বাঙালি সংস্কৃতি, সংস্কৃতির পরিস্থিতি, সামনের দিশা

গোলটেবিল বৈঠকে বাঁ থেকে: ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সুদীপ চক্রবর্তী, রায়হান রাইন, নবনীতা চৌধুরী, সামিনা লুৎফা ও সাজ্জাদ শরিফছবি: আশরাফুল আলম

অংশগ্রহণকারী

রায়হান রাইন

সাহিত্যিক; অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান

সংগীতশিল্পী

সামিনা লুৎফা

নাট্যকর্মী; শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নবনীতা চৌধুরী

সংগীতশিল্পী; পরিচালক, জেন্ডার কর্মসূচি, ব্র্যাক

সুদীপ চক্রবর্তী

নাট্যকর্মী; শিক্ষক, নাট্য ও প্রদর্শনকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্চালক:

সাজ্জাদ শরিফ

নির্বাহী সম্পাদক, প্রথম আলো

সাজ্জাদ শরিফ

দীর্ঘ ইতিহাসে গড়ে ওঠা একটা জাতীয় সংস্কৃতি আমাদের আছে। আজ আমরা তার বিভিন্ন দিক দেখার চেষ্টা করব। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরাধীনতার ভেতরে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল। তারই ফল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। স্বাধীন রাষ্ট্রে সেই জাতিচেতনার বৃহত্তর কোনো প্রসারের দরকার পড়েছে কি না, সে বিষয়টিও আমরা জানতে চাইব। আমরা জানতে চাইব, এ সময়ে আমাদের সংস্কৃতি কোন অবস্থার মধ্যে আছে, তার বিপদ কী। আমাদের সংস্কৃতিচর্চা কি ক্ষমতার করায়ত্ত হয়ে তার প্রাণশক্তি হারাল, মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো, শহর আর গ্রামে ভেদ ঘটে গেল? আমাদের সংস্কৃতির সামনের চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার পাশাপাশি সামনে এগোনোর পথ আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করব।

রায়হান রাইন

১৯৪৭–এর দেশভাগের কয়েক বছর পরই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমরা রক্ত দিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক দীর্ঘ একটি ইতিহাস আছে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সাহিত্যকীর্তিগুলোতে নানা গোষ্ঠীরই অংশগ্রহণ আছে। ধর্মের দিক থেকে দেখলে বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, সুফি, নাথপন্থীসহ বিচিত্র ধারার অংশগ্রহণ এতে আছে। ষোড়শ শতাব্দীর দিকেও আরবি–ফারসিতে যখন ধর্মকথা লেখা হচ্ছে, সে সময় আমাদের জনসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সুফিরা বাংলায় লিখেছেন বলে তাঁদের নিন্দা করা হয়েছে, বাধা দেওয়া হয়েছে। আবদুল হাকিম থেকে সৈয়দ সুলতান বা আলী রওজা পর্যন্ত প্রত্যেক কবিকে যুক্তি তুলে ধরতে হয়েছে, কেন তাঁরা বাংলায় লিখছেন। প্রতিরোধ নিশ্চয়ই একটা ছিল। নবীবংশ লেখার পর সৈয়দ সুলতানকে নিন্দা করা হয়েছে এই বলে যে কিতাবের কথাকে তিনি হিন্দুয়ানি করে ফেলছেন। এখানকার সুফিরা তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বৈষ্ণব সহজিয়াদের কথাও বলা যায়। গৌড়ীয় সহজিয়ারা বৃন্দাবনে বসে সংস্কৃত লিখতেন। অথচ বাংলা অঞ্চলের চৈতন্য–ভক্তরা বাংলায় লিখেছেন। এ কারণে তাঁদেরও সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যজীবনী লিখে অনুমোদন নিতে বৃন্দাবনে জীব গোস্বামীর কাছে গিয়েছিলেন। কিংবদন্তি আছে, তিনি সেটা যমুনায় ফেলে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য কৃষ্ণদাস কবিরাজের শিষ্যরা সেটি বাংলায় প্রচার করেছিলেন। বৈষ্ণব সহজিয়াদের বাংলায় লেখার লড়াই ছিল সংস্কৃতের সঙ্গে।

