স্কোয়ামোকলামনার জাংশনটা ভেতর দিকে চলে যাচ্ছে। যার জন্য আমরা ভায়া করলেও ভায়া পজিটিভ ওই জায়গা রিচ করতে পারি না। কাজেই এটা পজিটিভ আমরা বুঝতে পারি না। এই কারণে এগুলো সব—আমি বলব যে ভায়ার একটা সীমাবদ্ধতা। এসব সীমাবদ্ধতা থাকার জন্যই আমরা ভায়াতে আসলে অতটা ভরসা করছি না।

যদিও ভায়া টেস্ট এখন খুবই কম খরচের এবং অনেকেই করতে পারে। করাও সহজ। কষ্ট বা ব্যথাও পায় না, কিছু নেই, কোনো সমস্যাই নেই—কিন্তু সেটাকে আমরা যদি স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম হিসেবে আমরা সারভাইক্যাল ক্যানসারের প্রকোপ কমাতে চাই, এটা খুব একটা ভালো জিনিস হবে বলে আমার মনে হয় না; বরং যেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে এইচপিভি এবং কখন কখন করতে হবে, আমরা যদি সেটাকে নিয়ে আসতে পারি, সেটা অনেক বেশি কাজের হবে।

অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

বিভাগীয় প্রধান, গাইনি অনকোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)

জরায়ুমুখের ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের তিনটি প্রধান পদ্ধতি—প্যাপসমিয়ার, ভায়া টেস্ট এবং এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট। প্যাপসমিয়ারে জরায়ুমুখ থেকে কোষ সংগ্রহ করে অস্বাভাবিকতা আছে কি না দেখা হয়। ভায়া পরীক্ষায় জরায়ুর মুখে পাতলা অ্যাসিটিক অ্যাসিড দেওয়া হয় এবং পরিবর্তন হলে ঝুঁকি শনাক্ত করা হয়, যদিও এটি ক্যানসার নিশ্চিত করে না। তৃতীয় পদ্ধতি এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট, যা এসেছে কারণ জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রধান কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। ভাইরাসটি আছে কি না শনাক্ত করা গেলে স্ক্রিনিং অনেক বেশি নির্ভুল হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এইচপিভি টেস্ট ৯০-৯৫ শতাংশ রোগ ধরতে সক্ষম। বিপরীতে সাইটোলজিক্যাল প্যাপ টেস্টের সংবেদনশীলতা মাত্র ৫০-৬০ শতাংশ। তাই উচ্চ সংবেদনশীলতার কারণে এইচপিভি টেস্ট বেশি গ্রহণযোগ্য।

আরও একটি সুবিধা হলো—সাইটোলজি টেস্ট তিন বছর পরপর করতে হয়, কিন্তু এইচপিভি টেস্টের সংবেদনশীলতা বেশি হওয়ায় ৫ থেকে ১০ বছরের ব্যবধানেও করা যায়। এ জন্যই ডব্লিউএইচও সুপারিশ করেছে—৩৫ বছর বয়সে একবার, ৪৫ বছর বয়সে একবার স্ক্রিনিং করলেই জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব।

এইচপিভি ভাইরাসের প্রায় ২০০ জেনোটাইপ শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ১৪-১৫টি উচ্চ ঝুঁকির। বিশেষ করে এইচপিভি-১৬ ও ১৮—এই দুই জেনোটাইপের জন্যই ৭০ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যানসার হয়। তাই প্রথম ধাপে যদি এইচপিভি ডিএনএ টেস্টে পজিটিভ পাওয়া যায় এবং জেনোটাইপ পরীক্ষায় ১৬ বা ১৮ ধরা পড়ে, তাহলে দ্রুত কল্পোস্কপি করে পরবর্তী মূল্যায়ন জরুরি। অন্য জেনোটাইপে ঝুঁকি তুলনামূলক কম—তাদের ক্ষেত্রে এক বছর পর আবার জেনোটাইপ টেস্ট করলেই অনেক সময় শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভাইরাস দূর করে দিতে পারে। জেনোটাইপ পরীক্ষার আরেকটি উপকার হলো—এটি কল্পোস্কপির ওপর চাপ কমায়। এটি একধরনের ট্রায়াজ পদ্ধতি, যা স্বল্প-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্পদ সাশ্রয় করে স্ক্রিনিং কাভারেজ বাড়াতে সাহায্য করে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কাভারেজ দ্রুত বাড়ানোর জন্য এই উন্নত পদ্ধতির ব্যবহার অপরিহার্য।

