পোশাকশিল্প শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

গত ১৫ নভেম্বর প্রথম আলোর আয়োজনে ‘পোশাকশিল্প শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আলো কার্যালয়ে। এতে সহযোগিতা করে গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া), বিএমটি, দ্য ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), আইসিডিডিআরবি এবং ওয়েলকাম।

অংশগ্রহণকারী

মো. মুজিবুল হক এমপি

চেয়ারপারসন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

শহিদুল্লাহ আজিম

সহসভাপতি, বিজিএমইএ

মোহাম্মদ হাতেম

নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ

চায়না রহমান

সভাপতি, ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার

এ কে এম মাসুম উল আলম

প্রোগ্রাম অফিসার, আরএমজি ii, আইএলও

তানিয়া হক

অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার

অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

ফাহমিদা তোফায়েল

বিজ্ঞানী, পুষ্টি ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগ, আইসিডিডিআরবি

মো. হাফিজুর রহমান

চেয়ারপারসন, অকুপেশনাল সেফটি, আইইবি

নাফিজুর রহমান

সাসটেইনেবিলিটি সেক্রেটারি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট

ফাহিম নওরোজ তন্ময়

সহযোগী প্রধান প্রকৌশলী, বিএমটি এবং অ্যাডজান্ট রিসার্চ ফেলো, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া

জিন পলুটিকফ

অধ্যাপক, ক্লাইমেট সায়েন্স, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি

অলি জে

হিট অ্যান্ড হেলথ, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি

এরন ব্যাক

পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি

ফারজানা ইয়াসমিন

পিএইচডি গবেষক, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি 

আনিসুল হক

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

ফিরোজ চৌধুরী

তৈরি পোশাকশিল্প  খাতে ৪০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করেন, যার বেশির ভাগই নারী। রপ্তানি আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ আসে এই খাত থেকে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এই খাত মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এই খাতের শ্রমিকদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়েই মূলত আজকের গোলটেবিল বৈঠক।

ফাহিম নওরোজ তন্ময়

অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন রিসার্চ ফ্যাসিলিটি (এনসিসিএআরএফ), বিএমটি, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি এবং বুয়েট বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প (আরএমজি) কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে অতিরিক্ত গরমের কারণে হিট স্ট্রেসের প্রভাব নিয়ে তিন বছর মেয়াদি একটি গবেষণা প্রকল্প শেষ করেছে। এ গবেষণায় সহযোগিতা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলকাম। 

আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এই পরিবর্তনের কারণে যদি পোশাকশ্রমিকদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নিরাপত্তা এবং কর্মক্ষমতায় কোনো প্রভাব পড়ে, তবে দেশের জন্য তা হবে বড় একটি ক্ষতি। তাই এই গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তন ও পোশাকশিল্পকে একত্র করে দেখা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাব হলো ‘হিট স্ট্রেস’। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বছরে দু-তিন মাস অত্যধিক গরম পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০ থেকে ২৫ বছর পর বছরে পাঁচ থেকে সাত মাস অত্যধিক গরম পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে সময় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই, এমন কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের শারীরিক অবস্থা ও কর্মক্ষমতায় কী প্রভাব পড়বে, তা আমরা এই গবেষণায় বোঝার চেষ্টা করেছি। অস্ট্রেলিয়া থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে আমার ৪ সহকর্মী গবেষণার সারমর্ম তুলে ধরবেন।

  জিন পলুটিকফ

বাংলাদেশে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই, এমন পোশাক কারখানায় কাজ করা শ্রমিকেরা অত্যাধিক গরমে অতিষ্ঠ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতিরিক্ত গরমে একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া হলো কাজের গতি কমে যাওয়া, যা মজুরি ও উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবমতে, বাংলাদেশের উত্পাদন খাত হিট স্ট্রেস ও তাপীয় অস্বস্তির কারণে বর্তমানে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কর্মঘণ্টা হারায়, যা ২০৩০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে (আইএলও, ২০১৯)। যদি পোশাক কারখানাগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভবিষ্যতে এয়ার কন্ডিশনের ওপর বেশি নির্ভর করে, তাহলে এটি বাংলাদেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনকে আরও বাড়িয়ে দেবে; কারণ, বাংলাদেশের  বিদ্যুৎ প্রায় একচেটিয়াভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন হয়।

