কপ ২৮: অভিজ্ঞতা, ফলাফল ও ভবিষ্যৎ করণীয়

প্যানেল আলোচক

অধ্যাপক আইনুন নিশাত

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন

সহ–উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মির্জা শওকত আলী

পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন), পরিবেশ অধিদপ্তর

শামীম হায়দার পাটোয়ারী

সাবেক সংসদ সদস্য

গওহার নঈম ওয়ারা

লেখক ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক

ড. মোহাম্মদ ইমরান হাসান

হেড অব ক্লাইমেট জাস্টিস অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস  রাইটস, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ

ইলিরা দেওয়ান

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেনস ফেডারেশন

মো. শামছুদ্দোহা

প্রধান নির্বাহী, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

জান্নাতুল মাওয়া

নির্বাহী পরিচালক, বিন্দু  নারী উন্নয়ন সংগঠন (সাতক্ষীরা)

মো. রাজু আহমেদ

ক্লাইমেট অ্যাডভোকেট

শরীফ জামিল

সদস্য সচিব, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)

বিভূতি সিকদার

সহকারী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

অধ্যাপক আইনুন নিশাত

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

কপ–এর মতো আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তুতি নিতে হয়। এসব অনুষ্ঠানে যাঁরা যান, তাঁরা কি নিজেদের না বাংলাদেশের মতামত দেন, সেটা একটা প্রশ্ন।

আমার বিবেচনায় কপ ২৮–এর অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না। কপ ২৮–এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ খাতে ৭৯২ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন হয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল মাত্র ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। সালিমুল হক বলে গেছেন, অ্যাডাপটেশনের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ নেই। অ্যাডাপটেশনের সঙ্গে প্যারালালি লস অ্যান্ড ড্যামেজ আসবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ হলো দুর্যোগের পর পুনর্বাসনের প্রস্তুতি। অ্যাডাপটেশন হচ্ছে দুর্যোগ আসার আগের প্রস্তুতি।

আমি অক্সফামের কথা গুরুত্বের সঙ্গে শুনি। অক্সফামের বেনিটো মুলারের লেখা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য দিকনির্দেশনার কাজ করে। সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি লিখেছেন, কপের গ্রামার বদলানো দরকার।

কপ ২৮–এ ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ গেছে। সাইড ইভেন্টের কোনো মূল্য নেই। এখানে অন্য দেশের কেউ থাকে না। যারা আলোচনা করে, তারাই শোনে।

বাংলাদেশ সরকার একটা পজিশন পেপার তৈরি করে। সেখানে আমার নিজেরও অংশগ্রহণ থাকে। নাগরিক সমাজ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সরকারের অ্যাজেন্ডায় আনতে বাধ্য করতে পারে।

ফ্রান্স সরকার ১ বিলিয়ন ডলার দেবে। এটা কীভাবে খরচ হবে, সে বিষয়ে এখন থেকে কথা বলা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কি না, এখনো সেই প্রশ্ন ওঠে। ২০০৮ সালে রাজা দেবাশীষ রায় জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য আমাদের নিয়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জুনে সভা হবে। অক্টোবরে এর অ্যাজেন্ডা বের হবে। অ্যাজেন্ডা ধরে যদি জলবায়ু সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে পারেন, তাহলে এটা কাজে আসবে।

আগামী কপ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসূ করতে হলে অভিযোজন, সক্ষমতা, প্রযুক্তি, ক্ষতিপূরণ, পর্যবেক্ষণের মতো আটটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।  কপ–২৯ এর প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা দরকার।

অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন

সহ–উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

কপ-১৩ সম্মেলনে প্রথম লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয় আসে। তখন থেকে বলতে বলতে কপ-২৮–এ সেটা সামনে এসেছে। আমরা অনেক বছর তহবিলের কথা বলে আসছি। কপ-২৮–এর পর থেকে সেটা আলোর মুখ দেখছে।

পড়াশোনা ও গবেষণা থেকে যেটা জানতে পারি, জলবায়ু পরিবর্তনের জরুরি বিষয় হলো অ্যাডাপটেশন। বাংলাদেশের জন্য এটা বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। যাঁরা কপ সম্মেলনে যাবেন, তাঁরা একটু ইতিহাস জেনে যাবেন।

বাংলাদেশে বন্যা হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেউলিয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না, আবার কার্বন নিঃসরণের জন্য আমরা দায়ী না। কার্বন নিঃসরণের জন্য যারা দায়ী, তাদের কাছে গিয়ে বললে তারা হয়তো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাববে।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আলাদা করে দেখতে হবে। আমরা নিজেরা পাহাড় কাটছি, বন ধ্বংস করছি, নদী ভরাট করছি। এসব তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, সেটা কি করছি?