সুফিদের কাছে লক্ষ্যটাই ছিল প্রধান, উপায় নয়। এ জন্য স্থানীয় চর্চাগুলো তাঁরা দূরে ঠেলে দেননি। সুফি সাহিত্যে তার চিহ্ন দেখা যায়। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস এর সাক্ষ্য আছে। সুতরাং বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক ইতিহাসের ভিত্তিকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। অতীতের সেই চর্চার উদ্দেশ্য ছিল জাতি বা সম্প্রদায়ভেদের ঊর্ধ্বে ওঠা। ভাষার মতো কৃষিও এ অঞ্চলের সংস্কৃতির প্রধান ক্ষেত্র। কৃষিচর্চার পরিসরও অসাম্প্রদায়িক। দেশভাগের আগে যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে, সে পরিবেশেই হিন্দু-মুসলমানরাও যার যার ঐতিহ্যকে নিজের মতো করে নির্মাণ করতে শুরু করেছিল। বাউল না ফকির হবে, এ প্রশ্ন উঠল। ফকিরেরা মুসলিম ঐতিহ্য নিল, বাউলদের অনেকে নিল বৈষ্ণব সহজিয়া ধারা থেকে। গান থেকে কিছু পরিভাষা কীভাবে ধীরে ধীরে চলে গেল। মুসলমানদের পুঁথি বা গীতিকাগুলো আদৌ বাঙালি সংস্কৃতির অংশ কি না, সে প্রশ্ন তুলে আপত্তি করা হতো। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্​ বা দীনেশচন্দ্র সেনকে এর জবাব দিতে হয়েছে। 

এ সময়ে এসে দেখছি, বাঙালির ঐতিহাসিক সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার বা জাতভেদের ঊর্ধ্বে ওঠার যে চেষ্টা ছিল, তার মধ্যে একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাঙালি মুসলমান বর্গ তার সংস্কৃতির যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পূর্ণতা ছিল, সেটিকে এখন কাটছাঁট করে নিতে চাইছে, সেসব হিন্দুয়ানি কি না, সে প্রশ্ন তুলে পরিত্যাগ করতে চাইছে। এভাবে তো সব পরিত্যাগ করা যায় না। সংস্কৃতির যেসব জায়গায় জাতীয় বা ধর্মীয় অংশগ্রহণ ছিল, সেগুলো ছেঁটে ফেললে আমাদের অনেক শিকড়বাকড় উপড়ে ফেলতে হবে। ভক্তিবাদ, বৈরাগ্য, ব্রত পালন, বৃক্ষকে মর্যাদা দেওয়া, মানুষ ভজনা করা—এসব দীর্ঘ এক যাত্রা। দেহকেন্দ্রিক জগৎ–ভাবনা, নিজের ভেতরের পরমকে দেখা—এর স্রোত কিন্তু বাঙালির জীবনচর্চার গভীরে সঞ্চারিত হয়েছে এবং আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।

এই সমন্বয়ের জায়গায় এখন এসেছে বিভেদ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে বিশেষজ্ঞরা রাজনীতির কথা বলেন। কিন্তু রাজনীতি এই ঘটনাগুলো ঘটাতে পারে কেন? দৈনন্দিন জীবনে, অর্থাৎ সংস্কৃতির ভেতরে যদি সাম্প্রদায়িকতার চর্চা না থাকে, তাহলে কখনোই রাজনীতি এ ঘটনাগুলো ঘটাতে পারে না। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতির ভেতর সেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভাবগুলো চর্চিত হতে শুরু করেছে। আমাদের এটা প্রতিরোধের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হলো, গ্রাম আর শহরের বিভেদ। আমাদের গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে—বিশ্বাস, আচরণ, পোশাক, সংগীত, শিল্প এসবের ভেতরে—উপনিবেশকালের আগে থেকে একটা ধারাবাহিকতার প্রবাহ ছিল। নানাভাবে এটি সংকুচিত হয়েছে। প্রথমত, লোকসংস্কৃতি বলে জনসংস্কৃতিকে আমরা আলাদা করেছি। এই অপর করে তোলার একটা বড় কারণ আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত। অর্থাৎ উপনিবেশ একটা কারণ। পরের কারণগুলো হচ্ছে বর্তমান বৈশ্বিক যোগাযোগে সংস্কৃতির এমন একটি রুচি তৈরি হয়েছে, যা আমাদের ৯০ শতাংশের জীবন্ত সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা তো জায়গা ছিল ওখানে। নাথ সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন। মূলত মুসলমানরাই কিন্তু নাথ সাহিত্য রচনা করেছেন। গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস, শেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষ বিজয়—সেগুলোতে জাদুর ছড়াছড়ি। অথচ আমরা শিল্প-সাহিত্যে জাদু আনছি হয় ইউরোপ থেকে, নয় লাতিন আমেরিকা থেকে।

এভাবে আমাদের বড় রকমের একটি বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। পূর্ববঙ্গ গীতিকার যে সংকলন ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক বা দীনেশচন্দ্র সেন করেছিলেন, আমাদের বর্তমান চর্চায় সেগুলোর কোনো পরম্পরা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এই যে ৯০ শতাংশের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই, এটা একটা বড় সংকট। ভেতর থেকে এর চর্চা না হলে একে বলেকয়ে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক পুঁজি যখন সংস্কৃতির মধ্যে প্রবেশ করে, তখন তার সহযোগী হিসেবে ভাবাদর্শও ঢোকে পুঁজির পথকে সহজতর করে তোলার জন্য। আমি কী পোশাক পরব, কী খাব, কী উপভোগ করব—এ–জাতীয় ব্যক্তিরুচিকে একটা ছদ্মবেশী সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়। আপনার যদি যৌথ সংস্কৃতি না থাকে, আপনি যদি একা হন, তখন প্রত্যেকে দরজায় সে সহজে পৌঁছে যায়।