অলি জে

আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ না বাড়িয়ে কীভাবে প্যাসিভ কুলিং কৌশল ব্যবহার করে ভবিষ্যতে কারখানাগুলোকে ঠান্ডা রাখা যায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয় এমন একটি কারখানার কম্পিউটারভিত্তিক মডেল নির্মাণ করে গবেষণা দলটি তিনটি প্যাসিভ কুলিং কৌশল নিয়ে কাজ করেছে। এগুলো হচ্ছে সবুজ ছাদ (গ্রিন রুফ), প্রতিফলক ছাদ (হোয়াইট রুফ), ছায়াযুক্ত ছাদ।  
এতে দেখা গেছে যে গরম মাসগুলোতে এই কৌশল তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি কমিয়ে দেয়। তিনটি কৌশলের মধ্যে ছায়াযুক্ত ছাদ সর্বোত্তম কার্যকর দেখা গেছে। কম্পিউটার মডেলে দেখা গেছে যে তিনটি কৌশলই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই এমন কারখানাগুলোতে তাপমাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু এই কৌশলগুলো যথেষ্ট হবে না। খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এই কৌশলগুলোর সম্ভাব্যতা বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।

এরন ব্যাক 

পুরো কারখানা ভবনের তাপমাত্রা হ্রাসের পাশাপাশি আমরা আরও জানতে চেষ্টা করেছি যে শ্রমিকদের স্কেলে কী ধরনের কৌশল অবলম্বন করলে অতিরিক্ত গরমের খারাপ শারীরিক প্রভাবগুলো মোকাবিলা করা যায়।  
১৮ মাস ধরে ঢাকায় একটি অংশগ্রহণকারী দল এই কাজটি করেছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই, এমন পোশাক কারখানায় বিতরণ করা ৬৫টি সেন্সর দিয়ে সংগৃহীত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ডেটা ব্যবহার করে, শ্রমিকেরা যেসব থেকে গুরুতর অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তা চিহ্নিত করা হয়েছে (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৩৮% আপেক্ষিক আর্দ্রতা)। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপ ও স্বাস্থ্য গবেষণা ইনকিউবেটরে আমাদের গবেষণা দল, তারপর একটি অত্যাধুনিক জলবায়ু চেম্বারে এই কারখানার অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত পরিস্থিতি পুনরায় তৈরি করেছে এবং সেই পরিবেশে স্বেচ্ছাসেবকদের ইস্তিরি করা ও সেলাইয়ের মতো কাজগুলো করতে দেওয়া হয়েছে।  তারপর স্বেচ্ছাসেবকেরা জলবায়ু চেম্বারে তিন ঘণ্টা সময় ধরে ছয়টি পৃথক ভাগে এই কাজগুলো সম্পাদন করেন, প্রতিবার তাপনিয়ন্ত্রণ কৌশলগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয় যে কৌশলগুলো কতটা কার্যকরী (অর্থাৎ কৌশলগুলো শ্রমিকের শরীরের তাপমাত্রা, ডিহাইড্রেশন, রক্ত বজায় রাখার জন্য হৃৎপিণ্ডের কাজ করার পরিমাণ কতটা কমিয়ে দেয়)। যে কৌশলগুলো এখানে পরীক্ষা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ব্যক্তিগত ফ্যান, হাইড্রেশন (ঘন ঘন পানি খাওয়া), সবুজ ছাদের (গ্রিন রুফ) মাধ্যমে কারখানার তাপমাত্রা হ্রাস এবং এগুলোর বিভিন্ন কম্বিনেশন। এই কৌশলগুলো একটি সবচেয়ে খারাপ কেস পরিস্থিতি (কারখানার বর্তমান অবস্থা) এবং একটি সেরা কেস পরিস্থিতির (এয়ারকন্ডিশনিং কারখানা) সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানগুলো ইঙ্গিত করে যে ঘন ঘন পানি পান করার সুযোগের সঙ্গে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করা কর্মীদের হিট স্ট্রেস এবং অস্বস্তি কমানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।
গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখা গেছে যে পানি পান করার জন্য বিরতি নিলেও শ্রমিকদের ইস্তিরি ও সেলাই করার পরিমাণে কোনো সামগ্রিক হ্রাস লক্ষ করা যায়নি। কারণ, শারীরিকভাবে হিট স্ট্রেস ও অস্বস্তি অনুভব না করার কারণে, ইস্তিরি ও সেলাইকাজের পরিমাণ ভালো দেখা গেছে, যদিও তাঁরা ঘন ঘন পানি পানের বিরতি নিয়েছিলেন।