অধ্যাপক ডা. রেহানা পারভীন

সিনিয়র কনসালট্যান্ট, গাইনি অনকোলজি বিভাগ স্কয়ার হাসপাতাল এনআইসিআরএইচ

জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলে এইচপিভি টেস্টকে স্ক্রিনিং হিসেবে চালু করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট মূলত সেই ভাইরাসকে শনাক্ত করে, যার উপস্থিতিতে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। তবে মনে রাখতে হবে, এইচপিভি থাকলেই ক্যানসার হয় না। সংক্রমণের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুই বছরের মধ্যে ভাইরাসকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দূর করে দেয়। মাত্র ১০ শতাংশ সংক্রমণ স্থায়ী থাকে এবং ক্যানসারের ঝুঁকিও থাকে এই অংশের মধ্যেই।

সমস্যা হলো এইচপিভি টেস্ট অস্থায়ী সংক্রমণকেও ধরে ফেলে, যেটি কখনোই ক্যানসারে রূপ নেবে না। ফলে সব ক্ষেত্রে কল্পোস্কপি করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু উচ্চসংখ্যক পজিটিভ ফল কল্পোস্কপির ওপর অযথা চাপ তৈরি করে। তাই স্ক্রিনিং ব্যবস্থায় ‘ট্রায়াজ’ পদ্ধতি জরুরি।

ট্রায়াজের প্রথম ধাপ হলো জেনোটাইপিং। কারণ, এইচপিভি ১৬ ও ১৮ স্ট্রেন দিয়ে ৭০ শতাংশ ক্যানসার হয়। যদি কোনো নারীর ১৬ বা ১৮ পজিটিভ থাকে, তাহলে তাঁর ঝুঁকি বেশি, তাঁকে দ্রুত কল্পোস্কপি করতে হবে। বিশেষ করে ১৬ স্ট্রেন ধরা পড়লে তাৎক্ষণিক কল্পোস্কপি প্রয়োজন।

কিন্তু ১৬ ছাড়া অন্য স্ট্রেন হলে সরাসরি কল্পোস্কপি দরকার নেই। তখন দ্বিতীয় ধাপে প্যাপ টেস্ট বা ভায়া টেস্ট করা যায়। এইচপিভির জন্য নেওয়া একই নমুনা দিয়ে প্যাপ টেস্ট করা সম্ভব। প্যাপ পজিটিভ হলে কল্পোস্কপি আর নেগেটিভ হলে এক বছর পর আবার এইচপিভি টেস্ট, যাতে দেখা যায় ভাইরাস স্বাভাবিকভাবে দূর হয়েছে কি না।

কম সম্পদসম্পন্ন দেশে প্যাপের বদলে ভায়া টেস্ট কার্যকর। এইচপিভি পজিটিভ হলে ভায়ায় কোষের পরিবর্তন দেখা হয়। পরিবর্তন থাকলে কল্পোস্কপি আর রোগী হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলে ‘সি অ্যান্ড ট্রিট’, অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া যায়। ভায়া নেগেটিভ হলে এক বছর পর আবার এইচপিভি টেস্ট করা হয়। এভাবে এইচপিভি জেনোটাইপিং, প্যাপ বা ভায়া—এই তিন স্তরের ট্রায়াজ ব্যবস্থায় কল্পোস্কপির ওপর চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। আরেকটি অগ্রসর পদ্ধতি হলো ডুয়েল স্টেন। এটি ব্যয়বহুল হলেও যাঁরা সামর্থ্য রাখেন, তাঁদের জন্য কার্যকর। এটি পজিটিভ হলে সঙ্গে সঙ্গে কল্পোস্কপি আর নেগেটিভ হলে এক বছর পর পুনরায় এইচপিভি টেস্ট।

অধ্যাপক ডা. এস এস সাহিদা

ইউনিটপ্রধান, গাইনি অনকোলজি অবস ও গাইনি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

