সংস্কৃতিক্ষেত্রে কি আমরা পরাজিত হচ্ছি

প্রথম আলোর আয়োজনে ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে কি আমরা পরাজিত হচ্ছি’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৪ জুন ২০২২। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

প্রথম আলোর আয়োজনে ‘সংস্কৃতিক্ষেত্রে কি আমরা পরাজিত হচ্ছি’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৪ জুন ২০২২
ছবি: প্রথম আলো

অংশগ্রহণকারী

রামেন্দু মজুমদার

নাট্য সংগঠক, সাবেক সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট

শাহরিয়ার কবির

লেখক ও সাংবাদিক

আবুল মোমেন

লেখক ও সাংবাদিক

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

শিক্ষাবিদ ও লেখক

সৈয়দ জামিল আহমেদ

নাট্য সংগঠক; অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইলিয়াস কাঞ্চন

সভাপতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি

লুভা নাহিদ চৌধুরী

সংগীতশিল্পী; মহাপরিচালক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।

গোলাম কুদ্দুছ

সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

মিলন কান্তি দে

সভাপতি, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ

জহিরুল ইসলাম

সভাপতি, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম

সামিনা লুৎফা

নাট্যকর্মী; শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্চালনা

সাজ্জাদ শরিফ

ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

সাজ্জাদ শরিফ

মার্চ মাসে এক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতির প্রসার তো ঘটেইনি, বরং মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। বাঙালির যে কৃষ্টি, ঐতিহ্য, লোকজ সাহিত্য-সংস্কৃতি, পুঁথি পড়া—এগুলো কোনো কিছুই নেই। এতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর জন্য পোয়াবারো হয়েছে। তাদের কাজ চলছে।’ পয়লা বৈশাখে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মামুনুর রশীদ বললেন, ‘এতে আমাদেরও দায় আছে।’ এ ঘটনার পরম্পরা আছে।

২০১৭ সালে আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, রাষ্ট্র ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমাদের সংস্কৃতিচর্চা মূলত নগর ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। বৃহত্তর সাধারণ মানুষের কাছে এটিকে নিয়ে যেতে পারিনি।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সংস্কৃতিচর্চা এখন জনমুখী না হয়ে সরকারমুখী হয়ে পড়েছে। এর চেতনা এখন প্রতিবাদের নয়, আপসের। ফলে সংস্কৃতিচর্চা মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আজকের আলোচনায় আমরা বুঝতে চাই, আমরা কি সংস্কৃতিক্ষেত্রে পরাজিত হচ্ছি? পাকিস্তান আমলে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন মুক্তিকামী রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিল, তার আজ এ অবস্থা কেন, সেটা আমরা বুঝতে চাই। এই রুদ্ধ দশা থেকে সংস্কৃতির মুক্তি কীভাবে ঘটতে পারে, সেটাও আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা পরাজিত হইনি, তবে পিছু হটেছি। হারানো ভূমি ফিরে পাওয়ার সুযোগ আছে। এটাই আমাদের বড় কাজ। কথা শুরু করার আগে তিনটি বিষয় মনে রাখা দরকার। প্রথমত, সংস্কৃতি বলতে আমরা কী ‍বুঝি? একে অনেক সময় আমরা চারুকলাচর্চার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি। রেমন্ড উইলিয়ামস বলেছিলেন, সংস্কৃতি কিছু মূল্যবোধ তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, সাহিত্য–শিল্পের রেখে যাওয়া দলিলের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিকে অনুধাবনের একটা কাঠামো তৈরি হয়। তৃতীয়ত, সংস্কৃতি হলো আমাদের প্রতিদিনের কাজের যোগফল। দৈনন্দিন সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে, এর বাঁকবদল হচ্ছে। সেটাকে আমরা আমলে নিচ্ছি না। সংস্কৃতি এখন দেখার বস্তু হয়ে উঠেছে। এক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক দ্য সোসাইটি অব দ্য স্পেক্টেকল নামে ১৯৬৭ সালে একটি বই লিখেছিলেন। আমরা সেই চমকের পৃথিবীতে প্রবেশ করছি।