  ফারজানা ইয়াসমিন

তাপ-স্বাস্থ্য-উৎপাদনশীলতার সমস্যাগুলো পোশাককর্মী, কারখানা ব্যবস্থাপক এবং অন্য সেক্টর স্টেকহোল্ডারদের দৃষ্টি থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। কারখানায় কাজ করা চিকিৎসকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য–উপাত্ত ও শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার থেকে দেখা গেছে, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে দিনের মাঝামাঝি সময়ে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, ক্লান্তি ও বমি বমি ভাবের মতো উপসর্গগুলো দেখা যায়, যা উৎপাদনশীলতার ওপর একটি নীতিবাচক প্রভাব ফেলে। গ্রীষ্মে উচ্চ অনুপস্থিতির হারও লক্ষ করা গেছে। 

এ কে এম মাসুম উল আলম

অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ আমাদের মোট কর্মঘণ্টার ২ শতাংশ কমে যাবে, সেই সঙ্গে কর্মক্ষমতা কমে যাবে ৫ শতাংশ। পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এমনিতেই পিছিয়ে আছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াটা মূলত পেশাগত একটি বিপত্তি। এই বিপত্তি শনাক্ত করতে যে গবেষণাটি হয়েছে, তা অবশ্যই ভবিষ্যতে আলোচনার দাবি রাখে।

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যদি তাকাই, আমাদের একটি স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক নীতিমালা আছে। এ ছাড়া পরিবেশ ও কারখানাসংক্রান্ত নীতিমালাও রয়েছে। ওই নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার তাপমাত্রা বিষয়টি কীভাবে সেগুলোতে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যত্যয় থাকে, তবে সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা দরকার। 

কারখানাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকা, পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকা—এ ধরনের ছোট ছোট অনেক বিষয়ও সেখানে আছে। গবেষণায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলোর সঙ্গে আইনি বিষয়গুলোকে সমন্বয় করতে হবে। বিজেএমইএ, বিকেএমইএ কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে। প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের কথাও চিন্তা করতে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে শ্রমিকদের আচরণে কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয় নিয়েও কাজ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আইএলও কাজ করছে। প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের পাশাপাশি স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও এই গবেষণা কাজ করতে পারে। সর্বোপরি শ্রমিকদের সমন্বয় করে কীভাবে কাজ করা যায়, সে ব্যাপারে সরকার, মালিকপক্ষসহ সবাই কাজ করতে পারে।

চায়না রহমান

জলবায়ুর পরিবর্তন, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার—সবকিছুই একসূত্রে গাঁথা। যেকোনো সমস্যায় প্রথম আঘাতটাই পড়ে শ্রমিকের ওপরে। আমরা কোথায় আছি এবং কোন জায়গায় যাব—এই বিষয়গুলো বুঝতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একজন শ্রমিকের জায়গা থেকে চিন্তা করতে হবে। খুব ভালো কারখানায় যারা কাজ করেন, তাঁরা বড় একটি সময় এসিতে থেকে কাজ করেন। ওখান থেকে বের হলেই আবার ভিন্ন পরিবেশে থাকতে হয়। শ্রমিকদের আবাসনের যে জায়গাগুলো আছে, সেটি নিয়েও কাজ শুরু করা দরকার। 

