উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে করণীয়

ফ্রেন্ডশিপ ইনক্লুসিভ সিটিজেনশিপ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ৩১ জুলাই ২০২২। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

ড. শামসুল আলম

প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

মো. আবদুল মজিদ

প্রকল্প পরিচালক, এম ৪সি প্রকল্প, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ), বগুড়া

শেলডন ইয়েট

বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ইউনিসেফ

অনো ভ্যান ম্যানেন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ

লুভা নাহিদ চৌধুরী

মহাপরিচালক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

রুনা খান

প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, ফ্রেন্ডশিপ

ড. কাজী মারুফুল ইসলাম

অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আয়েশা তাসিন খান

ঊর্ধ্বতন পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধান, ইনক্লুসিভ সিটিজেন সেক্টর, ফ্রেন্ডশিপ

শাহরিয়ার সাদাত

পরিচালক, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন

সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জাহিদ রহমান

সদস্যসচিব, ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স

মো. নজরুল গনি

হেড অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আরডিআরএস বাংলাদেশ

আবদুল গফুর

চেয়ারম্যান, যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ, কুড়িগ্রাম

নূরী চৌধুরী

কমিউনিটি রিপ্রেজেনটেটিভ, গাইবান্ধা

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন খুবই জরুরি। এটা একটা জাতীয় বিষয়। সরকার ও স্থানীয় সরকার এ ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা প্রথম আলো উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলে কাজ করি। কুড়িগ্রামে একটি চরে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে একটি স্কুল পরিচালিত হয়। ২০০৯ সাল থেকে প্রথম আলো ট্রাস্ট সেখানে কাজ করছে। আবার ফ্রেন্ডশিপের মতো অনেক এনজিও চরাঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজ করে। আজকের আলোচনায় এসব বিষয় আসবে বলে আশা করি।

কাজী মারুফুল ইসলাম

কাজী মারুফুল ইসলাম

চরবাসীকে নিছক দরিদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে না দেখে নাগরিক হিসেবে তাদের পরিস্থিতি বোঝা ও তাদের সম্ভাবনা বিবেচনা করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আট বছর বাকি আছে। এ প্রচেষ্টা নিরর্থক প্রমাণিত হবে যদি এক কোটি চরবাসীর জীবনমানে উন্নয়ন না আসে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার স্লোগান হলো, ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’। যদি না আমরা চরের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।

দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের সফলতার বিপরীতে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার আমাদের অসম উন্নয়নের কথা বলে। এই বিভাগের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার অর্ন্তগত দুর্গম চরে দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশের বেশি, যখন জাতীয়ভাবে এই হার কমবেশি ২০ শতাংশ।

বন্যা ও নদীভাঙন চরবাসীর জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মসংস্থানের অভাব, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার অসুবিধা তাদের উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। নদীভাঙনে স্কুল বিলীন হয়ে যাওয়া, নিম্নমানের রক্ষণাবেক্ষণ ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব চরের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং বাল্যবিবাহ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে।

চরের জনগণকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ও সরকারি নানা কর্মসূচির সুযোগ প্রাপ্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে তারা নাগরিক হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে। চরবাসীর জীবনে অর্থপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সামাজিক ও অর্থর্নৈতিক উন্নয়নে গতিশীলতা আনয়নে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার।

চরবাসীর জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে টেকসই অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-পুষ্টি এবং আয়বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ ও নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। কাঠামোগত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে চরবাসীর শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নতি ঘটাতে হবে।

চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিদ্যুতায়ন এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর বিকল্প। চরের মাটির উর্বরতা শক্তিকে পুঁজি করতে হবে এবং চরের মানুষের মধ্যে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক উদ্যোগকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। পরিকল্পিত নদীশাসনের মাধ্যমে পুরোনো চরে বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে হবে।

