জলবায়ু পরিবর্তন: হাওরাঞ্চলের নারীর জীবন
সুইডিশ সরকারের সহযোগিতায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন: হাওরাঞ্চলের নারীর জীবন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১১ আগস্ট ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।
অংশগ্রহণকারী:
শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
সেখ ফরিদ আহমেদ, যুগ্মসচিব, ত্রাণ কর্মসূচি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
মনজুরুল হান্নান খান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও নির্বাহী পরিচালক, ন্যাকম।
ফারাহ কবির, কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ ।
মো. জিয়াউল হক, পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর।
গওহার নঈম ওয়ারা, প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব, ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরাম।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, পরিচালক (রাইটস অ্যান্ড গর্ভনেন্স), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
মো. শামসুদ্দোহা, প্রধান নির্বাহী, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
দিলরুবা হায়দার, প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, ইউএন উইমেন।
নিশাত সুলতানা, ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ।
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
গোলাম রাব্বানী, হেড অব ক্লাইমেট ব্রিজ ফান্ড সেক্রেটারিয়েট, ব্র্যাক।
সোহানুর রহমান, নির্বাহী সমন্বয়ক, ইয়ুথনেট গ্লোবাল ।
মো.আহসানুল ওয়াহেদ, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ।
সঞ্চালক: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।
আলোচনা
শাহীন আনাম
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
নাগরিক সমাজ বা এনজিও হিসেবে আমরা যা কাজই করি না কেন, তা কেবল একটি ব্যান্ডেডের মতো ছোট পরিসরেই থেকে যাবে, যদি এর পেছনে ব্যাপক নীতিগত সমর্থন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, সুশাসন ও জবাবদিহি না থাকে। আমাদের এনজিওগুলোর শক্তি হলো জনসচেতনতা সৃষ্টি, অ্যাডভোকেসি, গবেষণা ও লাইভলিহুড মডেলের মতো বিভিন্ন মডেল তৈরি করা। কিন্তু ব্যাপক প্রভাব ফেলতে হলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, অর্থায়ন ও অর্থের সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রই দিতে পারে।
এখনো আমরা হাওর অঞ্চলের দরিদ্র, বঞ্চিত নারীদের ব্যক্তিগত জীবনে তেমন গুণগত পরিবর্তন আনতে পারিনি। আমাদের সেই দিকেই নজর দিতে হবে, যেন একজন নারীকে প্রতিদিন দুই কিলোমিটার হেঁটে এক কলসি পানির জন্য যেতে না হয়। যেকোনো দুর্যোগে নারীরা নিরাপত্তা, জীবিকা, কাজের বোঝা ও স্বাস্থ্য—সব দিক থেকেই বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তা ছাড়া নারীর অবৈতনিক কাজের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে তাঁরা আরও প্রান্তিক অবস্থানে চলে যান, যা তাঁর বিপদাপন্নতাকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের চেয়ে বড় কোনো অগ্রাধিকার আর হতে পারে না। কারণ, এটি আমাদের অস্তিত্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও অর্থায়ন, অবকাঠামো ও সক্ষমতার মতো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবু আমি মনে করি, এ বিষয়ে আরও মনোযোগ ও উদ্যোগের প্রয়োজন।
আসন্ন নির্বাচনের আগে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনায় যুক্ত হতে হবে, যাতে ক্ষমতায় এলে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরে ও অগ্রাধিকার দেয়।
সেখ ফরিদ আহমেদ
যুগ্মসচিব, ত্রাণ কর্মসূচি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
সারা দেশের নারীদের সমস্যাগুলো প্রায় একই রকম হলেও আমি হাওর অঞ্চলের নারীদের প্রসঙ্গেই বলব। হাওর প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটারের একটি বিশাল অঞ্চল। প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ মানুষ সরাসরি হাওরের জীবিকার ওপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে দুই থেকে তিন লাখ নারীও আছেন। যাঁদের জীবনপ্রবাহ হাওরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
নারীদের নানা রকম সমস্যা সমাজে বিদ্যমান। জলবায়ু পরিবর্তন বাদ দিলেও এই সমস্যাগুলো অনেকটাই একই থাকত, কেবল মাত্রাগত পরিবর্তন হতো, ফলে তাঁদের জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন আসত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীরা তাঁদের মৌলিক ও আইনগত অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকার এখন পর্যন্ত হাওরে কত ধান উৎপাদন হলো, কত মাছ আহরণ হলো, সেটা হিসাব করে। এখন নারীর সংকটগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময়। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আরও সমন্বয় করা গেলে হাওর অঞ্চলের নারীর সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। দুর্যোগের সময় আমি দেখেছি, মাঠপর্যায়ে ইউনিয়ন, জেলা পরিষদ ও ডিসির নেতৃত্বে সব স্তরের মানুষ একত্র হয় এবং তখন সমন্বয়ের ঘাটতি তৈরি হয় না।
আমাদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ বের করতে হবে। আজকের গোলটেবিল থেকে হাওরে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নারীরা কী ধরনের সংকটে আছে, সেটা উঠে এসেছে। সেগুলো শনাক্ত করে সরকার সমাধানের পথ খুঁজবে। এর মাধ্যমে যদি হাওর অঞ্চলের নারীদের জীবনমান উন্নত হয়, তবে সেটাই হবে বড় অর্জন।
মনজুরুল হান্নান খান
নির্বাহী পরিচালক, ন্যাকম। সাবেক অতিরিক্ত সচিব, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়
হাওর যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, সেটার জন্য একটা মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ
(বহু খাত নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ) দরকার। এখন সেটা নেই। এই জায়গাটা তৈরি করতে হবে। পরিবেশ, স্থানীয় সরকার, মহিলা ও শিশুবিষয়কসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
আমাদের যে ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স আছে, সেখানে ডেভেলপমেন্ট মানেই হলো বড় বড় বিল্ডিং করা, রাস্তাঘাট করা, ব্রিজ করা।
এসব কিন্তু ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের মূল জায়গা। আপনি কোথাও কি দেখেছেন যে আমরা পাঁচ হাজার নারীকে তাঁর দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ করেছি? এটা ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে নিয়ে এসেছি? এ রকম কিন্তু কোনো ইনডেক্স করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদেরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
আমাদের রাজনীতিবিদেরা জলবায়ুর পরিবর্তন–সংক্রান্ত কাজে কতটুকু ইনভল্ভ? আমাদের মনে রাখতে হবে যে যাদেরকেই বলেন, এই আলোচনা থেকে যত কিছুই আসুক, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিবিদেরা এই আলোচনায় অংশগ্রহণ না করবেন, এই আলোচনাকে তাঁরা ধারণ না করবেন এবং পরবর্তী সময় তাঁরা ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য চেষ্টা না করবেন, আলোচনাটা আলোচনাই থেকে যাবে।
হাওরের নারীরা মানসিকভাবে ট্রমাগ্রস্ত। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, সন্তানসংখ্যার চাপ তাঁদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক নারী ১০টি সন্তান জন্ম দেন। কারণ, কয়েকজন মারা যাবে। এটি তাঁদের বেঁচে থাকার কৌশল। এ বিষয়ে জাতীয় নীতি প্রয়োজন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
ফারাহ কবির
কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ
আমরা একশনএইড ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুরে নারীদের জীবনযাত্রার অবস্থা বারবার তুলে ধরেছি। হাওরের নারীরা শুধু ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে পরিচিত হতে চান না; তাঁরা তাঁদের নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে আগ্রহী। আমরা দেখেছি যে তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে স্থানীয় সরকারের কাছে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের জন্য আবেদন করে সফল হয়েছেন, এমনকি ২০১৯ সালেও এমন অর্জন দেখা গেছে । তবে, ২০২২ সালের এক মাসের মধ্যে দুবার বন্যা হওয়ায় তাঁরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং উচ্চঝুঁকিতে পড়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন ও মানবিক বিপর্যয়ের এই আন্তসম্পর্কই আগামী দিনের বৈশ্বিক রাজনীতির মূল বিষয়। নারীদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে এবং তাঁদের আর্থিক সুযোগগুলোতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের আরও বেশি শক্তি, বিনিয়োগ ও সুযোগ তৈরি করতে হবে। এমনকি জামানতবিহীন ঋণের মতো আর্থিক সুবিধা সম্পর্কে অনেকে অবগতই নন। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুবিধাগুলোকে তাঁদের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে পারেনি।
নীতিমালার অভাব, সমন্বয়হীনতা বা আন্তবিভাগীয় কাজের অভাবের কথা আমরা প্রায় প্রতিটি সভায় বলি। কিন্তু এর মূল সমস্যা হলো রাজনৈতিক জবাবদিহি ও অঙ্গীকারের অভাব। আমাদের পলিসি আছে অনেক। কিন্তু কোনো পলিসি অ্যাকশন নেই। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয়ও দেখি না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্রাথমিকভাবে দাখিল করা প্রকল্প প্রস্তাবগুলো ধারণক্ষমতা বা মানের অভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। নারীর জলবায়ু পরিবর্তনসম্পর্কিত কাজ এগিয়ে নিতে আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। আশা করি, একটি নতুন, সংস্কারকৃত ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে এই বৈষম্যগুলো দূর করা সম্ভব হবে।
মো. জিয়াউল হক
পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর
আজকের আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এগুলো কীভাবে নীতি প্রণয়নে প্রতিফলিত হবে, তা ভাবা জরুরি। আমি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলোকে এই সুন্দর আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমরা চাই এই আলোচনার ভিত্তিতে একটি লিখিত সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হোক, যাতে পরবর্তী নীতি দলিলে সেগুলো বিবেচনা করা যায়। কেবল পত্রিকার এক পৃষ্ঠার আলোচনা যথেষ্ট নয়। লিখিত প্রস্তাবনা ছাড়া আমাদের সব ভালো কথা হারিয়ে যাবে। আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে অথবা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে লিখিত প্রসিডিংস দেখতে চাই।
জলবায়ু পরিবর্তনে নারীর সংকট চিহ্নিত করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নীতি প্রণয়নে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনায় এ মন্ত্রণালয়ের কাউকে দেখা যায় না। আমাদের উচিত তাঁদের আরও বেশি করে ডাকা এবং তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেওয়া।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের এখনো ভালোভাবে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করা যায়নি। আমাদের দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারীকে যেসব সংকট মোকাবিলা করতে হয়, সেগুলো হ্রাস করা যাবে।
আমাদের ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ) বাস্তবায়নের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। খুব শিগগির হয়তো প্ল্যানিং কমিশন থেকে একটি এসআরও (স্ট্যাটুটরি রেগুলেটরি অর্ডার) জারি হবে। যেখানে বলা হবে যে যেকোনো জলবায়ু পরিবর্তন–সম্পর্কিত প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ন্যাপের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া জরুরি। ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত না করে প্ল্যানিং কমিশন কোনো প্রকল্প অনুমোদন করবে না এবং তহবিলও দেবে না। এটি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এডিবি থেকে তহবিল পেতে হলেও আমাদের এটি লাগবে।
গওহার নঈম ওয়ারা
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব, ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরাম
হাওরকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের গবেষণার পদ্ধতি ভিন্ন হতে হবে। হয়তো
একটি সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু কয়েকটি সংস্থা মিলে কাজ করলে সারা বছর ধরে হাওরের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
শুধু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে টিক চিহ্ন দেওয়ার চেয়ে সেখানে থেকে পরিস্থিতি বুঝে নেওয়াটা অনেক জরুরি। এক বছর না দেখলে হাওরকে চেনা খুবই কঠিন কাজ।