আমাদের সংস্কৃতিও এখন প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সংস্কৃতির বড় অংশ দৃশ্যমাধ্যমে পর্যবসিত হয়েছে। সবই দ্রুত প্রযুক্তির আওতায় চলে আসবে। গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে এটি বিরাট পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। প্রযুক্তি আর বাজার অর্থনীতি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এভাবে আমরা যা তৈরি করি, তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও হতে থাকে। সংস্কৃতি মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। সংস্কৃতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলে এর শক্তি হরিয়ে যায়।

গ্রামে সেভাবে বিনিয়োগ হয়নি। আমরা ভেবেছি, এভাবেই চলবে। গ্রামে অনেক ক্ষেত্রে ওয়াজের মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে। এর বিপরীতে কি কোনো সংস্কৃতি আমরা দিতে পারছি?

সংস্কৃতি যেন ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করে, এমন প্রবণতা তেরি হয়েছে। এটি হয়েছে সবচেয়ে খারাপ কাজ। আমি মনে করি, সংস্কৃতি উদ্ধারের পথ শিক্ষা। শিক্ষা নিজেই একটি সংস্কৃতি। তার আলো দিয়েই সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার সম্ভব।

শাহরিয়ার কবির

শাহরিয়ার কবির

বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষ মানবতা। সারা পৃথিবীতে এর জমিন সংকুচিত হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একরকমের দক্ষিণ পন্থার উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে সেক্যুলারিজম বলতে ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র থেকে নয়, রাজনীতি থেকেও বিযুক্ত করা হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতারা দারুণ একটা কাজ করেছিলেন। প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার যে অবস্থান ছিল, এমনকি আমেরিকাতেও তা এত প্রগতিশীল ছিল না। প্রতিবেশী ভারত বা ইউরোপের কোনো সংবিধানও নয়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে সমাজ ও রাজনীতিতে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তানীকরণ শুরু হয়েছে। এখনো সেই বৃত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। সংবিধানে চার মূলনীতি ফিরে এলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে কুদরাত–এ–খুদা বা বর্তমান সরকারের শিক্ষা কমিশন—কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।

শঙ্কর দেবনাথ নামে কুমিল্লার একজন স্কুলশিক্ষক জানিয়েছেন, তাঁর গ্রামে পাঁচটি মাদ্রাসা থাকলেও কোনো স্কুল ছিল না। তিনি তাঁদের বাড়িতে একটা স্কুল করলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি মন্তব্যের একজন প্রশংসা করেছিলেন। শঙ্কর দেবনাথ তাতে লাইক দেন। এ অপরাধে তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করা হলো। ছয় মাস জেলে থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁর স্কুলটা ধ্বংস হয়ে গেছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে জামায়াতে ইসলামীর ইমাম বের হয়। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, সেখানে জামায়াতিরা কীভাবে আছে। মহাপরিচালক মাওলানা আবদুল আউয়াল বলেছিলেন, আমি মহাপরিচালক হলে কী হবে? অন্য প্রায় সব পদেই জামায়াতিরা।

এখানে পদ্মা সেতুর পর সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো মডেল মসজিদ নির্মাণ। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমামরা এটা নিয়ন্ত্রণ করবেন। এক ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা আরও ৫৬০টি ইসলামিক ফাউন্ডেশন তৈরি করছি।

জহিরুল ইসলাম

জহিরুল ইসলাম

সংস্কৃতি একেক সময়ে একেক রূপ ধারণ করে। এই রূপবদল যে সব সময়ই খারাপ, তা নয়। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যেমন বলেছিলেন, চলচ্চিত্র আসার পর শিল্পকলার একধরনের গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে। একসঙ্গে বহু মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখছে। পরস্পরের যোগাযোগ হচ্ছে। চলচ্চিত্রকে নানাভাবে পাঠ করা যায়। তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশি ব্যবহার করছে, পড়ছে কম। এখানে ভালো কনটেন্ট দিতে পারলে তারা উপকৃত হবে। এটা ঠিক যে যেকোনো প্রযুক্তি এলে প্রথম দিকে এর অপব্যবহারের সুযোগ আছে।

আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্র তো আলাদা নয়। আমরা বলছি, আমরা সংস্কৃতিক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছি। প্রশ্ন হলো, আমরা কি রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে জয়ী হয়েছি?

যেকোনো সংস্কৃতির গোড়ার কথা হলো নতুন মানুষ গড়ে তোলা। ১৯৭০–এর দশক থেকে ইউনেসকো বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি নিয়ে দলিল তৈরি করেছে। তারা এই নতুন মানুষ তৈরির কথা বলেছিল। একাত্তরে বিজয়ের পর আমাদের ঘোষণাপত্রে ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ‍ও ‍সুবিচারের কথা। বাংলাদেশের মানুষ সেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা ‍ও ‍সুবিচারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে। সংস্কৃতির মূল কথা হলো মানবিক মর্যাদা। এমন সংস্কৃতি মানুষের কাছে নিতে হবে, যেটা মানুষের মানবিক মর্যাদাকে আহত করবে না। যদি করে, তাহলে সে সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যাত হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি কি তাদের রাজনীতির জায়গায় আছে? বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে। আওয়ামী লীগ কি তার আগের রাজনীতির জায়গায় আছে? তারা একসময় শ্রমিক, ছাত্রসংগঠন ও বামপন্থীদের নিয়ে রাজনীতি করেছে, যেটা অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সহায়ক ছিল।

ধর্মের সঙ্গে আমরা কোনো সংলাপ তৈরি করতে পারিনি। খুব সহজেই ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে গেছি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন সংস্কৃতির ভাঙা সেতুর কথা। একজন সুফি বলেছিলেন, জ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি ক্ষমতা থেকে দূরে থাকেন; আর ক্ষমতাবানদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি জ্ঞানীদের সংস্পর্শে থাকেন।

রাজনীতিবিদেরা আগে ‍বুদ্ধিজীবীদের অনুসরণ করতেন। এখন বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিবিদদের অনুসরণ করেন। এটাই বাস্তবতা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো বাংলা ভাষা। স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও মাদ্রাসা—সব জায়গায় আমরা বাংলা চালু করতে পারিনি। এভাবেই আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে।

সৈয়দ জামিল আহমেদ

সৈয়দ জামিল আহমেদ

‘সংস্কৃতি’ বলতে আমি মূলত আচার–আচরণ, বিশ্বাস, শিল্প-সাহিত্যের কথা বলছি। ‘পরাজয়’ শব্দের তিনটি অর্থ আছে—লজ্জা, অধীনতা ও পরাভূত হওয়া। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নয়া উদারতাবাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শের কথা কীভাবে বলবেন। তিনি তাঁর ইচ্ছেমতোই পেশা বেছে নেবেন।

আমরা প্রায় সব ধরনের বিশ্বাস থেকে দূরে সরে গেছি। রাস্তা বন্ধ করে ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। আমরা কোনো যুক্তির কথা বলি না। হোলি আর্টিজানের ঘটনায় বিশেষ পোশাকে যে তরুণদের ছবি আমরা দেখেছি, তারা কারা? বিশ্বাস করুন আর না–ই করুন, তারা শেষ পর্যন্ত আমরা। কথা আরও আছে। আমরা অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা আমরা ধর্ম বুঝি না, কোরআন-হাদিস পড়ি না, সেখানে কী বলা আছে জানি না। কোন জায়গায় থেকে কথা বলতে হবে, আমাদের তা জানা নেই।

আমরা এখন সবকিছুতে আপস করছি। সব মেনে নিচ্ছি। আদি সংবিধানে আমরা আর নেই। প্রতিনিয়ত হিসাব করে দেখুন, বাংলাদেশের আদর্শ নিয়ে আমরা কখন কোথায় কথা বলি।