নূরী চৌধুরী

নূরী চৌধুরী

চরাঞ্চলে বর্ষাকালে গর্ভবতী মায়েদের অবস্থা শোচনীয় হয়। কারণ, নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে প্রায় ৮০০ টাকা নৌকাভাড়ার প্রয়োজন হয়। তাই নৌকা ও টাকার অভাবে অনেকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে যেতে পারেন না। ফলে অনেক সময়ে মায়ের গর্ভেই সন্তান মারা যায়। এরপরও সেই মাকে মৃত সন্তান গর্ভে নিয়েই হাসপাতালে যেতে হয়। কারণ, তাঁর মৃত সন্তান তো প্রসব করা দরকার। বন্যার সময় যারা শিশু, বৃদ্ধ ও পঙ্গু; তাদের ভীষণ খারাপ অবস্থা হয়।

শিশুরা এক জায়গা থাকতে চায় না, এরা ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকে পানিতে পড়ে মারা যায়। শিশুদের অনেক সময় স্কুলের মাঠে রাখা হয়, সেখানে গরু-ছাগল, কুকুর-বিড়াল সবই থাকে। কখনো কোনো শিশুকে যদি কুকুরে কামড়ায়, তখন তাকে ভ্যাকসিন দেওয়া যায় না।

বন্যার সময় চরের মানুষজনকে অসহায়ের মতো ঘরের কোণে জড়ো হয়ে থাকতে হয়। এ সময় মানুষ ও গবাদিপশুর খাবারের চরম অভাব হয়। তরুণ–তরুণীরা খাবারের কষ্ট সহ্য করতে পারলেও যারা বৃদ্ধ ও শিশু, তারা খাবার না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। প্রতিবন্ধীরা যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য তাঁদের রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। বন্যার সময় আমরা স্কুলের মাঠে আশ্রয় নিই। কিন্তু কিশোরী ও নারীদের ওখানে থাকার মতো কোনো পরিবেশ থাকে না। নিরাপদ পানির অভাব থাকে। এ জন্য অনেকের ডায়রিয়া হয়। আসলে আমাদের চরাঞ্চলের মানুষের কষ্টের কোনো শেষ নেই।

আবদুল গফুর

আবদুল গফুর

কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি। কেননা পরিষদের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে আটটি ওয়ার্ডই চর এলাকা। চরে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ফ্রেন্ডশিসসহ অন্য এনজিওদের স্কুল আছে। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের অভাবে পাড়শোনা ঠিকমতো হয় না। চরাঞ্চলে নদীভাঙন লেগেই থাকে। প্রতিবছর কয়েক শ বাড়ি ভেঙে যায়। এর কোনো টেকসই সমাধান করতে না পারলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের চর এলাকায় কোনো উচ্চবিদ্যালয় নেই। সে জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পর মেয়েদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। ফ্রেন্ডশিপের স্কুলে অবশ্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। বন্যার সময় স্কুলসহ বেশির ভাগ জায়গা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন মানুষ, গরু-ছাগল, হঁাস-মুরগি কোনো কিছুরই আশ্রয় থাকে না। এর সমাধান হিসেবে জায়গা উঁচু করে এমনভাবে আবাসন করতে হবে, যেন স্কুল হিসেবে তা ব্যবহার করা যায়, আবার বন্যার সময় আশ্রয়ও নেওয়া যায়। এখানে যোগাযোগের জন্য যদি সাশ্রয়ী মূল্যে স্পিডবোট ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে গর্ভবতী মা, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও এনজিও কর্মীসহ চরবাসীর অনেক উপকার হবে।

আয়েশা তাসিন খান

আয়েশা তাসিন খান

চরাঞ্চলে পুরুষের চেয়ে নারীদের সমস্যা বেশি। সমতা ও সম্পদ—দুই দিক থেকেই তারা পিছিয়ে আছে। নারী ও কিশোরীদের সমস্যার যেন শেষ নেই।

জন্ম থেকেই নারীদের প্রতি একধরনের নেতিবাচক মানসিকতা থাকে। আমাদের আগে খুঁজে দেখতে হবে যে কেন নারী ও কিশোরীদের প্রতি বৈষম্য হয়। বৈষম্যের কারণ চিহ্নিত করতে পারলে এটা দূর করা সহজ হবে যে কেন মেয়েশিশুরা ঝরে পড়ছে, কেন তাদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

চরের মানুষের উন্নতি করতে হলে সেখানের নারী-পুরুষ সবাইকে অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা কঠিন। সেটা নারী ও কিশোরীদের জন্য আরও কঠিন। নারী-পুরুষের বৈষম্য কমলে অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের মাধ্যমে চরাঞ্চলের মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।

দক্ষতা অর্জন করতে পারলে তারা নিজেরাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে। সরকারের দিক থেকে এমন কিছু প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন যেন চরাঞ্চলের নারী-পুরুষেরা সেসব প্রকল্পে থেকে উপকৃত হতে পারে। চরের মানুষ যা উৎপাদন করে, সেটা বাজারজাত করা একটি বড় সমস্যা। কারণ, উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজ থেকে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। চরাঞ্চলের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। চরের মানুষের জীবনমানের উন্নতি করতে হলে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

জাহিদ রহমান

জাহিদ রহমান

২০১৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা প্রথম কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে একটি চর কনভেনশন করেছিলাম। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ছিলেন প্রধান অতিথি। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, গবেষক, চরাঞ্চলের মানুষসহ প্রায় এক হাজার মানুষের উপস্থিত ছিল। সারা দিনের এ আলোচনায় আমাদের গবেষকেরা ১৬টি পেপার উপস্থাপন করেছিলেন।

আমরা সেখানে ১৪ দফা দাবি দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ছিল জাতীয় চর উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, জাতীয় চর উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন, চরের মানুষদের সরকারের সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতায় আনা, তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দসহ সোশ্যাল সেফটি নেটের বৈষম্য কমানো ও অন্যান্য।

আগামী ২০ বছর পর চরের মানুষকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই—এর একটি পরিকল্পনা থাকা দরকার। যেন মানুষ বুঝতে পারে যে আগামী দিনে চরের মানুষকে নিয়ে এসব পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনেও আমরা এটা বলেছি। আমাদের অ্যাডভোকেসির জন্য ২০১৭ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে চরাঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, অবকাঠামোর উন্নয়ন, পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি সম্প্রসারণে সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তনে সক্ষমতা অর্জন ও সবশেষে চরাঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে। আজকের আলোচনার প্রধান অতিথির কাছে আমাদের বিশেষ আবেদন, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য যেন দ্রুত একটি চর উন্নয়ন বোর্ড গঠন ও চর নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। চর আমাদের সম্পদ। চরের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে তারা অবদান রাখবে।

অনো ভ্যান ম্যানেন

অনো ভ্যান ম্যানেন

চরের শিশুদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা এবং তাদের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো কীভাবে চরের শিশুদের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং তাদের জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের অনুঘটক হতে পারে, তা আলোচনায় আসা প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকা, পুষ্টি এবং সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভাঙার প্রচেষ্টায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার একসঙ্গে কাজ করা দরকার।

চরের শিশুদের জন্য অনেক সংগঠন কাজ করলেও তারা এই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রটি ভাঙতে পারেনি। কারণ, আমরা দেখতে পাই, একই চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি ঘটছে বছরের পর বছর ধরে। চর এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের সমস্যা মোকাবিলায় সম্পদের ঘাটতি চিহ্নিত করে, দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করা এখন সময়ের দাবি।