পাহাড়ি ঢলের সময় হাওরে পানি দূষিত হচ্ছে, যা স্থানীয় জনস্বাস্থ্যর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ঢলের সময় কীভাবে দূষণ বাড়ছে, সেটার উৎস খুঁজে বের করতে হবে।
সুন্দরবনের বাঘবিধবাদের মতো হাওর এলাকায় বজ্রবিধবাদের সংখ্যা বাড়ছে, প্রতিবছর বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছেন। আমরা অবকাঠামো তৈরি করছি, যেমন বজ্রপাত নিরোধক লাগাচ্ছি, কিন্তু সেগুলোর প্রধান অংশই নেই, ফলে সেগুলো অকেজো।
হাওরের কিছু এলাকায় নারীরা ছয়–সাত মাস ইটভাটায় কাজ করতে যান। ইটভাটায় তো ছেলেমেয়ে নিয়ে যেতে হয় তাঁকে। এই জায়গাগুলোয় আসলে আমাদের কাজ করা খুব দরকার। তাঁদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
বাল্যবিবাহ বন্ধের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের একটি নতুন ব্যবস্থাপনার মধ্যে যেতে হবে, এই আইনটিকে পর্যালোচনা করতে হবে এবং অবশ্যই নারীদের একটি বড় অংশকে এর কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পুরুষদের জেন্ডার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। পুরুষদেরও তাঁদের মা, বোন বা কন্যার কথা ভাবতে হবে।
বনশ্রী মিত্র নিয়োগী
পরিচালক (রাইটস অ্যান্ড গর্ভনেন্স),মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
হাওর বাংলাদেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যময় ও ভৌগোলিকভাবে বিশেষ অঞ্চল, যা প্রতিবছর মৌসুমি বন্যা, অকাল বন্যা, অতিবৃষ্টি ও নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব দুর্যোগের তীব্রতা ও ঘনত্ব আরও বেড়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি, অবকাঠামো ধ্বংস, জলাবদ্ধতা ও জীববৈচিত্র্য বিনাশের পাশাপাশি বিশেষ করে মাছসহ হাওরের সম্পদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে নারীর বিপন্নতাও বাড়ছে, অথচ এ বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা প্রায় অনুপস্থিত।
জেন্ডার বাজেটের ক্ষেত্রে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের ঘাটতি কমিয়ে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে—জলাবদ্ধতা, অবকাঠামো, অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্য ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় দেখে, ফলে পরিকল্পনায় সামগ্রিক সমন্বয় হয় না। হাওরেরও ভিন্ন ভিন্ন ধরন আছে—পাহাড়ঘেঁষা, গভীর জলসম্পর্কিত ও সুরমা নদীর সঙ্গে যুক্ত জলাশয়, যার কারণে নারীরা ভিন্নভাবে সমস্যার মুখোমুখি হয় এবং এলাকাভিত্তিক আলাদা পদক্ষেপ প্রয়োজন।
হাওরে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নারীর জীবনে দারিদ্র্য, সহিংসতা ও বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। তাই প্রশ্ন হলো—আমরা এসবকে কীভাবে মোকাবিলা করব এবং এগুলো কি আমাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে? এ ক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় সরকার ও বহু খাতকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে এবং মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।
হাওরের নারীরা প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন; তাঁরা শুধু ভুক্তভোগী নন, বরং সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমাদের কাজ হলো তাঁদের কণ্ঠস্বরকে সামনে আনা, ক্ষমতায়ন করা এবং একটি ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু নীতি প্রণয়ন করা।
মো. শামসুদ্দোহা
প্রধান নির্বাহী, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
যখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করি, তখন ‘ন্যাচারাল ডিজাস্টার’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এর ফলে আমাদের রাজনৈতিক যুক্তি দুর্বল হয়ে যায় যে এগুলো জলবায়ু পরিবর্তন-প্ররোচিত দুর্যোগ। দুর্যোগকে আমরা এখন আর পুরোপুরি ‘ন্যাচারাল ডিজাস্টার’ বলছি না; কারণ, এটি অনেকটাই মানবিক কারণে সৃষ্ট। অক্ষমতা, দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব—এগুলো দুর্যোগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
যখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও এর ফল নিয়ে কথা বলি, তখন প্রথমেই আমাদের মনে আসে দুর্যোগ বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তন-প্ররোচিত বিপদ বৃদ্ধি। এর প্রথম ধারণাটি আসে অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা। আমরা অর্থনৈতিক পরিমাপ করে বলতে চাই যে এই বিপদ বৃদ্ধির প্রতিকার হলো একধরনের ‘হার্ড অ্যাপ্রোচ’
বা কারিগরি সমাধান, যেমন বাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা করা বা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা। এক দশক পর্যন্ত আমরা হয়তো এটি মেনে নিয়েছি।কিন্তু, এখন আমরা বলতে চাই যে এটি কেবল ‘হার্ড অ্যাপ্রোচ’ নয়, এর একটি মানবিক দিকও আছে। আমরা এখন জানি কীভাবে দুর্যোগ বৃদ্ধির ফলে একজন নারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর অনেক সামাজিক ও মানবিক দিক আছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাল্যবিবাহ বেড়েছে, এটি একটি সরল আখ্যান। আমিও অনেক জায়গায় এটি বলেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যতটুকু না বাল্যবিবাহ বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে অন্য সামাজিক সমস্যার কারণে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত সামাজিক সমস্যাগুলোকে একীভূত করে কাজ করতে হবে।
দিলরুবা হায়দার
প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, ইউএন উইমেন
আমি সুনামগঞ্জে গেছি। পানির একটা ব্যাপার আছে। ইলেকট্রিসিটির একটা ব্যাপার আছে। দেখেছি হাওর এলাকায় নারীদের জীবন কতটা কঠিন। ওখানে পাঁচ–ছয় মাস পানিবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়। সে সময় মেয়েদের জন্য স্কুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যাতায়াতের বড় সমস্যা, তার সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা সব সময়ই থাকে। ফলে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, ড্রপআউট বেড়ে যায়।
গবেষণায় এসেছে, বন্যার সময় নারীদের পানি সংগ্রহ করতে ৪/৫ ঘণ্টা সময় চলে যায়। ফলে জীবন–জীবিকা নিয়ে ভাবার সময় তাঁরা পান না। একটু বয়স হলেই পরিবার থেকে তাঁদের বিয়ে দেওয়া হয়। কারণ পড়াশোনার সুযোগ নেই, কাজের সুযোগও নেই, তাহলে মেয়েরা আর কী করবে?
অনেকে সোজাসুজি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার প্রকোপ বাড়ছে, তাই স্কুল থেকে ঝরে পড়া আর বাল্যবিবাহ বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবটা এত সরল নয়। এটা শুধু জলবায়ুর বিষয় নয়, সামাজিক বাস্তবতাও জড়িয়ে আছে। ব্যাপারগুলো আমাদের আরও গভীরভাবে বোঝা দরকার।
শুধু জলবায়ুকে দায়ী করলে আসল সমাধান পাওয়া যাবে না। হাওরে কাজ করার অনেক জায়গা আছে। বিশেষ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি স্পষ্ট। এ জন্য শক্তিশালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গড়ে তোলা জরুরি। স্থায়ী একটি কাঠামো থাকলে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে কাজের সমন্বয় সহজ হবে। এটাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সুযোগ আছে এবং সেই সুযোগ কাজে লাগানো দরকার।
হাওর এলাকায় ঘন ঘন বন্যার কারণে নারীর সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জায়গায় এত বেশি সন্তুষ্ট হয়ে গেছি যে এসব নিয়ে খুব বেশি গবেষণা করিনি। নারীর ভাগ্য উন্নয়নে কী করা যায়, সেটা নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন আছে।
নিশাত সুলতানা
ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস),
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার একটি গভীর যোগসূত্র আছে। আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওর অঞ্চলের নারীদের জীবনের যে ভয়াবহ বাস্তবতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা আলাদা কোনো বিষয় নয়। নারী সামগ্রিকভাবে যে বৈরী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন, সেটিই তীব্রতর হয়ে ওঠে দুর্যোগ পরিস্থিতিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব নারীর জীবনযাপনের ঝুঁকিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। দরিদ্রতা হোক কিংবা প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট দুর্যোগ; এর ফলাফল হিসেবে সহিংসতা বেড়েছে নারীর ওপর। বেড়েছে পারিবারিক ও যৌন নির্যাতন, বেড়েছে বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা।