যেকোনো সমাজে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও পেশাভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠী থাকে। প্রত্যেকে তার প্রভাব টিকিয়ে রাখার জন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এটাই হলো সামাজিক নাট্য। বাংলাদেশের জন্মের সময়ও ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ছিল। সরকার মনে করে, ওদের চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। করলে সরকারের সমস্যা হবে। এই মানসিকতা থাকলে সংস্কৃতি টিকে থাকবে না।

ইতিহাসের পরম্পরায় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিভেদ চলতে থাকল। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই বিভেদ ক্রমাগত বেড়েছে।

নাটক, গান, সাহিত্য সমাজের মধ্যে একটা বোধ তৈরি করে; প্রশ্ন করতে শেখায়। আমরা কি প্রশ্ন তোলার মতো সমাজ তৈরি করতে পেরেছি? আমরা ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি না, রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি না, ইতিহাস–সমাজ–সংস্কৃতির নায়কদের নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি না। এসব ব্যক্তি ও বিষয়ের সংকট, দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে কি আমরা সাহিত্য, নাটক, সিনেমা করতে পারব? আমাদের নেতাদের জবাবদিহি করতে পারব? সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা কারা দেখতে চায় না? উগ্রবাদীরা দেখতে চায় না। গণজাগরণ কোথায়? এভাবেই আমরা সাংস্কৃতিক ভূমি হারাচ্ছি।

একাত্তরে আমরা যেভাবে চিন্তা করতাম, উগ্রবাদীরা এখন আনন্দে আর হাসিমুখে সেভাবে চিন্তা করে। কিন্তু জীবন পরিবর্তনশীল। আমরা যদি ঠিকঠাকভাবে কাজ করি, সংস্কৃতিতে আবার জোয়ার ফিরে আসবে। একটা সম্মতির জায়গা তৈরি করতে হবে।

গোলাম কুদ্দুছ

গোলাম কুদ্দুছ

রাষ্ট্র যদি অসাম্প্রদায়িক না হয়, তাহলে সংস্কৃতির চর্চা সম্ভব নয়। সরকার ও সরকারের বাইরে সব জায়গায় এখন সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণেরা কেন জঙ্গি, মাদকাসক্ত ও বিপন্ন হচ্ছে? এ জন্য করণীয় কী? গ্রাম–শহর সব জায়গায় সংস্কৃতিচর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একটি উপজেলায় চার থেকে পাঁচ লাখ লোক বাস করে, কিন্তু তাদের সংস্কৃতিচর্চা তদারকের জন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা নেই। এবার বাজেটে দেখলাম, প্রতি উপজেলায় মডেল মসজিদ, ছোট স্টেডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং দুটি করে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা হবে। তাহলে প্রতিটি উপজেলায় কেন একটা মিলনায়তন আর মুক্তমঞ্চ থাকবে না? শিল্পকলা কর্তকর্তা কিংবা সংগীত, নৃত্য, নাট্য ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক থাকবে না?

একসময় গ্রামে ক্লাব–সংস্কৃতি ছিল। এখন সেসবও হারিয়ে যাচ্ছে। এই ক্লাবগুলোকে সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র করা যায়। আমরা তরুণদের তেমন কিছু দিতে পারছি না, শুধু তাদের দোষ দিচ্ছি। ৮–১০ বছরের ছেলেরা পর্যন্ত অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করছে; আর গাছের আড়ালে বসে পর্নো ছবি দেখছে, মাদক নিচ্ছে, অপসংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। অন্যদিকে উগ্রবাদীরা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। তাহলে সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

অর্থের চেয়ে বড় বিষয় হলো সংস্কৃতিকর্মীদের এমন একটা পরিবেশ দিতে হবে, যেখানে তারা সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ পাবে। ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করে। অভিনয় করার মতো কয়টা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে?

