পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য: চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনা

কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা প্রকল্প, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশন ও ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য: চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩০ আক্টোবর ২০২২। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো। 

অংশগ্রহণকারী

মনোজ কুমার রায়

অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অধিশাখা), স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। 

মো. শফিকুল ইসলাম

কান্ট্রি ডিরেক্টর, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

কামাল ইউ এ চৌধুরী

অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ ও পরিচালক, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো. মোখলেছুর রহমান

প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

হেলাল উদ্দিন আহমেদ

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন)

মো.এমরান খান

সহকারী প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশে শিশু সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প (সিএসপিবি), সমাজসেবা অধিদপ্তর।

জেনা দেরাখসানী হামাদানি

ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট, ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইন্ড হেলথ ডিভিশন, আইসিডিডিআরবি

মনিরা রহমান

প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক, ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশন

নাসরীন জাহান

প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক, ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন 

হাসিনা মমতাজ

ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (মানসিক স্বাস্থ্য), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

মো. তাইফুর ইসলাম

ডেপুটি লিড, এমএইচপিএসএস, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

ছেনক্য রাখাইন

ছাত্র, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ, প্রকল্প এলাকার অংশগ্রহণকারী

সৈয়দ সালমান হায়দার

রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিড, 

আঁচল ফাউন্ডেশন

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম 

প্রায় দুই বছর করোনায় শিশুরা স্কুলে যেতে পারেনি। তারা ঘরে ছিল। এখনো অনেকে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না। একধরনের মানসিক অস্থিরতা কাজ করছে। এ অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, সেটা ভাবা দরকার। শিশু–কিশোরেরা স্কুলে যেতে পারলে খুশি হয়। তরুণেরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। বিভিন্নভাবে তাদের মানসিক শক্তি দিতে হবে। আজকের আলোচনায় নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা  উপস্থিত আছেন। তঁারা এসব বিষয় আরও বিস্তারিত বলবেন।

মো. শফিকুল ইসলাম

এ সময়ের জন্য আজকের বিষয়টি অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। আমাদের তরুণেরা বলেছেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে এত কিছু জানার আছে, এটা তাঁদের জানা ছিল না। তাঁরা আগে সেভাবে ভাবেননি। তাঁরা জানত না যে অনেক বিষয় খুব সহজে সমাধান করা যায়। তাঁদের অনেকে বলেছেন, অনেক ডাক্তার তাঁদের পাগল    মনে করেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সবার কথা বলা দরকার।

শুধু গ্রামে নয়, শহরেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। ধনী–দরিদ্র সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল ধারণা আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক সমস্যায় আছেন, এমন ৯২ ভাগ মানুষ মানসিক ডাক্তারসহ কারও পরামর্শ নেননি।

অধিকাংশ মানসিক রোগী জানে না কোথায় গেলে চিকিৎসা ও সঠিক পরামর্শ পাবেন। এ বিষয় নিয়ে এডিডি ইন্টারন্যাশনাল তিন বছর ধরে কাজ করছে। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। মানুষ যদি মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় না জানেন, তাহলে তাঁরা সেবা গ্রহণ করতে আসবেন না।

অতিসম্প্রতি আমাদের একটি টিম পাবনা মানসিক হাসপাতালে গিয়েছিল। মানসিক হাসপাতালে যেসব রোগী আসেন, তঁাদের অধিকাংশ পরিবার আর তাঁদের ফেরত নিতে চায় না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ সরকারি–বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান সেবা দিচ্ছে। এ বিষয় নিয়ে আরও তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করা দরকার।

সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সবাইকে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলতে হবে। যেন সবার কাছে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি পৌঁছে যায়। মানুষ এর গুরুত্ব বুঝতে পারে। 

হেলাল উদ্দিন আহমেদ

করোনার পর আমাদের কিশোর–তরুণদের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আজকের আলোচনা। গত দুই বছরে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিবর্তন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলবায়ুর পরিবর্তন বিভিন্নভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এসব ছাড়াও কিন্তু গত দুই বছরে করোনা ব্যাপকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। গড়ে ১০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে যঁারা আছেন, তঁারাই তরুণ বা কিশোর-যুবা। করোনা তঁাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। করোনায় মানুষের চিন্তা, আচরণ, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে। আসক্তি বললে আমরা মাদকাসক্তি বোঝাই। কিন্তু করোনায় ভীষণভাবে ডিভাইস ও নানা আসক্তি বেড়েছে। এ সময় ১০ মাসে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে। করোনায় আমরা এক ধরনের নতুন জীবনধারায় প্রবেশ করেছি।

আমাদের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে মানসিক রোগী ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। বছরে আত্মহত্যা ঘটে গড়ে ১০ থেকে ১৪ হাজার। দেশে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন ৩৫০ জন। সাইকোলজিস্ট ৫০০ জনের কিছু বেশি।

কিছু মাস্টার্সের শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে তাঁদের মানসিক সমস্যার জন্য তঁারা কোথায় যাবেন। পাবনা মানসিক হাসপাতাল ছাড়া তঁারা আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানে না যে মানসিক সমস্যায় কোথায় যেতে হবে।

আমাদের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে ৬ নভেম্বর ২০০ থেকে ৪০০ শয্যার হাসপাতালে পরিণত করা হবে। আমাদের অনেক নীতি ও কৌশলের মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি ২০২২, এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-২০৩০।

জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, ৭ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের মানসিক রোগের হার বেশি। গ্রাম থেকে শহরে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেশি। সব ক্ষেত্রে মেয়েদের থেকে ছেলেদের সংখ্যা বেশি। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। স্নায়ু বিকাশজনিত উদ্বিগ্নতা, আচরণ, বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি কারণে কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।  প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৮ শতাংশ  আর শিশু–কিশোরদের ৬ শতাংশ মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছে। 

২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের গবেষণায় দেখা গেছে, মোট মানসিক রোগের ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছরের আগে। ৭৫ শতাংশ শুরু হয় ২৫ বছরের আগে। আমরা যদি এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিই, তাহলে অনেক বড়সংখ্যক মানসিক রোগীর রোগ প্রতিরোধ করতে পারব। তাই মানসিক রোগ প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। 

ছেনক্য রাখাইন

আমি বৌদ্ধমন্দির হোস্টেলে বড় হয়েছি। করোনার সময় অনেক সমস্যায় ছিলাম। একটা সময় আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। পরে সে অন্য জায়গায় চলে যায়। তখন আমি মানসিকভাবে খুব অসহায় বোধ করি। আমি কোনো সহযোগিতা না পেয়ে ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ প্রতিষ্ঠান আমাকে সাহায্য করে। সে সময় আমি মানসিকভাবে অনেক ভালো অনুভব করি। পরে আমি বৌদ্ধমন্দিরে যাই। আমার সমস্যার কথা বলি। মন্দির থেকেও আমাকে সহযোগিতা করে। আমি মানসিকভাবে খুব শক্ত। এখন ভালো আছি। 

হাসিনা মমতাজ

সারা বিশ্বে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের প্রতি ৭ জনে ১ জন মানসিক রোগে ভুগছে। আমাদের দেশে ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ১৩ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। কিশোরীদের অসুস্থতা ও প্রতিবন্ধিতা মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে অনেকটা হয়ে থাকে। এ জন্য বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা আচরণগত সমস্যাও হয়ে থাকে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ কারণ আত্মহত্যা। সামাজিক বৈষম্য মানসিক রোগের একটা বড় কারণ। যুদ্ধ, পরিবেশ বিপর্যয় মানসিক স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।

করোনার প্রথম বছরেই বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কিশোর বয়সে তাঁদের মধ্যে যে শারীরিক, মানসিক ও আবেগীয় পরিবর্তন হয়, এর সঙ্গে অনেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। মাদক ও প্রযুক্তি আসক্তি কিশোর–কিশোরীদের ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। প্রেমের সম্পর্ক, পড়াশোনার চাপ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কিশোর ও তরুণদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ করে তুলতে হবে। তারা ও তাদের পরিবারের জন্য সহায়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘ কর্তৃক শিশুদের জন্য মানবাধিকারের বিষয়টি মনে রেখে তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিতে হবে। মানসিক সমস্যা প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নানা উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি, কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথের কাজ চলমান। এখানে শিশু–কিশোর ও যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