আবার দরিদ্রতা প্রশমনে নারী যখন অর্থ উপার্জনের জন্য, কিংবা গৃহস্থালি কাজ যেমন বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে বাইরে বের হয়েছেন, তখনো তিনি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাঁকে নানা কটু কথা শুনতে হচ্ছে। এ যেন
এক জটিল চক্র। এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হলে সমস্যার মূলে আমাদের কাজ করতে হবে। নারীর চাহিদা ও ক্ষমতায়নের বিভিন্ন উদ্যোগে পুরুষদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে, তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তন হলে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাবেন নারীরা।
এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নারীর সক্ষমতা, দক্ষতা বাড়াতে হবে যেন পরিবর্তনটির সূচনা হয় নারীদের নেতৃত্বে ও তাদের অংশগ্রহণে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল নারীদের সক্ষমতা ও নেতৃত্বে সব সময় বিশ্বাসী। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের নেতৃত্বেকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি আমরা। প্ল্যান বিশ্বাস করে জলবায়ু পরিবর্তনের চাবিকাঠি প্রোথিত আছে প্রান্তিক পর্যায়ের যুব নারী ও কন্যাদের মধ্যে।
ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা বারবার শুনি হাওর অঞ্চলে বাল্যবিবাহের হার বেশি, কিন্তু এই যে বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়, তাতে কি হাওর অঞ্চলের জীবন ও পানির চক্র থেকে সেই মেয়েশিশু রক্ষা পায়? সে তো শুধু সেই পানি ও দুর্যোগের চক্রে আবদ্ধ থাকে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, কোন সাইকোসোশ্যাল এন্টিটি হাওর অঞ্চলের বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা এখনো জানি না হাওর অঞ্চলের নারীদের ওপর পানির সম্পর্কিত রোগ বা সামাজিক প্রভাব কী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে পার্থক্য করে দেখা উচিত।
জলবায়ুর ব্যাপারটা অনেকটা অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতির মতো, যা তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায় না, তাই এর গুরুত্বও আমরা ভালোভাবে অনুভব করতে শিখিনি। হাওর অঞ্চলের সমস্যার বহু-স্তরীয় (মাল্টি-লেয়ারস) দিক রয়েছে। যদি শুধু একটি একক দিক জলবায়ু পরিবর্তন দিয়ে হাওরের নারীকে দেখতে চাই, তাহলে সেটি সম্ভব নয়।
গোলাম রাব্বানী
হেড অব ক্লাইমেট ব্রিজ ফান্ড সেক্রেটারিয়েট, ব্র্যাক
হাওর অঞ্চলের নারী এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের বেশ কিছু ‘পলিসি গ্যাপ’ রয়েছে। আমাদের নীতিগুলোর মধ্যেই পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে, যা আমাদের দূর করতে হবে। এসব নীতিমালায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বাস্তবায়নকারী সংস্থা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু নারীর দৃষ্টিভঙ্গি ও জেন্ডার ইস্যু এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না।
২০১৬ সালে হাওর এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে প্রস্তাবিত গবেষণাকাজের অগ্রগতি কত দূর? গত আট বছরে তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। হাওর অঞ্চলের উন্নয়ন ও অভিযোজন পরিকল্পনা করতে হলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে নীতিমালার মধ্যে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না।
বর্তমান মাস্টারপ্ল্যানের রিভিউ ২০২৪ সালের মধ্যে হওয়ার কথা। এই মাস্টারপ্ল্যানে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সোহানুর রহমান
নির্বাহী সমন্বয়ক, ইয়ুথনেট গ্লোবাল
হাওরের তাহিরপুরে আমরা যুব-নেতৃত্বাধীন একটি গবেষণা করেছিলাম। সেখানে পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছিল। বাল্যবিবাহের বিষয়টিও বড় আকারে এসেছিল।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাল্যবিবাহ বন্ধে যত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সবই ব্যর্থ হয়েছে—এ কথা সত্য। এর পেছনে দারিদ্র্য, দুর্গমতা এবং দুর্যোগ—এগুলোকেও বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