জাতীয় জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলকরণের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যানটির ২০২৩ সালে উন্নত সংস্করণ করা হয়। অক্টোবর ২০২৫ সালে এর পর্যালোচনায় বিশেষভাবে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমে ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের অংশ করা এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, অনাথ  ও কর্মজীবী মেয়েরা যেন বাদ না পড়েন, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রাইমারি টার্গেট হলো পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি অথবা ১০ থেকে ১৪ বছরের স্কুলে না–পড়ুয়া মেয়েরা। কারণ, এ বয়সী মানুষদের এইচপিভি সংক্রমণের আশঙ্কা কম। সেকেন্ডারি বা ক্যাচআপ গ্রুপ (১৫ থেকে ২৬ বছর) এ বয়সী মানুষদের যদিও ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তি এখন সহজ নয়। এদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহিত করা জরুরি। ২৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের জন্য গাইনি–বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রয়োজন।

বর্তমানে যেহেতু দেশেই ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে। এর মূল্য কমানো এবং ডোজ নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে দুই ডোজের কার্যকারিতার ওপর বিএমইউ ও জাতীর ক্যানসার গবেষণা  ইনস্টিটিউটে এ দুটি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরেকটি গবেষণা চলছে।  কীভাবে আমরা সবার কাছে এটি পৌঁছে দিতে পারি সে বিষয়ে আমাদের আরও উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে।।

স্কুলের বইয়ে এই রোগের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভুল ভাবনা দূর করা। মিডিয়া ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে সচেনতা আরও জোরদার করা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে,টিকাদানের সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

অতি শিগগির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যানের চূড়ান্ত মিটিংয়ে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।  আমরা আশা করতে পারি, এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে।

ত্রপা চক্রবর্তী

হেড অব হরমোন মার্কেটিং, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি

‘২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল—আমরা কোথায়?’ প্রশ্নটি শুধু আলোচনার বিষয় নয়; এটি আমাদের দেশের লাখো নারীর নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার অঙ্গীকার।

বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যানসার নারীদের সবচেয়ে প্রতিরোধযোগ্য অথচ প্রাণঘাতী ক্যানসারগুলোর একটি। প্রতিবছর অসংখ্য নারী আক্রান্ত হচ্ছেন শুধু সচেতনতার অভাব, দেরিতে শনাক্তকরণ এবং টিকাদানের সীমিত সুযোগের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলের যে বৈশ্বিক রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেখানে তিনটি স্তম্ভ—সচেতনতা, স্ক্রিনিং এবং টিকাদান—এই লড়াইয়ের মূল ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

আমি আজ পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসির প্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই, আমরা ২০২২ সাল থেকে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে নিজেরা যুক্ত হয়েছি জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধী টিকা এইচপিভির মাধ্যমে। আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট: সচেতনতা বৃদ্ধি, সহজলভ্য টিকাদান নিশ্চিত করা এবং মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। এ লক্ষ্যে আমরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজ, করপোরেট অফিস, গার্মেন্টস সেক্টরসহ নানা স্তরের নারীদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে সচেতনতা ও টিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। শহর হোক কিংবা গ্রাম—সব পরিবেশেই নিরাপদ ও সুরক্ষিত একটি ভ্যাকসিনেটেড জনগোষ্ঠী তৈরি করতে আমরা কাজ করছি এবং ভবিষ্যতেও আরও জোরদারভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি রাখছি।

তবে সামনে এখনো অনেক পথ বাকি। টিকাদানের আওতা আরও বিস্তৃত করা, কিশোরী মেয়েদের লক্ষ্যভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্ক্রিনিং–সুবিধাকে আরও সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য করা—এসব বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যেই বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। কারণ, বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়েরই অধিকার—একটি নিরাপদ, সুস্থ ও ক্যানসার-ঝুঁকিমুক্ত ভবিষ্যৎ।

আমরা যদি সবাই মিলে দায়িত্ব নিই, ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূল—এটি শুধু সম্ভাবনা নয়, এটি নিশ্চিতভাবে অর্জনযোগ্য। এটাই নারীর সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি—এটাই আমাদের আগামী প্রজন্মের সুস্থ ভবিষ্যতের ভিত্তি।

সভাপতির বক্তব্য

অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম

প্রেসিডেন্ট,

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালে ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্মূলের লক্ষ্য স্থির করেছে। আমাদের দেশে এখনো লক্ষ্য পূর্ণ হয়নি। আজকের আলোচনা মূলত সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে আমরা কোথায় আছি, তা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে।

জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের শনাক্তকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা ১৪-১৫ বছর বয়সে বিয়ে হচ্ছে, ১৬-১৭ বছরের আগে মা হচ্ছে। এই অল্প বয়সী বিয়ে ও প্রেগন্যান্সি ঝুঁকি বাড়ায়। তাই জরায়ুমুখের ক্যানসার বিষয়ে পাবলিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।

টিকাদান গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। ২০২৩ সালে সরকার ১০-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের জন্য বিনা মূল্যে এক ডোজ এইচপিভি টিকা প্রদান শুরু করেছে। এটি দেশের বিভিন্ন স্কুল এবং স্কুলে না থাকা মেয়েদের মধ্যে কার্যকরভাবে বিতরণ করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত হওয়ায় টিকাদান আরও সহজ ও সুলভ হয়েছে। প্রাইমারি টার্গেট ১৪ বছর পর্যন্ত এবং ১৫-২৬ বছর বয়সী ক্যাচআপ গ্রুপের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ঝুঁকিপূর্ণ বেশি বয়সী নারীদের জন্য স্ক্রিনিং–সুবিধা সীমিত। সমাধান হিসেবে স্কুলে টিকাদানের সময় তাদের মায়েদের সচেতন করা এবং গর্ভাবস্থার সময় প্রেগন্যান্টদের এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট করানো। এই পরীক্ষা একটু ব্যয়বহুল হলেও ইচ্ছে করলেই তা সাধারণের হাতের নাগালে আনা যায়। কোভিড সময় ব্যবহৃত পিসিআর মেশিন ও সরকারি সহায়তায় সহজলভ্য করা সম্ভব।

টিকা ও স্ক্রিনিংয়ের সঙ্গে জনসচেতনতা অপরিহার্য। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়া প্রচার, টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিয়মিত বার্তা প্রচার করতে হবে। সহজ বার্তা, যেমন ‘তুমি যদি মারা যাও, বাচ্চার ভবিষ্যৎ কী হবে’, নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে কার্যকর।

ওজিএসবি ও অন্যান্য পেশাজীবী সংস্থা ধাপে ধাপে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। সরকারি–বেসরকারি অংশীদারদের সমন্বয়ে এবং মিডিয়ার সহায়তায় প্রচার ও কার্যক্রম চালিয়ে গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরকে সচেতন ও সক্রিয় করা হলে নারীদের জীবন রক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব।

সুপারিশ:

  • ঝুঁকিপূর্ণ মহিলাদের শনাক্তকরণ নিশ্চিত করা।

  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও ভুল ধারণা দূর করা।

  • ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের লক্ষ্যভিত্তিক এইচপিভি টিকাদান করা।

  • ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সী মহিলাদের উচ্চসংবেদনশীল এইচপিভি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা।

  • স্ক্রিনিংয়ে ‘ট্রায়াজ’ পদ্ধতি ব্যবহার করে কল্পোস্কপির চাপ কমানো।

  • সামাজিক ও মিডিয়ার মাধ্যমে নিয়মিত সচেতনতা প্রচার করা।

অংশগ্রহণকারী

অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম

প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

 

অধ্যাপক ডা. মুসাররাত সুলতানা

মহাসচিব, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

 

অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম

সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)

 

অধ্যাপক ডা. ফারহাত হোসেন

প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ

 

অধ্যাপক ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

বিভাগীয় প্রধান, গাইনি অনকোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)

অধ্যাপক ডা. রেহানা পারভীন

সিনিয়র কনসালট্যান্ট, গাইনি অনকোলজি বিভাগ, স্কয়ার হাসপাতাল এনআইসিআরএইচ

 

অধ্যাপক ডা. রোকেয়া আনোয়ার

বিভাগীয় প্রধান, গাইনি অনকোলজি বিভাগ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল-এনআইসিআরএইচ

 

অধ্যাপক ডা. এস এম সাহিদা

বিভাগীয় প্রধান,

গাইনি অনকোলজি ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

 

ডা. মির্জা মো. আসাদুজ্জামান

কনসালট্যান্ট, গাইনি অনকোলজি ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

 

ত্রপা চক্রবর্তী

হেড অব হরমোন মার্কেটিং

পপুলার ফার্মসিউটিক্যালস পিএলসি

 

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো