নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বাজার সংযোগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউয়ার্স ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ (উই-ফাই)’ প্রকল্পের সহযোগিতায় এসএমই ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বাজার সংযোগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। প্রথম আলো কার্যালয়ে ১১ মার্চ ২০২৪ এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়।ছবি: খালেদ সরকার

অংশগ্রহণকারী

মো. মাসুদুর রহমান

চেয়ারপারসন, এসএমই ফাউন্ডেশন

হোসনা ফেরদৌস সুমি

সিনিয়র প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট, িবশ্বব্যাংক

তানিয়া হক

অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সালাহউদ্দিন মাহমুদ

ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), এসএমই ফাউন্ডেশন

হুমায়রা আজম

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্রাস্ট ব্যাংক

ফারহানা এ রহমান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেড

ঈশিতা শারমিন

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিক্রয়.কম

স্বর্ণলতা রায়

সভাপতি, সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

ফারজানা খান

মহাব্যবস্থাপক, এসএমই ফাউন্ডেশন

সাদরুদ্দীন ইমরান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইনোভেশন কনসালটিং

ফাহাদ রহমান

সিনিয়র ম্যানেজার, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, আড়ং

ফারহানা মুনমুন

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা

মুনির হাসান

সমন্বয়ক, যুব কর্মসূচি, প্রথম আলো

সঞ্চালনায়

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

মো. মাসুদুর রহমান

মো. মাসুদুর রহমান

চেয়ারপারসন, এসএমই ফাউন্ডেশন

ফরচুন গ্লোবাল ফাইভ হান্ড্রেড করপোরেট প্রতিষ্ঠান বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য ক্রয় করে। এর মাত্র ১ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের। আর এসব প্রতিষ্ঠান ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের। সে তুলনায় আমাদের অবস্থা খারাপ না। আশাহত হওয়ার কারণ নেই। আমরা আরও দ্রুত নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করব।

১৯৭৪ সালে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৯০ সালে ১৪ শতাংশ। ২০১০ সালে নারীর অংশগ্রহণ ৩৬ শতাংশ। ২০২২ সালে নারীর অংশগ্রহণ ৪৩ শতাংশ। ভারতের জিডিপিতে নারীর অবদান ১৮ শতাংশ। ভারতের ২০ শতাংশ ব্যবসার মালিক নারী। বাংলাদেশের জিডিপিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এটা ৫ থেকে ৭ শতাংশের বেশি হবে না। ভারতের তুলনায় ব্যবসায়ে আমাদের নারীরা অনেক পিছিয়ে।

২০০৯ ও ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে এসএমই ফাউন্ডেশন রিসার্চ পরিচালনা করে। সেখানে আমরা দেখেছি যে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে সমাজের ধারণা ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। ২০০৯ সালের গবেষণায় দেখেছি প্রায় ৫০ শতাংশ মা-বাবা চান না যে তাঁদের মেয়েরা বাইরে কোনো কাজ বা ব্যবসা করতে যাক। ২০১৭ সালে প্রায় অধিকাংশ মা–বাবা চান যে তাঁদের মেয়েরাও কোনো না কোনো কিছু করুক। ২০০৯ সালে ১০ শতাংশ নারীর টিআইএন সনদ ছিল। ২০১৭ সালে ৫৬ শতাংশ নারীর টিআইএন সনদ আছে। ২০০৯ সালে ১০ শতাংশ নারী কম্পিউটার চালাতে পারতেন। ২০১৭ সালে ৩৭ শতাংশ নারীর কম্পিউটার চালাতে পারেন। আমাদের ২০ হাজার ফেসবুক আইডি আছে। এর মধ্যে ১২ হাজার মেয়েরা চালান। আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের যে মূলধন দরকার হয়, এর ৬৩ শতাংশ তার নিজের। ৭ শতাংশ পান স্বামীর কাছ থেকে। ব্যাংক দেয় মাত্র ১৯ শতাংশ। আমাদের ব্যাংকও আগের মতো নেই। গত বছর তিন লাখ কোটি টাকা এসএমই খাতে ব্যাংক লোন দিয়েছে। আমরা সবাই মিলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কাজ করলে ভবিষ্যতে তাঁরা ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে পারবেন।

বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমরা যে কাজটি করছি, সেটি হলো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পণ্য কেনার ক্ষেত্রে আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের যেন একটা সংযোগ তৈরি হয়। আমাদের করপোরেট প্রতিষ্ঠান কী ধরনের পণ্য কেনে, তাদের চাহিদা কী—এটা যেমন আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের জানা প্রয়োজন, তেমনি আমাদের যাঁরা নারী উদ্যোক্তা আছেন, কী পণ্য উৎপাদন করছেন, তাঁদের সক্ষমতা কী, এটাও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জানা প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে আমরা দুই পক্ষের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করব। আজকের আলোচনায় বারবার আসছে করপোরেট গিফট আইটেমের কথা। আমরা ধরে নিয়েছি আমাদের নারীরা করপোরেট গিফট আইটেম ছাড়া আর কিছু তৈরি করতে পারবে না। দেশে তিন ধরনের ব্যবসা আছে। আমাদের ৬৯ শতাংশ নারী ট্রেডে আছেন। উৎপাদন কারখানায় আছে ১৯ শতাংশ। সেবা খাতে আছে ১২ শতাংশ। শুধু গিফট আইটেম না, আমাদের নারী উদ্যোক্তারা আরও অনেক পণ্য উৎপাদন করতে পারেন।

বড় প্রতিষ্ঠানে পণ্য বিক্রি করতে হলে কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। পণ্য সরবরাহের যোগ্যতা, পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা, পণ্যের মান উন্নয়ন, পণ্যে নতুনত্ব আনা, সৃজনশীলতা, বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি।

আমার সবাই এ বিষয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। একজন উদ্যোক্তা যদি দেশে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে না পারেন, তাহলে তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে কীভাবে প্রবেশ করবেন। সুতরাং আমরা যা উৎপাদন করছি, সেটা সম্পর্কে কেন আমাদের উদ্যোক্তারা জানেন না। নীলক্ষেতে ক্রেস্টের যে বক্স থাকে, সেটা চীন থেকে আমদানি করা হয়। তাহলে আমাদের সক্ষমতা কোথায় দাঁড়াল যে একটা ক্রেস্টের বক্সও আমরা তৈরি করতে পারছি না। ব্যবসায়ীরা হয়তো অনেক বিদেশি পণ্য কম খরচে পান। তার মানে আমরা সেই সক্ষমতা এখনো অর্জন করিনি। এসব সক্ষমতা আমাদের অর্জন করতে হবে। আমরা এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে সেটা করার চেষ্টা করছি। এসব বিষয়ে আমরা নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।

হোসনা ফেরদৌস সুমি

হোসনা ফেরদৌস সুমি

সিনিয়র প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট, বিশ্বব্যাংক

নারী উদ্যোক্তা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অনেক প্রকল্প আছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশ্বব্যাংকের নানা উদে্যাগ আছে। বিশ্বের ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেড কোম্পানির প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা ক্রয় করে। তার মাত্র ১ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ক্রয় করে। তখন থেকে চিন্তা ছিল কীভাবে এসব বড় প্রতিষ্ঠানে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য ও সেবা পৌঁছানো যায়। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশে কাজ শুরু হয়েছে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮-১৯ সালে আমরা কাজ শুরু করি। তখন আমরা এসএমই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলাম। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান জানে না যে এখানকার নারী উদ্যোক্তারা কী কাজ করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ধারণা, নারী উদ্যোক্তারা বাসায় আচারজাতীয় পণ্য বানান। আর তাঁরা ফ্যাশন ডিজাইনের কিছু কাজ ও পারলারে কাজ করেন। অনেক ক্ষেত্রে এটা হয়তো সত্য। কিন্তু তাঁরা কখনো চিন্তা করেন না তঁাদের প্রতিষ্ঠানে কীভাবে নারী উদ্যোক্তারা যুক্ত হতে পারেন। আমরা তাঁদের বললাম কী ধরনের সেবা ও পণ্য আপনারা ক্রয় করেন। আপনারা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম থেকে পণ্য ও সেবা নেন। তারা সাধারণত আইটি সেবা, অফিসের উপকরণ, রেন্টাল কার এ ধরনের সেবা ও পণ্য ক্রয় করে। বিভিন্ন উৎসবে উপহারসামগ্রী কেনে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য নিতে চাইলে তারা তা দিতে প্রস্তুত আছে। এ ধরনের পণ্য ও সেবা সরবরাহে নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে নারী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