নারীর ক্ষমতায়নের কথা হচ্ছে। পোশাক খাতে কেন নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর কয়েক মাস ধরে আমি দিয়ে যাচ্ছি। এর অনেক কারণের মধ্যে গরমও একটি কারণ। অত্যধিক গরমের ফলে তাঁরা দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। দক্ষতা হারিয়ে ফেলছেন।  ফলে অনেকে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

ভবন নির্মাণে নিরাপত্তাসহ অনেক বিষয়ে কথা হয়, কিন্তু স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এখনো তেমন নজর দেওয়া হয়নি। সব শ্রমিকের কথা চিন্তা করতে হবে। কেবল পুরস্কারপ্রাপ্ত কারখানা বা উন্নত কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের নিয়ে কথা বললে হবে না। সব ধরনের শ্রমিকের কথা চিন্তা করতে আমি মালিকদের অনুরোধ করব।

মো. হাফিজুর রহমান

গবেষণার ক্ষেত্রে কোন জায়গা থেকে নমুনা বা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সে বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যদি শুধু ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়, এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে ঢাকার পরিবেশের সঙ্গে ঢাকার বাইরের পরিবেশের অবশ্যই পার্থক্য আছে। আরও একটি বিষয় হলো, মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার ভেতরে আগামী তিন থেকে চার বছরে একটি বড় পরিবর্তন আসবে। এখন গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত বাস আসে এবং যানজটে পড়ে একই জায়গায় বিষাক্ত ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেট্রোরেল বিদ্যুতে চলে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে ক্ষতির পরিমাণ নেই বললেই চলে।

আমি আশা করি, আগামী পাঁচ বছরে ঢাকা শহরে যে পরিবর্তন আসবে, তাতে বর্তমানে যে হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে না–ও বাড়তে পারে। পোশাকশিল্পের বলয় যদি বৃদ্ধি করতে চাই, তবে বাংলাদেশের সেসব অঞ্চলকে বেছে নিতে হবে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সেভাবে এখনো পড়েনি। এখন বিভিন্ন পোশাক কারখানায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য নানান ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কার্বন নির্গমনের বিষয়েও যত্নবান হতে বলা হচ্ছে। এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

নাফিজুর রহমান

স্থপতিদের পেশাটাই এমন যে পরিবেশবান্ধব টেকসই ভবন কীভাবে নকশা করতে হয়, তা আমাদের শেখানো হয়। একজন স্থপতিকে দিয়ে ভবনের নকশা করানো হলে, সে ক্ষেত্রে সমস্যা থাকার কথা নয়। বিদ্যুতের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দুইভাবে করা যায়। প্রথমত, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম দিয়ে। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত নকশা করার মধ্য দিয়ে। এর মাধ্যমে বিদ্যুতের চাহিদা কমানো যায়। তাই পোশাক কারখানার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই স্থপতিদের সঙ্গে কাজ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ স্থাপত্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে। 

জ্ঞান ভাগাভাগি করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক উদ্যাক্তা ভালো নকশা করার কথা ভাবেন। হয়তো যথাযথ পেশাদার ব্যক্তির কাছে যেতে পারেন না। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তির বিষয়টি এখন পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা বেশ কয়েকটি কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এখন মালিকেরা নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। কারণ, এতে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই লাভ হচ্ছে।

ফাহমিদা তোফায়েল

পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের বেশির ভাগই দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসছেন। তাঁদের আয় বাড়ছে ঠিক, কিন্তু স্বাস্থ্যগত সচেতনতা তাঁদের নেই। তাঁরা নিজেদের খাওয়াদাওয়া, অপুষ্টিসহ প্রভৃতি বিষয়কে অবহেলা করেন। যে কারণে তাঁরা অপুষ্টিতে ভোগেন। তাঁদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতা, পেশির ব্যথা, মাথা ঘোরানো প্রভৃতি পরিচিত রোগ। এসব কিছুর সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। 