অভিভাবকেরা জানান, ‘আমার মেয়ে যে স্কুলে যেতে পারছে না, ছয় মাস ধরে বাসায় বসে আছে, আমি কী করব?’ সেখানে স্কুল না থাকলে বিয়েই একমাত্র পথ। পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলোও সেখানে অনুপস্থিত।
আমরা কি কোনো মূল্যায়ন করতে পারছি যে নারীরা তাদের কতটা সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে? কোনো গান, কোনো ধান, কোনো পিঠা হারিয়ে যাচ্ছে কি না? লস অ্যান্ড ড্যামেজের নন-ইকোনমিক অংশে এই মূল্যায়ন দেখতে পাচ্ছি না। হাওরে নারীর জন্য আর্থিক নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও আমাদের সবার সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে হাওরের নারী, কিশোরী ও তরুণদের জলবায়ু সহনশীল করে গড়ে তুলতে হবে।
মো.আহসানুল ওয়াহেদ
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ডাটাস্কেপ ২০২৪ সালে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার তিনটি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে নারীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নির্ণয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সিলেট ও নেত্রকোনা অঞ্চলের তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সময়ের ব্যবধানে গড় তাপমাত্রা বাড়ছে, পাশাপাশি উত্তর–পূর্ব পাহাড়ি এলাকায় বর্ষার আগে–পরে ও বর্ষায় বৃষ্টি বাড়বে। তথাপি অনিয়মিত বৃষ্টি হবে।
গবেষণায় ৮৪.৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ও আবহাওয়ার তারতম্যের ফলে তাদের জীবিকা বারবার বিপর্যস্ত হচ্ছে ও দরিদ্রতা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। ৮৫.৪ শতাংশ মানুষ সামাজিক প্রথা ও অন্যান্য কারণের পাশাপাশি এই দরিদ্রতাকে নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ হিসেবে দেখছে। ৬৪.৭ শতাংশ বলছে, দুর্যোগ যেমন বন্যার সময় সহিংসতা বাড়ে, ১৭.১ শতাংশ নারী আশ্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার স্বীকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে। প্রায় ৭৮ ও ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা যথাক্রমে দারিদ্র্য ও সামাজিক প্রথাকে বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করেছে, ৩৩ শতাংশ বলছে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়। ৮৪ শতাংশ বলেছে দুর্যোগে নারীর অবৈতনিক কাজের চাপ বাড়ে, ৭৯ শতাংশ বলেছে বন্যার সময় নারীরা মাসিককালীন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারেন না। পাশাপাশি ৮৭.৬ শতাংশ অন্যান্য কারণের সঙ্গে আর্থিক সংকটকে কিশোরীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার জন্য দায়ী মনে করছে।
হাওরাঞ্চলের নারী ও কিশোরীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই জলবায়ু নীতি ও অভিযোজন কর্মপরিকল্পনায় নারীকেন্দ্রিক এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল পদক্ষেপ জরুরি।
সুপারিশ
• হাওর মাস্টার প্ল্যান ও অন্যান্য হাওরবিষয়ক দলিলকে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ও অন্যান্য জলবায়ু পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং জলবায়ু অর্থায়নে লিঙ্গ-সংবেদনশীল পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার প্রদান।
• পানিবণ্টন ও আবহাওয়াসংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
• জাতীয় ও স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে আন্তমন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
• স্থানীয় পর্যায়ে জেন্ডারভিত্তিক ঝুঁকি মূল্যায়ন, পরিবেশবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা করা।
• স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা।
• স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিবীক্ষণে যুক্ত করা এবং সেবাদাতার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
• পর্যাপ্ত পরিমাণে নারী ও প্রতিবন্ধীবান্ধব বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং সেগুলোর জেন্ডার সংবেদনশীল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
• পুরুষ ও কিশোরদের যুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মনোজাগতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করা।