বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি

জিপিএইচ ইস্পাত-প্রথম আলোর  আয়োজনে ‘বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

জিপিএইচ ইস্পাত-প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।ছবি: প্রথম আলো

অংশগ্রহণকারী

নুরুল হুদা

সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক এবং সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)

মেহেদী আহমেদ আনসারী

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ; অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট

আকতার মাহমুদ

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

মোহাম্মদ আবু সাদেক

নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ

মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন

সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

দিলারা জাহিদ

পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আবু সাঈদ মো. মাসুদ

মেজর জেনারেল (অব.); উপদেষ্টা, জিপিএইচ ইস্পাত

মুনির হাসান

সমন্বয়ক, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্রোগ্রাম, প্রথম আলো

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

সম্প্রতি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো। এ জন্য আমাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে। ১৮৯৭ সালে আসামে একবার বড় ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েছিল। আমাদের এক আলোচনায় এসেছিল, কোনো এলাকায় বড় ভূমিকম্প হলে এর ১০০ বছরের মধ্যে আবার সেখানে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। আমরা সে আলোচনায় ভূমিকম্পের প্রস্তুতির কথা বলেছিলাম।

ভূমিকম্পের জন্য আমাদের কী প্রস্তুতি দরকার, সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়। আমাদের এখন অন্যতম কাজ হলো সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারকদের সচেতন করা। নগর-পরিকল্পনা ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় আসবে বলে আশা করি।

মেহেদী আহমেদ আনসারী

এমন একটি আলোচনার জন্য প্রথম আলো ও জিপিএইচ ইস্পাতকে ধন্যবাদ। তুরস্কের ভূমিকম্প নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। মানুষের মধ্যে আলোচনা আছে; কিন্তু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ ধরনের আলোচনা এই প্রথম। তুরস্কে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প হয়।

১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের এ অঞ্চলে পাঁচটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প সবচেয়ে বড় ছিল। এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। এক তথ্যে জানা যায়, ঢাকায় তখন ১০০ পাকা দালান ছিল। আহসান মঞ্জিলের কিছু অংশ ধ্বংস হয়েছিল। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৯০ হাজার। আয়তন ছিল ২০ বর্গকিলোমিটার। এখন ঢাকার লোকসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। রাজউকের হিসাবমতে, আয়তন ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার। ভবন প্রায় ২১ লাখ। চারতলার ওপরের ভবন ছয় লাখ।

১৮৮৫ সালে বগুড়ার শেরপুরে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। যমুনা সেতু নির্মাণের সময় এটা বিবেচনায় নেওয়া হয়। আর ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার বড় ভূমিকম্প হয়। অনেকেই বলেন, এই ভূমিকম্পের ফলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তৈরি হয়েছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে ফিরে আসে। সে হিসাবে আমাদের দেশে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫০ থেকে ৩৫০ বছর পর পর আসে। বিম ছাড়া ভবন (ফ্ল্যাটপ্লেট) ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। ২০২০ সালের ভবন নির্মাণবিধিতে বিম ছাড়া ভবন না করার কথা স্পষ্ট বলা আছে।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, তুরস্কে একজন মানুষকে উদ্ধারের পেছনে প্রায় ২ কোটি টাকার সমান অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ২০০১ সালে ভারতের গুজরাট রাজ্যের ভুজে শহরে ভূমিকম্প হয়। তখন ওই শহরে দেড় লাখ মানুষ ছিল। ভূমিকম্পে ১৫ হাজার মানুষ মারা যায়। তারপর ভারত সরকার তাদের পেশাদারদের ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পরে তারা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়েছে। আমিসহ বুয়েটের কয়েকজন সেখানে ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। গুজরাটের এ ভূমিকম্প  থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। এরপরই বুয়েটে ভূমিকম্প ইনস্টিটিউট করি। প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার প্রকৌশলী ও স্থপতি তৈরি হন। ভবন নির্মাণবিধির ওপর প্রকৌশলীদের তিন মাসব্যাপী, স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৫০টি কোম্পানির ভবন তদারকের ভালো সক্ষমতা আছে। তাদের দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। রাজউক, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ও সিটি করপোরেশন আমাদের ভবনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু দেশে প্রায় ৫০টি ভালো প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধু ভবন নির্মাণের কাজ করে থাকে। তাদের দক্ষতা অনেক বেশি। আমাদের পাশের দেশ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভবন তদারকের কাজ করছে। আমাদের দেশেও এটা করতে হবে।

