প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে বেশি বেশি আলোচনায় ভাঙবে কুসংস্কার

সংলাপে বক্তারা বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কৈশোর থেকে সঠিক তথ্য জানার সুযোগ দিতে হবে।

ইউএসএআইডি সুখীজীবন প্রকল্পের সহযোগিতায় পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘কৈশোর ও যুববান্ধব প্রজননস্বাস্থ্য সেবা: স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে করণীয়’ শীর্ষক যুব সংলাপ শেষে অতিথি ও অংশগ্রহণকারীরা। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

কিশোর–কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, তত বেশি এ নিয়ে কুসংস্কার কাটবে। এ ব্যাপারে শুধু কিশোর–কিশোরী ও যুবদের নয়, শিক্ষক, বাবা–মা ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি করার ওপর জোর দিয়েছেন যুব সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তারা। গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত যুব সংলাপে বক্তারা আরও বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কৈশোর থেকে সঠিক তথ্য জানার সুযোগ দিতে হবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রগতি ভবনে ‘ইউএসএআইডি সুখী জীবন’ প্রকল্পের সহযোগিতায় পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো যুব সংলাপের আয়োজন করে। ‘কৈশোর ও যুববান্ধব প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা’ শিরোনামে আয়োজিত যুব সংলাপের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভা।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, মাসিক ও বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো গোপন করার অভ্যাস গড়ে ওঠে কিশোর–কিশোরীদের। কারণ, বাড়িতে বাবা–মা ও স্কুলে শিক্ষকেরা এ বিষয়ে তাদের কিছু শেখাতে চান না।

অনুষ্ঠানে কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তথ্য উপস্থাপন করেন ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের কৈশোর ও যুববিশেষজ্ঞ ফাতেমা শবনম। তিনি ২০১৯ সালের তথ্য তুলে ধরে জানান, অবিবাহিত মাত্র ৩২ শতাংশ কিশোরী ও ২১ শতাংশ কিশোর সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে যায়। ৬১ শতাংশ বিবাহিত কিশোরী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নিতে ফার্মেসির ওপর নির্ভর করে। তিনি ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল ও কমিউনিটিভিত্তিক সেবা দেওয়ার তথ্য তুলে ধরে জানান, ৮০ লাখের বেশি মানুষ তাদের প্ল্যাটফর্মে প্রজননস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য দেখেছে।

যুব সংলাপে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া আখতার বলেন, কৈশোরকালীন প্রজননস্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য অভিভাবক, শিক্ষক এমনকি বিশেষজ্ঞ পর্যায়েও নেই। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিটি পর্যায়ে তথ্য পৌঁছাতে হবে। নীতিনির্ধারকদেরও এ নিয়ে সংবেদনশীল হতে হবে।

ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্পের পরিচালক ও পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের এ দেশে নিযুক্ত পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম বলেন, বাংলাদেশ এখন জনমিতিক লভ্যাংশের (নির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি) সুবিধায় আছে। তরুণ জনসংখ্যা বেশি থাকলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকে। বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বন্ধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

ইউএসএআইডির জনসংখ্যা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিভাগের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ইশরাত নায়ার বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে বহুভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এখানে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মেয়াদ শেষেও প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, তত বেশি কুসংস্কার ভাঙবে। সবকিছু পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করে উপদেশ ও করণীয় দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এখন সঠিক তথ্য ছড়াতে ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হবে।

আইপাস বাংলাদেশের এ দেশে নিযুক্ত পরিচালক সাইদ রুবায়েত বলেন, সমস্যার উৎস শনাক্ত করে কাজ না করলে সমস্যার সমাধান হবে না।

কিশোর–কিশোরীদের কাছ থেকে শুনে তাদের চাহিদা অনুসারে কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ রিয়াদ মাহমুদ। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে টিকার বিষয়টিও যুক্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, অক্টোবর মাস থেকে কিশোরীদের জরায়ুমুখের ক্যানসারের টিকা বিনা মূল্যে দেওয়া হবে।

ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি বিভাগের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, এখন কেউ কেউ মাসিক নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারেন। তবে প্রজননস্বাস্থ্য মানে শুধু মেয়েদের মাসিক নয়। কিশোরেরা তাদের শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করতে না পেরে পর্নোগ্রাফি দেখে কৌতূহল মেটায়। পর্নোগ্রাফি দেখে প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে জানা সমাজের জন্য ভয়াবহ বার্তা দেয়।

অভিনয়শিল্পী সোহানা সাবা বলেন, অনেক আধুনিক শিক্ষিত মা–বাবাও প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন না। বাবা–মাকেও সচেতন হতে হবে।

সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের দিয়ে ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে তা স্কুলে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক সদস্য সাথিরা জাকির জেসি।

সাইবার টিনসের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক শিশুশান্তি পুরস্কার বিজয়ী সাদাত রহমান জানান, প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অনলাইনে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সাইবার অপরাধের বিষয়ে সহায়তা দিতে তাঁর সংস্থা অক্টোবর মাসে ১৩২১৯ (থার্টিন টু নাইনটিন) চালু করছে।

প্লেপেন স্কুলের শিক্ষক ও সংগীতশিল্পী জয়ীতা তালুকদার বলেন, কিশোর–কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে প্রতিটি স্কুলে কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক বলেন, বন্ধুসভার নিয়মিত কাজের মধ্যে প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঋতুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শারমিন কবির, ইয়ুথ ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি হাসিনা মোস্তাফিজ ও সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান মাহমুদ, সিলেট বন্ধুসভার বন্ধু সমীর চন্দ্র বৈষ্ণব ও দীপান্বিতা সেন, ময়মনসিংহ বন্ধুসভার সভাপতি সুব্রত কুমার সিংহ, চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধু মৃত্তিকা রক্ষিত ও শিহাব জিশান এবং কিশোর আলোর দুই স্বেচ্ছাসেবক রাফিয়া আনজুম ও মোহাম্মদ উল্লাহ জাফরী।