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ছোট অনুদান দিয়ে কিছু হবে না, এখানে বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলে চার থেকে পাঁচ বছর পর এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হবে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হবে, প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নেবে, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে রক্ষা করবে। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য শতকোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর সামান্য কিছু অংশ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ তৈরির জন্য ব্যয় করা হলে স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গিবাদ বন্ধ হয়ে আসত। যদি পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান পাঁচটায় বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে তো জঙ্গিবাদের ধারণাকেই উৎসাহিত করা হয়। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সরকারি খরচে একটি যাত্রা প্যান্ডেলও নির্মিত হয়নি।

সামিনা লুৎফা

সামিনা লুৎফা

সংস্কৃতি বা জীবনচর্চার দুটি দিক আছে—একটি বস্তুগত, আরেকটি অবস্তুগত। এই বিশ্বায়নের যুগে যে কারও কাছ থেকে আমি বস্তুগত সংস্কৃতি গ্রহণ ও বর্জন করতে পারি। কিন্তু অবস্তুগত সংস্কৃতি—মূল্যবোধ, মানবিকতা—অত সহজে পাওয়া যায় না। একটা বড় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজকের এই বৈশ্বিক ব্যবস্থা আমাদের এই জায়গায় এনেছে। বস্তির মানুষ, কোটা সংস্কারকারীরা তাদের অধিকারের জন্য রাস্তায় নামছে। সংস্কৃতি রক্ষার জন্য আমরা কি সেটা করছি? গত তিন দশকে শহর-গ্রামের, কৃষি-শিল্পেরব্যাপক পার্থক্য হয়েছে। যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, তা আমার এমন রূপান্তর ঘটাচ্ছে, যার সঙ্গে আমার মূল্যবোধেরবিশাল ফারাক।

দেড় দশক ধরে যে সরকার আছে, এরা সুফি এবং বাউলসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমরা নদী, পরিবেশ, সুন্দরবন রক্ষা, নারী নির্যাতনসহ এসবের বিরুদ্ধে তেমন কথা বলি না। সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা যখন খুন হন, তাঁদের খুনের বিচার হতে দেখি না। এই সরকারকে তো আমরা সংস্কৃতিবান্ধব মনে করি, কিন্তু সব ক্ষেত্রে ‘জি হুজুর’, ‘জাহঁাপনা’ ধরনের প্রবণতা রয়েছে। যে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সরকারকে চাপ দেবে, তারা বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণের দিকে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন। তাঁরা সেখান থেকে শুধু অর্থই পাঠান না, সে দেশের সংস্কৃতিও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এটা নিয়ে কখনো কেউ ভাবি কি না, জানি না। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে আমরা নজর দিচ্ছি না।

আবার নজর দিলে কী হয়, সেটাও আমরা জানি। সেটা আমাদের একজন হৃদয় মণ্ডল, একজন জুলহাস বা অভিজিৎ রায় হওয়া থেকে বিরত রাখে। এভাবে একটা ভয়ের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা হয়েছে।

শিক্ষক সমাজ আর সংস্কৃতিকর্মীদের সবার আবার জেগে উঠতে হবে। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আমরা এখানে থাকব, আমাদের সন্তানেরা থাকবে—তাদের জন্য মূল্যবোধসম্পন্ন বাঙালি সংস্কৃতির একটা সুন্দর রাষ্ট্র রেখে যেতে হবে।

মিলন কান্তি দে

মিলন কান্তি দে

অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে আমি যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিল্পের অনেক উত্থান-পতন দেখেছি। আমার মনে হয়, শুধু একখণ্ড মাটির জন্য যুদ্ধ করছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, মেঘ হলো ক্ষণিকের আর সূর্য চিরদিনের; আমরা সংস্কৃতির ভূমি উদ্ধার করতে পারব, বিলম্বিত হলেও আমরা জয়ী হব—এ বিশ্বাস আমার আছে। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও নাট্যকর্মীরা একসময় ছিলেন ক্ষমতাসীন সরকারের বিপরীত পক্ষ। এখন প্রায় সবাই সুবিধা গ্রহণের দিকে যাচ্ছেন।