টেকসই এনার্জি বলতে আমাদের সূর্য ছাড়া তো আর কিছু নেই। সূর্যের শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার কী করতে পারি, সেটা ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা তহবিলের জন্য আবেদন করতে পারি। খরাপ্রবণ এলাকায় বৃষ্টি ছাড়া পানির আর কী বিকল্প উৎস আছে, সেটা ব্যবহারের জন্য তহবিল চাইতে হবে।

লস অ্যান্ড ড্যামেজের ক্ষেত্রে আমরা অর্থনৈতিক ক্ষতি দেখতে পাই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, সেখানে মানবাধিকার রক্ষা হচ্ছে কি না, তাদের সমতা নিশ্চিত হচ্ছে কি না, সেটা দেখতে হবে।

অভিযোজন কৌশলগুলো আরও কত ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। পরিবেশ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যদি লস অ্যান্ড ড্যামেজ, অভিযোজন কৌশলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়।

মির্জা শওকত আলী

পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন), পরিবেশ অধিদপ্তর

মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা কী হবে এবং আমরা কী করছি—এ দুটো বিষয়ে কথা বলব। আমরা কী করছি, সেটা আলোচনা করা প্রয়োজন। ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ে আমরা কাজ করছি। কারণ, আমরা জানি যে মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির ফলেই আমরা বিভিন্ন দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি। অনেকেই আরও তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করেছেন।

আমরা এখন কাজ করছি কীভাবে কার্বন নিঃসরণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ, ২০৩৫ সালে ৬০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা যায়। এ জন্য আমরা জাপানের সঙ্গে কাজ করছি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সঙ্গে মডেলিং করছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঠিক করেছে কত সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনবে। ২০৭০ সালে ভারত, ২০৬০ সালে চীন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে।

বিশ্বের ৫৪টি উন্নত দেশ ন্যাপ প্রণয়ন করেছে। যদিও সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়া উচিত। আগামী ২২ থেকে ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে ন্যাপেক্সপো হবে। এটা হবে আমাদের অভিযোজন কার্যক্রমের স্বীকৃতি। এখানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলবেন, তাঁরা কীভাবে ন্যাপের বাস্তবায়ন করবেন। ন্যাপ বাস্তবায়নের চ্যলেঞ্জও আলোচনায় আসবে। আমরাও আমাদের কার্যক্রম তুলে ধরব। সবুজ জলবায়ু তহবিল, অভিযোজন তহবিলসহ বিভিন্ন তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখানে আলোচনা হবে। বিশ্ব ব্যাংকসহ নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠানও থাকবে।

আমাদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। অভিযোজনের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা। কয়েকটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত আমরা কিছু কাজ করব। আগামী দুই বছরের মধ্যে বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করব।

ন্যাপ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের ২৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কপ থেকে আমরা তেমন বড় তহবিল হয়তো পাইনি।  কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান ভালো। আমরা ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার সমান অর্থ পেয়েছি। ন্যাপ বাস্তবায়নে আমরা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ফ্রেঞ্চ ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেশন এজেন্সি ও আইএমএফের সঙ্গে কাজ করছি। এ মুহূর্তে আমরা দুটো প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকার কাজ করছি।

কপ সম্মেলনে যাওয়ার আগে প্রতিবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে পজিশন পেপার তৈরি করি। আমার জানি যে আমাদের কী করতে হবে এবং আমরা সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী

সাবেক সংসদ সদস্য

আমি তিনটি কপে গিয়েছি। প্রতিটিতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ হয়। কয়েক হাজার সাইড ইভেন্ট হয়। সেখানে আমদের ভূমিকা খুব কম। কিন্তু আমাদের মতো ২০ থেকে ২৫টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে তথ্য–উপাত্ত উপস্থাপনের দায়িত্ব আমাদের বেশি। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু বিপর্যয়–সংক্রান্ত কোনো গবেষণা কেন্দ্র আছে কি না, আমি জানি না। যদি না থাকে, তাহলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনজিওগুলো এটা করতে পারে। বছরব্যাপী সমন্বিতভাবে তাদের কাজ করা দরকার।

গ্লাসগোয় যে কপ হয়েছে তিন মাস আগে রোমেই সিদ্ধান্ত হয়েছে সেখানে কী হবে। আগামী কপ হবে অক্টোবরে। এর কয়েক মাস আগেই এর কাজ শেষ হবে। সে জন্য আমাদের কতটা প্রস্তুতি আছে?

আরেকটা হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ‘এইড ল’-এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। লস অ্যান্ড ড্যামেজের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। ধনী দেশগুলো টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু না দিলে কিছুই করার নেই। আমার মনে হয়, একটা বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার।

জলবায়ু বিপর্যয় রোধে আমদের সক্ষমতা আছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের টাকা দিলে সেটি যে ভালোভাবে খরচ করতে পারব, তেমন আরও সক্ষমতা দেখাতে হবে।

দুবাই কপে  বাংলাদেশের কোনো আইনজীবীকে দেখিনি। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন দেশের আইনজীবীদের নিয়ে আইনবিষয়ক সম্মেলন হয়। জলবায়ুর বিষয়ে প্রতি মন্ত্রণালয়ে একজন ফোকাল পয়েন্ট থাকা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী একজন আন্তর্জাতিক নেতা। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তিনি এই চাপ নিতে পারবেন বলে আশা করি। কারা কপে যাবে, কে কোন বিষয়ে কথা বলবে—এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের হয়ে কারা নেগোশিয়েট করবে। তারা মধ্যস্থতার জন্য কতটা দক্ষ, এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। পেশাদার মধ্যস্থতাকারী তৈরি করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে মন্ত্রণালয় যদি বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারকে নিয়ে আলোচনায় বসে, তাহলে জলবায়ু সম্মেলনের ব্যাপক প্রস্তুতি হবে বলে আশা করি।

ড. মোহাম্মদ ইমরান হাসান

হেড অব ক্লাইমেট জাস্টিস অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস  রাইটস, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনের প্রায় তিন দশকের যে প্রচেষ্টা, কপ ২৮–এর উদ্বোধনের দিনে সে তহবিল ঘোষণা ছিল ঐতিহাসিক ও আশাব্যঞ্জক। তবে এ তহবিলে অনুদান ছিল ঐচ্ছিক। উন্নয়নশীল দেশকেও অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং উন্নত দেশগুলোর নামমাত্র অনুদান ছিল হতাশাব্যঞ্জক। যেখানে বিভিন্ন গবেষণায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের প্রভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলার, তার বিপরীতে উন্নত দেশগুলোর সমন্বিত অনুদান ৭৯২ মিলিয়ন ডলার নিছক কৌতুকমাত্র।

জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে ‘গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপটেশন’ পরিকল্পনা গৃহীত হওয়া একটা ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু ধনী দেশগুলোর এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিপরীতে অর্থ প্রদান এড়িয়ে যাওয়া ছিল বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ, সিভিল সোসাইটি ও জলবায়ু কর্মীদের জন্য চরম হতাশার। উপরন্তু, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কর্মপরিকল্পনার UNFCCC মূলনীতি, 'Common but Different Responsibility and Respective Capabilities'–কে স্বল্পোন্নত দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলেও উন্নত দেশগুলো তা এড়িয়ে গিয়েছে।

জীবাশ্ম জ্বালানির অবলুপ্তিকরণ জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের একটি অনন্য দাবি, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য অপরিহার্য। এক দশকের বেশি সময়জুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিপূর্ণ অবলুপ্তিকরণ জলবায়ু কর্মীদের প্রাণের দাবি হলেও বিগত কপগুলোতে উল্লেখ করার মতো কিছুই ছিল না। এদিক থেকে কপ ২৮ অন্তত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে, যা কিছুটা ইতিবাচক বৈকি। এই অঙ্গীকার নবায়নযোগ্য শক্তিকে তিন গুণ বর্ধিত করা, কার্যকরিতা দ্বিগুণ বর্ধিত করার বিষয়ে প্রায় সবগুলো দেশ ঐকমতে৵ পৌঁছতে পেরেছে। তবে কপ ২৮–এর প্রেসিডেন্টের ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির অবলুপ্তিকরণের বৈজ্ঞানিক সম্পর্ককে নাকচ করে দেওয়া, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ-আউট সদিচ্ছার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে।

জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠন যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক হলেও আদতে জলবায়ু অর্থায়নের দর–কষাকষির ফলাফল স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য হতাশাজনক। প্রয়োজনের তুলনায় জলবায়ু তহবিল খুবই স্বল্প, বিশেষ করে অভিযোজনে। সর্বোপরি এবারের কপ জলবায়ু পরিবর্তনের সংজ্ঞায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বরাবরের মতো এবারের কপেও ১০০ বিলিয়ন ডলারের শর্ত পূরণ, অনুদান, ঋণের হিসাবের উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এনার্জি ট্রাঞ্জিশনের ক্ষেত্রে যদিও বা তিন গুণ নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর করার ঘোষণা এসেছে, তবে তা বাস্তবায়নে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহযোগিতার ব্যাপারে উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।

ইলিরা দেওয়ান

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন

আমি পার্বত্য এলাকা থেকে এসেছি, যেখানকার বাস্তবতা সমতল থেকে একেবারেই আলাদা। আজ আমরা কপ নিয়ে আলোচনা করছি। আমার এলাকার লোকজন জানেই না, কপ কী। তারা জানে যে প্রতিবছর খরা হয়। খাদ্য ও পানির সংকট দেখা দেয়। এটাই হলো তাদের বাস্তবতা।

অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে জনবসতি করা হচ্ছে, পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব বন্ধের জন্য তহবিলের দরকার নেই, দরকার শুধু উদ্যোগের।

আমরা বারবার বলি যে পরিবেশ রক্ষা পেলে আমরা বাঁচব। যেখানে পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে, সেখানে পরিবেশের রক্ষা কীভাবে হবে? একটা অর্থলোভী দুষ্ট চক্র এটা করছে। ইচ্ছা করলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, সেটাই প্রশ্ন। 

ইঁদুর পাহাড়ের ব্যাপক ফসল খেয়ে কৃষককে সর্বস্বান্ত করে দেয়। ‘ইঁদুরবন্যা’ শব্দটা আপনাদের কাছে অপরিচিত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর পাহাড়ে ইঁদুর বন্যা হচ্ছে। ইঁদুরবন্যা হলে খাদ্যসংকট হবে। ২০১২ সালে আমরাও প্রথমবার ইঁদুরবন্যার কথা শুনি। এসবের জন্য তহবিলের চেয়েও বেশি দরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।

সম্প্রতি প্রকাশিত ডেইলি স্টার–এ একটা ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে, পাহাড়ে একজন নারীকে কত কষ্ট করে দূর থেকে পানি আনতে হয়। পানির জন্য পাহাড়ে বাস্তুচ্যুতি হচ্ছে। এটাও আরেকটা মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে। পাহাড়ে প্রায়ই ভূমিধস হয়। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে। পাহাড়ে সাধারণত বন্যা হলে তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি থাকে না থাকে। কিন্তু গত বছর  বান্দরবানে যে ভয়াবহ বন্যা হলো, তা স্মরণকালে দেখা যায়নি। গুরুত্বের সঙ্গে এসব পরিবর্তনের বিষয় ভাবতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা

লেখক ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক

আমিরাতে হয়েছে কপ ২৮ সম্মেলন। সে দেশের ওয়েল জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাডনকের প্রধান নির্বাহী সুলতান আল জাবের ছিলেন এই সম্মেলনের সভাপতি। তাই সম্মেলন শেষে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পক্ষে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত যে আসবে না, অনেকে তা আগেই আন্দাজ করেছিলেন। হয়েছেও তা–ই। তারপরও বলতে হবে যে এবারই প্রথম জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার আহ্বান এসেছে।

আমরা সালিসে বসেছিলাম স্বাগতিক জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসায়ীদের দেশে। সিদ্ধান্ত তাঁদের মতোই হয়েছে। আপনারা হয়তো দেখেছেন যে বক্তারা নির্দিষ্ট সময়ের কতটা ব্যয় করেছেন বন্দনায় আর কতটা বলেছেন কাজের কথা। পৃথিবীর মানুষ আমাদের অভিজ্ঞতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহসী ভূমিকার কথা শুনতে চান। তাঁরা আমাদের হাত ধরতে চান। কিন্তু আমরা আত্মতুষ্টির বন্দনায় তাঁদের অনেককে হতাশ করেছি।

