গোলটেবিল বৈঠক
কর্মক্ষেত্রে চক্ষু পরীক্ষায় কর্মদক্ষতা বাড়ে
‘বিশ্ব দৃষ্টি দিবস: কর্মক্ষেত্রে চোখের গুরুত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে ভিশন স্প্রিং ও প্রথম আলো।
নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা যেমন দৃষ্টিশক্তিকে ভালো রাখে, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কর্মীর কর্মদক্ষতা বাড়ে। তাতে উৎপাদনও বেড়ে যায়। ফলে আর্থিক দিক থেকেও প্রতিষ্ঠানের জন্য তা লাভজনক হয়ে ওঠে। কর্মক্ষেত্রে চোখের যত্নের বিষয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
গতকাল রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভিশন স্প্রিং ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব দৃষ্টি দিবস: কর্মক্ষেত্রে চোখের গুরুত্ব’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এই মন্তব্য করেন। ১২ অক্টোবর বিশ্ব চক্ষু দিবস। দিবসটি সামনে রেখে গতকাল ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে চক্ষুবিশেষজ্ঞ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, শ্রম সংস্থার প্রতিনিধি, চক্ষু নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা, পোশাকশিল্পের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এইচ এম এনায়েত হোসেন।
সভাপতির বক্তব্যে এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, ২০২৩ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য গৃহীত কর্মসূচিতে চোখের বিষয়টি রয়েছে। গত ১০ বছরে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। চোখের সমস্যাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে আলোর সঠিক মান থাকা প্রয়োজন। যাঁরা ঝালাইয়ের কাজ করেন, করাতকলে কাজ করেন, এমন অনেক জায়গাতেই চোখের সুরক্ষায় বিশেষ ধরনের চশমা ব্যবহার করা প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না।
এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, পোশাক কারখানায় যাঁরা সূক্ষ্ম কাজ করেন, তাঁদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষার প্রয়োজন। তাঁদের চোখ ভালো থাকলে উৎপাদন বাড়বে। চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, নানা পর্যায়ের অংশীজনসহ সবার অংশগ্রহণে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আলোচনার শুরুতেই ভিশন স্প্রিংয়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মিশা মাহজাবীন মূল বিষয়টির ওপরে পাওয়ার পয়েন্ট প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিশ্ব চক্ষু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘চোখকে ভালোবাসতে হবে।’ এবার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘কর্মক্ষেত্রে চোখকে ভালোবাসুন’। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য কর্মস্থানের পরিবেশ চক্ষুবান্ধব হতে হবে। পাশাপাশি সেখানে কর্মীদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষারও ব্যবস্থা রাখতে হবে।
মিশা মাহজাবীন বলেন, ভিশন স্প্রিং ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে। এর মধ্যে ২০১৮ সাল থেকে কর্মক্ষেত্রে চক্ষু পরীক্ষা ও সুলভে চশমা বিতরণের কাজ করছে। এই পাঁচ বছরে তাঁরা ১০৫টি প্রতিষ্ঠানের পৌনে তিন লাখ কর্মীর চোখ পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের ৩০ শতাংশের চশমা প্রয়োজন হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮১ জন জীবনে প্রথমবার চশমা পেয়েছেন। চক্ষু সমস্যা নিয়ে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একত্রে কাজ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক পরিচালক ও ন্যাশনাল আইকেয়ার পলিসির (এনইসি) কনসালট্যান্ট চিকিৎসক খালেদা ইসলাম বলেন, দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে হলে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন। এ জন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। পাশাপাশি চক্ষুচিকিৎসা সেবা জনসাধারণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। কর্মক্ষেত্রে চোখের চিকিৎসার বিষয়ে কার কী ভূমিকা থাকবে, তা নির্ধারণ করে কর্মপরিকল্পনা করতে হবে।
বিজিএমইএর পরিচালক আরশাদ জামাল বলেন, তাঁর নিজের তৈরি পোশাক কারখানায় ভিশন স্প্রিংয়ের মাধ্যমে কর্মীদের চোখের পরীক্ষা ও চশমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এতে কর্মীদের উৎপাদন বেড়েছে। তবে খরচের বিষয়টিতে তিনি সরকারি অংশগ্রহণের প্রস্তাব করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি সৈয়দ মাহফুজুল হক বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চোখের চিকিৎসা নিয়ে সদস্যদেশগুলোর জন্য কর্মপরিকল্পনা করেছে। সেটি ধরে কাজ করলে সংস্থার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশের এন্টারপ্রাইজ অ্যাডভাইজার সাবেত ইসলাম বলেন, দৃষ্টিশক্তির সমস্যার ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে চোখ পরীক্ষা করে চশমা নিলেই সমাধান হয়ে যায়। এ জন্য কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে কারখানাগুলোতে কর্মীদের চোখের চিকিৎসার ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
আইএলও বাংলাদেশের কর্মসূচি কর্মকর্তা এ কে এম মাসুম-উল-আলম বলেন, সরকারের স্বাস্থ্যনীতিতে সব ধরনের চিকিৎসার মধ্যে চোখের চিকিৎসাও রয়েছে। তবে চোখের চিকিৎসা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। নীতিমালায় চক্ষু চিকিৎসার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে থাকা প্রয়োজন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্লিয়ার ভিশন কালেকটিভের (সিভিসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, চোখের অনেক সমস্যার চিকিৎসায় দ্রুত ফল পাওয়া যায়। চোখ পরীক্ষা করে চশমা নিলে মাত্র ১৫ মিনিটে দৃষ্টির সমস্যা থাকে না।
সাইটসেভার্সের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও আইএনজিও ফোরামের কো-চেয়ার অমৃতা রেজিনা রোজারিও বলেন, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে চক্ষুচিকিৎসা সেবার আওতায় আনতে হবে। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
অরবিস ইন্টারন্যাশনালের এ দেশের প্রতিনিধি ও আইএনজিও ফোরামের চেয়ারপারসন মুনির আহমেদ বলেন, শিশুদের চোখের সমস্যায় প্রথম থেকেই পরীক্ষা করালে ভবিষ্যতে তাদের সমস্যা কম হবে।
তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান শিনশিন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল সাদাত বলেন, তাঁর কর্মীদের চোখ পরীক্ষা ও চশমা দেওয়ার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পেয়েছেন। তবে ব্যাপক অগ্রগতির জন্য দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা।
লিভাই স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক স্বপন পাল বলেন, ব্র্যান্ড হিসেবে তাঁরা তাঁদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মীদের চোখ পরীক্ষা ও চশমা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। অন্য ব্র্যান্ডগুলোরও এই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
পোশাকশিল্পের দুই কর্মী ডেনিটেক্স লিমিটেডের সালমা আক্তার ও কন্টিনেন্টাল ফ্যাশনের আবদুল আজিজ জানান, তাঁদের দৃষ্টিতে সমস্যা ছিল। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হচ্ছিল না। তাঁদের কারখানায় চোখ পরীক্ষা করে চশমার ব্যবস্থা করায় তাঁরা ভালো দেখছেন এবং কাজে স্বস্তি পাচ্ছেন, নিজেদের কাজের পরিমাণও বেড়েছে।
গোলটেবিল আলোচনার সূত্রপাত করে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দীর্ঘদিন যেন ভালো দৃষ্টিশক্তির উপকারিতা ভোগ করা যায়, সে জন্য চোখের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।
গোলটেবিল আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।