সাংস্কৃতিক কর্মীরা সমস্যায় আছেন। যাত্রাশিল্প তো মৃতপ্রায়। ১৮৭৬ সালের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল হয়েছে, কিন্তু ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার যাত্রাশিল্পের ওপর যে বিধিনিষেধ দিয়েছিল, সেটা এখনো রয়ে গেছে। ওই আইন দিয়ে এখনো যাত্রাশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সংস্কৃতিকর্মীদের আন্দোলনের কারণে যাত্রাশিল্পের একটা নীতিমালা তৈরি হয়েছে। যাত্রাদলগুলো নিবন্ধিত হচ্ছে, কিন্তু অনুষ্ঠান করতে পারছে না। শিল্পকলা একাডেমি যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতে পারে না। ডিসি, এসপি এবং ওসির মাধ্যমে অনুমতি নিতে হয়। বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ অনুমতি পাওয়া যায় না। আমরা চাই শিল্পকলা একাডেমি থেকে যাত্রা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হোক।

রামেন্দু মজুমদার

রামেন্দু মজুমদার

সংস্কৃতি হলো জীবনধারা। আজকের দিনে বাস্তবতা হলো, পুঁজিবাদ এই জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সঙ্গে আছে রাজনীতি ও বাজার অর্থনীতি। মুক্তিযুদ্ধের পর যে মধ্যবিত্ত সমাজ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, আজ তারা ভোগবাদী হয়ে উঠছে। বর্তমানে ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনে সংস্কৃতির ভূমিকা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাণিজ্য সবকিছুকে গ্রাস করছে। অথচ বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতির শক্তি দিয়েই আমাদের টিকে থাকতে হবে।

সরকার ভাবছে যে টিকে থাকতে হলে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস করতে হবে। আবার আমরাও শক্ত কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। প্রতিবাদ না করে বসে থাকব, সেটা তো হতে পারে না। আমরা একটা প্রশ্ন না তোলা প্রতিবাদহীন সমাজে পর্যবসিত হয়েছি।

হোলি আর্টিজানের দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের অনুরোধে আমরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে প্রস্তাবে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব ছিল। সবাই বললেন ভালো, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পাকিস্তান আমল থেকে সাম্প্রদায়িকতা এখন বহু গুণ বেড়েছে। সবাই আছে সুবিধার সন্ধানে। সমাজে শ্রদ্ধা করার মতো মানুষের বড় অভাব।

কয়েক বছর ধরে আমি শিল্পকলা একাডেমির সদস্য। এক সভায় সংস্কৃতিমন্ত্রীকে বলেছি, অনুগ্রহ করে বলুন আমাদের দায়িত্ব কী। বর্তমান মহাপরিচালক ১২ বছর ধরে আছেন। তিনি কারও কথা শোনেন না। নিজের মতো চলেন। তাঁকে দুদক ডেকে নিল। আবার সব নীরব। যাত্রাশিল্প ধ্বংস হয়েছে। তাদের অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয় না। কিছু জেলায় শিল্পকলা একাডেমি হয়েছে, কিন্তু তদারকির অভাবে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ৩০০ দল আছে। ৫০টি দলও নিয়মিত নাটক করে না।

কিছু হলেই আমরা শুধু বিপুল টাকা খরচ করে বাজি পোড়াই। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলতেন, সরকারের কাছ থেকে ২০ হাত দূরে থেকে সংস্কৃতিচর্চা করতে হয়। সরকারের কাছ থেকে সামান্য অর্থ পেয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে গেলে তো চলবে না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছু হটেছি। সে জায়গা ফিরে পেতে হলে সমবেত চেষ্টার প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। কয়েক দিন ধরে রাজধানীতে অনেক বড় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতে হবে। এরপর একে সারা দেশে নিয়ে যেতে হবে।