২০২১ সালে ওম্যান এন্ট্রাপ্রেনিউর ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টের কার্যক্রম শুরু হয়। এসএমই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি অনলাইন সাপ্লায়ার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। এর আগে করপোরেট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে। প্রায় সব ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায়। কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবস্যা তাদের ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। নারী উদ্যোক্তাদের তালিকা পাওয়া যায় না। তাঁদের মধ্যে তেমন সমন্বয়ও নেই। অনেক নারী উদ্যোক্তা বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কীভাবে নিজের উদ্যোগ তুলে ধরবেন, সেটাই অনেক সময় জানেন না। এসব বিষয় আমরা তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে নারী উদ্যোক্তাদের করণীয় সম্পর্কে আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।

তানিয়া হক

তানিয়া হক

অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তারা একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে নারীর একটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। একজন নারী উদে্যাক্তা শুধু একাই উপার্জন করছেন না, আরও অনেকের উপার্জনের সুযোগ তৈরি করছেন।

একজন নারী উদ্যোক্তা মানে হলো তিনি একজন ব্যবসায়ী। এখনো আমাদের পরিবার ও সমাজ নারী ব্যবসায়ীকে সেভাবে মূল্যায়ন করে না। আজকের অনুষ্ঠানের নারী উদ্যোক্তাদের সমাজে একটা বিশেষ অবস্থান আছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের অনেক সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। গ্রাম এলাকার উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন বাধার মুখে পড়তে হয়।

গ্রাম, জেলা বা উপজেলা শহরের নারী উদ্যোক্তার কেবল করপোরেট প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগে বাধা না, পরিবার থেকেও তিনি বাধার সন্মুখীন হন।

সম্প্রতি আমি নারী উদে্যাক্তাদের একটা প্রশিক্ষণে যাই। সেখানে একজন নারী উদ্যোক্তার কথা জানি, যিনি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আট মাস কাজ করেছেন। কিন্তু শুরুতে তিনি তাঁর পরিবারকে বিষয়টি বলতে পারেননি। তিনি জানেন যে তাঁর পরিবার এটা মেনে নেবে না। তিনি গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করেন। যেন তাঁর পরিবার না জানে।

এভাবে একজন নারী কত দূর যেতে পারবেন, তাঁর কাজের মধে্য কতটুকু আনন্দ পাবেন, সে প্রশ্ন থেকে যায়। এখনো নারী উদে্যাক্তাদের প্রতি পরিবার ও সমাজের এই যে নেতিবাচক ধারণা, সেট দূর করতে হবে।

নারীরা যখন এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজ করেন, তখন অনেকে তাঁদের অার নারী মনে করেন না, বলবে ওভার স্মার্ট, বেশি বোঝে। এটা একধরনের নেতিবাচক মনোভাব।

আবার শুধু অর্থ থাকলেই যে একজন নারী উদ্যোক্তা হতে পারবেন, তা নয়। একজন ভালো উদে্যোক্তা হতে হলে তাঁকে নানা বিষয়ে জানতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ভালো নেটওয়ার্ক ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা থাকতে হবে। সর্বোপরি তাঁর ধৈর্য থাকতে হবে। কারণ, আমাদের সমাজের প্রায় অধিকাংশ নারীর ঘরের কাজ যেমন করতে হয়, তেমনি বাইরের কাজও করতে হয়। এখনো ঘরের কাজ মানে নারীর কাজ, সেটা নারীকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে।

একজন নারী উদ্যোক্তাকে বিভিন্নভাবে মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। নারী উদ্যোক্তাদের যেমন স্মার্ট হতে হবে, তেমনি তার ক্লায়েন্টকেও স্মার্ট হতে হবে। এ জন্য শুধু নারী উদ্যোক্তাদের নয়, ক্লায়েন্টদেরও মনোভাব পরিবর্তনে প্রশিক্ষণ দরকার। দেশের সব অঞ্চলের নারী উদ্যোক্তার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

সালাহউদ্দিন মাহমুদ

সালাহউদ্দিন মাহমুদ

ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), এসএমই ফাউন্ডেশন

আমাদের নারী উদ্যোক্তারা অনেক ধরনের পণ্য উৎপাদন করছেন। কিন্তু কোথায় সরবরাহ করবেন, কার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, সেখানে সমস্যা রয়েছে।

আমাদের দেশে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারী উদে্যাক্তাদের পণ্য সরবরাহের সুযোগ কম। কিন্তু বহির্বিশ্বে জাপান, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে এ সুযোগ আছে। সেখানে নারী উদে্যাক্তারা আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন কী পণ্য উৎপাদন করবেন এবং কখন, কীভাবে, কার কাছে তঁাদের পণ্য ও সেবা বিক্রি করবেন।