ভবিষ্যতে যাঁরা সম্মেলনে বাংলাদেশের কথা বলতে যাবেন, তাঁদের মধ্যে একটা সমন্বয় দরকার। আমাদের প্রতিনিধিদের কষাকষির দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দক্ষতা বাড়ানো আর সমন্বয় তৈরির কাজ বছরজুড়েই চলতে পারে। সম্মেলনের আগে যে পজিশন পেপার তৈরি হয়, এর কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সেসব বিষয় আলোচনা হতে পারে।

কপ ২৮–এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল নিয়ে এক যুগান্তকারী চুক্তি হয়েছে। স্বাগতিক আমিরাত এটাকে তাদের বিশাল অর্জন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী যেমন ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট এটাকে অপর্যাপ্ত হিসেবে সমালোচনা করেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে আমিরাতের অঙ্গীকারটি যথেষ্ট নয়, কিন্তু এই প্রথম লস অ্যান্ড ড্যামেজের স্বীকৃতি এসেছে। তবে এটার মধ্যেও একটা চালাকি আছে। দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষকে চাল না দিয়ে চালকুমড়া দিয়ে বিদায় করার নকশা এখানে থাকতে পারে। লস অ্যান্ড ড্যামেজের মুলা ঝুলিয়ে অভিযোজন তহবিল আরও সংকুচিত হয়ে যাবে না তো? ট্রিলিয়ন ডলার আশা নিয়ে যে তহবিলের সূচনা হয়েছিল, প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটা এখন মিলিয়নে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যারা টাকা দেয়, তারা খোঁজ রাখে, কীভাবে টাকা খরচ হয়। তারা যখন দেখে যে অভিযোজনের নামে ঢাকা শহরে যাত্রী ছাউনিতে টাকা ঢালছি, তখন আমাদের আহ্বানে তারা কতটুকু সাড়া দেবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।

মো. শামছুদ্দোহা

প্রধান নির্বাহী, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের অবশ্যই শূন্য কার্বন নিঃসরণের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। কিন্তু দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ ২৮–এ সে প্রত্যাশা অর্জিত হয়নি। তবে এ কপের একমাত্র ইতিবাচক দিক হলো, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ক্রমেই সরে আসা। কিন্তু এ জন্য কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের রূপরেখা কেমন হবে, সে বিষয়েও তেমন কিছু বলা হয়নি।

কপ প্রেসিডেন্ট দুবাইভিত্তিক অন্যতম বৃহৎ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। বিস্ময়কর হলো, দুবাই কপ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিলিয়ন ডলারের নতুন চুক্তি করেছেন। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতাদের এমন দ্বৈত নীতি অবশ্যই বিপর্যয় বাড়াবে।

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার তহবিল গঠনের জন্য কপ ২৭-এ রাষ্ট্রগুলো একমত হয়। এ তহবিলের অর্থের জোগান, তহবিল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও সমঝোতা দলিল তৈরির জন্য ট্রানজিশনাল কমিটি তৈরি হয়।

এ কমিটির প্রস্তাবনা অনুসারে কপ-২৮ ক্ষয়ক্ষতি তহবিল পরিচালনার নীতিমালা অনুমোদন করে। যদিও মোটা দাগে এটি একটি অর্জন, কিন্তু এটি জলবায়ু ন্যায্যতার পরিপন্থী। এ তহবিলে অর্থ প্রদানের জন্য উন্নত দেশ যারা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী, তাদের বাধ্য করা যাবে না। তারা স্বপ্রণোদিতভাবে অর্থ প্রদান করবে। উন্নত দেশের পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়, তারাও অর্থ প্রদান করবে। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য চলমান সব কার্যক্রম লস অ্যান্ড ড্যামেজ হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে প্রতীয়মান হয় যে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার জন্য নতুন ও অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া যাবে না। চলমান সব প্রকল্পে অর্থায়ন, যেমন দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাস, মানবিক সহায়তা—এসবও লস অ্যান্ড ড্যামেজ হিসেবে দেখা যাবে, যা অন্যায্য।

পৃথিবীর উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়টি ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা। ২০৪০ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপ উৎপাদন থেকে সরে আসতে হবে। নতুন কোনো কয়লা বা অন্য জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক তাপ উৎপাদনে বিনিয়োগ করা যাবে না।