ইলিয়াস কাঞ্চন

ইলিয়াস কাঞ্চন

পাকিস্তান আমলে আমাদের যে শক্তি, সাহস ও উদ্দীপনা ছিল, বাংলাদেশে আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। ১৯৭৭ সালে আমি চলচ্চিত্রে এসেছি। তখন আমজাদ হোসেন বা চাষী নজরুল ইসলামদের শুধু চলচ্চিত্রের মানুষ হিসেবে দেখেছি। পরে তাঁরা হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগ, নয় বিএনপি। এই যে দলের সিল লেগে গেল, এটা সাংস্কৃতিক কর্মীদের বড় ব্যর্থতা। অধিকাংশ সাংস্কৃতিক কর্মী সরকারি সুযোগ-সুবিধার পেছনে ছুটছেন। এখন তাঁদের চিন্তার ও বলার শক্তি কমে গেছে।

জীবনচর্চা যদি সংস্কৃতি হয়, তাহলে ধর্মও কিন্তু সংস্কৃতির বাইরে নয়। ধর্ম নিয়ে যে সংঘাত তৈরি হচ্ছে, কারও জন্য তা মঙ্গল হবে না। এ নিয়ে ভাবার দরকার আছে। আমরা বলছি মৌলবাদীদের উত্থান ঘটছে। যুবসমাজকে তারা এমন কী দিচ্ছে, যা আমরা দিতে পারছি না, সেটা বোঝা দরকার। বৈশ্বিক ও প্রতিবেশীর চাপ মোকাবিলা করতে করতে আমাদের রাষ্ট্র দিশেহারা। তাঁদের কোনো ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরাও দাঁড়াতে পারছি না। তাই যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে।

পুলিশ বিভাগের সঙ্গে এক আলোচনায় আমাদের বলা হলো, নাটক–সিনেমায় নাকি তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম, মেজর সিনহার ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানালে কি সেটা মিথ্যা হবে? আমরা কি এ ঘটনা নিয়ে ছবি বানাতে পারব? আমরা পাকিস্তান আমলে জীবন থেকে নেয়া সিনেমা হলে দেখিয়েছি। এখন কি কেউ রাজনৈতিক ছবি করার সাহস দেখাতে পারবেন? সংস্কৃতিকে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে আবার জেগে উঠতে হবে।

লুভা নাহিদ চৌধুরী

লুভা নাহিদ চৌধুরী

তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আমি আশাহত নই। সবকিছুতেই তাদের ভীষণ আগ্রহ। আমরা ওদের কতটা দিতে পারছি, প্রশ্নটা সেখানে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা আমরা যেভাবে বলছি, তাতে অধিকাংশ তরুণ একে একটা ইভেন্ট মনে করছে। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ওরা বলে, মুক্তিযুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলনের কথা আমরা জানি; দুটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের ইতিহাসচর্চা খুব দুর্বল হয়ে আছে। ইতিহাসের যে অনেক পর্ব, স্তর আছে, নানাভাবে যে একে পর্যালোচনা করা যায়—তরুণেরা সেটা দেখতে পায়নি। আমাদের রাষ্ট্রও একটা বিবরণ দিয়ে বলছে, এটাই দেখো। ইতিহাসকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই।

আবার যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে, তারা এই দেশটাকে অনেক ক্ষেত্রে অনুভব করতে পারছে না, ধারণ করতে পারছে না।

আমি দেখেছি, তরুণেরা অনেক গুরুগম্ভীর আলোচনাও শুনছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর বিনোদনের মধ্যে পার্থক্যও তাদের বোঝাতে হবে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে যারা এসেছে, এ অনুষ্ঠানটির জন্য তাদের আবেগ লক্ষ করেছি। তাদের যত্ন ও মমতা দিলে তারা কাছে আসবে।

রাষ্ট্র যখন কোনো কিছুর সীমানা ঠিক করে দেয়, তখন সেটা কল্যাণকর হয় না। সাংস্কৃতিক অবকাঠামো না থাকলে কি এর চর্চা থেমে থাকবে? কই, আগে তো এমন ছিল না। মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী—তাঁদের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী চলছে। তাঁরা তো ফিল্ম, থিয়েটার, লেখালেখি—অনেক কিছুর সঙ্গে ছিলেন। আমরা একটা বৃত্তে আটকে আছি। এটা ভাঙার সময় এসেছে।