এসএমই ফাউন্ডেশন যে অনলাইন সাপ্লায়ার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমাদের দেশের নারী উদে্যাক্তারা অনেক বেশি উপকৃত হতে পারবেন বলে আশা করি। তবে সবাই মিলে এ প্ল্যাটফর্মকে আরও বেশি কার্যকরের উদ্যোগ নিতে হবে।

আজ প্রথম আলোর সঙ্গে এ বিষয়ে একটা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে। এই আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা জানতে পারবেন, তাঁদের যে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আছে, সেগুলো প্রদর্শন করার একটা প্ল্যাটফর্ম আছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানে যারা আছে, তারা যেন এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। আর এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমরা দুই পক্ষের মধে্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখব।

কেননা, নারী উদে্যাক্তাদের যদি মানসম্মত পণ্য থাকে, সেটা যেমন আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারব, তেমনি দেশীয় প্রয়োজনও মেটাতে পারব। এ ক্ষেত্রে নারী উদে্যাক্তা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান দুই পক্ষেরই সুুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করি।

আরেকটা বিষয় হলো, পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে ভালো প্যাকেজিংয়ে ্ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। যেকোনো পণে্যর সঠিক প্যাকেজিং ও প্রাইসিং হলে সেটা ব্র্যান্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়। তাই মানসম্মত প্যাকেজিং ও সঠিক প্রাইসিংয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এসএমই ফাউন্ডেশন এসব বিষয়ে সব সময় আপনাদের পাশে থাকবে।

হুমায়রা আজম

হুমায়রা আজম

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্রাস্ট ব্যাংক

যেকোনো ঋণের ক্ষেত্রে প্রথমে আমাদের দেখতে হয় যে বাণিজ্যিকভাবে সেটা কতটা ফলপ্রসূ। কেউ যদি ব্যবসা করতে চান, তাঁর প্রথমে প্রয়োজন রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এসব ঠিক করতেও টাকার প্রয়োজন হয়। একটা ট্রেড লাইসেন্স নিতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক সমস্যা সামনে আসে।

নারী ব্যাংকে এলে দেখা হয় তাঁর টাকা ব্যবহারের সক্ষমতা। নারীর জন্য এটা সহজ হওয়া উচিত ছিল। কারণ, তিনি সংসারের যাবতীয় খরচ করে অভ্যস্ত। ব্যাংকে একটা হিসাব খোলার ফরমে যত কিছু লেখা থাকে, সেটা দেখলে যে কেউ ভয় পাবে। একজন নারীর জন্য সেটা আরও কঠিন। আমি মনে করি, এটা একধরনের মানসিক বাধা তৈরি করা। প্রথমে এটা দূর করতে হবে।

নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনেক সহজ হওয়া উচিত ছিল। তবে দুঃখজনকভাবে সেটা হয়নি। একজন নারী উদ্যোক্তা কী ধরনের পণ্য উৎপাদন করেন, পণ্যের মান কী, কী পরিমাণ অর্থ তাঁর ঋণ পাওয়া উচিত—এ ক্ষেত্রে এসএমই ফাউন্ডেশনের কাজ করা প্রয়োজন।

আবার শুধু ব্যাংকের ওপর কেন নির্ভার করতে হবে। যে করপোরেট প্রতিষ্ঠান পণ্য নেবে, সে–ও একজন নারী উদ্যোক্তাকে অগ্রিম টাকা দিতে পারে। শুধু ব্যাংক নয়, যেকোনো উৎস থেকে তিনি অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার জন্য ব্যাংকের একটা বাধ্যবাধকতার নিয়ম থাকতে হবে। তাহলে একজন নারী উদ্যোক্তার সহজে অর্থ পাওয়ার সুযোগ হবে।

আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংক, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ অনেকে যখন নারী উদ্যোক্তাদের সফলতার বিষয়টি ভাবছে, এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটা পরিবর্তন আসবে। আমরা এনজিওর মাধ্যমে প্রায় ২৪ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করছি। আমি কয়েক শ নারী উদ্যোক্তাকে ফাইন্যান্স করেছি।

ফারজানা খান

ফারজানা খান

মহাব্যবস্থাপক, এসএমই ফাউন্ডেশন

নারী উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার জন্য তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সংযোগ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। আমাদের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ অবধারিত। ২০ বছর আগে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল নগণ্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের উন্নয়নে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নারীর উন্নয়ন মানে দেশ, জাতি, পরিবার ও সমাজের উন্নয়ন করা।