জান্নাতুল মাওয়া

নির্বাহী পরিচালক, বিন্দু  নারী উন্নয়ন সংগঠন (সাতক্ষীরা)

আমি উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলা থেকে এসেছি। সেখানকার বাস্তবতা দেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। সাতক্ষীরায় গাইনি চিকিৎসকের কাছে যত রোগী আসেন, তার ৯০ শতাংশই ইউরিনের সমস্যা নিয়ে আসেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি আজ লবণাক্ত। অনেক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করতে হয়। এই পানিতে গোসল করতে হয়। এ জন্য নারীরা জরায়ু সমস্যা, চুলকানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকেরা বলেন, পুকুরের পানিতে গোসল করা যাবে না। পরিষ্কার পানিতে গোসল করতে হবে। এখন সমস্যা হলো, আমরা যেখানে খাবার পানি পাই না, সেখানে পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানিতে গোসল করা তো অনেক দূরের কথা!

নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অভিযোজন ও প্রশমনের জায়গায় তাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবার কপে ২৮–এ লস অ্যান্ড ড্যামেজের ফান্ড দেওয়া হয়েছে। সেটাকে সবাই বলছে পিনাট ফান্ড। এ ফান্ডে মানবাধিকার, জেন্ডার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও যুবাদের বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

আমাদের লস অ্যান্ড ড্যামেজ ও অ্যাডাপটেশন ফান্ডকে আলাদা করতে হবে। অ্যাডাপটেশনের ফান্ডকে লস অ্যান্ড ড্যামেজের মধ্যে আনলে হবে না। আমাদের এখনো অ্যাডাপটেশনের ফান্ড লাগবে। কোনোমতেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেন ১ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে না ওঠে, সে জন্য এলডিসি দেশগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যেতে হবে।

মো. রাজু আহমেদ

ক্লাইমেট অ্যাডভোকেট

লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের বাইরে কপ ২৮–এ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল গ্লোবাল স্টকটেক–সংক্রান্ত ঘোষণা। কপ ২৮–এর তৃতীয় দিনে কপের প্রেসিডেন্ট মন্তব্যে করেন যে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ মন্তব্যের পর এই ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে, যা আমাদের হতাশ করেছে। এ ছাড়া এ–বিষয়ক সিদ্ধান্তে আমরা এমন কিছু দেখিনি যা নতুন ও আশাব্যঞ্জক।

অভিযোজন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের বাইরে মনে করি, বাংলাদেশের জাতিসংঘের ফ্যাশন চার্টারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এবারের কপে এ–সংক্রান্ত আলোচনায় দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিকে দেখতে পাইনি।  আমাদের বৈদেশিক আয়ের প্রায় পুরোটা পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। আমরা দেখেছি যে বিভিন্ন ব্র্যান্ড বায়োফুয়েল সমাধানের সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ বিষয় চার্টারে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে যা ভবিষ্যতে আমাদের শিল্পকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। আমাদের মতো দেশের জন্য যেকোনো ত্রুটিপূর্ণ সমাধান এ ক্ষেত্রে মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

শুধু তা–ই নয়, ইউরোপে এখন যে সিএসডিডিডি অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে শিল্পের ঝুঁকি নির্ণয় করে সেসব বিষয় কপের মতো প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা এই আইনের আওতায় মানবাধিকারের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এমন সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞার জন্য বিবেচনা করা হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য কার্যকর আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রত্যাশার জন্য কপ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম বলে আমি মনে করি।

শরীফ জামিল

সদস্য সচিব, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)

শুধু বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষা করার মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য আমাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন অনেক বড় বিষয়।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমরা পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করছি। তারপরও দুবাই কপ ২৮ আমার জীবনে প্রথম। আমার অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। কপে প্রথম হিসেবে অনেক বেশি সচেতন ছিলাম। প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয়েছে, কপে দুটো পক্ষ হয়েছে। এক পক্ষ মনে করে, কপ হচ্ছে সময় নষ্ট। কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ানো। আরেক পক্ষ মনে করে, এখান থেকে স্বার্থ আদায় করতে হবে। সরকার, নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে শুরু থেকেই আমাদের ইস্যুগুলো তুলে ধরতে চেয়েছি।

কপ ২৮–এ বিশ্বের নাগরিক সমাজের জন্য আলাদা জায়গা ছিল। এখানে জলবায়ুকর্মীরা কথা বলেছেন। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ফিরে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের খাল-বিল, নদী–নালা, বন রক্ষা করতে হবে। প্রশমনের ওপর জোর দিতে হবে। জলবায়ুর প্রভাবে অনেক মানুষ বিপর্যস্ত। তাদের জন্য অভিযোজনের ওপর জোর দিতে হবে। আবার আমাদের মতো দেশ যারা প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন, তাদের লস অ্যান্ড ড্যামেজের দাবি তুলতে হবে।

আমাদের দেশের মানুষ পরিবেশ ও জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আমাদের জেলেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যে জেলে ২০০ মণ মাছ পেতেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তিনি এখন ২০ মণ মাছ পান। তাঁর জীবনের হুমকি আমরা এখান থেকে বুঝব না। কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। লবণ চাষ হারিয়ে যাচ্ছে। লবণের জমি শিল্পের জন্য দেওয়া হচ্ছে।

জলবায়ু সম্মেলনে যাওয়ার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে কীভাবে দর–কষাকষি করব। আমাদের প্রচলিত দর–কষাকষি কতটা ফলপ্রসূ হবে, সেটা ভাবতে হবে। আমাদের তথ্য যেন বিজ্ঞানভিত্তিক হয়, সেদিকে জোর দিতে হবে। কোনো একটা বিশেষ ক্ষেত্রে জোর দিলে হবে না। আমাদের মিটিগেশন, অ্যাডাপেটশন এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ—এই তিন জায়গায় সমানভাবে কাজ করতে হবে।

বিভূতি সিকদার

বিভূতি সিকদার

সহকারী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ ২৮–এর অন্যতম প্রধান ফলাফল ছিল প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অনুসরণ। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর প্রথম গ্লোবাল স্টক টেক করা। কপ ২৮–এ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ বিষয়ে স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে আর্থিক অনুদান ও প্রণোদনা দেওয়ার সম্মতি দেওয়া হয়। সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

বৈশ্বিক জলবায়ু সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান খুবই নগণ্য। জলবায়ুসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্তের প্রমাণের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদনকে সর্বাত্মকভাবে বর্জন করে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। তাই আমাদের ক্ষেত্রে কীভাবে এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব। কারণ, এটা আমাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশের অর্থনীতির গতি, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রাখার অন্তরায়। বাংলাদেশের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি কীভাবে হবে, তার বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে জলবায়ুবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, জ্বালানিবিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন গবেষক ও সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্ষতিপূরণ, কার্যকর অভিযোজন ও সহনশীলতার পাশাপাশি প্রশমনের ব্যাপারেও আমাদের ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে আইপিসিসি থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা মেনে প্রয়োজনীয় আর্থিক পদ্ধতি ও কৌশল, জলবায়ুপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে সরকারকে খুব দূরদর্শী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও যথার্থ বাস্তবায়নের বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।

গোলটেবিলে আরো অংশ নেন:

ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশের ক্লাইমেট অ্যাকশনের প্রধান কাজী এমদাদুল হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) ক্যাম্পেইন অ্যান্ড পলিসির সমন্বয়কারী বারিশ হাসান চৌধুরী, শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (এসডিএস) নির্বাহী পরিচালক রাবেয়া বেগম, ফ্রেন্ডশিপের ডেপুটি ডিরেক্টর তানজিনা শারমিন, কোডেকের ক্লাইমেট জাস্টিস উইংয়ের প্রধান হাসিবুর রহমান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ তারেক মাহমুদ, জনস্বাস্থ্য গবেষক জাহিদ হোসাইন খান ও ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সোহানুর রহমান।

সুপারিশ

  • জলবায়ু অভিযোজনের (অ্যাডাপটেশন) ১০০ বিলিয়ন তহবিল, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল আলাদা হতে হবে এবং পূর্বঘোষিত প্রতিশ্রুত অর্থ নতুন তবহিলে প্রদানের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি বন্ধ করতে হবে।

  • নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা এবং কার্যকর প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে।

  • বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ন্ত্রিত রাখতে দেশগুলোকে উচ্চাভিলাষী জাতীয়ভাবে নির্ধারিত প্রতিশ্রুতি (NDC)  গ্রহণ করতে হবে।

  • নতুন তহবিল গঠন, তহবিলের অর্থ প্রদানে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি, তহবিল থেকে অর্থ প্রাপ্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

  • বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নের ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।