পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের সুরক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা

৩০ মে ২০২৩ সজাগ কোয়ালিশন ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ‘পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের সুরক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

অংশগ্রহণকারী

মুজিবুল হক

এমপি: চেয়ারম্যান, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

মাহীন সুলতান

টিম লিডার, সজাগ কোয়ালিশন; সদস্য, নারীপক্ষ

শহীদউল্লাহ আজিম

সহসভাপতি, বিজিএমইএ

মোহাম্মদ হাতেম

নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ

সায়মা হক বিদিশা

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নুজহাত জাবীন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ

আফসানা চৌধুরী

ট্রেনিং অফিসার, বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম, আইএলও

আঞ্জুম নাহীদ চৌধুরী

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ

মো. আবু বকর সিদ্দিক

ব্যবস্থাপক, কমপ্লায়েন্স, ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস লি.

জলি তালুকদার

সহসভাপতি, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

মো. বরকত আলী

পরিচালক (লিগ্যাল), ব্লাস্ট 

রওশন আরা

সদস্য, নারীপক্ষ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আব্দুল কাইয়ুম

পোশাকশিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ শিল্পে লাখ লাখ নারী শ্রমিক কাজ করেন। পোশাকশিল্পের উন্নয়নে তাঁরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু নারী শ্রমিকেরা বিভিন্ন ধরনের বৈষমে্যর শিকার হন। তাঁদের যাতায়াতে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। পোশাকশিল্পের মালিকেরা যদি নারী শ্রমিকদের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন, সেটা তাঁদের জন্য সুবিধা হয়। নারী শ্রমিকের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি।  

এ জন্য প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। তাই আজকের আলোচনার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পোশাকশিল্পের নারীরা ভালো থাকলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। দিন শেষে মালিকেরা উপকৃত হবেন।

নারীরা পোশাকশিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাঁরা মনোযোগী। সময় নষ্ট করেন না। এ জন্য প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাঁদের কাজের পরিবেশ যেন ঠিক থাকে, তাঁরা হয়রানির শিকার না হন, বেতন–ভাতা ঠিকমতো পান ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এসবই আজকের আলোচনার বিষয়।

আঞ্জুম নাহীদ চৌধুরী

সজাগ কোয়ালিশন ব্লাস্ট, নারীপক্ষ ও ক্রিশ্চিয়ান এইডের সম্মিলিত উদ্যোগ।

সজাগ কোয়ালিশন ২০১৭ সাল থেকে কাজ করে আসছে। এই কোয়ালিশনের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের ওপর সহিংসতা রোধ করা। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সজাগ কোয়ালিশনের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।

 প্রথম প্রকল্প ছিল পোশাকশিল্পে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন করা ও দ্বিতীয় প্রকল্প ছিল প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার জায়গায় কাজ করা, যেন শ্রমিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত হয়। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে কারখানায় মধ্যম সারির কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে সজাগ কোয়ালিশন ও পোশাক কারখানা যৌথভাবে কাজ করেছে।

মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রকল্পভুক্ত পোশাক কারখানাগুলোতে সজাগ সাথি তৈরি করা হয় ৭০ শতাংশ নারী ও ৩০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিকদের সমন্বয়ে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সজাগ সাথিদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কারখানাগুলোতে নারী নেতৃত্ব তৈরি করে যাচ্ছে।

এ ছাড়া সজাগ কোয়ালিশন কোভিডকালীন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আইনগত অধিকার নিয়ে গবেষণা করেছে। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিভাগ। শ্রম আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য পলিসি ব্রিফের সাহাযে্য গণমাধ্যমে গবেষণার ফল শেয়ার করা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় বর্তমানে পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের ন্যায্যতাপ্রাপ্তি প্রকল্প জানুয়ারি ২০২২ সালে শুরু হয়েছে, যা শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা সরাসরি ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৩৩ জন সুবিধাভোগীর সঙ্গে কাজ করব। গাজীপুর সদর, সাভার, মির্জাপুর ও টাঙ্গাইল এলাকার ৩০টি পোশাক কারখানার ৫০ হাজার নারী শ্রমিককে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ ছাড়া  এসব এলাকার ৫ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধা পাবেন। উল্লেখ্য, প্রকল্পটি কারখানা, কমিউনিটি, ৫টি ট্রেড ইউনিয়ন এবং ৩০টি নারীপ্রধান সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে।