এসএমই ফাউন্ডেশন দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে যত কাজ করে, তার মধ্যে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমরা নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা এবং তা সমাধানের মাধ্যমে তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য কাজ করছি। এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের প্রেক্ষাপটে ২০০৯ ও ২০১৭ সালে দুটি গবেষণা করেছে। সরকারের নীতি সহায়তা এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরি ও উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তারপরও নারীর চলার পথ এখনো বাধাহীন না। নারী চাইলেই স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁর ব্যবসায়িক কাজ করতে পারেন না। তাঁদের জন্য একটা সহায়ক পরিবেশ দরকার। এ জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন নানা ধরনের কাজ করছে।

২০২১ সাল থেকে এসএমই ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের করপোরেট বাজার সংযোগে কাজ করছে। দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়লেও তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। ফলে নারী উদ্যোক্তারা পণ্য উৎপাদন করলেও তা বিক্রয়ের জন্য একটি শোরুম দেওয়া সম্ভব হয় না। অনলাইন মার্কেট প্লেস অথবা প্ল্যাটফর্ম স্বল্প পুঁজির নারী উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজার তৈরির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান মাধ্যম। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এসএমই ফাউন্ডেশন তৈরি করেছে SMEF Suppliers Platform for Women Entrepreneurs (http://wsmesuppliersplatform.smef.gov.bd). এ ছাড়া এসএমই ফাউন্ডেশন আঞ্চলিক ও জাতীয় মেলা এবং ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মিলন আয়োজনের মাধ্যমে এসএমই উদ্যোক্তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণে সহায়তা করছে।

স্বর্ণলতা রায়

স্বর্ণলতা রায়

সভাপতি, সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে এসএমই ফাউন্ডেশন যে কাজটি করছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য এটা একটা ভালো সুযোগ। তবে ঢাকার উদ্যোক্তারা যে সুযোগ পান, প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তারা অনেক ক্ষেত্রে সেটা পান না। নারী উদ্যোক্তারা তথ্যের অভাবে অনেক কাজ করতে পারছেন না। সিলেট উইমেন চেম্বার থেকে চেষ্টা করছি যেন তাঁরা ভালো মানের পণ্য তৈরি করেন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য কীভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা যায়, আমরা সে চেষ্টা করছি।

সমস্যা হলো, এসএমই ফাউন্ডেশনের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে। কিন্তু অনেক উদ্যোক্তা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে কীভাবে তাঁর পণ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করবেন, সেটা জানেন না। অথচ তাঁর কাছে হয়তো ভালো পণ্য আছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারসহ প্রযুক্তিতে নারী উদ্যোক্তাদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক নারী উদ্যোক্তা আজ তাঁদের জীবনে সফলতা এনেছেন। উদ্যোক্তাদের জন্য আরও বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। অনেক নারী উদ্যোক্তা যেমন সঠিক কাগজপত্রের অভাবে ঋণ পান না এটা যেমন ঠিক, তেমনি কাগজ সঠিক থাকার পরও অনেককে ঋণ দেওয়া হয় না।

এ ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সিলেটের নারী উদ্যোক্তারা শীতলপাটি তৈরি করছেন। সেটা আমরা সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্সের মাধ্যমে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

ঢাকা ও অন্যান্য স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলার আয়োজন করা প্রয়োজন। সেটা অনলাইন ও সরাসরি হতে পারে। এসএমই ফাউন্ডেশন, বিশ্বব্যাংক ও ইনোভেশন, প্রথম আলো সবাই মিলে কাজ করলে নিশ্চয়ই নারী উদ্যোক্তাদের আরও বেশি সাফল্য আসবে।

সাদরুদ্দীন ইমরান

সাদরুদ্দীন ইমরান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইনোভেশন কনসালটিং

এসএমই ফাউন্ডেশন যে সাপ্লায়ার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, করপোরেশনের সঙ্গে পেশাদার নারী উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ করা। ব্যবসার মূলত দুটি ধরন আছে। একটি হলো ভোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা, আরেকটি হলো অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা।

বৈশ্বিক ও দেশীয়ভাবেও দেখা গেছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ খুবই দুবল। করপোরেট প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি।