পোশাক কারখানায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা নারীদের সমস্যা নিয়ে অনেক গবেষণা ও কাজ হয়েছে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত বিষয় নিয়ে কোনো কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটি খুবই বড় একটি সমস্যা। খেয়াল করে দেখবেন, পোশাক খাতে নারী শ্রমিকেরা ১৪–১৫ বছর বয়স থেকে কাজ শুরু করেন। খুব বেশি হলে ৩০–৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা কাজ করতে পারেন। এর পরে কোনো না কোনোভাবে তারা কর্মক্ষমতা হারিয়ে বসেন। ফলস্বরূপ তাঁরা সমাজে একধরনের বোঝায় পরিণত হন। সাধারণ বিনিয়োগ দিয়েই তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি কমানো যায়। সামনে কিন্তু এ সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। তাই এটি নিয়ে কাজ করা জরুরি। এতে আমাদের ঝুঁকি কমবে। পাশাপাশি কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

তানিয়া হক

বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এমন একটি বিশেষ খাত, যেখানে ৮০ শতাংশ নারী যুক্ত আছেন, যদিও অন্য সব খাত মিলিয়ে দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের এই হার ৩৬ শতাংশের মতো। নারীরা দুই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। একটি হলো শ্রমিক হিসেবে, অন্যটি নারী হিসেবে। জলবায়ু পরিবর্তন তাঁদের এই চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও কঠিন করে তুলছে।

কর্মপরিবেশ নিয়ে চিন্তা তো আছেই, পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছানোর বিষয়টি নিয়ে আমি আরও বেশি চিন্তিত। যাতায়াতের পথ নারীর জন্য যেন রণক্ষেত্র। সেখানে নারীকে বিভিন্ন উপায়ে হেনস্তার শিকার হতে হয়। নারীদের যৌন হেনস্তার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে গণপরিবহন একটি 

বিশেষ জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে হেনস্তার চাইতে মৌখিকভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনা অনেক বেশি। এসব কিছুর পর নারী যখন কারখানায় গিয়ে পৌঁছান, সেখানেও আবার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখলেও নারীদের সেভাবে গ্রাহ্য করা 

হচ্ছে না। এখানে আরও একটি বিষয় ভাবতে হবে যে নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সবাই সমগোত্রীয় নয়। এখানে বিবাহিত, অবিবাহিত, গর্ভবতী, প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন অংশ আছে। সুতরাং নীতিমালা করার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।

বিভিন্ন কারণে নারীর শরীর তাপমাত্রাসহায়ক নয়। সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শ্রমিক হিসেবে যেমন নারী কর্মক্ষমতা হারাবেন, তেমনি কারখানাও উৎপাদনক্ষমতাও হারাবে। তাই পোশাক কারখানার তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। 

আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার 

পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমি পোশাকশিল্প নিয়ে কাজ করছি। এর পুরো সময় পোশাকশিল্পে তরুণদের উপস্থিতির কথা শুনে আসছি। সে হিসেবে এখন অনেক পরিপক্ব-অভিজ্ঞ কর্মী থাকার কথা। কিন্তু অভিজ্ঞ শ্রমিকেরা আর কাজ করতে পারছেন না। অন্য একটি গবেষণা বলছে, তাদের খুব স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। এই পরিবেশে বেশি দিন কাজ করা সম্ভব হয় না।

২০১৩ সালে বুয়েটের সঙ্গে আইএলওর অর্থায়নে ভবনসংক্রান্ত নিরাপত্তা নিয়ে সব পোশাক কারখানা মূল্যায়ন করি। সে সময় যেসব কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে রানা প্লাজার মতো ঘটনা আর ঘটেনি।