রাজউক ৬ লাখ ভবনের মধ্যে মাত্র ৬০টি ভবনের অকুপেন্সি সনদ দিয়েছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ও সিটি করপোরেশন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এখনই ভবন তদারকের কাজ শুরু করতে পারে। এখানে সরকারের কোনো ব্যয় নেই। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

মোহাম্মদ আবু সাদেক

ভূমিকম্প দু‌র্যোগ ব্যবস্থাপনার দুটি ধাপ—দু‌র্যোগ–পূর্ব ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম ও দু‌র্যোগ–পরবর্তী সাড়া

প্রদান। যেকোনো দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ। দু‌র্যোগ সাড়া প্রদান কার্যক্রমে ১ টাকা খরচ করেল তা দু‌র্যোগোত্তর সাড়াদানে ১০ টাকা খরচ কমায়। যুক্তিসংগত কারণেই দু‌র্যোগ–পূর্ব ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমের ওপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।

দু‌র্যোগসংশ্লিষ্ট সরকারি নীতি ও কার্যক্রম ঝুঁকি হ্রাস সহায়ক নয়। ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমের প্রধান উপাদান হলো যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, গবেষণাভিত্তিক ভবন নির্মাণবিধি প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন।  এর কোনোটিই দৃশ‍মান নয়।

২০১০ সালের দু‌র্যোগ ব‍্যবস্থাপনা আইন দ্বারা ঝুঁকি হ্রাসবান্ধব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কারণে গবেষণাভিত্তিক ভবন নির্মাণবিধি প্রণয়নের সক্ষমতা অর্জিত হয়নি। হালনাগাদ তথ্য সন্নিবেশিত না হওয়ায় বিএনবিসি-২০২০ এখনই হালনাগাদ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া বিএনবিসি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

রাজউক ও চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ) ১৫ বছর আগের ২০০৮ সালে প্রণীত ভবন নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করছে। অন্যরা অনুসরণ করছে ১৯৯৬ সালের বিধিমালা। জাতীয় বা অন্য কোনো পর্যায়ে ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস বা সাড়াদান পরিকল্পনা আছে বলে জানা নেই। অথচ আপদভিত্তিক দু‌র্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার গুরুত্ব সর্বজনস্বীকৃত। ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণে মাটি পোড়া ইট একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ইটের তৈরি দেয়াল ভবনের ভূমিকম্পঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অথচ আমরা বেশি ভূমিকম্পসহনীয় সাশ্রয়ী কংক্রিট ব্লকের এখনো তেমন ব্যবহার করছি না। তা ছাড়া সুশাসনের অভাব এবং শ্রেণিস্বার্থ বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (িবএনবিসি) ও ড্যাপসহ অন্যান্য জনবান্ধব বিধি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করছে।

ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হলো আগাম সতর্কসংকেত কাজে লাগানো। অন্যান্য দু‌র্যোগের মতো যথেষ্ট সময় আগে সতর্কসংকেত পাওয়া না গেলেও ২০ সেকেন্ড থেকে ৬০ সেকেন্ড আগে ভূমিকম্পের সতর্কসংকেত পাওয়া যায়। এই সংকেত পাওয়ার সঙ্গে বিদ‍্যুৎ, গ্যাস বা পানির লাইন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বন্ধ করাসহ বিভিন্নভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের জানমালের নিরাপত্তাঝুঁকি হ্রাস করেছে। বাংলাদেশের জন্য এই পদ্ধতি গ্রহণ করা বিচক্ষণতার কাজ হবে। কারণ, অতি সামান্য খরচে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব।

ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দু‌র্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়ক বিষয় পাঠ‍ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ইতিমধ্যে অন্তর্ভুক্ত পাঠ‍ক্রমকে হালনাগাদ করা জরুরি।

ভূমিকম্প দু‌র্যোগ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কোনো গবেষণা হচ্ছে না বললেই চলে। পৃথিবীর উন্নত দেশে সরকার থেকে শিল্প, কলকারখানা বা বাণিজি্যক প্রতিষ্ঠান দু‌র্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বেশি সহায়তা প্রদান করে থাকে। আশা করি, আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে গবেষণা খাতে বেশি সহায়তার মাধ্যমে একটি ‘ঝুঁকি হ্রাস সংস্কৃতি’ গড়ে তুলবে।  

আকতার মাহমুদ

একজন নগর–পরিকল্পনাবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে চাই। ভূমিকম্প মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তাই পৃথিবীর যেসব দেশ ভূমিকম্প মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাদের দেশে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে আমরা ২০১০ সালে হাইতি ও চিলির ভূমিকম্পের উদাহরণ দিতে পারি। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইতিতে রিখটার স্কেলের ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। অথচ একই বছরে চিলিতে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে মাত্র ৫২৫ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। ১৯৬০ সালে চিলিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের পর তারা একটি ভালো ভবন নির্মাণবিধি তৈরি করেছিল। চিলি সরকার সেই অনুযায়ী ইমারত নির্মাণে বাধ্য করেছিল। ফলে ভূমিকম্পে তারা ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পেরেছিল। আমাদের দেশেও ভবন নির্মাণবিধি প্রণয়ন করা হলেও তার প্রয়োগ নেই। বড় শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত দালান উঠছে; অথচ ভবন নির্মাণবিধি অনুসরণ অত্যন্ত সীমিত। বিএনবিসি রেগুলেটরি অথরিটি তৈরির প্রস্তাব করা হলেও এখনো সে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

শহরে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভূমির গঠন  জেনে মাটির উপযুক্ততা অনুযায়ী ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। দুর্বল মাটির ওপর ভারী স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মাটির গঠন অনুযায়ী নগরায়ণের জন্য যথোপযুক্ত ভূমি ব্যবহার করা হলে ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকা শহরের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা ভরাট করে নগরায়ণ হয়েছে। এটা সম্ভাব্য ভূমিকম্পে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

সুষ্ঠু নগর-পরিকল্পনার মাধ্যমে নদী, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ইত্যাদি সংরক্ষণ করা সম্ভব। দুর্যোগকালে জরুরি সেবার কথা বিবেচনা করে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অগ্নিনির্বাপণকারী প্রতিষ্ঠান, বাসস্টেশন, বিমানবন্দরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে ঝুঁকিমুক্ত এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের শহরকে জরুরি মুহূর্তে সচল রাখতে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি ভূমিকম্প সহনশীল করে গড়ে তুলতে হবে।

ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে আইন না মেনে ইমারত নির্মাণ করার ব্যাপক অভিযোগ আছে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন সময় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এর কোনো আশানুরূপ ফল দেখা যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে প্রাথমিকভাবে জনসাধারণের ব্যবহার করা সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনাগুলো দ্রুত জরিপ করা উচিত। পর্যায়ক্রমে ভবনমালিকদের সহায়তায় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন দুর্বল ভবন চিহ্নিত করা যেতে পারে।

পূর্ত বিভাগ ও হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট গবেষণার মাধ্যমে দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার পদ্ধতি বের করেছে। সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে হবে। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুযায়ী রেট্রোফিট বা দৃঢ়করণ করার মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। যেসব ভবন রেট্রোফিট করার উপযোগী নয়, সেগুলো ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা যেতে পারে।

ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সিটি করপোরেশন, ফায়ার ব্রিগেড, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক—সবাইকে দুর্যোগ–পরবর্তীকালীন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

জাপান ও বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় আমরা ঢাকা শহরের একটি ওয়ার্ডে বিভিন্ন স্থাপনার ওপর জরিপ থেকে দেখেছি, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ভবনধসে ওই ওয়ার্ডের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পথ বন্ধ হয়ে যাবে। জরিপ করা হলে শহরের অন্যান্য ওয়ার্ডেও একই চিত্র দেখা যাবে।

তাই ব্যক্তিগত ভবন মালিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের ভবনের পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুযায়ী রেট্রোফিট করার ব্যবস্থা নিতে পারেন।

দিলারা জাহিদ

ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও ভূতাত্ত্বিকেরা যা বলেন, সেটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেমন ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ২০১০ সালের একটা গবেষণায় বলা হয়েছে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৫৩ শতাংশ ভবন ধ্বংস হবে। ধ্বংস হওয়া ভবন সরানোও আমাদের জন্য অনেক কঠিন হবে।

আমরা অনেক বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছি। এটা যেভাবে আলোচনায় আসে সেভাবে বিশ্বাস করি না। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে ভূমিকম্প হতে পারে। এর জন্য আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা পদ্মা সেতু ও যমুনা সেতুর মতো বড় সেতু করেছি। এখন আমাদের কাজ হলো ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নেওয়া। পরে করব বলে অপেক্ষা করা যাবে না।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো এখনই ভূমিকম্প সহনীয় করতে হবে। ধীরে চলো নীতি ভূমিকম্প দুর্যোগের ক্ষেত্রে চলবে না। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হব। কিন্তু একটা ভূমিকম্পে সব উন্নয়ন ধ্বংস হতে পারে। তুরস্ক থেকে আমাদের পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ হতে পারে। কারণ, আমরা ঘন জনবসতির দেশ। আবার জলাভূমি ভরাট করে যেনতেনভাবে ভবন করেছি। আমাদের ঝুঁকির অনেক কারণ আছে। ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে এখনই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬ থেকে ১০ মিনিট আগে যেন সতর্কসংকেত পেতে পারি, এর জন্য গবেষণা হচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক বিষয় নিয়েও গবেষণা হতে পারে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন আছে। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এটা আছে। জীবন ও জীবিকা রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। তাহলে কেন আমরা ভবন নির্মাণবিধি মানছি না, সেটা দেখতে হবে। প্রশাসনিক জায়গা থেকে আমাদের গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে।

আমাদের স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টারে সবকিছু বলা আছে যে রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে একজন প্রকৌশলীসহ সবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার কথা বলা আছে, প্রতিটা ক্ষেত্রে কীভাবে কাজ করবেন। তিন মাস পর গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা কখনো পাই না।

আমাদের কাজের সমন্বয়ের অনেক অভাব আছে। এসব বিষয় কাজ করা জরুরি। এ জন্য তহবিল ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এর জন্য আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এটা প্রাইভেট পার্টনারশিপ হতে পারে। আগে থেকে তহবিলের প্রস্তুতি থাকলে দুর্যোগের সময় সমস্যা হয় না।

স্কুল, হাসপাতালে নারী-শিশুসহ সবার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। কীভাবে একটা ভবনে হালকা দ্রব্য ব্যবহার করা যায়, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। গণমাধ্যমের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে সমন্বয়টা খুব জরুরি। ভূমিকম্পের প্রস্তুতি আমাদের এখনই নিতে হবে।

মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন

তুরস্ক–সিরিয়া টেকটোনিক প্লেটের ওপর অবস্থিত। এ জন্য এখানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশও এখন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে।  ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে খুব সামান্যই কাজ হয়েছে।

আমরা শুধু বারবার করতে হবে– এই কথাটা বলে যাচ্ছি। কিন্তু কাজ শুরু করা হচ্ছে না। ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মান সংস্থার প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে রয়েছে ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম উন্নত করা। ইমার্জেন্সি অপারেশন সিস্টেম উন্নত করা। গত ১৪ বছরে এর খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন করা কঠিন ছিল না।

ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার এমনভাবে করা হবে যেন তা ১০ মাত্রার ভূমিকম্পেও নষ্ট না হয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সেটা কতটুকু ভূমিকম্প সহনীয় জানি না। সিটি করপোরেশনগুলো ও অন্যান্য বড় শহরে ফঁাকা জায়গা খোলা রেখেছে কি না জানি না। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মাত্র ১৯ শতাংশ জায়গার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ ভূমিকম্প সংবেদনশীল। ২০ বছর ধরে আমরা এসব বিষয়ে বলে যাচ্ছি। কিন্তু সরকারের দিক থেকে তেমন কোনো ভূমিকা দেখছি না।

টেকসই ভবন নির্মাণসামগ্রীর ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়েছি। পোড়া মাটির ভারী ইট ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। আমরা এখনো হলো ব্লক ব্যবহার করছি না।

হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট কিছুদিন আগে বলেছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৮০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হবে। আমরা ইউএনডিপির পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিলাম। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন সংস্থা ও কমিটিকে তাদের এসওপি দেখাতে অনুরোধ করেছিলাম। কেউ দেখায়নি। ভূমিকম্পের সময় কীভাবে কাজ করা হবে, তার কোনো গাইডলাইনও নেই।

ভবন নির্মাণবিধি না মানার ক্ষেত্রে পেশাদাররাও দায় এড়াতে পারেন না। ভবন নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ দিক ও নিরাপদ ভবন নিয়ে আমরা সভা করেছি। তারপরও একা কাজ করার মানসিকতা থেকে বের হতে পারছে না। টেকসই নগর গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। আমরা নতুন নগরে ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে থাকি। ডিটেলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ব্লক ডেভেলপমেন্টের কথা বলেছি। আমাদের এখানে বড় ভূমিকম্প হলে মৃত্যু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আমরা জানি না। ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড এবং ২০২০ সালের বিল্ডিং কোডের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। যারা ১৯৯৩ সালের বিল্ডিং কোড মতে ভবন নির্মাণ করেছে, সেটা কি টেকসই না? এসব জটিলতা কীভাবে নিরসন করা হবে, সেটাও জরুরি।

আবু সাঈদ মো. মাসুদ

তুরস্কে ভূমিকম্পে এত ভবন ধসে পড়ল। সেটা বড় বিষয় না। বড় বিষয়, এত মানুষের মৃত্যু হলো। জীবনের মূল্য থেকে বড় কিছুই না। রানা প্লাজা ভবন ধসে মানুষ স্তূপের মধ্যে চাপা পড়েছে। তখন সব জায়গা থেকে সবাই সহযোগিতা করেছে। সবাই তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। কারণ, জীবনের মূল্য অনেক। দুর্যোগের ক্ষেত্রে নিয়মের থেকে মানুষকে বাঁচানোর তাগিদটাই বড়।

দুর্যোগে মানুষ যেভাবে এগিয়ে আসে তাতে মনে হয় যে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আছে। তবে আরও সচেতন করতে হবে। আজকের এই গোলটেবিল আলোচনায় আসার আগে বাংলাদেশে কর্মরত চাইনিজদের জিজ্ঞেস করলাম তারা কীভাবে ভূমিকম্প মোকাবিলা করে। তারা বলল যে ছোটবেলায় স্কুলে তারা এসব বিষয় শেখে। কীভাবে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এটা তারা স্কুলে শেখে। ভূমিকম্পে দুটি ওয়েভ আসে একটা ভার্টিক্যাল, আরেকটা হরাইজেন্টাল। এই দুটি ওয়েভের মধ্যে যতটুকু সময় পাওয়া যায়, এর মধ্যেই তারা নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার বিষয় শেখে। তারা বাসার মধ্যে খাবার রাখে। পানি রাখে। দীর্ঘ সময় আটকে থাকলেও যেন বেঁচে থাকতে পারে। বাসা বা বাড়িতে এসব চর্চা করে।

একবার আমি যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোয় ছিলাম। তখন ভূমিকম্প হলো। সেখানে আমার মেয়ে থাকে। ভূমিকম্েপর সময় তাকে নিয়ে বাইরে গেলাম। কিন্তু অন্যরা রুম থেকে বের হয়নি। তখন মনে হলো  ভবন নিরাপত্তা এমনভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে যে ভূমিকম্পে তারা ভয় পায় না। কিন্তু আমাদের দেশে ভবন নির্মাণে তেমন তদারকি নেই। নিয়মনীতি নেই। এসব কারণে আমরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছি।

আমাদের অঞ্চলে আগে কয়েকটা বড় ভূমিকম্প হয়েছে। সেটা যদি এখন হয় তাহলে ব্যাপক হারে মানুষের মৃত্যু ও ভবন ভেঙে পড়বে। কী ভয়াবহ অবস্থা হবে, ধারণা করতে পারছি না। বিএনবিসি ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিমুক্ত জোন ঠিক করেছে। জোন এক, দুই, তিন ও চার করা হয়েছে। জোনভিত্তিক ভবন-নকশা করতে হবে। যারা ডিজাইন করবেন তঁাদের এ বিষয় সতর্ক থাকতে হবে। মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেটা কঠোর তদারকির মধ্যে রাখতে হবে। ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণে কলাম ও বিমের বিষয়ে গভীরভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

জিপিএইচ ইস্পাত স্টিল নিয়ে গবেষণা করেছে। হাইরাইজ ভবন নির্মাণে স্টিলের যে মান থাকা প্রয়োজন, জিপিএইচ  ইস্পাত সব সময় সেটা নিশ্চিত করে। আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি এ দেশের জনগণ। এ দেশের মানুষকে যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।

মৃত্যু মানুষকে কঁাদায়। এটা অনুধাবনের জন্য যা করা দরকার, এর সবকিছুই করতে হবে। পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো যদি ভূমিকম্প–সহনীয় করতে পারি তাহলে একটা ভবন কেন পারব না। অবশ্যই পারব। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ও সদিচ্ছা থাকতে হবে। ভূমিকম্পে জীবন বাঁচাতে আমাদের যা যা করা দরকার, সেটা করতে হবে।

মুনির হাসান

আমাদের প্রবণতা হলো কোনো ঘটনা ঘটলেই সতর্ক হই। তুরস্কের ভূমিকম্পে অনেক আলোচনা হয়েছে। গণমাধ্যমেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। দুর্যোগের সময় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরা কথা বলি। গণমাধ্যম সারা বছর এটা নিয়ে কীভাবে আলোচনা করবে, সেটা ভাবা যেতে পারে। সমাজের নানা ইস্যু আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশ করি। নানা প্রশ্ন সামনে আনি। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা ঘটনাতাড়িত হই।

কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে সারা বছরই আলোচনা করতে পারি যদি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের সহযোগিতা করে। ভূমিকম্প, অগ্নিদুর্ঘটনা, ভবনধস—এসব ক্ষেত্রে সারা বছরই আলোচনা করা যেতে পারে।

আজকের আলোচনার বিষয় নানাভাবে আমার তুলে ধরব। বড় সেতু নির্মাণ, নদীশাসনের মতো কাজে আমরা সফল হয়েছি। তাহলে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কেন পারব না, সে প্রশ্ন গণমাধ্যম তুলতে পারে। গণমাধ্যম সেটা করেও থাকে। ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বসহকারে করবে বলে আশা রাখি।

নুরুল হুদা

বড় দুর্ঘটনার আতঙ্ক মানুষকে দীর্ঘদিন তাড়িত করে। রানা প্লাজা ধসের পর আমার এটা হয়েছে। তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সেটা আলোচনা হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। একটা বড় ভূমিকম্প হলে যে সময় অতিক্রম করলে আরেকটা ভূমিকম্প হয় সে সময় আমরা অতিক্রম করছি। তাই যেকোনো সময় দেশে একটা বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে সে ভূমিকম্প যেমন এখনই হতে পারে আবার ৫–১০ বছর পরও হতে পারে। কী হবে, জানি না। তবে আমাদের প্রস্তুতিটা ঠিকভাবে নিয়ে রাখতে হবে।