সৈয়দ সালমান হায়দার

আমাদের গবেষণায় দেখেছি যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। করোনার পর শিক্ষার্থীরা স্কুলে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। এ জন্য শিক্ষার্থীরা বেশি বিষণ্নতায় পড়েছে। পরীক্ষার ফল নিয়ে আবার তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। খুব সামান্য কারণে তারা অস্থির হচ্ছে। মা-বাবার কাছে কোনো জিনিস চেয়ে না পেয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। খুব অল্প বয়সে সন্তানেরা মোবাইল ব্যবহার করে। তখন তারা একটা কল্পনার জগতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে     যখন এ জগতের মিল থাকে না, তখন তারা হতাশায় ভুগতে থাকে।

মা–বাবা হয়তো চাকরি করছেন। শিশুরা তাদের মনের কথা শেয়ার করতে পারছে না। তখন ছোট শিশুও অনেক ক্ষেত্রে তখন আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে, যদিও এ সংখ্যা খুবই কম। এখন মনের কথা শেয়ার করার মানুষ নেই। আবার প্রেমঘটিত কারণেও অনেকে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। 

মো. তাইফুর ইসলাম

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মায়ের গর্ভে থাকতেই শুরু হয়। মায়ের যদি মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তাহলে শিশুর মানসিক বিকাশের সঙ্গে মেধা, ভাষা, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশ ভালো হবে। শিশুর এসব বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব পড়ে। শিশুকে ভালো একটি পরিবেশ দিলে সে সমাজ ও জাতির জন্য ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। 

আমাদের লক্ষ্য থাকে শিশুর মানসিক বিকাশ কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়। ২০১২ সালে ঢাকার সাভারে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা হয়। শিশু–কিশোরেরা আমাদের বলে যে তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। তাদের প্রয়োজন কেউ বুঝতে চায় না। আমাদের গবেষণার লক্ষ্য ছিল, শিশু–কিশোরদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ধারণা সম্পর্কে জানা। গবেষণায় আমরা বুঝতে চেষ্টা করি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন সম্পর্কে তারা কী ধারণা পোষণ করে।

আমরা সব সময় মনে করি বড়রা বলবে। কিশোর-কিশোরীদের কথার যে গুরুত্ব আছে, তাদের কথাও যে শুনতে হবে, সেটাকে কখনো গুরুত্ব দিই না। 

শিশুদের কথা শোনার জন্য আমরা ৬০০ প্যারা কাউন্সেলর তৈরি করেছি। আমরা ব্র্যাকের আইইডি থেকে শিশুদের জন্য ক্রিয়েটিভ ক্লাবের কাজ করছি। এখানে শিশুরা তাদের স্বাধীন মতামত দিতে পারে। শিশুরা যখন স্বাধীনভাবে ভাবতে পারবে, তখন তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ হবে। 

নাসরীন জাহান

সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক বিকাশের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। তারা যেন সবার সঙ্গে সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। তারা আলাদা কেউ নয়, এই সমাজেরই অংশ। অধিকাংশ প্রতিবন্ধী সন্তানের মা-বাবা দুশ্চিন্তা ও হতাশার মধ্যে থাকেন। এসব অভিভাবকের অনেকে কাঁদেন। তাহলে তাদের  ওই সন্তানের কীভাবে মানসিক বিকাশ হবে। এ ক্ষেত্রে অনেক কাজ করতে হবে। আমরা পাবনার মানসিক হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের  জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। সেবাদানকারীদের জানতে হবে যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে। তাদের চিকিৎসাসেবা কীভাবে দিতে হবে। তাদের যেন কোনোভাবে অবহেলা করা না হয়। প্রতিবন্ধী শিশু–কিশোরদের মানসিক বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ক্ষেত্রে সবাই বিশেষ গুরুত্ব দেবেন বলে আশা করি।