বিদ্যুতের দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। ২৫ বছর আগেও দেখা যেত পোশাক কারখানাগুলোতে শত শত বাতি জ্বলছে। ২০২২ সালে এসেও দেখা যাচ্ছে, একই অবস্থা। বাতির কারণে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। মেশিনারির ক্ষেত্রে হচ্ছে ৪৫ শতাংশ। প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা থাকলে বিদ্যুৎ খরচ অনেক কমানো যেত। আমাদের কারখানাগুলোতে এখন শীতাতপনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ৭৪ শতাংশ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে মালিকপক্ষের। ফলে ব্যয় বাড়ছে। কারখানায় প্রাকৃতিকভাবে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা রেখে ভবনের নকশা করতে হবে। 

  মোহাম্মদ হাতেম

কেবল কারখানার ভেতরের পরিবেশ ভালো করলে বা তাপমাত্রা কমালেই কি শ্রমিকের জীবন ভালো হয়ে যাবে? একজন শ্রমিক কারখানার বাইরে থাকেন ১৪ ঘণ্টা। সেখানে কী হবে?

জাতিসংঘের ট্রেড সেন্টারের প্রকাশনায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও সবুজ পোশাক কারখানার দেশ বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর ডিজনিল্যান্ড ফিরে গেলেও তারা এখন আবার এসেছে। রানা প্লাজার ঘটনার পর আমাদের ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছিল। তবে ওটিই ছিল আমাদের পোশাক খাতের টার্নিং পয়েন্ট। 

আমাদের কারখানার কর্মপরিবেশ এখন অনেক ভালো। পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। আমরা পরামর্শ চাই যে কী করে কারখানাগুলোকে আরও ভালো করা যায়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের পর্যাপ্ত গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। এ সংকটের মধ্যেও আমাদের যে রপ্তানি হচ্ছে, তা সন্তোষজনক। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমরা বিদেশি ক্রেতাদের না করার মতো অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। কারণ, চীন ও ভিয়েতনামে সমস্যা ছিল, যা ছিল আমাদের জন্য সম্ভাবনার।

আমাদের এখন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কাজের ঘাটতি আছে। আমাদের যেসব অর্ডার আছে, তা–ও সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে পারছি না। কিছু ক্রেতা শিপমেন্ট নিলেও মূল্য পরিশোধ করছে না। আবার পণ্য প্রস্তুত হলেও শিপমেন্ট নিচ্ছে না। ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব শিডিউল ছিল, ক্রেতারা তা আরও ছয় মাস পিছিয়েছে। সুতরাং আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। এরপরও আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কারখানায় শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখাতে আমরা সব পরামর্শকে স্বাগত জানাই।

  শহিদুল্লাহ আজিম

আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে বিশ্বের সেরা ১০টি কারখানার মধ্যে ৮টিই বাংলাদেশের। বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সবুজ কারখানার রেকর্ডও বাংলাদেশের। এ ছাড়া বিশ্বের ১০০টি প্লাটিনাম কারখানার ৪৯টিই বাংলাদেশের। এ কারখানাগুলো রাতারাতি তৈরি হয়নি। এ কাজগুলো আমাদের নিজেদের করতে হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছুর পরিবর্তন করেছি। অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের জরিপে বলা হয়েছে, আমাদের দেশের কারখানাগুলো ৮২ থেকে ৯৮ শতাংশ কমপ্লায়েন্স ক্যাটাগরিতে আছে।

কর্মপরিবেশে নিরাপত্তা শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিকল্প কোনো কিছু নেই। এটি করতেই হবে। এটি ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, আমাদের ব্যবসার স্বার্থেই করতে হবে। এসি ব্যবহারের পরিবর্তে প্রাকৃতিকভাবে তাপমাত্রা কমানোর বিষয়টি ভালো প্রস্তাব। এ জন্য রুফটপ বা শেডিংয়ের বিষয়গুলো করা যায়। এটি করতে খুব বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের যেসব দেশের অর্থনীতি ও জীবনমান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে অবশ্যই কর্মক্ষমতা কমে যাবে, উৎপাদনশীলতাও কমবে। আমাদের কর্মীরা ঘনঘন অসুস্থ হবে। এতে আমাদেরই ক্ষতি। তাপের বিষয়ে অবশ্যই আমরা নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করব। কারখানাকে তার স্থানে রেখেই কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, তার প্রস্তাব আমরা চাই। আমাদের কারখানার হিট স্ট্রেস ও শক্তি দক্ষতার ওপর নজর দিতে হবে। এখানে সবার যৌথভাবে কাজ করতে হবে। আমরা একা এটি বাস্তবায়ন করতে পারব না। আমাদের প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একটি যৌথ কর্মশালা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