২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি কারখানায় যেন অভিযোগ  কমিটি গঠন করা হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি লিগ্যাল এইড ক্যাম্প, পথনাটক এবং শ্রমিক জিজ্ঞাসা অ্যাপের মাধ্যমে আইনি সহায়তাসহ শ্রমিকদের অধিকার ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

আইনি সহায়তা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম একই সঙ্গে জোরদার করার চেষ্টা করছি। তাহলে কোনো কারণে নারীরা সহিংসতার শিকার হলে দ্রুত আইনি সহায়তা পাবেন।

শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলেই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ হবে এবং পোশাকশিল্পের উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

মাহীন সুলতান

পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের ন্যায্যতাপ্রাপ্তি  প্রকল্প শুরু করার সময় আমরা কারখানা ও কমিউনিটিতে জরিপ করেছি। কর্মপরিবেশ শুধু কারখানায় নয়, তাঁরা কোথায় থাকেন, কীভাবে আসেন, কীভাবে যান—এসবও বিবেচনায় নিতে হবে। নারী শ্রমিক সম্পর্কে পরিবহন শ্রমিক ও তঁার কমিউনিটির মানুষের ধারণা কী, সেটাও আমাদের কাজের মধ্যে নিয়েছি। কারণ, নারীদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা থাকলে সেটা নারী শ্রমিকের সহিংসতার কারণ হতে পারে। 

আমাদের একটা জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, পরিবারের প্রধান হওয়া উচিত পুরুষেরা। ৫৬ শতাংশ মনে করেন, নারীর মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত পরিবারের দেখাশোনা করা। ৫৭ শতাংশ বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা গ্রহণযোগ্য। ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নারীরা পোশাকের জন্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

তবে কিছু পরিবর্তন  দেখা যাচ্ছে । কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে আমাদের সামাজিক নিয়মনীতির পরিবর্তন হচ্ছে। ৮৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, মারধর করার অধিকার পুরুষের নেই। ৯৬ শতাংশ মনে করেন, বাড়ির কাজ নারী-পুরুষ যৌথভাবে করা উচিত, এমন কথা প্রায় সবাই বলে থাকেন, কিন্তু করেন কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

৮২ শতাংশ মনে করেন, যাঁরা বাড়ির বাইরে কাজ করেন, তাঁদের হয়রানি করা উচিত নয়। ৮২ শতাংশ মনে করেন, নারীরা বাড়ির বাইরে ভালো নেতৃত্ব দিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে হয়রানি সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই। তাঁরা জানেন না কোন ধরনের কাজ হয়রানির মধ্যে পড়বে। আমাদের জরিপে ৯১ শতাংশ মনে করেন আপত্তিকর মন্তব্য, ধাক্কাধাক্কি, চিমটি দেওয়া হয়রানি। আকার-ইঙ্গিতে কিছু বলাকে হয়রানি মনে করেন ৭২ শতাংশ। ৫৪ শতাংশ গায়ে হাত দেওয়া, গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়াকে হয়রানি মনে করেন।

১৫০ জনের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মনে করেন, নারী পোশাককর্মীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সেটা কারখানায় না অন্য কোথাও, সেটা বলা হয়নি। তাঁদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এসব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের কী করা উচিত। তাঁদের ৫৪ শতাংশ মনে করেন, মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করা উচিত। ৫৭ শতাংশ মনে করেন, পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত। ৫৩ শতাংশ মনে করেন, কারখানার কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়া যায়।

৪৮ শতাংশ মনে করেন, হেল্পলাইন ব্যবহার করা যায়। ৪০ শতাংশ মনে করেন, পরিচিতজনের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। ৩০ শতাংশ মনে করেন, সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। ৯ শতাংশ মনে করেন, নারীরা নিজেরা থাপ্পড় ও ধাক্কা দিয়ে প্রতিবাদ করতে পারেন। ১০ শতাংশ মনে করেন, কিছুই করা উচিত নয়। ১৭ শতাংশ মনে করেন, ট্রেড ইউনিয়নের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।

কারখানার বাইরে কীভাবে পোশাককর্মীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, সে ক্ষেত্রেও সবাই মিলে কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সেটা ঠিক করা প্রয়োজন।

রওশন আরা

সজাগ কোয়ালিশন ২০১৭ সাল থেকে কাজ করছে। শুরু থেকেই এ সংগঠনের সঙ্গে আছি। শুরুর দিকে আমরা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কাজ করতাম। আমরা নারী শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সহিংসতা নিরসনে কাজ করেছি। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, প্রতিষ্ঠানে কোনো সমস্যা হলে এখানেই কমবেশি সমাধানের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোনো সমস্যা হলে সমাধানের তেমন ব্যবস্থা নেই।

আমার মনে হয় আজকের উপস্থাপনায় যে বিষয়গুলো এসেছে, এগুলো নিয়ে পোশাকশিল্পের কর্তৃপক্ষ, এনজিও এবং শ্রমিক সংগঠন যৌথভাবে কাজ করতে পারলে এ সমস্যা সমাধানের একটা উপায় বের হবে বলে আশা করি। পোশাকশিল্পের কর্মীরা সাধারণত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন। এ জন্য তাঁরা কোনো সমস্যার শিকার হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেরা সমাধান করতে পারেন না। কীভাবে সমাধান করতে হবে, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা জানেনও না। তাই যে প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কাজ করেন, সে প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, এনজিও, শ্রমিক  সংগঠন সবাই যদি সম্মিলিতভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে পরিবর্তন আসবে বলে আশা করি।

আমাদের নারী শ্রমিকেরা অনেক কষ্ট করে একসময় দক্ষ হচ্ছেন। কিন্তু দক্ষ হওয়ার পর অনেক সময় তাঁরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারছেন না। কারণ তাদের সন্তান এবং পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয়।

এই ব্যাপারে পোশাক কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের সন্তানের লেখাপড়া এবং অন্যান্য বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করলে পোশাকশিল্প দক্ষ শ্রমিককে আরও বেশি কাজে লাগাতে পারবে।

আফসানা চৌধুরী

প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকের হয়রানিসহ সব ধরনের অভিযোগ নিরসনের ব্যবস্থা আছে। পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি আছে। কিন্তু এ কমিটি কতটুকু কার্যকর, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। আমি আইএলওর পক্ষ থেকে বেটার ওয়ার্ক বাংলাদেশ প্রকল্পে কাজ করছি। ৪৫০টা কারখানায়  কাজ করি। আমরা মূলত নারীর অধিকার, মতপ্রকাশ ও নারী নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করি।

বেটার ওয়ার্ক থেকে যখন পরিদর্শনে যাই, তখন কারখানায় এর উপস্থিতি কমবেশি দেখতে পাই। আমরা মনে করি, নারী শ্রমিকের কথা বলা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

আমরা নারী নেতৃত্ব ও কথা বলার অধিকার নিয়ে কাজ করছি। পোশাকশিল্পে মাত্র ১০ শতাংশ নারী নেতৃত্বে আছেন। বিভিন্ন সমস্যার জন্য নারী নেতৃত্ব বাড়ছে না। কী কারণে নারী নেতৃত্ব বাড়ছে না, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুযোগ-সুবিধার গাইডলাইন আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও কাজ করার আছে। কারখানায় নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন বৈষম্য নিরসনের যে ব্যবস্থাপনা আছে, সেটাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

মো. আবু বকর সিদ্দিক

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পোশাকশিল্প ও পোশাকশ্রমিকের উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। আমাদের কারখানায় আমরা নারীবান্ধব পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। আমাদের প্রতিষ্ঠানে নারীর সমস্যা নিরসন পদ্ধতি গ্রিভেন্স পলিসি আছে। নারীরা যেন হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য কমিটি আছে। এ কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য নারী শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।

আমরা গর্ভবতী নারীর প্রতি গুরুত্ব দিই। নারী শ্রমিকেরা যেন নেতৃত্ব দিতে পারেন, সে জন্য কাজ করি। যেহেতু পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি, আমরা এটা অনুভব করেছি যে এখানে নারী নেতৃত্ব প্রয়োজন। তাহলে নারীরা আরও স্বাচ্ছন্দে্য কাজ করতে পারবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীদের কিছু চ্যালেঞ্জে রয়েছে। তাঁদের ঘরে ফেরার তাড়া থাকে। স্বামী–সন্তানকে সময় দিতে হয়। পরিবার থেকেও অনেক সময় আগ্রহ দেখা যায় না। তবে এ সমস্যা উত্তরণে আমরা কাজ করছি।

নারী শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও চিন্তা করি। পোশাকশিল্প আগের অবস্থানে নেই। এখন প্রত্যেক মালিক আশা করেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে নারীরা যেন নিরাপদে কাজ করতে পারেন, তাঁরা যেন ভালো থাকেন।

মো. বরকত আলী

নারী-পুরুষ যেকোনো শ্রমিকের ভালো থাকা, খারাপ থাকা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেটা হলো, তিনি কোথায় কাজ করেন। সেখানে কীভাবে যান। কীভাবে আসেন। কোথায় থাকেন। আমরা জানি যে অধিকাংশ শ্রমিকের থাকার জায়গা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শ্রমিকদের যাওয়া-আসার ব্যবস্থাও ভালো নয়। কারণ, তাঁরা পাবলিক যানবাহনে যাতায়াত করেন।

আমাদের দেশের পরিবহনের পরিবেশের অবস্থা সবার জানা। নারী শ্রমিক যেখানে কাজ করেন, সেখানে কতটা নিরাপদে কাজ করছেন, সেটা দেখার বিষয়। তাঁর পাশে যে পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন, তাঁর ওপর তিনি কতটা আস্থাশীল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

আইনে প্রতিটি বিষয়ের উল্লেখ আছে। আইনে নারী পোশাককর্মীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা আছে। যেমন রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত তাঁদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। তাঁদের মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের জন্য শিশুকক্ষ থাকবে। আলাদা বাথরুম থাকবে।

২০০৯ সালে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি দূর করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে। কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। উদ্যোগটা প্রশংসনীয়।

সরাসরি আইনে কোনো বিষয় না থাকলে তা বিধিমালায় যুক্ত করা হলে তা কার্যকর ভূমিকা পালন করে না। মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে আইনে আছে, গত তিন মাসের গড় বেতন পাবেন। কিন্তু বিধিমালায় আছে, গত ২৬ দিনের গড় বেতন পাবেন। এতে মালিক–শ্রমিকের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্রের উচিত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।

আবার অনেকে বলেছেন, অ্যান্টি–হ্যারাসমেন্ট কমিটি। কিন্তু উচ্চ আদালত অভিযোগ কমিটির কথা বলেছেন। সজাগ কোয়ালিশন থেকে আমরা ৩০টা কারখানায় অভিযোগ কমিটি করব। আজকের অনুষ্ঠানে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে উপস্থিত শহীদউল্লাহ আজিম ও মোহাম্মদ হাতেমকে অনুরোধ করব আপনারা যদি আপনাদের প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি করেন, তাহলে নারী শ্রমিকেরা আরও বেশি উপকৃত হবেন।

নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা জরুরি। মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করা দরকার। প্রতিষ্ঠানের পুরুষ কর্মীরা যে নারীদের জন্য ক্ষতিকর নয়, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রত্যেক নারী শ্রমিক যেন মনে করতে পারেন, তাঁর কর্মক্ষেত্র নিরাপদ ও বৈষম্যহীন।

মোহাম্মদ হাতেম

বাংলাদেশে বহু ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে পোশাকশিল্পের নারীরা সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা পাচ্ছেন। কেবল পোশাকশিল্পের নারীদের নিয়ে নয়, সব প্রতিষ্ঠানের নারী শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

বিদেশ থেকে পোশাকশিল্পের ক্রেতারা প্রতিবছর কারখানা পরিদর্শন করেন। আবার তাঁরা প্রয়োজন মনে করলে মাঝেমধ্যে পরিদর্শন করেন। আমাদের সব ঠিক আছে কি না, সেটা তাঁরা তদারক করেন।

শুধু নারী নয়, কোনো শ্রমিক তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই সুযোগ এখন আর নেই। শ্রমিকদের জন্য আমাদের বেশ কিছু কর্মসূচি আছে। পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, কর্মক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধ পানের ব্যবস্থা, ল্যাকটেটিং মায়েরা প্রতি মাসে কারখানা থেকে ৮০০ টাকা করে পান। প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে কর্মসূচি আছে।

 যৌথভাবে কাজ করার জন্য আমরা সজাগ কোয়ালিশনকে আহ্বান জানাই। আমরা চাই আমাদের কর্মক্ষেত্র আরও উন্নত হোক। ২০১৩ সালের আগে অভিযোগ সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানতাম না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে অনেক সচেতন হয়ছি।

আমাদের যদি কোথাও ঘাটতি থাকে, আমরা সেটা ঠিক করে নেব। যেসব কারখানায় আপনারা কাজ করছেন, সেখানে কোনো সমস্যা পেয়েছেন কি না, আমাদের জানান। আমাদের কাজের পরিবেশ তাঁদের থাকার জায়গা থেকে ভালো।

পোশাককর্মীরা সাধারণত কারখানার আশপাশে থাকেন। অনেকের নিজস্ব পরিবহন আছে। কেউ কেউ হয়তো দূর থেকে আসেন। আইন ও বিধিমালার মধ্যে কোনো মতবিরোধ থাকলে আইনে যেটা থাকবে, সেটা কার্যকর হবে।

মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে মাসিক মজুরির ভিত্তিতে তার প্রাপ্য নির্ধারিত হবে।

জলি তালুকদার

পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতিতে যেমন ভূমিকা রাখছেন, তেমনি তাঁরা নারীমুক্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন। অনেক সময় আলোচনায় মনে হয়, পোশাকশিল্পে কোনো সমস্যা নেই। এটা সত্যি নয়। এখানে এখনো অনেক সমস্যা আছে। সস্তা শ্রমের জন্য বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের বিকাশ হয়েছে। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিককে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম করতে হয়। যৌন হয়রানিসহ যেকোনো ধরনের হয়রানি হোক না কেন, সেটা নিয়ে তিনি ভাবতে পারেন না।

আমাদের শ্রমিকেরা যেখানে থাকেন, এর ভাড়া গুলশান, বনানী এলাকার থেকেও বেশি। এসব সমস্যা তাঁদের জন্য অনেক বড় সমস্যা। রাত বেশি হলে এখনো নারীরা একা চলতে ভয় পান। রাষ্ট্র বা পোশাকশিল্পের মালিকেরা এই নিরাপত্তা দিতে পারেননি। অনেক সময় অনেক রাতেও তাঁদের চলাচল করতে হয়।

কারখানায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি আছে। কিন্তু এসব কমিটি কাজ করে না বললেই চলে। সরকারি পর্যায়ে কিংবা এনজিওসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। কিন্তু পোশাকশিল্পের নারীদের অবস্থা কী, সেটা আপনারা জানেন।

পোশাকশিল্পে অটোমেশনের ফলে নারীদের সংখ্যা কমে আসছে। কর্মকর্তা পদে যেমন নারীরা নেই, তেমনি ট্রেড ইউনিয়নেও নারীর সংখ্যা কম। পোশাক কারখানার নারীরা তাঁর কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে এর বাইরে তিনি আর কিছু ভাবতে পারেন না। সন্ত্রাসীদের আক্রমণসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নারীরা বিশাল ভূমিকা রাখেন।

অভিযোগ বাক্স থাকলেও নারী শ্রমিকেরা সত্যিকার অর্থে কোনো অভিযোগ দেন না। তাঁরা নিজেরা সংগ্রাম করে যে ভূমিকা রাখছেন, সে কারণে পোশাকশিল্পের পরিবেশের কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

করোনার পর মালিকদের রপ্তানি বেড়েছে। সরকারের কাছ থেকে তাঁরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু আজ শ্রমিকের সন্তানেরা অর্থের অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না। কিন্তু মালিকদের বুঝতে হবে যে শ্রমিক বেঁচে থাকলে কারখানা বেঁচে থাকবে।

সায়মা হক বিদিশা

আমরা একটা গবেষণায় দেখেছি, পোশাক কারখানায় নারীর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ। অটোমেশনের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে পোশাক কারখানায় নারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পোশাক কারখানা নারীদের একটা ঠিকানা ছিল, যেখানে তাঁরা আসলেই কাজ পেয়ে যেতেন। আজ সে জায়গাটা যদি কমতে থাকে, তাহলে নারীদের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। কীভাবে পোশাক কারখানায় আবার নারীদের ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।

উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার জন্য যদি নারীদের  মজুরি কম হয়, তাহলে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যাঁরা পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁদের এটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাজেটে শ্রমিকের রেশন, ন্যূনতম মজুরি, মজুরি বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ তাঁদের অধিকারের বিষয় বিবেচনা করা উচিত। বাজেটে নারী শ্রমিকদের প্রণোদনার বিষয় থাকা প্রয়োজন।

পোশাক কারখানায় মধ্যবয়সের নারীদের রাখা হয় না বা তাঁরা চলে যান। তাঁদের যদি চলে যেতে হয়, তাহলে কারখানা তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারল না। তাঁরা নতুনদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। বিভিন্নভাবে তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে কারখানার উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারেন। কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।

কাজের ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। এ জন্য কম দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, সরকার, এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

শহীদউল্লাহ আজিম

আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল আশির দশকে। তখন একজন শ্রমিকের বেতন ছিল ৩০০ টাকা। সে সময় আমরা অনেক কিছু জানতাম না। তখন কারখানা বলতাম। এখন বলি ইন্ডাস্ট্রি। বর্তমানে আমাদের পোশাকশিল্প এমন এক অবস্থায় গিয়েছে যে বিশ্বের পোশাক ক্রেতাদের নিরাপদ জায়গা হলো বাংলাদেশ। আমরা মনে করি, যতক্ষণ নারী শ্রমিক কারখানায় থাকেন, ততক্ষণ তাঁরা সুরক্ষিত থাকেন। আমাদের অনেক জবাবদিহির মধ্যে থাকতে হয়।

রানা প্লাজা ধসের পর থেকে আমরা আজও কারখানার পরিবেশ ভালো করার কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইচ্ছা করলেই সবকিছু করতে পারি না। এখন সব কারখানাকে সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তবু প্রতিনিয়ত কারখানার পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু ট্রেড ইউনিয়নের ভুল পদক্ষপের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের অভিযোগ কমিটি, অংশগ্রহণ কমিটি, কল্যাণ কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটি আছে। সবকিছু তদারকির ব্যবস্থা আছে। আমাদের হেলথকেয়ার আছে। লাইফ ইনস্যুরেন্স চালু করেছি। তিন লাখ শ্রমিক লাইফ ইনস্যুরেন্সের আওতায় এসেছেন। এখানে শ্রমিক ও মালিক সমানভাবে বিমার টাকা প্রদান করেন। আমাদের টেলিমেডিসিন সেবার ব্যবস্থা আছে। তবে সব কারখানায় হয়তো অভিযোগ কমিটি হয়নি। এটাও সত্যি যে অভিযোগ খুব কম আসে। একজন বলেছেন, অভিযোগ বাক্স সিসিটিভির সামনে। এটা আমি অবশ্যই খোঁজ নেব। এ রকম যেন না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।

আমাদের শ্রমিকনেতাসহ প্রায় সবাই শ্রমিকের মজুরির কথা বলেন। যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে, তাতে আমরাও মনে করি, শ্রমিকদের চলতে কষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের ক্রেতারা দাম বাড়ান না, বরং তাঁরা কমানোর চেষ্টা করেন। আমাদের ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা যেমন আমাদের শ্রমিকদের মজুরির কথা বলেন, বায়ারদের কাছে কেন বলেন না। 

নুজহাত জাবীন

আলোচনায় নারী শ্রমিকের নানাবিধ সমস্যা যেমন এসেছে, তেমনি কিছু সমস্যা সমাধানের আশ্বাসও পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের কারখানার কর্মপরিবেশ আগের থেকে ভালো হয়েছে। নারী শ্রমিকেরা হয়তো আগের থেকে ভালো আছেন। কিন্তু এখনো তাঁদের নানা সমস্যা রয়েছে। প্রতিনিয়ত তাঁদের এসব সমস্যায় পড়তে হয়। পোশাক কারখানার মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এসব বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা নেবেন বলে আশা করি।

মুজিবুল হক

আমাদের ছোটবেলায়  মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটি। তারপরও খাবার ও কাপড়ের ভয়াবহ অভাব ছিল। আজ মানুষ প্রায় ১৭ কোটি। সেই অভাব নেই। আমরা যা–ই বলি না কেন, কোনো সন্দেহ নেই আমরা সামনে যাচ্ছি।

রানা প্লাজা ধসের পর এমন অবস্থা হলো যেন আমাদের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা সবাই খারাপ। ক্রেতারা কিন্তু রানা প্লাজা থেকেই কাপড় কিনেছে। তারা কম পয়সায় পেয়েছে। এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি।

একবার জার্মানিতে বিশ্বের বড় বায়ারদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, আমাদের উদ্যোক্তারা কারখানার অনেক মানোন্নয়ন করেছেন। কারখানা উন্নয়নে মালিকেরা যে পরিমাপ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, সেই তুলনায় রপ্তানি খাতে পোশাকের মূল্য  বাড়েনি।

ট্রেড ইউনিয়নের কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। ট্রেড ইউনিয়ন করলেই মালিক মনে করেন, ভাঙচুর হবে। এ জন্য ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে মালিক–শ্রমিক সবাইকে সহনশীল হতে হবে। আস্থা অর্জন করতে হবে।

শ্রম আইন সংশোধন প্রয়োজন। কারণ, একজন শ্রমিক ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পাওনার জন্য একজন উকিল রেখে মামলা চালাতে পারবেন না।  এ আইনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিক তাঁর পাওনা পান না।

কারখানার কর্মপরিবেশ ভালো থাকলে নারীর উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়ে। তাতে মালিকই উপকৃত হন। প্রতিটি কারখানায় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য একজন ইমার্জেন্সি ডাক্তার থাকা প্রয়োজন। কারখানার পাশে নারীদের খাবার থেকে শুরু করে স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যন্ত যা যা লাগে, এর সবকিছুর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

শ্রমিকদের বঞ্চিত করলে হবে না, আবার মালিক অতিরিক্ত চাপ দিলেও হবে না। সবাই যেন ভালো থাকেন, সেভাবে  সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

পোশাক খাত দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী রপ্তানি খাত। আজকের গোলটেবিল আলোচনায় অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা এসেছে। আশা করি, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। প্রথম আলো ও সজাগ কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কারখানার পরিবেশ ভালো রাখা জরুরি।

  • নারী শ্রমিকেরা যেন প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

  • ৩৫–ঊর্ধ্ব দক্ষ নারী শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। 

  • অটোমেশনের ফলে পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

  • মজুরি বৃদ্ধির জন্য নারীদের আরও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

  • জাতীয় বাজেটে নারী শ্রমিকদের প্রণোদনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

  • নারী শ্রমিকের যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের হয়রানি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

  • পোশাক কারখানার মালিকদের নারী শ্রমিকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা উচিত।

  • প্রতিটি কারখানায় বাধ্যতামূলক অভিযোগ কমিটি থাকতে হবে।

  • এমন উদ্যোগ নিতে হবে, যেন প্রত্যেক  নারী শ্রমিক মনে করেন তাঁর কর্মক্ষেত্র নিরাপদ ও বৈষম্যহীন।

  • নারী শ্রমিকেরা যেন প্রতিষ্ঠানের বাইরে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য সরকারের প্রশাসন, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং শ্রমিক সংগঠন সবার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।