মনিরা রহমান

গত ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইয়ুথ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং কার্নিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যাঁরা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা প্রায় সবাই এসেছিলেন। সবাই শিশুদের ইতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলেছেন। একজন বলছিলেন আমি পারব না—এ শব্দটি কোথাও বলব না। একজন বলছিলেন, এসো জীবনের গল্প বলি। এখানে যেসব তরুণ-তরুণী এসেছিলেন, তাঁরা নিজেদের কথা বলতে চান। শিশু–কিশোরদের কথা বলার তেমন কোনো জায়গা নেই। আমাদের কার্নিভ্যাল অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বিনোদনজগতের সেলিব্রিটিসহ সবাই বলেছেন শিশু-কিশোরদের মধ্যে অসীম ক্ষমতা আছে। আমাদের তরুণেরা দেশ স্বাধীনে ভূমিকা রেখেছেন। বড় আন্দোলন–সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন।

এই তরুণেরা তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। একজন মানুষ প্রথমেই আত্মহত্যা করে না। প্রথমে সে এটা নিয়ে ভাবতে থাকে। এই ভাবনার সময় যদি তাকে বোঝানো যায়, তার সঙ্গে কথা বলা যায়, তাহলে হয়তো তাকে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।

একজন মানসিক ডাক্তারের কথা জানি, তিনি একজন আত্মহত্যাচেষ্টার রোগীকে শুধু ওষুধ লিখে ছেড়ে দিয়েছেন। রোগী, তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন—কারও সঙ্গে একটা কথা বলেননি। এটা তো কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি হলো না। মাতৃস্বাস্থ্যের সঙ্গে খুব কম খরচে মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি যোগ করে দেওয়া যায়। শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের, অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের মানসিক সাপোর্ট দেবেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক–অভিভাবকের মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না। তাহলে তাঁরা কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভূমিকা রাখবেন। কার্নিভ্যালে মানসিক সেবা দেয়, এমন ১২টি সংগঠন অংশ নিয়েছিল। প্রতিটি স্টলে তরুণদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। তাঁরা টাকা দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন না। আমরা তাঁদের বিনা মূল্যে সেবা দিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব, মানসিক সেবা দেওয়ার জন্য আমাদেরও আপনারা কাজে লাগান। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে বলে আশা করি।

মো. এমরান খান

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখার জন্য যে পরিমাণ সমাজকর্মী দরকার, সেটা আমাদের নেই। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা কোনো বিশেষ মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের সম্পদের অভাবের কথা বলা হয়। আমি মনে করি না যে সম্পদের অভাব প্রধান সমস্যা। আমাদের বড় সমস্যা হলো সমন্বয়ের। আমরা পাশাপাশি কক্ষে কাজ করলেও জানি না কে কী করছেন। 

১০৯৮ নম্বরে শিশুকে সহায়তা দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী এটা উদ্বোধন করেছেন। ১০৯৮ নম্বরে এ পর্যন্ত আমরা আট লাখের বেশি শিশুর কথা শুনেছি। শিশুরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে।

 কেউ বলে, দাদা-দাদির সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। কেউ বলে, আমাদের তালাবদ্ধ করে মা–বাবা বাইরে যান। প্রতিটি উপজেলায় আমরা সাইকো সোশ্যাল পদে লোক দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। 

একটি শিশু আরেকটির মতো নয়। এ জন্য প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যের পৃথক ব্যবস্থাপনা দরকার। প্রতিটি পরিবার, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় সবার মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজের সমস্যা সমাজ থেকেই নিরসন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দিকনির্দেশনা দেবে বলে আশা করি।

জেনা দেরাখসানী হামাদানি

যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, তাদের আচরণের পরিবর্তন হয়। আমরা একবার একটি গবেষণা করতে গিয়ে কিছু শিশুকে তাদের মায়ের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করলাম। মায়েরা শিশুদের মারবেন না। তাদের সঙ্গে গল্প করবেন। খেলবেন, আদর করবেন, ভালোবাসবেন। শিশুদের বিষয়ে ইতিবাচক থাকবেন। এ গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল, তাদের থেকে যেসব শিশু মায়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছে, তাদের মানসিক বিকাশ বেশি হয়েছে। ১৫ বছর পরও দেখা গেছে তারা অন্যদের থেকে ভালো করেছে। 

খুব অল্প বয়সে শিশুকে ভালোভাবে নার্সিং করা জরুরি। অনেক পরিবার থেকে বলা হয় যে তুমি ছেলে তুমি কাঁদবে না। তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। আবার মেয়েদের বলা হয় যে তুমি মেয়ে, জোরে কথা বলবে না। বাইরে যাবে না। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলবে না ইত্যাদি। বড় হলেও ছেলেমেয়েদের মধ্যে এর প্রভাব থেকে যায়। 

এ জন্য পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা উচিত নয়। আমি মনে করি, গণমাধ্যম অনেক বেশি শক্তিশালী। এ মাধ্যমে এসব বিষয় বেশি করে প্রচার করতে হবে।

মো. মোখলেছুর রহমান

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কাজ করি। দুই বছর আগে আমরা ‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ দুটিরই সমান প্রয়োজন—এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বেশ কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছি। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমরা টেলিভিশনে প্রচার করেছি। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি প্যাকেজ নামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আমরা মনে করি, ছোটবেলা থেকেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হবে। আমরা শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা দিতে চেষ্টা করি। শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা পাঁচ হাজার বই  প্রকাশ করব। আমরা শিক্ষক ও অভিভাবকদের শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। তাহলে শিক্ষক তাঁদের শিক্ষার্থীদের, অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের ধারণা দিতে পারবেন। মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বেশ কিছু কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠক করা জরুরি বলে মনে করি। মানসিক স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আর অবহেলিত থাকবে না। 

কামাল ইউ এ চৌধুরী

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে সময় আমাদের কাজ শুরু করার কথা ছিল, সে সময়ে করতে পারিনি। এ জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে। গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, চার ধরনের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে দূরে থাকেন বা বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহী—১. যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বিষয়ে কিছু জানেন না বা এটাকে কোনো সমস্যা বলে মনে করেন না; ২. যাঁরা মনে করেন এটা পাপের শাস্তি, অভিশাপ বা কর্মফল, প্রায়শ্চিত্ত করলেই ঠিক হয়ে যাবে; ৩. যাঁরা জানেন বা বোঝেন এটা একধরনের রোগ, কিন্তু জানলেও চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে কবিরাজ, ওঝা বা ধর্মীয় গুরুর শরণাপন্ন হন এবং (৪) যঁাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই বা সামর্থ্য থাকলেও যাঁরা জানেন না ঠিক কোথায় গেলে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যাবে। কোন ধরনের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। মানসিক সেবা দেওয়ার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। মানসিক রোগের চিকিৎসক বাড়াতে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। 

আমাদের সম্পদ কম কিন্তু যেটুকু আছে, এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিবছর সরকারি–বেসরকারি জনবল নিয়ে এক হাজার সেবাকর্মী তৈরি করতে পারে। এসডিজি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এভাবে এগোতে হবে। তাঁদের বড় কাজ হবে মানসিক রোগের প্রতিরোধ। অনেক অভিভাবক মনে করেন, সন্তানদের প্রশংসা করা যাবে না। এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা।

কোনো সন্তান নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বড় হলে তার মধ্যে প্রতিহিংসা কাজ করবে। তরুণেরা প্রশংসা শুনতে চান। এ জন্য যুবসমাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচ্ছে। সেখানে তারা নানা ধরনের প্রশংসা পায়। জিপিএ–নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার দরকার। আমাদের শিশুদের অনেক পরীক্ষা দিতে হয়। উন্নত বিশ্বে পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য খাতে এক টাকা বিনিয়োগ করলে কয়েক গুণ ফেরত পাওয়া যায়।