তৃতীয় বিষয়টি হলো ক্ষমতা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক। রাষ্ট্রমাত্রই নিপীড়নমূলক। জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার তার ভাবাদর্শ প্রচার করে। সেই ভাবাদর্শ সংস্কৃতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের, বিদ্যায়তনের, গণমাধ্যমের বড় অংশ তার মুখপাত্র হয়ে ওঠে। সে ভার বহন করতে গিয়ে আমাদের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে সংকুচিত, ফাঁপা ও অর্থহীন হয়ে আসছে। এর পাশাপাশি নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডও চলে। বই বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া হয়, সিনেমা সেন্সর করা হয়, যাত্রাপালা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, বাউলদের চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়। শাসকের ভাবাদর্শের সংস্কৃতির মধ্যে আমরা এমনভাবে ডুবে থাকি যে আমরা বুঝতেও পারি না, আমরা ডুবে আছি। সচেতনভাবে এর বিপরীত ভাবাদর্শ আমাদের তৈরি করতে হবে। এই সচেতনতা ছাড়া কোনোভাবে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

আমি জানি না, ধরেবেঁধে পরিকল্পনা করে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব কি না। তবে সচেতন তো আমাদের হতেই হবে। আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা নানা রকম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। নিশ্চয়ই ক্ষমতা বা বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে মানুষ সচেতন হবে।

সামিনা লুৎফা

সংস্কৃতি একটা জনগোষ্ঠীর জীবনাচার। এই সংস্কৃতির মধ্যে নানা আলাদা আলাদা ধারাও থাকে—ইংরেজিতে যার কোনো কোনোটিকে আমরা সাবকালচার, কাউন্টার কালচার বা ডমিনেন্ট কালচার বলে থাকি। জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে যে মূল্যবোধ-বিশ্বাস থাকে, সেটাই ডমিনেন্ট কালচার বা প্রধান সংস্কৃতি। এই প্রধান ধারার সঙ্গে অন্য সংস্কৃতি বা উপধারার আদান-প্রদান চলতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে নানা স্রোত এসেছে। ভৌগোলিকভাবেও এমন স্রোত আসার কারণ ও প্রমাণ দেখা যায়। বাংলাদেশ তো একসময় আসামের পাহাড়ের পাদদেশে ভৌগোলিকভাবে একটা গর্তের মতো ছিল। এই গর্তের মধ্যে নানা কিছু জমতে জমতে গর্তটা উঁচু হয়েছে, সেখানে মানুষ থাকতে শুরু করেছে। কী ধরনের মানুষেরা থাকতে শুরু করেছে? ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে সব দিক থেকে যারা প্রান্তিক বা বিতাড়িত, তারা এখানে এসে ঠাঁই পেয়েছে। ক্ষমতাবানেরা এই জলা–জংলা বা সাপখোপের দেশে আসবে কেন!

এখানকার মানুষের মধ্যে নানা স্রোতকে গ্রহণ করার মন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। সমাজে যখন কেবল একই রকম সংস্কৃতির মানুষ থাকে, তখন একটা বিষয় ঘটতে পারে। কারও সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দিলে সংস্কৃতি তখন যুদ্ধের একটা উপাদান হয়ে দাঁড়ায় এভাবে যে আমরা আলাদা। সেখান থেকে জাতীয়তাবাদও গড়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে অন্যকে ছোট এবং নিজেকে বড় করে তোলার একটা বিপজ্জনক ঝোঁক থাকে। জাতীয়তাবাদ আমাদের রাষ্ট্র গড়ে ওঠার বড় অস্ত্র ছিল। এখন তার মধ্যে সেই ঝোঁকটা থেকে গেছে। আগে এই জাতীয়তাবাদ অপরায়ন করেছিল তাঁদের, যাঁরা বাঙালি নন। এখন অপরায়ন ঘটছে বিভিন্ন জাতিসত্তার যে মানুষেরা আমাদের দেশে আছেন, তাঁদের।

সত্তরের দশকে আমরা স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সত্তরের দশকে বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি উন্নয়ন দর্শনের চাপ দিচ্ছিল। এর কেন্দ্রে ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, যেটি মাপার সূচক ছিল জিডিপি। জিডিপি দিয়ে বিচার করা অর্থনৈতিক মুক্তিই তো এখন আমাদের রাষ্ট্রদর্শনের মূল জায়গা। পরে এল নতুন নয়া–উদার উন্নয়ন নীতিমালা। শুরুর দিকে দাতারা এসেছিল সাহায্যের চেহারা নিয়ে, আশির দশকে সেটা হয়ে গেল উন্নয়ন সহযোগিতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অবকাঠামো নির্মাণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একই মডেল অনুসরণ করা হলো, বাংলাদেশে আমরা যা দেখছি। সরকার বদলেছে, স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু এই দর্শন অবিচল থেকেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানুষ আরও প্রান্তিক হয়েছে, বৈষম্য তীব্রতর হয়েছে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা জয় নিয়ে এসেছেন, সেই স্মৃতিটা তাঁদের বেশ প্রভাবিত করে। এ রকম সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে কেউ যখন জয়ী হয়, তখন তার চর্চা করে আরও বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে যাওয়া যায়। তাঁরা এখন প্রবীণ হয়েছেন।