এ ক্ষেত্রে সরকার এবং আমরা যারা পেশাদার আছি তাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সারা বাংলাদেশের কথা বাদই দিলাম। রাজউকের সীমানা হলো মাত্র ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার। এখানে নগরসংক্রান্ত ৫০টি সংস্থা কাজ করলেও তাদের সমন্বয়ের জন্য কেউ নেই। তাহলে ঢাকা শহরের জন্য কেন একটা মন্ত্রণালয় করছি না। নীতিনির্ধারকদের সম্মান জানিয়েই বলছি, অনেক মন্ত্রণালয় আছে, আরো একটা মন্ত্রণালয় তৈরি করুন। এই মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে ঢাকা    শহরের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা। আইনবিধির সঠিক বাস্তবায়ন করা।

সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থার আইনের মধ্যে মতানৈক্য আছে। এসব মতানৈক্য দূর করার জন্য ফাইল করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব ফাইল যেখানে যেভাবে রেখে এসেছিলাম, সেখানে সেভাবে আছে।

১৯৫৬ সালের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট বলবৎ রয়েছে। এটা পরামর্শকের মাধ্যমে আমার ও বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেছি। আজ আট বছর গত হলো এটা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বিধি সংশোধনের জন্য ফাইল জমা দিয়েছি। সেটারও কিছু হয়নি। ১২টি সংস্থা মিলে ওয়ান–স্টপ সার্ভিসের উদ্যোগ নিয়েছি। সেটারও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সব সংস্থা মনে করে, তার সিদ্ধান্তই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিৎ। ফলে কাজ করতে গেলে বাধা আসে। এসব সমন্বয়ের জন্য একটা মন্ত্রণালয় দরকার।

২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ড্যাপ করেছিলাম। তারপর নতুন ড্যাপ করার জন্য কাজ শুরু করেছিলাম, যেটা শেষ হলো ২০২২ সালে। রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সবাইকে নিয়ে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখন যদি ঢাকার মেয়রকে দায়িত্ব দেন তাহলে অন্য মেয়ররা হয়তো আসতে চাইবেন না।  এ ক্ষেত্রে একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিতে হবে। কারণ, একজন সিনিয়র মন্ত্রী দায়িত্ব নিলে সবাই তাঁর ডাকে আসবেন। তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিধি, আইন পরিবর্তন করে সবার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করবেন।

সমন্বয়টা অত্যন্ত জরুরি। রানা প্লাজা ধসের সময় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করেছে। তুরস্ক, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা কার্যকর কর্মপরিকল্পনা করতে হবে।

আবার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে গেলে বা ভালো কেনো কিছু করতে গেল সেখানে ইনজাংকশন দেওয়া হয়। হাতিরঝিল করার সময় ৭৮টি ইনজাংকশন ছিল। এদের অধিকাংশই ছিল অবৈধ দখলদার। আমরা এর সমাধান করেছি।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • নির্মাণবিধি না মানা ভবনের  ক্ষেত্রে  ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

  • ভবন নির্মাণবিধির ওপর প্রকৌশলী, স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

  • তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এখনই ভবন তদারকের কাজ শুরু করতে হবে।

  • ভবনে হালকা দ্রব্য ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

  • বছরের পর বছর ভূমিকম্পে প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু  প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে না।

  • পোড়ামাটির ভারী ইট ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

  • শহরে ভূমির গঠন অনুযায়ী ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

  • মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটি কঠোর তদারকির মধ্যে রাখতে হবে।

  • বিম ছাড়া ভবন (ফ্ল্যাটপ্লেট) ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।  বিম ছাড়া ভবন যেন না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

  • ভূমিকম্পের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করা প্রয়োজন।