অনেক অভিভাবকেরা গান, নাটক, সিনেমা, খেলাধুলাকে সময় নষ্ট মনে করছেন। কিন্তু এসবও পড়ালেখার মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। খেলায় হেরে গেলেও যে উঠে দাঁড়ানো যায়, সে মানসিকতা তৈরি হয়। ১০ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। মাসব্যাপী নানা ধরনের কার্যক্রমের আয়োজন করেছি। এসব আয়োজন আরও বাড়াতে হবে। 

মনোজ কুমার রায়

আমাদের সন্তানেরা ভার্চ্যুয়াল জগতে সারা পৃথিবী দেখে। কিন্তু প্রকৃতি দেখে না। জ্যোৎস্না দেখে না। আগে যৌথ পরিবার ছিল। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারত। এখন আমাদের পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন। নিজের ভাইবোনের মধ্যেও যোগাযোগ নেই। একজন আরেকজনের দুঃখকষ্ট জানে না। জীবনের চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না। পরিবারের বড়রা ছোটদের সময় দিচ্ছেন না। আমাদের সন্তানদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। 

করোনার আগেও তরুণদের মানসিক সমস্যা ছিল। করোনা হয়তো একটু বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে সমন্বিতভাবে কাজ করার। এত উন্নয়ন কার জন্য করছি। আমাদের প্রজন্ম যদি ভালো মানুষ না হয়, তারা যদি মানসিকভাবে সুস্থ না থাকে, তাহলে এ দেশ গড়বে কারা। কিন্তু এদের চিকিৎসাই বা কারা করবে? সাইক্রিয়াটিস্টের সংখ্যা ৩৫০। সাইকোলজিস্ট আছে ৫০০–এর কিছু বেশি।

এমন অবস্থায়ও আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের সেবাদানকারীর অভাব। আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবাদানকারী দেওয়ার চেষ্টা করছি। ৩৪টি মেডিকেল হাসপাতালে শিশু বিকাশকেন্দ্র আছে। এখানে মস্তিষ্ক বিকাশের সমস্যা, অটিজম ইত্যাদির চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাবনার মানসিক হাসপাতালকে কীভাবে বিশ্বমানের হাসপাতাল করা যায়, এর চেষ্টা চলছে। 

২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আইন হয়েছে। ২০২২ সালে নীতিমালা হয়েছে। স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানও হয়েছে। কীভাবে মানসিক রোগের চিকিৎসা হবে, আইনের মধ্যে সবই বলা আছে। জেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য রিভিউ কমিটি আছে। জেলা প্রশাসক এ কমিটির সভাপতি। সিভিল সার্জন সদস্যসচিব। মনে হয় না এ কমিটিকে কার্যকর করার জন্য কোনোভাবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 

আবার যাঁরা মানসিক রোগী, তাঁরাও কিন্তু সেভাবে সমানে আসছেন না। কেউ হয়তো তাঁদের সমালোচনা করবেন, এই ভয়ে পেছনে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান মানসিক স্বাস্থ্যের কাজ করছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। অটিজমের ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব পালন করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। 

সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা আর পিছিয়ে থাকব না বলে আশা করি।

ফিরোজ চৌধুরী

করোনার পর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজকের আলোচনায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিকে আলোচনা হয়েছে। অনেক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

সুপারিশ

■ মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য সাইকোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। 

■ তরুণদের মানসিক শক্তিতে উজ্জীবিত করতে কাজ করা জরুরি

■ মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।

■ কিশোর ও তরুণদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ করে তোলা জরুরি। 

■ শিশুদের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। 

■ ডিভাইস ও মাদকাসক্তি থেকে কিশোর–কিশোরীদের নিরাপদে রাখা জরুরি 

■ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে এখনই কাজ শুরু করা জরুরি।

■ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে মানসিক স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে পর্যালোচনা সভা করা প্রয়োজন। 

■ মানসিক রোগের চিকিৎসক বাড়াতে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

■ একটু ভালো কাজ করলেও সন্তানদের প্রশংসা করতে হবে।

■ আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

■ স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের একটি লিড কমিটি গঠন করা জরুরি।