আরবি, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম—এই তিন রকমের শিক্ষাব্যবস্থাও সমাজের মধ্যে একটা ভেদ তৈরি করেছে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে এর প্রভাব আমরা বুঝতে শুরু করেছি। তিন রকম শিক্ষা শেষে যারা বের হচ্ছে, তাদের সাংস্কৃতিক টুলবক্স একেবারেই আলাদা। এরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না। তাদের মধ্যে যোগাযোগের সাধারণ কোনো জায়গা নেই। শাহবাগ আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি যে তাদের সাংস্কৃতিক টুলবক্সের মধ্যে মেলার কোনো ক্ষেত্র নেই। কেউ কারও ভাষা বোঝে না। অথচ একটা সাম্য আসবে এই স্বপ্ন দেখে দেশটির স্বাধীনতার জন্য আমরা এত সংগ্রাম করেছি। আমরা আবার দেখলাম, ধর্মীয় গোষ্ঠীর দাবিতে বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যবই বদলে গেল। মানে মাদ্রাসা রাজনৈতিকভাবে বাংলা মাধ্যমের শক্তিকে হারিয়ে দিল। পরিবর্তনটা ঘটল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংস্কৃতিবান্ধব বলে পরিচিত সরকারের আমলে। সংস্কৃতি অঙ্গনের নেতারা আগে এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতেন, এখন আর তাঁদের আন্দোলনে দেখছি না। আমরা শুনছি, এই সরকারকে জায়গামতো রাখাই নাকি তাঁদের মূল দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। এই তাঁবেদার আর সহমত সৃষ্টিকারী সাংস্কৃতিক নেতাদের কারণেই দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও একই ব্যক্তি বারবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থেকে যাচ্ছেন। দেশে একটা সম্মতি উৎপাদনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেছে।

জনজীবনের সাধারণ সংস্কৃতি আর সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে একটু তফাত আছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা সাহিত্য, গান, চলচ্চিত্র, থিয়েটার ইত্যাদি করেন, একটা উদ্দেশ্য আছে বলেই তাঁরা এটি করেন। তাঁরা তো আসলে গ্রামীণ বাউল নন। তিনি যে শহুরে পরিবেশে বাউল গান করছেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর কিছু বলার আছে। যে গানটি তিনি গাইছেন বা নাটকটি তিনি করছেন, সেটি সরাসরি প্রতিবাদের জায়গা না–ও হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তিনি হয়তো তাঁকে ব্যবহার করছেন প্রতিবাদের জন্য। শিল্প কাজ করছে একটা ভাবসম্পদ হিসেবে। অর্থাৎ আমি সুন্দরবন বাঁচানোর একটা গান লিখেছি, একটা নাটক বানিয়েছি। এই জায়গাটাতে এখন মানুষের সংখ্যা কমে গেছে।

একজন সংস্কৃতিকর্মীর যে আত্মপরিচয় আমি নির্মাণ করেছি, তার মধ্যে আমি কী দেখতে চাই। আমার সামনে যে শিক্ষার্থীরা বসে থাকে, তাদের আমি কোন সংস্কৃতি বা ভাবাদর্শের দিকে নিয়ে যেতে চাই? কোনো প্রান্তিক বর্গের মানুষ—সে নারী বা শিশু হতে পারে, ভিন্ন জাতিসত্তা বা লিঙ্গের হতে পারে, প্রকৃতি বা এর অন্তর্গত প্রাণীকুল হতে পারে—অর্থাৎ যা কিছু আমাদের কারণে নিষ্পেষিত, আমাদের জীবনাচার যেন তাদের আরও প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যায় না, সেটাই আমাদের ভাবাদর্শ হওয়া উচিত। এটা সব সময় আমাদের সংস্কৃতির মূল স্রোতে ছিল। সে স্রোত থেকে আমরা অনেক দূরে চলে গেছি। কিন্তু এটা তো আমাদের গভীরে আছে। একে অবশ্যই বের করে আনা সম্ভব। আমি আশাবাদী মনুষ।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান

আমি একজন সংস্কৃতিকর্মী, এ সমাজের সদস্য, বাংলাদেশের একজন নাগরিক, একজন নারী এবং বাঙালি। আমার দায়িত্বটা আসলে কী। আমি গান লিখি, ধরুন আমি একজন কবি। কবি হিসেবে আমার কাজ কী? আমার আদৌ কি কোনো দায়িত্ব আছে? বাংলাদেশের বা বাঙালি সাহিত্য–সংস্কৃতি নিয়ে আজকের আলোচনায় অনেক কথা হলো। একে বহন করাই কি আমার দায়িত্ব? তাহলে কি আমি সংস্কৃতির যথার্থ বাহক হব? ইতিহাসটাকে জেনে এসে তার কোটাগুলোয় টিকচিহ্ন দিয়ে বলব, হ্যাঁ, আমি বাঙালি হয়েছি, এভাবে পোশাক পরেছি, এখানে আনুগত্য দেখিয়েছি, বাঙালি হয়েছি বলে এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। সেটা একটি পথ। আলাদা কোনো পথ নয়, পুরো প্রক্রিয়াটা যৌগিক। ‘আমি মুসলমানের মেয়ে’ বলে নানা ভাবাদর্শের মানুষকে মিলিয়ে যে গানটি আমি লিখেছি, সেটাই তো আমার সমাজ। এটা আমার স্বাভাবিক একটি ধারণা। এর মধ্যে কোনো জটিল বা কঠিন কথা নেই।

একটা কঠিন সময় চলেছে। অনেককে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কাজল, মোশতাক, দিদারুল ভূঁইয়া। এ রকম ঘটনা ঘটছে। আমি তখন দেশের বাইরে। সেখান থেকে কবিতা লিখেছি, প্রতিবাদ করেছি। আপাতত তখন সেটাই আমার কাজ। কবি হিসেবে সংস্কৃতিই আমার ধর্ম।

ত্বহা নামের এক ব্যক্তি ওয়াজ করেন, তিনি গায়েব হলেন। আমার কাছে একটা ই–মেইল এল, আপনারা যারা পেশাদার প্রতিবাদী, পয়সা নিয়ে প্রতিবাদ করেন, এখন আপনাদের বিবেকটা কোথায়? আমি একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লাম। ওই গায়েব হয়ে যাওয়া লোকটা তো আমার সমাজেরই একজন নাগরিক। তিনি যে সংস্কৃতি অনুশীলন করেন, আমি হয়তো সেটা করি না। আমি লিখলাম, শুধু এই মানুষটা নয়, সমাজের কোনো মানুষকেই এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া যায় না, নাগরিক হিসেবে, কবি হিসেবে, শিল্পী হিসেবে আমি এর প্রতিবাদ জানাই। এটাই আমার অবস্থান।

আমি যখন একটা সমাজে থাকি, সেখানে অনেক রকম মানুষ থাকেন। কেউ হয়তো বাঙালি নন, পাহাড়ের মানুষ। তাঁর পাশেও আমি দাঁড়াতে চাই। আমি চাকমার জন্য তার মতো করেই গাইতে চাই। আমি চাই না পৃথিবীতে ইহুদিরাও নিধন হোক। আমি রমেশ ঠাকুরের কথা বলতে চাই। তিনি একজন বাউল। তাঁর ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো। তিনি তাঁর চর্চা করতে পারলেন না। আমরা কথা বলছি সংস্কৃতিচর্চার পরিস্থিতি নিয়ে। প্রান্তিক এই মানুষটির ওপর অত্যাচার হলো ধর্মের জায়গা থেকে।

আমি অন্যের অভিজ্ঞতায় না গিয়ে নিজেরই গল্প বলি। বছর পাঁচেক আগে দেশের বড় একটি গণমাধ্যম তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাকে গান গাইতে বলল। বড় বড় মানুষ সেখানে আসবেন। আমার গান তাঁদের ভালো লাগবে। আমি বললাম, আমার একটা অনুরোধ আছে। আমাকে যদি ডাকেন, সেটা ভালো কথা। তবে আমাকে ডাকলে আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন না। তারা বলল, আপনি আপনার মতো গান গাইবেন। আমি যখন মঞ্চে উঠব, তখন সে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় একজন আমাকে আলাদা করে বললেন, দুই নেত্রীর গানটা কিন্তু করা যাবে না। এটাও কি নিষ্পেষণ নয়? শিল্পী হিসেবে আমার ধর্ম কী? আমি সমাজের সঙ্গে সেই দর–কষাকষিই তো করতে চাই। এই মুহূর্তে সমাজে অনেক ঘটনা ঘটছে। দর–কষাকষি করে আমার প্রাণের কথাটা বলার পরিবেশ আমাকেই তৈরি করতে হবে। আমি সেটুকুরই চেষ্টা করে যাই। কবি হিসেবে এটুকুই আমার ধর্ম।

আমার সংস্কৃতিকে আমি বিশ্বের দরবারে তো নেবই, বিশ্বকেও যেন আমার দরবারে নিয়ে আসতে পারি। কোক স্টুডিওতে নয়, ইউরোপকে যেন নদীতীরে আমার বাউলের গান শোনাতে নিয়ে আসতে পারি, সেই শক্তি ও মেরুদণ্ড যেন আমার হয়। সব মানুষের পেটেভাতে থাকার যে দাবি, সেগুলো যেন আমার শিল্পচর্চার মধ্যে থাকে।

নবনীতা চৌধুরী

আমি এমন একটা বাড়িতে জন্মেছি, যেখানে আমার মা–বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁরা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার নানা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের কাছে এটা স্বতঃসিদ্ধই ছিল যে আমাকে আর আমার বড় বোনকে সংস্কৃতিচর্চা করতে হবে। বাঙালির সংস্কৃতিচর্চাকে তাঁরা রাজনৈতিক চর্চা বলেই মনে করেছেন। আমি হয়তো ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের মতো নিজের গান নিজে লিখে গাইতে পারব না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একটা গান গাইতে গিয়ে আমি কোন পরিস্থিতিতে কোন গান নির্বাচন করছি, তার ভেতর দিয়ে শ্রোতার সঙ্গে আমার কী রকম সংযোগ তৈরি হচ্ছে; সেটাও একধরনের রাজনৈতিক চর্চা। একটা বিশেষ শ্রেণির সদস্য হিসেবে আমি আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। যেহেতু এই সুযোগটা পেয়েছি, আমার কাজ সেটা ক্রমাগত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। ২০২৩ সালে এসে সে দায়িত্বটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে। কারণ, এখন আমাদের পেটে ভাত আছে, কিন্তু সুকুমারবৃত্তির চর্চায় আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কোন মানের কাজ করছি। আমরা কি বিশ্বমানের দোতারাবাদক বা ঢোলবাদক তৈরি করতে পেরেছি? ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় মঞ্চে আমি যে আয়োজনটি করছি, তা কি বিশ্বমঞ্চে হাজির করার যোগ্য? আমি কেন বাউল গানকে বিশ্বসংগীতের অভিজ্ঞতা করে তুলতে পারছি না? সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে এ প্রশ্নগুলো আমাদের করতে হবে।

আমি সব সময় দেখে আসছি, বাঙালি মুসলমান ‘বাঙালি’ হয়ে উঠতে পারল না পারল কি না—এ নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। একসময় আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে বাঙালি সংস্কৃতি চেনার চেষ্টা করেছি। তারপর খুঁজে পেলাম লালন সাঁইকে। সাংবাদিকতার সূত্রে গ্রামে গিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশের তাঁতি, জেলে, মাঝির আলাদা আলাদা গান রয়েছে। এ গান থামিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। আমি গ্রামে গিয়ে দেখেছি, আমাদের নানা ধর্মাচরণের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল যে সংস্কৃতি, তাকে আসলে আমরা সংস্কৃতি বলে স্বীকার করিনি। গানে, পাখায় বোনা ‘ভুলো না আমায়’ লেখাতে, নকশিকাঁথায় হিন্দু বা মুসলমান বাঙালির চর্চায় কোনো বিরোধ ছিল না।

ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা গ্রহণ করলাম সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ইত্যাদির ধারণা। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে তখন কত শতাংশ শিক্ষিত। তারা কীভাবে একে বুঝে মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপান্তর করতে পারল, এটা তো আশ্চর্য একটা ঘটনা। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ তো আসলে আশরাফ-আতরাফের যুদ্ধ। আমাদের এই অঞ্চলের হিন্দু বা মুসলমান কোনো বাঙালিই তো উচ্চবর্ণের নই। আমার পেটে ভাত ছিল না। যুগ যুগ ধরে সামষ্টিক স্মৃতিতে রয়েছে যে ঈশ্বরকে আমরা মানুষে পর্যবসিত করেছি। আমি বলেছি, ‘আমার অন্তরে সে আছে।’ মানুষকে ভজনা করতে হবে। এই লড়াই তো আমাদের একদম ভেতরে আছে। অথচ আমরা আমাদের শিল্পকে শিল্প ভাবিনি, লোকশিল্প ভেবেছি। মনে করেছি, বাউল গান বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার মতো বিষয় নয়।

গত কয়েক দশকের উন্নয়নের বড় সুফল হচ্ছে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু কমে আসা, আমার-আপনার আয়ু বেড়ে যাওয়া। শিক্ষিতের হারও ব্যাপক আকারে বেড়েছে। শিক্ষার মান যদিও গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গ। লোকগান আর লোকশিল্পের প্রতি আমাদের প্রকৃত আগ্রহ তৈরি হয়েছে, গবেষণা হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটছে। এখন কেন যেন মনে হয় যে আশরাফ-আতরাফের ভেদ ক্রমে মুছতে থাকবে। কারণ, এই দুইয়ের একটা মিলনের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

আমার মনে হয় আমরা সুবিধাভোগীরা অনেক সময় অনেক অযথা তর্ক তুলি। বাঙালি সংস্কৃতি গেল গেল বলে হাহাকার করারও কিছু নেই। সংস্কৃতি তো কোনো একটা স্থির জিনিস নয়। গিটারের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যাবে কি যাবে না, এ নিয়ে দীর্ঘ লড়াই হয়েছে। এমনও হতে পারে যে বাংলাদেশে এখন শিল্পীরা মুখাবয়ব আঁকার ব্যাপারে কম আগ্রহী। মানে সংস্কৃতিকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।

নববর্ষ উৎসবকে আমরা আমাদের চোখের সামনে বিরাট উৎসব হয়ে উঠতে দেখলাম। এখন পয়লা বৈশাখে দেখবেন, সাদা–লাল শাড়ি পরে শ্রমজীবী নারী-পুরুষেরাও পরিবার নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। তাঁরাও এই উৎসবের অংশী হতে চান। সেটা কিন্তু আমরা দেখি। সংস্কৃতি যখন মানুষকে আনন্দ দেয়, একটা মান, সংযোগ আর শক্তি দেয়, তখন সে এটাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে।

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের কিছু বাউল আখড়ায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ভীষণ চিন্তিত হওয়ার মতো বিষয়। অন্যদিকে এটাও সত্যি যে বাউলচর্চা থেকে বাঙালিকে কেউ বিরতও করতে পারেনি। একদিকে একদল ঘর ছেড়ে দিয়ে বাউল হয়েছেন। আরেক দল রবীন্দ্রনাথের মতো ঘরে থেকে বাউলদর্শনে ভেসে গেছেন। এই সব রকমের শক্তিই আমাদের চিহ্নিত করা দরকার।

এ দেশে এখনো সত্যিকার অর্থে গান গেয়ে জীবন ধারণ করা যায় কি না, সে প্রশ্ন তোলাও জরুরি। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আব্বাসউদ্দীন সম্পর্কে বলেছিলেন, দুঃখের বিষয়, তাঁর মতো গুণী শিল্পীর সরকারি দপ্তরে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়! এই বাস্তবতা এখনো রয়ে গেছে যে শিল্পে পূর্ণ সময় দিয়ে বাংলাদেশে সম্মানের জীবন হয় না। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে যিনি সংস্কৃতিচর্চা করেন, তাঁর জীবনও সংগ্রামের জীবন, করপোরেটের জীবন নয়। কিন্তু সৎ থেকে নিজে যা করতে চান, সে জায়গা ঠিক রেখে সংস্কৃতিচর্চায় পুরো আত্মনিবেদন করতে পারেন। আমাদের এখানে সে পরিস্থিতি নেই। তারপরও যে বাঙালি সংস্কৃতি এভাবে টিকে আছে, তার বড় কারণ সেটা আমাদের হৃদয়ে আছে, আমাদের সামষ্টিক স্মৃতিতে আছে, আমাদের চর্চার মধ্যে আছে। আমাদের মধ্যে আত্মশক্তি খুঁজে পাওয়ার যে তৃষ্ণা, সেটা আমাদের বাউল গানে বা আমাদের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে পাই বলেই, সেটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে বলেই, সেটা টিকে আছে।

আমি খুব আশাবাদী যে বাংলাদেশে প্রাক্​প্রাথমিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সংগীতশিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। এই সুযোগগুলো যেন রাষ্ট্র সততা এবং গুরুত্বের সঙ্গে করে। যোগ্য শিক্ষক যেন তারা নিয়োগ দেয়। দীর্ঘ সময় আমরা ভেবেছি, প্রাথমিক শিক্ষা পৌঁছে দেওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে গান শেখানোর সিদ্ধান্তও রাষ্ট্র নিতে পারছে। এগুলোই উন্নয়ন। কিশোর–কিশোরীদের কাছে যেন মানসম্পন্ন শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া হয়, যাতে তারা গানের আনন্দ, সুরের আনন্দ, তালের আনন্দ নিয়ে বড় হতে পারে। এমন একটা সমাজ আমরা চাই, যেখানে ১২–১৩ বছর বয়সে একটা মেয়েকে নাচ ছেড়ে দিতে না হয়। আমাদের সমাজে যেন কেউ না বলতে পারে যে এই গ্রামে গান হতে পারবে না। আমাদের সমাজকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন সে সবকিছু গ্রহণ করতে পারে।

সাজ্জাদ শরিফ

আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

সুদীপ চক্রবর্তী

সংস্কৃতির নানা সংকট আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। এখন অনেক অদৃশ্য সংকট দেখতে পাচ্ছি, যা নিয়ে আমরা কথাও বলতে পারব না। যাহোক, নাটকে সুর আর অসুর—দুই-ই আছে। আমাদের সমাজে শুধু সুরই থাকবে, অসুর থাকবে না, তা তো নয়। লড়াই করেই দেখাতে হবে যে সুরকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

তবে ইতিহাস তো একদিনে নির্মিত হয় না। ফরায়েজি আন্দোলনের দিকে তাকান। আন্দোলনটাকে যত ইতিবাচকভাবে দেখা হয়, ব্যাপারটা তা নয়। ফরায়েজি আন্দোলনের সময় তো তারা বলে দিল যে উর্দু-আরবি-ফরাসি শব্দ ব্যবহার করতে হবে, বাংলা ব্যবহার করা যাবে না। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মধ্যযুগে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কবিরা চেষ্টা করে গেছেন। ২০২৩ সালে এসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে যা দেখতে পাচ্ছি, তার সূত্রপাত তো খুঁজতে হবে সেই ফরায়েজি আন্দোলনে।

ক্লাসে দেশজ নাট্য সম্পর্কে আমি কী বলতে পারব, তা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়, কোনো ধর্মালম্বী বা রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষার্থীরা যেন আঘাত না পায়। একটা সেলফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে ক্লাস নিতে হয়। অসংখ্য ইতিহাস আমাকে এই সেলফ সেন্সরশিপের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

১৯৭৫ সালের পরে পাকিস্তানপন্থী দুজন শক্তিশালী শাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্ম নিয়ে প্রবলভাবে চর্চা শুরু হয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রধর্ম হয়েছে। তখনো কি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, নাট্যকর্মী, শিল্পীরা ছিলেন না? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো তাঁরা নীরবে সব সয়ে গেছেন। বাংলাদেশে আজ সংস্কৃতিকর্মী, নাট্যকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী—সবাই নিপীড়িত হচ্ছেন। এককভাবে কোনো সরকারকে বলে লাভ হবে না। আমরা দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে, অনেক ঘটনা নীরবে সহ্য করে এখানে এসে এমনভাবে দাঁড়িয়েছি যে আর কথাই বলতে পারছি না।

মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে রুয়ান্ডার গ্রাসরুট থিয়েটারের চর্চার কথা এখানে বলতে চাই। এর মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছিল, গণহত্যা ঘটে যাওয়ার পরে কীভাবে একটি রাষ্ট্রের নাগরিকের মধ্যে একটা অভিন্ন পাটাতন তৈরি করা যায় এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বয়ে নেওয়া যায়। গ্রাসরুট থিয়েটারে তারা একটা কাজ করেছিল। যারা অপরাধ করেছে আর যারা অপরাধের শিকার, তাদের কারও সন্তানকেই জানতে দেওয়া হয়নি কে কী। কারণ, তারা জানলে পরস্পরের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি হবে। ঘৃণা বৃদ্ধি মানে বিভাজন বৃদ্ধি। গ্রাসরুট থিয়েটারকে তারা বলে গাচাচা। গাচাচা হচ্ছে বড় বৃক্ষ। গাচাচাতে তারা সপ্তাহে একদিন করে বসত একটা ঘটনা নিয়ে। প্রথমে সালিস পর্যায়ে কথা হবে। পরে নাটক। যিনি অপরাধের শিকার হতেন—উভয়ের উপস্থিতিতে অভিনেতারা অভিনয় করত। নাটকটা এমনভাবে পরিবেশিত হতো যে অপরাধী শেষে কেঁদে বলত, আমিই অপরাধ করেছি। নিজের অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়ার কথা বলত। এটা দীর্ঘদিন চলতে পারেনি। কারণ, রুয়ান্ডাতে আবার সাম্প্রদায়িক সংকট তৈরি হয় এবং আবার তারা সহিংসতার দিকে চলে যায়। কিন্তু একটা ইঙ্গিত তো পাওয়া গেল।

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আজকে শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা হচ্ছিল। সেখানে শুনতে পেলাম, জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটি পাঠ্যসূচি থেকে উঠে যাচ্ছে। কারণ, এই কবিতায় ফিরে আসা বলতে নাকি জন্মান্তরবাদের কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের কাজ যদি সরকার করতে শুরু করে এবং তারা মানতে শুরু করে যে কবিতাটা রাখা যাবে না, তাহলে তো একদিন বিজ্ঞান থেকে বিবর্তনবাদও উঠে যাবে। এই শিক্ষার ভেতর দিয়ে কিশোরদের মধ্যে যে অজ্ঞানতা তৈরি হবে, সেটা নিয়ে সে রাষ্ট্র আর সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে আসবে। সে কোন রাষ্ট্র নির্মাণ করবে?

আমি বলব, আমাদের সামষ্টিক কর্তব্য রয়েছে। নিজ নিজ জায়গা থেকে কথাগুলো তুলে ধরতে হবে। শিল্পীর গানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে না। সংস্কৃতিচর্চার নতুন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিতর্ক আসুক। কিন্তু আমি যেন প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি। তার মধ্য দিয়েই নতুন দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল হোক।

জনসম্পৃক্ত হয়েই আমাদের সংস্কৃতিচর্চা করতে হবে। শুধু আজকের দিনের ঘটনাকে দিয়ে আমরা যেন সমকালকে বুঝতে না চাই, হাজার বছরের ঘটনা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে, আমাদের সংস্কৃতি কোনো একটি সুনির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, এর মধ্যে নানা গোষ্ঠীর অবদান আছে।