রাজনৈতিক অধিকার ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

একশনএইড বাংলাদেশের সুশীল প্রকল্পের অধীনে এই সংলাপ আয়োজিত হয়। নির্বাচনে ‘না’ ভোট রাখার পক্ষেও মত আসে।

‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক ঢাকা জেলা সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

নির্বাচন করার দায়িত্ব শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়। এর সঙ্গে পুরো রাষ্ট্রকাঠামো জড়িত। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। তবে একটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি একটি নিরাপদ পরিবেশও তৈরি করতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংলাপে এ কথাগুলো উঠে আসে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহায়তায় একশনএইড বাংলাদেশ ‘সুশীল’ প্রকল্পের অধীনে সেফটি অ্যান্ড রাইটস ঢাকা জেলা সংলাপের আয়োজন করে। এর প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

সংলাপের বিষয়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়টিও যুক্ত করার কথা জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী নাজিফা জান্নাত বলেন, সহিংসতা ও ঝামেলাপূর্ণ নির্বাচন যেন না হয়। নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দলগুলোকে নির্বাচনী বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যেন সুস্থ প্রতিযোগিতা হয়।

নাজিফা বলেন, নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে এত দিনেও একমত হওয়া যায়নি। নতুন করে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচনের সময়ও খুব বেশি নেই, দ্রুত এটা শেষ করতে হবে। নির্বাচনের জন্য গুণগত ক্যাম্পেইন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দলগুলো নারীদের অধিকারের বিষয়ে রক্ষণশীল। নারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে কমিশন বলছে, তারা অসহায়, এখানে ব্যর্থতার দায় তাদের ওপরও বর্তায়।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য হালিদা হানুম আখতার বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। যারা এই নির্বাচন বাস্তবায়ন করবে তাদের উদ্দেশ্য কী হবে, কারণ এই ব্যক্তিগুলোই আগে চেয়ারে ছিল। আর কথায় কথায় সৈন্য আনা যাবে না। আইনশৃঙ্খলার জন্য আরও বাহিনী আছে। পুলিশের মনোবল বাড়াতে হবে। এসব জায়গায় অনেক করণীয় আছে। এগুলো ঠিক না করলে সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু কাগজে আর মাথায় থাকবে।’

অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে হালিদা হানুম বলেন, যেখানে ৫১ শতাংশ নারীই অবহেলিত, সেখানে যে কেউই অবহেলিত হতে পারে। সেখানে অন্তর্ভুক্তি কীভাবে হবে, সে প্রশ্ন তোলেন। তিনি আরও বলেন, নারীদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে, পরিবারকেও নারীদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। সব অন্য কেউ করে দেবে না।

মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান স্থানীয় সরকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন সদস্য হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, তাঁরা যেসব সুপারিশ করেছিলেন, তার অনেক কিছুই ঐকমত্য কমিশনে আসেনি। অন্তর্ভুক্তিকে যেন টোকেন হিসেবে দেখা না হয়। সংখ্যালঘু যেসব মানুষ আছেন, তাঁদের কথা যেন শোনা হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহযোগী সমন্বয়কারী ও উপসচিব মর্যাদায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কর্মরত নেসার আমিন বলেন, নির্বাচন মানে হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প বাছাই করা। একটি সুষ্ঠু অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন মানে কিন্তু শুধু নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব নয়। এর সঙ্গে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম—সবাই মিলেই একটি প্যাকেজ।

নারীদের আরও বেশি অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে নেসার আমিন বলেন, ঐকমত্য কমিশন নিজ থেকেই পাঁচবার নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি উত্থাপন করে কিন্তু দলগুলো ছাড় দিতে রাজি হয়নি। আর কমিশনও নিজ থেকে কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না।

নারীদের জন্য এবারের নির্বাচনেই ৩৩% আসনের দাবী করেছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) সহকারী অধ্যাপক আফরোজা সোমা। তিনি বলেন, পুরুষশাসিত সংস্কার কমিশন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। নারী চিরকালই ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয়ভাবেই নারী বৈষম্যের শিকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাওন তালুকদার বলেন, নির্বাচনে এখন টাকা, পেশিশক্তির সঙ্গে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেভাবে ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি হচ্ছে, তাতে নির্বাচনের সময় এসব ভুল তথ্যকে ফ্যাক্টচেক করতে হবে।

নির্বাচনে গণমাধ্যমের ভূমিকার দিক তুলে ধরেন দ্য ডেইলি স্টার–এর সাংবাদিক তানজিম ফেরদৌস। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সহিংসতাগুলো সঠিকভাবে রেকর্ড হচ্ছে কি না এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ আসছে কি না, তা ভাবতে হবে। সেখানে কোন দল বেশি সহিংসতা করছে, কোন ধরনের সহিংসতা করছে, এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। প্রার্থীদের প্রকৃত ব্যয় বের করা কঠিন, তবে এখন থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওপর নজর রাখলে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ‘না’ ভোট থাকা প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।

বাংলাদেশ ডিজেবল ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্টের ম্যানেজিং ট্রাস্টি মো. মনিরুজ্জামান খান ব্যালটে ব্রেইল পদ্ধতি রাখার কথা উল্লেখ করে বলেন, দৃষ্টিহীন ভোটার অনেক। এ ছাড়া যাঁদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে, তাঁদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে হবে। 

সংলাপে সূচনা বক্তব্য দেন একশনএইড বাংলাদেশের ‘সুশীল’ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মৌসুমী বিশ্বাস এবং সেফটি অ্যান্ড রাইটসের নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন সিএসও হাব–এর প্রেসিডেন্ট আবদুল ওয়াহেদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সুশীল প্রকল্পের ঢাকা জেলা সমন্বয়কারী নাসরিন মাহমুদ। এ ছাড়া সিএসও হাবের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা জেলা সংলাপের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।