চরের মানুষ এবং স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে সামাজিক চুক্তি বজায় রাখার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুদের এখনই প্রস্তুত করতে হবে। জন্মগ্রহণের সময়, স্থান বা পিতামাতার পরিচয় অথবা সামাজিক অবস্থান–নির্বিশেষে, প্রত্যেক শিশু স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক শিক্ষা এবং খাদ্যনিরাপত্তার মৌলিক মানবাধিকারের দাবিদার।

মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন

মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন

চর নিয়ে আমার গবেষণা রয়েছে। আয়ারল্যান্ডে এ গবেষণা উপস্থাপন করি। চরের মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন দেখে তাঁরা বলেছিলেন, আমাদের চরের মানুষেরা আয়ারল্যান্ডের মানুষের চেয়েও স্মার্ট। প্রত্যেক মানুষই সমাজের প্রতিনিধি। চরের মানুষ অত্যন্ত দক্ষ। ফ্রেন্ডশিপের মতো এনজিও যদি ক্ষমতায়নে কাজ করে, তাহলে তারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

সরকারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কাজ করছে। এরপরও সমস্যা থেকে যাচ্ছে। কত মানুষ চরে বাস করে, কতজন নদীভাঙনের কবলে, কতজন শহরে আসছে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে সঠিক পরিকল্পনা করা যায় না।

আইনি জটিলতার জন্য চরের জমিতে চরের মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জমি দখল করেন। এ ক্ষেত্রে ‘চর ব্যবস্থাপনা’ নামে যদি কোনো সংস্থা থাকে, তাহলে তারা বিষয়টি দেখাশোনা করতে পারবে। একজনের কতটুকু জমি আছে, কতটুকু নদীতে গেছে, এসব জানার জন্য যখন সে সরকারি অফিসে যায়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে কিছু জানতে পারে না।

বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো এখানে একটি কর্তৃপক্ষ থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ, সরকার ও এনজিও প্রতিনিধি, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, জমিসংক্রান্ত আইনজীবী এবং চর এলাকার প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি দল গঠন করা যেতে পারে। এসব ব্যক্তি চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করবেন। আজকের মতো এ ধরনের সংলাপ চালু রাখা দরকার, যেন চরের সমস্যাগুলো সামনে আসে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে চরের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

মো. আবদুল মজিদ

মো. আবদুল মজিদ

সুইজারল্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর একটি চরে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চরের মানুষ খুব স্মার্ট। সেখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। চরের প্রধান জীবিকা হলো কৃষি ও পশুপালন। চর জীবিকা উন্নয়ন প্রকল্প (সিএলপি) অধীনে অনেক চরে নির্দিষ্ট কিছু ভিটা উঁচু করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গে চরে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা প্রায় সবাই এর অংশীদার ছিলেন। আমরা তাঁদের নার্সারি করার ব্যবস্থা করেছি। কুড়িগ্রাম চরের ৬০ জন ছোট নার্সারি করার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁদের একজন প্রায় পাঁচ লাখ গাছ বিক্রি করেছেন, যা চরে সবুজায়ন ও মাটির ক্ষয়রোধে অবদান রাখছে।

এবার ভুট্টায় চরের মানুষ অনেক বেশি আয় করেছে। পাঁচ বছর আগে এক বিঘা জমিতে ১০ মণ ভুট্টা উৎপাদিত হতো। এখন সেখানে ৪০ মণ উৎপাদিত হয়। বিঘাপ্রতি ৩০ মণ উৎপাদন বেড়েছে। সবার উদ্যোগে এটা হয়েছে। কিন্তু এই ভুট্টা তারা সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ জন্য ছয়টি শস্য সংরক্ষণাগার করা হয়েছে, যেন গরম ও শীতের প্রভাব থেকে ভুট্টা রক্ষা পায়। চরে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। চরে প্রায় ১ কোটি মানুষের ১৫ লাখ পরিবার রয়েছে। এমন কোনো পরিবার নেই, যে পরিবারে একটি গরু নেই। গরুর জাত পরিবর্তনের জন্য সিএলপি কাজ করছে।

সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৪২টি পরিবার রয়েছে। তাদের জন্য তেমন কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই। তাদের জন্য প্রকল্প নিতে হবে। সরকার তাদের মধ্যে দেশি মুরগি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। কুড়িগ্রাম চরে প্রায় ৩ লাখ একর জমি আছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৭ হাজার একর জমিতে এক ফসলের চাষ হয়। এখনো প্রায় ১ লাখ একর জমিতে চাষ হচ্ছে না। চরে যদি সঠিকভাবে ভুট্টা উৎপাদন করা যায়, তাহলে সেখান থেকে ৩ হাজার ২৪০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

মো. নজরুল গনি

মো. নজরুল গনি

১৯৯৩ সাল থেকে কুড়িগ্রাম জেলার সব চরে গিয়েছি। সেখানে থেকেছি। সে সময় আমরা কুড়িগ্রামের সমগ্র চর এলাকায় হাই ফ্রিকোয়েন্সির ওয়্যারলেস স্থাপন করেছিলাম। এরপর ২০০২ সালে চর জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় আমরা চরে অনেক কাজ করেছি।

৫০ হাজার চরবাসীকে গরু ও হাঁস-মুরগি দেওয়া হয়েছিল। গরুর অসুখের ভ্যাকসিন ও সোলারচালিত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে ‘চরের সাফল্য, সম্ভাবনা ও আগামীর অঙ্গীকার’ শিরোনামে আঞ্চলিক চর সম্মেলন হয়েছিল, সেখানে চরের মানুষ নিজেদের সমস্যার কথা বলেছে। নারীদের একটি বড় সমস্যার কথা ছিল। সেটি হলো, রাতের বেলা প্রসববেদনায় অনেকের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। আমরা কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের সেবা দিয়েছি। সবার সঙ্গে আমরাও একমত যে চরের মানুষের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে।

শাহরিয়ার সাদাত

শাহরিয়ার সাদাত

আমরা চরের মানুষের দুঃখ–দুর্দশার কথা বলব নাকি তাদের স্বপ্ন ও আকঙ্ক্ষার কথা বলব, সেটি একটি বিষয়। চরের মানুষের নিজস্ব একটি শক্তি আছে। সেই শক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়ে ভাবতে হবে। আমাদের উন্নয়নভাবনার মধ্যে ন্যায়বিচারের বিষয়টি আনতে হবে। ডিজিটাল ইউনিয়ন ও গ্রাম আদালত—বাংলাদেশের এ দুটি ভালো উদ্যোগ রয়েছে। ডিজিটাল ও ন্যায়বিচারের সেবা মানুষের দোরগোড়ায় নেওয়া হয়েছে। এই সেবার হয়তো অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু এই সেবা আরও কীভাবে জনবান্ধব করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করা প্রয়োজন। ফ্রেন্ডশিপের সঙ্গে চরের মানুষের অবস্থা দেখতে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে, তারা অফুরন্ত শক্তির অধিকারী, তাদের সে শক্তি কাজে লাগাতে হবে।

২০১৭ ও ২০১৮ সালে একটি জাস্টিস অডিট হয়েছিল। সেখানে দেখা গেল, বিচার পেতে প্রান্তিক মানুষকে এক থেকে তিন ঘণ্টা যাতায়াত করতে হয়। প্রতিবার যাতায়াতে ৬৪০ টাকা খরচ হয়। এর সঙ্গে সময়ের মূল্য যোগ করলে অঙ্কটা অনেক বড় হয়। সাধারণত মানুষ বিচার পাওয়ার জন্য তিন কিলোমিটারের বেশি দূরে যেতে চায় না। বিচারপ্রাপ্তির স্থান মানুষের বসবাসের কাছে হতে হয়। চরের মানুষের জন্য এটা আরও বেশি প্রয়োজন।

ফ্রেন্ডশিপের সঙ্গে চরে গিয়ে মনে হয়েছে, চরবাসী ও আমাদের উন্নয়নভাবনার মধ্যে পার্থক্য আছে। চরের মানবসম্পদের উন্নয়নে বেশি জোর দিতে হবে।

লুভা নাহিদ চৌধুরী

লুভা নাহিদ চৌধুরী

যে উন্নয়ন মানুষের কল্যাণ করে না, সে উন্নয়ন অর্থহীন। আলোচনায় প্রশিক্ষণের কথা এসেছে। ওয়াটারল্যান্ড রিলেশনশিপ নিয়ে নতুন করে ভাবা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখতে হবে। ভূমি থেকে জলের দিকটা চিন্তা করছি। একটু অন্যভাবে চিন্তা করা যায় কি না, সেটি ভাবতে হবে।

আমাদের যে ডেলটা প্ল্যান আছে, তার সঙ্গে চরের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটি নিয়েও ভাবা দরকার। নগরের মতো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য চরে নেই। কারণ, এখানের যে বৈচিত্র্য, যে বহুত্ব, এর মধ্যে তাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি হয়তো আছে। যেটা অন্য জায়গা থেকে আলাদা।

তাদের যে নিজস্ব স্পন্দন আছে, সেভাবেই তাকে গ্রহণ করতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মায়না দ্বীপে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি সেটি পেরেছিলেন কি না, উপন্যাসে তা আর জানা হয়নি।

তবে আমরা চাই, চরে একটি মানবিক সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠিত হোক।

শেলডন ইয়েট

শেলডন ইয়েট

চর এলাকায় শিশুদের কল্যাণে কাজ করার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। পৃথকভাবে কাজ করলে চরের শিশুদের সহায়তা প্রদানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। শহরের একটি বস্তিতে অপুষ্টি ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলো একটি চর এলাকা থেকে ভিন্ন হতে পারে। মোট কথা, একই সমস্যার মূল কারণ জায়গাভেদে ভিন্ন হতে পারে।বিগত সময়গুলোতে সরকার ও ইউনিসেফ যৌথ অংশীদারত্বে একাধিক গবেষণা পরিচালনা করেছে, যা বিভিন্ন খাত, অঞ্চল ও সম্প্রদায়গুলোকে বিবেচনায় রেখে করা হয়েছে। চরবাসী, বিশেষত চরের শিশুদের উন্নয়নের জন্য, সুশীল সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বহুমাত্রিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো দরকার। উন্নয়ন কার্যক্রমে সব অংশীদারকে সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব আসতে হবে সরকারের তরফ থেকে। টেকসই উন্নয়নের প্রয়াসসফল করতে সীমিত সম্পদের ব্যবহার, জ্ঞান ও তথ্য আদান-প্রদান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনা করাঅতি গুরুত্বপূর্ণ।

রুনা খান

রুনা খান

প্রায় ২৭ বছর ধরে চরের মানুষ ও তাদের উন্নয়ন আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চরের মানুষ মূলধারা থেকে অনেক দূরে। একজন নারীর কথা জানি। তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়েছিলেন। ওই নারী ৩ দিন ধরে হেঁটে ঢাকায় গিয়ে ১৫ দিন কাজ করে পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করেছেন। স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছেন। এই হলো চরের একজন নারীর চ্যালেঞ্জ।

এসব মানুষের জীবনমানে পরিবর্তন আনতে হলে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে, সমাজের সঙ্গে মিশে কাজ করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে পরিবর্তন আসবে না। চরের ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তাঁদের অনেকে শহরে চাকরি করেন। একটি এনজিও যতই কাজ করুক, কোনোভাবেই একা সমস্যার সমাধান করতে পারে না। দিন শেষে সরকারকে এগিয়ে আসতেই হবে, সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। এই সময়ে ইপিআইয়ের জাতীয় কভারেজ ৭২ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ফ্রেন্ডশিপ ভাসমান হাসপাতাল, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, প্যরামেডিকরা চরের শিশুদের কাছে সরকারের টিকা কর্মসূচির পূর্ণ সুবিধা প্রদান করছে।

আমাদের কাজের ফলাফল আমরা দেখি মানুষের সচেতনতার পরিবর্তনে। আজ চরের মানুষ কথা বলছেন এই সেমিনারে, জলবায়ু সম্মেলনে, নিশ্চয়ই চরের একজন শিক্ষার্থী অদূর ভবিষ্যতে অক্সফোর্ডে পড়বেন। সরকার ও আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে চরের মানুষের জীবনমানে আরও পরিবর্তন আসবে। কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চর নিয়ে কথা হয়েছিল। তিনি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আমাদের চর নিয়ে কাজের কথা শুনেছেন। তিনি চরের মানুষের খোঁজখবর রাখেন এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে বলেছেন।

শামসুল আলম

শামসুল আলম

আজকের এ আলোচনা খুব প্রাসঙ্গিক। দুর্গম এলাকার মানুষ কোনো না কোনোভাবে সুবিধাবঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। সারা দেশেই প্রায় চর আছে। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, সারা দেশের চরের বিষয় আলোচনায় তুলে আনলে ভালো হতো। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আছে, কেউ পেছনে থাকবে না। তাই আজকের এই আলোচনাটা খুব জরুরি।

আশার কথা হলো, বিভিন্ন এনজিও চর এলাকায় কাজ করছে। কিছু সমস্যার সমাধান করছে। অনেক সমস্যা সামনে আসছে। আবার প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি জানেন। চর নিয়ে অনেক আশার কথা শুনেছি। বাজেটে চরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু হতাশার কথা হলো, এ বরাদ্দ অনেক সময় ব্যয় হয় না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল; কিন্তু বরাদ্দ ব্যয় হয়নি। আবার চর উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ রাখা হলো, ব্যয় হলো না। কোথায় সমস্যা, এ বিষয়টি দেখা দরকার।

আমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দরিদ্র অঞ্চলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রেখেছিলাম। তখন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এসব অর্থ ব্যয় হয় না। পরে দেখা গেল, এমন অনেক খাতের অর্থ ব্যয় হয় না। চরে স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির সমস্যা রয়েছে। আবার সব চরের সমস্যা এক রকম নয়। ফলে একটি ফাউন্ডেশন ব্যবস্থা নিলেই যে সেটি সুফল দেবে, তা নয়। সরকারের বর্তমান যে সুযোগ-সুবিধা আছে, সেটিকে আরও কীভাবে ফলপ্রসূ করা যায়, তা ভাবতে হবে।

প্রতিটি চরই থানা বা উপজেলার সঙ্গে যুক্ত। কৃষি, শিক্ষা, পয়োনিষ্কাশন, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে যাতে আরও বেশি সহযোগিতা দেওয়া যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

চরাঞ্চলের সম্ভাবনা ব্যাপক। এটি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে চরের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। নীতিনির্ধরণী পর্যায় থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

সুপারিশ

  • চরের মানুষের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় বা জাতীয় চর বোর্ড গঠন।

  • সরকারি–বেসরকারি নানামুখী উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষতাবৃদ্ধি করা।

  • চরবাসীর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ও সরকারি নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।

  • যোগাযোগব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন করা।

  • স্বাভাবিক সময় শিক্ষাদান ও বন্যার সময় আশ্রয় নেওয়া যায়—এমন টেকসই ও স্থানান্তরযোগ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা।

  • চরাঞ্চলের স্কুলের শিক্ষকসংকট দূর করা।

  • কত মানুষ চরে বাস করে, তার সঠিক পরিসংখ্যান জরুরি।

  • বন্যার সময় নারী, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

  • চরবাসীর জন্য সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টির সহজলভ্যকরণ।

  • আয়বর্ধক কাজের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।

  • পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধ ও চরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।