আবুল মোমেন

আবুল মোমেন

ভাষা আন্দোলন, অর্থাৎ একটি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল। এখন আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে, সংস্কৃতিতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি কি না। দেশভাগের আগেই পাকিস্তানের পক্ষে পূর্ববঙ্গে একটা ব্যাপক জাগরণ তৈরি হয়েছিল। চট্টগ্রাম সম্মেলনের প্রস্তাব ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতিচর্চা বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। আমরা আজ যেটা বলছি, চট্টগ্রাম সম্মেলনে সেটা প্রায় ৭২ বছর আগে বলা হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জেগে উঠল, তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ল। আওয়ামী মুসলিম লীগ হলো আওয়ামী লীগ। ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের উত্থান হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় এর প্রভাব দেখতে পাই।

পরে সংস্কৃতি অঙ্গনের আরও কিছু দায়িত্ব ছিল, যা সঠিকভাবে পালন করা হয়নি। ১৯৭৩ সালে এম এন লারমা প্রশ্ন করেছিলেন, সংবিধানে আমাদের স্থান কোথায়? বঙ্গবন্ধু তঁাদের বাঙালি হওয়ার কথা বললেন। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে এটা বলতে পারেন। কিন্তু একাডেমিশিয়ানরা কিছু বলেননি। ১৯২৬ সালে বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনে যাঁরা জড়িত হয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে ধর্মচর্চা করতেন। কাজী মোতাহার হোসেন কোরআন অনুবাদ করেছেন। আবুল ফজল কুরআনের বাণীহাদীসের বাণী নামে বাই লিখেছেন। এঁরা চেয়েছিলেন মুসলিম সমাজের সংস্কার। নবাববাড়ি থেকে সেই সংস্কার তঁাদের করতে দেওয়া হয়নি। পাঁচ বছর পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের এখানে ইসলামচর্চার প্রবণতা তৈরি হয়নি। এ জন্য বারবার মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আঘাত আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তচিন্তার জায়গা হতে পারত। কিন্তু সেখানে আপসকামিতা দেখছি। বিভিন্নভাবে এই মানুষগুলোর কাছে যেতে হবে। মাদ্রাসায়ও যেতে হবে। সেখানে আমাদের কাজ করতে হবে।

সাজ্জাদ শরিফ

আজকের আলোচনায় অনেক বিষয় এসেছে। প্রথমত, এখন সরকারি ছায়ায় সংস্কৃতিচর্চা চলছে। সে কারণে আমরা প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলেছি। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের চর্চা আমরা মুক্তভাবে করতে পারছি না। সার্বিক আতঙ্কের আবহাওয়ায় কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলার পরিস্থিতি নেই। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আমরা ক্রমশ হাতছাড়া হতে দিয়েছি।চতুর্থত, সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ধর্মকে আমরা বোঝার চেষ্টা না করে উপেক্ষা করেছি। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয়। এখান থেকে বেরোনোর পথগুলোও হয়তো এসব চিহ্নিত সমস্যার মধ্যেই নিহিত আছে। আমরা সবার জন্য আলোচনা উদ্বোধন করলাম। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • নাগরিক মধ্যবিত্তের বৃত্তে আটকে পড়া সংস্কৃতিচর্চাকে জনমানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

  • সংস্কৃতিচর্চাকে জনমুখী, প্রতিবাদী এবং প্রশ্নমুখর হতে হবে।

  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তম কনটেন্ট দিতে হবে।

  • প্রযুক্তির প্রভাবে সংস্কৃতির পালাবদলের ভাব বুঝতে হবে।

  • সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র চালু করতে হবে।

  • মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে আপস করে সংস্কৃতিচর্চা করা সম্ভব নয়।

  • ইতিহাস পর্যালোচনা ও চর্চা করার নির্ভয় পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

  • সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ধর্মকে নিয়ে পর্যালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।

  • সংস্কৃতির ওপর থেকে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক বাধা দূর করতে হবে।

  • সংস্কৃতিক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ করলে এক প্রত্যয়ী প্রজন্ম তৈরি হবে।