শিশুর জন্য বাড়াতে হবে বিনিয়োগ

‘জাতীয় বাজেটে শিশুর জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ’ শিরোনামে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ইউনিসেফ বাংলাদেশ, সিপিডি ও প্রথম আলো।

শামসুল আলম, সুলতানা সাঈদা, শেলডন ইয়েট ও মোস্তাফিজুর রহমান

কর্মক্ষম প্রজন্ম গড়তে শিশুর প্রতি বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে শিশুর প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে এ বিনিয়োগ শুরু করতে হবে। এর জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা খাতে শিশুর জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

গতকাল শনিবার ইউনিসেফ বাংলাদেশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ মত প্রকাশ করেন বক্তারা। তাঁরা বলেন, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে ভবিষ্যতে দক্ষ একটি প্রজন্ম পাবে দেশ।

‘জাতীয় বাজেটে শিশুর জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ’ শিরোনামে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সার্বিক সহায়তায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

গোলটেবিল বৈঠকে ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে কোভিডকালে বাংলাদেশের শিশুদের কল্যাণে অগ্রসরমূলক ব্যবস্থা নেওয়া’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, কোভিডে শিশুদের কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা শনাক্ত করে সেই ক্ষতিপূরণে যথাযথ বরাদ্দ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

কোভিডে সরকার ২৮টি প্রণোদনা দিয়েছিল, তবে তার কোনোটিই সরাসরি শিশুদের জন্য ছিল না। সরকারের ১২০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে মাত্র ১৯টি সরাসরি শিশুদের জন্য। এটা এ খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ৮ শতাংশ। আরও ৫১টি সুরক্ষা খাত থেকে শিশু পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়, সেগুলো ধরা হলেও শিশুর জন্য বরাদ্দ ১৬ শতাংশের বেশি হয় না। ২০১৮ সালে সরকার ২০২০ সালের মধ্যে শিশুর জন্য বাজেট বরাদ্দ ২০ শতাংশ রাখার লক্ষ্য ঠিক করে। তবে ২০২১–২২ অর্থবছরেও দেখা গেছে, বাজেটের মাত্র ১৫ শতাংশ শিশুর জন্য বরাদ্দ রয়েছে।

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে শিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৫ থেকে ২০২৫ মেয়াদে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র (এনএসএস) তৈরি করে। ২৪টি মন্ত্রণালয় এনএসএস বাস্তবায়ন করে।

তবে কোভিডে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ২০২৫ সালের মধ্যে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এটাকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত নিতে হতে পারে। স্কুলের দুপুরের খাবার কর্মসূচিকে সর্বজনীন করতে চায় সরকার। তাঁর মতে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, কোভিডের সময় দেওয়া সরকারের প্রণোদনা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট কার্যক্রম ও মূল্যায়ন) সুলতানা সাঈদা বলেন, মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি, প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের জন্য বড় পদক্ষেপ। শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য প্রতিবছরই এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ছে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের এদেশীয় প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আশা যখন দেখা গিয়েছিল, তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক দুরবস্থা আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্রদের নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছে। এরপরও শিশুরা যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপ আরও শক্তিশালী করার সুযোগ ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে শিশুদের পরিবারগুলোর কেনাকাটার সক্ষমতা কমেছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, অপুষ্টি, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার শিকার হতে পারে শিশুরা।

বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ইশরাত শবনম বলেন, শিশুর জন্য কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, সেটার দিকেও নজর দেওয়া দরকার। শিশু কর্মসূচি বাস্তবায়নে কিছু ঘাটতি দেখা যায়। এ ছাড়া তথ্যেরও ঘাটতি রয়েছে। যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে পরিস্থিতি পরিমাপ করা না গেলে কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়া কঠিন।

অনুষ্ঠানে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেন, শিশুদের বয়স অনুপাতে সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো সাজাতে হবে। দেশে যা সম্পদ বা উৎস আছে, তার তুলনায় শিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দে বৈষম্য অনেক বেশি।

দেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সংখ্যা বেশি, কিন্তু বরাদ্দ কম উল্লেখ করে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসন এম এ রাজ্জাক বলেন, সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। যাদের সুবিধা পাওয়া উচিত, তাদের সবাই সুবিধা পাচ্ছে না।

বয়স, ভৌগোলিক অবস্থান ও ঝুঁকির বিষয়গুলোতে আলোকপাত করে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর সামাজিক নীতিবিশেষজ্ঞ হাসিনা বেগম। তিনি বলেন, দুর্গম এলাকার অনেক মা তিন মাসের পরিবর্তে এক বছর পর ভাতা তুলতে যান। এতে মায়ের পুষ্টি, গর্ভে থাকা শিশুর পুষ্টি এবং জন্মের পর শিশুর পুষ্টি নিশ্চিতের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না।

মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির বিষয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কর্মসূচি নীতি কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, এ কর্মসূচির ৯৮ শতাংশ ভাতা বরাদ্দ এবং মাত্র ২ শতাংশ বাস্তবায়ন খাতে ব্যয় হয়। ফলে সামান্য বাস্তবায়ন ব্যয়ের মাধ্যমে শিশুর প্রতি বিনিয়োগ করতে মায়েদের কতটা যত্নবান হতে হবে, সেই বার্তা পৌঁছানো যাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জাতীয় প্রকল্প সমন্বয়ক (শিশুশ্রম) সৈয়দা মুনিরা সুলতানা বলেন, কোভিডের কারণে শ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা বাড়লেও তারা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশের উপদেষ্টা (শিশুদের জন্য বিনিয়োগ) জাফর সাদিক বলেন, শিশুদের কাছেও তাদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া উচিত। আরও গবেষণার জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয়ের তথ্যগুলো উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন।

এ ছাড়া অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ মো. আশিক ইকবাল এবং সিপিডির কর্মসূচি সহযোগী মো. আসিফুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।