মো. মুজিবুল হক এমপি

সারা পৃথিবীতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। আমরা ছোটবেলায় যে জলবায়ু বা পরিবেশ দেখেছি, তার পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা এ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি।

২০১৪ সালে সংকটের মুহূর্তে আমি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিই। তখন আমরা যেসব দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতাম, তাদের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে সময় আমরা কয়েকজন জার্মানির বার্লিনে ক্রেতা ও শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করি। সেখানে তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম, ফলে ক্রেতারা আবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল।

আপনারা সবাই কারখানার উন্নত পরিবেশ কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে বলেন, কিন্তু দাম কীভাবে বাড়বে, তা কেউ বলেন না। তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা লাভ করবেন কীভাবে? তাঁরা শ্রমিকদের বেতন দেবেন কোথা থেকে? কীভাবে কারখানার পরিবেশ উন্নত করবেন?

বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী এই মুহূর্তে দেশে পাঁচ কোটি মানুষ বেকার। পোশাক কারখানাগুলোতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আমাদের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে।

হিট স্ট্রেস, বিল্ডিং সেফটি শব্দগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় দীর্ঘদিনের নয়। এখন আমরা বুঝতে পারছি, বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছি। এর পরিবর্তন হচ্ছে, অচিরেই আরও হবে। হিট স্ট্রেস নিয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে, তার জন্য আমি গবেষকদের সাধুবাদ জানাই। আমি বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, এটি নিয়ে পাইলট একটি প্রকল্প করতে। একটি কারখানায় দেখা যেতে পারে, এ পদ্ধতি কাজ করছে কি না। পাশাপাশি দেখতে হবে এটি লাভজনক কি না। লাভজনক হলে মালিকেরা নিজেরাই এ পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তাঁরা নিজেদের স্বার্থেই মোকাবিলা করবেন।

আনিসুল হক

এতগুলো প্রতিষ্ঠান মিলে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম। আমরা নিশ্চয় চাইব বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে আমাদের সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেবেন এবং আমাদের মধ্যে যাঁরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা এটা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন। যাঁরা কারখানার মালিক, তাঁরা ভালো ভবন তৈরি করবেন। শ্রমিকেরা যখন বাড়ি ফিরে যাবেন, তাঁদের বাড়িতেও যেন ভালো পরিবেশ থাকে, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। আমরা আশাবাদী, সবার মিলিত উদ্যাগেই আমাদের পোশাক খাত ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানাই ধন্যবাদ জানাই।

সুপারিশ:

  • কারখানার হিট স্ট্রেস ও শক্তি দক্ষতার (এনার্জি এফিসিয়েন্ট) ওপর নজর দিতে হবে।

  • এসি ব্যবহারের পরিবর্তে প্রাকৃতিকভাবে তাপমাত্রা কমানোর বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

  • হিট স্ট্রেস নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প দ্রুত শুরু করা দরকার।

  • পোশাক কারখানার ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থপতিদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হবে।

  • নারীর শরীর তাপমাত্রা সহায়ক নয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নারী শ্রমিক যেন কর্মক্ষমতা না হারায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

  • সব কারখানায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

  • পোশাক খাতে কেন নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।

  • কারখানার বাইরে পোশাকশ্রমিকদের আবাসন নিয়েও ভাবতে হবে।

  • তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত প্রভাব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার

  • পোশাক খাতের উন্নয়নে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি।