পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে দরকার সচেতনতা

‘গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নয়নে নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটির ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক।

শাহ গোলাম নবী, নাজমা শাহীন, মোহাম্মদ রাজু আহমেদ, আকরাম হোসেন চৌধুরী

পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও ক্ষুধা নিবারণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। তবে সে তুলনায় পুষ্টিমান অর্জিত হয়নি। বিশেষত দরিদ্র জনসাধারণের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে খাদ্যে বৈচিত্র্য আনা, ভেজালমুক্ত রাখা ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তাঁরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সেমিনারকক্ষে ‘গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা উন্নয়নে নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটির ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই অভিমত দেন বিশেষজ্ঞরা। জার্মানভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে এবং প্রথম আলো যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

আলোচনায় সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহ গোলাম নবী বলেন, ‘আমাদের খাদ্যবিষয়ক আলোচনাগুলোতে সাধারণত খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। পেট ভরল কি না, খাবারে তৃপ্তি পাওয়া গেল কি না—এসবই বিবেচনা করা হয়। খাবারটি কতটুকু পুষ্টিকর, তা দেখা হয় না। আমাদের দেশে ভাত প্রধান খাবার। তাতে শর্করার চাহিদা মেটে। ক্ষুধা দূর হলেও পুষ্টির চাহিদা পুরোপুরি মেটে না।’ তিনি বলেন, পুষ্টির মান নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য নিয়ে সচেতন হতে হবে। সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে পুষ্টি নিয়ে কাজ করে। পুষ্টিনিরাপত্তায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে হলে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। তবে কর্মসূচি যা–ই নেওয়া হোক, তা টেকসই হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘সরকারে সহস্রাব্দ উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রধান লক্ষ্য ছিল ক্ষুধা নিবারণ। এ ক্ষেত্রে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যেই ক্ষুধার্ত জনসংখ্যার হার ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এটা উল্লেখযোগ্য অর্জন। তবে পুষ্টিমানের ক্ষেত্রে আমরা কিছু পিছিয়ে আছি। আমাদের খাদ্যে বৈচিত্র্যের অভাব রয়েছে। সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা অর্জন করতে হলে খাবারে পুষ্টির মান নিশ্চিত করতে হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্পের পরিচালক আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, পুষ্টিহীনতা সাধারণভাবে চোখে দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা পুষ্টিহীনতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। গর্ভবর্তী মায়ের এই সমস্যা থাকে। তাঁদের সন্তানদের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। পুষ্টি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের নানা উদ্যোগ রয়েছে। পুষ্টি বাগান প্রকল্প এর একটি। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এই প্রকল্পে কাজ করা হচ্ছে।

আলোচনার সূত্রপাত করে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের প্রকল্প প্রধান মামুনুর রশীদ। সংস্থাটি বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে জনসাধারণের পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ‘নিউট্রিশন স্মার্ট কমিউনিটি’ নামের প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রথম ও ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাদের দ্বিতীয় দফার প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধারণাপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদন অনুসারে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী অপুষ্টির শিকার। মায়ের পুষ্টির ঘাটতির প্রভাব শিশুদের ক্ষেত্রেও পড়ে। এতে জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে তাদের নানা সমস্যায় ভুগতে হয়।

ধারণাপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক পুষ্টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের কিছু অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও তা ধীরগতির। পুষ্টিমানের উন্নয়ন তারা চারটি অনুসরণের কৌশল ও পাঁচটি অভ্যাস চর্চার সুপারিশ করে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এসএসিপি প্রকল্পের কম্পোনেন্ট পরিচালক ও উপসচিব ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, পুষ্টির ঘাটতি নিবারণে পুষ্টি বিষয়ের জ্ঞান থাকা খুব জরুরি। এতে স্কুলপর্যায়ের শিক্ষকেরা ভূমিকা রাখতে পারেন। জনগণের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ সৃষ্টির জন্য খাদ্যমেলার আয়োজন করা যেতে পারে।

খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মহসীন আলী বলেন, সর্বস্তরের মানুষের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য অধিকার আইন থাকা প্রয়োজন। পুষ্টির জন্য অন্য খাবারের পাশাপাশি মাছ, মাংস, দুধ প্রত্যেক মানুষের পেতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে অতিদরিদ্র মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা আনন্দর চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের জন্য পুষ্টিমান নিশ্চিত করার প্রতি জোর দেন। কারণ, তাঁরা সাধারণত যে ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন, তাতে পুষ্টির ঘাটতি ব্যাপক।

সার্ক অ্যাগ্রিকালচার সেন্টারের কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ নাসরিন সুলতানা বলেন, নারীরাই পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছেন বেশি। বয়ঃসন্ধিকালের নারীদের পুষ্টিমান ঠিকঠাক না হলে সন্তান ধারণে তাঁর নিজের ও সন্তানের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড উইমেন্স স্টাডিজের অধ্যাপক তানিয়া হক তাঁর বক্তব্যে খাদ্যে পুষ্টিমান নিশ্চিত করার পাশাপাশি খাদ্যসামগ্রী ভেজাল ও দূষণমুক্ত রাখার ওপর জোর দেন।

সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও এফআইভিএডির নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জায়েদ মোহাম্মদ বলেন, সরকারের অন্যান্য কর্মসূচি যতটা গুরুত্ব পায়, পুষ্টির বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায় না। যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়, সেগুলোতেও যথাযথ নজরদারি থাকে না।

আলোচকদের মতামতের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের বাংলাদেশের পরিচালক পঙ্কজ কুমার বলেন, ক্ষুধা নিবারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের চেয়ে এগিয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষুধার হার কমলেও পুষ্টির ঘাটতি কমছে না। এটা কাটানো কঠিন। জার্মান সরকার এ ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়ে যাবে।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।