এ প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের তহবিলে এসএমই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ইনোভেশন কনসালটিং বাস্তবায়ন করছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অংশীদার হিসেবে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, অন্তত ৪০০ এসএমই নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। এমন নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাঁরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করতে সক্ষম। এই প্রশিক্ষণের একটি লম্বা মডিউল আছে। এর মধ্যে রয়েছে কীভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা হবে। কীভাবে বিভিন্ন সেবা ও পণ্য সরবরাহ করা যায়। কীভাবে ব্যবসা চালিয়ে রাখা যায়—এমন নানা বিষয়। এসএমই ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে গেলে সাপ্লায়ার্স প্ল্যাটফর্মের লিংক দেখা যাবে। যেখানে নারী উদ্যোক্তা, করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত হতে পারবে।

অনেক নারী উদ্যোক্তা বলেছেন, এর অ্যাপ ভার্সন থাকলে তাঁদের জন্য সুবিধা হয়। আমরা এটিকে অ্যাপে রূপান্তর করেছি। যে কেউ অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোনে এটা কাজে লাগাতে পারবেন। এসএমইএফ (SMEF) লিখে সার্চ দিলে এ অ্যাপ পাওয়া যাবে। এটা ডাউনলোড করা যাবে। নারী উদ্যোক্তারা এই অ্যাপে তাঁদের পণ্যের বর্ণনা ও তালিকা দিতে পারবেন। ব্যাংকসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে আমরা এই প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য কাজ করছি। একদিকে নারী উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্য এখানে দেখাতে পারবেন, অন্যদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠান এখানে তাদের চাহিদা দিতে পারবে।

ফারহানা এ রহমান

ফারহানা এ রহমান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেড

নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ধারণা কী, সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন। আমি একজন আইটি উদ্যোক্তা। ২০০৭ সালে আমরা দুটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আদেশ পেয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানের মালিক নারী বলে পরে সে আদেশ বাতিল হয়। কারণ, নারী উদ্যোক্তারা বেশি দিন সেবা দিতে পারবেন না। আমি আজও কাজ করে যাচ্ছি। আমার প্রতিষ্ঠান টিকে থাকবে বলে আশা করি। আজকের এই প্ল্যাটফর্ম করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরবে বলে আশা করি।

নারী উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ধারণা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। একবার একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু তারা যে যোগ্যতা চেয়েছিল, সেটা আমার ছিল না। তখন অংশীদারি ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন থেকেই আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কারণ, এখান থেকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও বাধা কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সে ক্ষেত্রে ধরাণা হয়েছে। এখন যাঁরা নারী উদ্যোক্তা আছেন, তাঁরাও কারও অংশীদার হয়ে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারেন। শুধু প্ল্যাটফর্ম করলেই যে নারী উদ্যোক্তারা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করতে পারবেন, সেটা নয়। তাঁদের মাঠে নেমে কাজ করতে হবে।

সবচেয়ে ভালো হয় কোনো নারী বা পুরুষ উদ্যোক্তার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারলে। এসএমই যে প্ল্যাটফর্ম করেছে, সেখানে রেজিস্ট্রেশন করতে হলে একটা ফি থাকা দরকার। উদে্যাক্তার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। তাহলে অন্যরা এ প্ল্যাটফর্মের প্রতি আস্থা পাবে।

ঈশিতা শারমিন

ঈশিতা শারমিন

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিক্রয়.কম

আমরা বাংলাদেশে একটি ‘মার্কেট প্লেস’ লঞ্চ করেছি। আজ ১২ বছর ধরে ব্যবসা করছি। দেশের ৩৫ লাখ মানুষ আমাদের অ্যাপ ব্যবহার করছে। মার্কেট প্লেসের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা দুই পক্ষকে এক জায়গায় করা একটা চ্যালেঞ্জ। করপোরেট প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সময় ঠিক করা একটা বড় ব্যাপার।

আবার সব প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তার প্রস্তাব গ্রহণ করবে না। শুরুতে একটা বড় প্রতিষ্ঠান হয়তো পণ্য ও সেবা নিতে চাইবে না। প্রথমে ছোট প্রতিষ্ঠানে পণ্য সেবা সরবরাহ শুরু করতে হবে।

করপোরেট প্রতিষ্ঠান কী ধরনের পণ্য ও সেবা নেবে, সে বিষয়ে ধারণার অভাব থাকতে পারে। আবার অনেক সময় এমন হতে পারে যে উদ্যোক্তা একটা বিক্রয় আদেশ পেলেন। কিন্তু এটা উৎপাদন করতে যে ধরনের মানবসম্পদ, অর্থ ও অন্যান্য বিষয় থাকা দরকার, সেটা তার নেই। এসব ক্ষেত্রে তারা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করায়। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে পণ্যের মান ঠিক থাকে না। এ জন্য উদ্যোক্তাদের ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়। এসব সমস্যার একটাই সমাধান, সেটা হলো অনলাইনে পণ্যকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

যত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখানে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য উপস্থাপন করতে হবে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে কাজের আদেশ পাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি থাকবে। আমাদের সাইটে পুরুষ উদ্যোক্তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা নারী উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি।

নারী উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করব এসএমই ফাউন্ডেশনের প্ল্যাটফর্ম, ‘বিক্রয় ডটকম’সহ সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য উপস্থাপন করা উচিত। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছে সহজে পৌঁছানো যাবে।

ফাহাদ রহমান

ফাহাদ রহমান

সিনিয়র ম্যানেজার, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, আড়ং

নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য নিয়মিত ক্রয় আদেশ দেওয়া প্রয়োজন। আড়ং সেটা করে থাকে। আড়ং সাধারণত পাঁচ বিভাগের জন্য গিফট আইটেমসহ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করে থাকে। নারী কর্মীদের আমরা আর্টিজেন বলি। নারী উদ্যোক্তাদের বলি উৎপাদনকারী।

আমাদের প্রায় ৭৫ হাজার কর্মীর মধে্য নারী কর্মী ৫৫ হাজার। আমাদের প্রায় ৮০০ জন উৎপাদনকারীর ৩০০ জন নারী উৎপাদনকারী। আমার ৩০ হাজারের বেশি নারী কর্মীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

এক হাজারের বেশি নারী উৎপাদনকারীর সঙ্গে কথা বলেছি। সম্প্রতি আমি একটা গবেষণায় করেছি। সেখানে দেখেছি একজন পুরুষকে তার গ্রহণযোগ্যতার জন্য যতটুকু চেষ্টা করতে হয়, একজন নারীকে প্রায় এর দ্বিগুণ করতে হয়।

আমাদের এমন নারী উদ্যোক্তা আছেন, যিনি শিশুদের জামা তৈরি করতেন। তিনি শূন্য থেকে আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন। আজ তিনি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর সন্তান এখন বিদেশে লেখাপড়া করেন। তাঁর কর্মীরাই একসময় আমাদের উৎপাদনকারী হয়েছেন। আমরা নারী ও পুরুষের পোশাক, অ্যাকসেসরিস, জুয়েলারি, হোম ডেকর। হোম ডেকরের মধ্যে থাকে লিভিং, ডাইনিং ও ডেকর। কয়েক বছর হলো আমরা বিউটি প্রোডাক্টস লঞ্চ করেছি।

আড়ং প্রচলিত করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। করপোরেট প্রতিষ্ঠান সাধারণত স্টেশনারি, ডেস্ক আইটেমস, ফার্নিচারসহ গিফট আইটেম ক্রয় করে।

নারী উদ্যোক্তাদের কী পণ্য ও সেবা আছে, এর মূল্য কী, প্রথমে এসবের একটা ক্যাটালগ তৈরি করতে হবে। ক্যাটালগে আপনি যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করেন, এসব পণে্যর মূল্য দিতে হবে। সময়মতো মানসম্মত শ্রেষ্ঠ পণ্য দিতে পারাটা জরুরি। পণে্যর একটা ইমেজ তৈরি করতে হয়। তাহলে বাজারে নিজের একটা ব্র্যান্ড তৈরি হয়।

সুপারিশ

  • করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উচিত নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য ও সেবা ক্রয় করা।

  • নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দিতে হবে।

  • নারী উদ্যোক্তাদের ঋণপ্রাপ্তির বাধা দূর করা জরুরি।

  • করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা ও ব্যাংক থেকে লোন নিতে নারী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

  • এসএমই ফাউন্ডেশনের অনলাইন সাপ্লায়ার্স প্ল্যাটফর্ম ‘এসএমইএফ সাপ্লায়ার্স প্ল্যাটফর্ম ফর উইমেন এন্টারপ্রেনিউয়ার্স’কে আরও বেশি কার্যকর করতে হবে।

  • নারী উদ্যোক্তাদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আরও বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে।