স্বাস্থ্য খাতে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি: একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এবং প্রথম আলোর আয়োজনে ‘স্বাস্থ্য খাতে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

অংশগ্রহণকারী

হোসেন জিল্লুর রহমান

নির্বাহী চেয়ারপারসন, পিপিআরসি ও সাবেক  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

ফারুক আহমেদ

ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও

সাবেক নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল

আবু জামিল ফয়সাল

সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর, এনজেন্ডার হেলথ

আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন

সাবেক পরিচালক, আইইডিসিআর

রুমানা হক

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সায়েদুর রহমান খসরু

চেয়ারপারসন, ফার্মাকোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মালেকা বানু

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, সুইডেন দূতাবাস ঢাকা

শেহলীনা আহমেদ

সাবেক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, এফসিডিও, ইউকে

সামিয়া আফরিন

প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, নারীস্বাস্থ্য অধিকার কর্মসূচি, নারীপক্ষ

শিশির মোড়ল

বিশেষ প্রতিনিধি, প্রথম আলো

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

সম্মানিত আলোচকদের স্বাগত জানাই। আগামী দিনের স্বাস্থ্য খাত কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত, সেসব বিষয় নিয়েই আজ আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় স্বাস্থ্য খাতের আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য  আসবে, যা সাধারণ মানুষকে সচেতন করবে। এর পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ক্ষেত্রেও কিছু সুপারিশ আসবে।

ফারুক আহমেদ

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ একটি নাগরিক প্রতিষ্ঠান। এটি ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করে। নাগরিক সমাজের যাঁরা স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁদের নিয়েই আমাদের যাত্রা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্জন ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে দুই বছর অন্তর আমরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করি ও বিভিন্ন ফোরামে অ্যাডভোকেসি করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকার, দাতা সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে তাদের করণীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।

আমাদের মনে হয়েছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বৃদ্ধি, মানসম্পন্ন ওষুধ, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, মহামারি মোকাবিলায় কৌশলপত্র প্রণয়নসহ ইত্যাদি বিষয় সামনে  আনা উচিত।

এবারের সংসদ নির্বাচনে স্বাস্থ্য খাতের কিছু মানুষ নির্বাচিত হবেন। তাঁদের নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান অবস্থার মধে্যই আমাদের কৌশল খুঁজে নিতে হবে। আশির দশকে ফজলে হাসান আবেদের উদে্যাগে ব্র্যাক ও কেয়ার   টিকাদান কর্মসূচি ২ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নতি করেছিল।

থাইল্যান্ডে  একটি স্বাস্থ্য সম্মেলনে গিয়েছিলাম। তখনকার প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা বললেন যে তাঁরা স্বাস্থ্যকে খুব গুরুত্ব দেন। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর খাবার, ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ, ব্যায়াম এসবের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাবাইকে অংশগ্রহণ করতে বলেন। আমরা গত পাঁচ দশকে শিক্ষা–স্বাস্থ্য খাতে এমন গুরুত্ব দেখিনি। এ বিষয়ে যদি নাগরিক সমাজ এগিয়ে আসে, তাহলে দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে। আমরাও স্বাস্থ্যসম্মত জেনারেশন তৈরি  করতে পারব।

রুমানা হক

২০১৩ সালে ল্যানসেট–এর একটি গবেষণায় স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের উন্নয়নকে ‘অস্বাভাবিক অর্জন’ বলা হয়েছিল। কারণ, এত স্বল্প বিনিয়োগে এত অর্জন আসলেই বিস্ময়কর। এ খাতে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। বিশেষত মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, যক্ষ্মা, পোলিও, গুটিবসন্তসহ এমন কিছু রোগ নির্মূলে আমাদের সাফল্য রয়েছে।

তারপরও আমাদের কিছু চিন্তার বিষয় রয়ে গেছে। এমন অনেক নির্দেশক আছে, যা নিচের দিকে যাচ্ছে। আমাদের প্রজননহার ২০১১ সাল থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে স্থির হয়ে আছে। বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসংক্রামক রোগের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক চাপ আমাদের বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রোগের সংখ্যা বাড়ছে। এই সবকিছু চিন্তা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে আমাদের যে ব্যয়, তা অনেক কম। বৈশ্বিক মানদণ্ডে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। মাথাপিছু আয়ের ৮৮ ডলার স্বাস্থ্য খাতে খরচ করার আদর্শমান হলেও খরচ করা হচ্ছে মাত্র ৪৫ ডলার। স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়কে বিনিয়োগ বলার জন্য আমরা দাবি তুলি। জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে জেলা বা এলাকায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের প্রয়োজন সমান নয়, তাই প্রয়োজনভিত্তিক বরাদ্দ প্রদান করা জরুরি।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমাদের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও অন্যরা সেবা পাবে, তাতে ভবিষ্যতে সুফল পাওয়া যাবে। অসুস্থ হলেই চিকিৎসা করতে যাওয়ার চেয়ে আগে থেকেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা ভালো। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জোর দেওয়া উচিত।

আমাদের দেশে অসংক্রামক রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতি ওজনসহ বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে। ২০২২ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, আমাদের দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপ, ১১ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে এবং ২৯ শতাংশ মানুষ অতি ওজন রোগে ভুগছে।

ওষুধশিল্প বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমাদের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোই মেটাতে পারছে। তবে এই খাতে আরও উন্নতির প্রয়োজন আছে। শতভাগ চাহিদা পূরণ করতে পারলে আমাদের যে সঞ্চয় হবে, তা দিয়ে বৈশ্বিক মানদণ্ডে আরও বেশি শক্তিশালী হওয়া সম্ভব।

বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটারি ব্যবস্থা, বায়ুদূষণসহ অনেক ধরনের সমস্যা আমাদের এখনো রয়ে গেছে। এগুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। এদিকে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামের তুলনায় শহরে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই এখন থেকেই নগরস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের পক্ষ থেকে আলোচনা-পর্যালোচনা করে আমাদের মনে হয়েছে, ছয়টি বিষয় সামনে নিয়ে আসা উচিত।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বৃদ্ধিসহ রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধের ওপরে জোর দেওয়া জরুরি।  তালিকাবদ্ধ ও মানসম্পন্ ওষুধ জনসাধারণের কাছে বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি শহরে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। মহামারির মতো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা পর্যালোচনা করে একটি যুগোপযোগী ও জনকল্যাণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন, দক্ষ জনবল সৃষ্টি ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।

মালেকা বানু

আমাদের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য যদি হয় একটি সুস্থ জাতি ও সুস্থ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, সেখানে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীদের বিষয়ে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য কার্যক্রমে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ নারীর জীবনব্যাপী যে স্বাস্থ্য সমস্যা, তা গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে প্রত্যাশা করছি। স্বাস্থ্য বাজেটে নারীর অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে, বাজেট হতে হবে জেন্ডার রেসপনসিভ। অনেক নারী চিকিৎসাশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন; কিন্তু সামাজিক বাধাসহ নানা কারণে তাঁরা চিকিৎসা পেশাকে গ্রহণ করছেন না। কীভাবে তাঁদের চিকিৎসা পেশায় আরও যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের স্কুল স্বাস্থ্য কর্মসূচি অনেক বেশি অবহেলিত। এ কর্মসূচি শক্তিশালী করার প্রতি সুনজর দিতে হবে। এর মধ্যে কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যশিক্ষা, প্রজননস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় পাঠ্যক্রমে এলেও তা পড়ানো হচ্ছে না। এ কাজে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা যায় কি না, তা ভাবতে হবে। যেকোনো মূল্যে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। নারীস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাধাগুলো দূর করতে হবে।

আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন

স্বাস্থ্য খাতের প্রতিশ্রুতি দ্বিপক্ষীয় হতে হবে। যাঁরা সেবা প্রদান করবেন, তাঁদের প্রতিশ্রুতি থাকবে, আর যাঁরা সেবা গ্রহণ করবেন, তাঁদের কোনো দায়িত্ব থাকবে না, এটি হতে পারে না। সেবাগ্রহীতারা তাঁদের পক্ষে কথা বলার জন্য যেসব জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচন করবেন, তাঁরা যেন নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করেন, সেই জায়গায় আমাদের নজর দিতে হবে।

২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন) পাস হয়, যা ২০১০ সালে সংশোধন করা হয়। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে। বাংলাদেশে ৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা তাদের নেই। আমরা দক্ষতা না তৈরি করেই তাদের দায়িত্ব দিয়েছি। তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু তাদের সহায়তা দেবে কে!

সাপ্লাই সাইড নিয়ে চিন্তা করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি বিষয় (স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য মানবসম্পদ, স্বাস্থ্যতথ্য ব্যবস্থা, চিকিৎসাদ্রব্য, টিকা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য অর্থায়ন এবং স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্ব) নিয়ে চিন্তা করব। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ ছয়টি উপাদানের অবস্থা দেখতে হবে। এমডিজি-৩ অর্জনের জন্য আমাদের প্রতি হাজারে ৪ দশমিক ৪৫ জন সেবা প্রদানকারী প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত লাখ সেবা প্রদানকারী প্রয়োজন। এর মধ্যে ৯০ হাজার চিকিৎসক, আড়াই লাখ নার্স, চার লাখের মতো প্যারামেডিক প্রয়োজন। আমাদের রিসোর্স অনেক কম, যা দিয়ে প্রত্যাশিত অর্জন নয়।

বাজেট বিতরণে কাকে কতটুকু দিতে হবে, তা যুক্তিসংগতভাবে নির্ধারণ করতে হবে। আমার প্রস্তাব, জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা হোক। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা হয়। সব পরিকল্পনা জাতীয় পর্যায়ে হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের তথ্য খুব কমই ব্যবহার করা হয়। কারণ, কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সংযোগ নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। এতে চিকিৎসা খরচ কমে আসবে।

সামিয়া আফরিন

সরকারের জায়গা থেকে মনিটরিং ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কমিটিগুলো আছে, জনপ্রতিনিধিরা ওই কমিটির প্রধান, সে কমিটিকে কীভাবে সচল ও সক্রিয় করা যায়, তার উপায় বের করা দরকার। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, দায়িত্ব ও বাজেট না থাকায় এসব কমিটি সক্রিয় হচ্ছে না।  বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। নারীর স্বার্থরক্ষা করে স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে অবশ্যই বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু যে বাজেট আছে, তা কি আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারছে? তা-ও সব ক্ষেত্রে খরচ করতে পারছে না।

এই না পারার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে, ঘাটতিগুলো শনাক্ত করতে হবে। জনসংখ্যা বাড়লেও স্বাস্থ্য খাতে সেবা প্রদানকারীর সংখ্যা অনেক কম। বরিশাল বিভাগে আমরা একটা কাজ করেছিলাম। সেখানে মাঠপর্যায়ে ৬২ শতাংশ সেবা প্রদানকারী নেই। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁদের জায়গায় নতুন কাউকে দেওয়াও হচ্ছে না।

সরকারের যেসব কর্মসূচি ও নীতিমালা আছে, তা সম্পর্কে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা পরিষ্কার নন। স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁদের প্রতিশ্রুতি যেমন দরকার, তেমনি তাঁদের সম্পৃক্ততাও জরুরি।

সায়েদুর রহমান খসরু

স্বাস্থ্যরক্ষায় এখন পর্যন্ত আমাদের ধারণা ওষুধকেন্দ্রিক। স্বাস্থ্যে মানুষের যে ব্যয়, তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ওষুধ খাতে করেন। মানুষের গরিব হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় প্রধানত একটি কারণ অসংক্রামক (এনসিডি) রোগের ওষুধের বোঝা। একটা পরিবারে বয়স্ক মানুষ থাকা এবং সারা বছর তার ওষুধের ব্যয়ের ফলে পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় ও দরিদ্র হয়ে ওঠে। সুতরাং যদি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হয়, তাহলে প্রধান কাজ হবে ওষুধের ভার মানুষের কাঁধ থেকে রাষ্ট্রকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এটি সরানোর একটা সহজতম উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যকীয় ওষুধগুলোর একটা তালিকা করা। এর সংখ্যা ২৫০-২৮০-এর মতো হতে পারে৷ বর্তমানে বিজ্ঞানের যতটুকু বিকাশ হয়েছে, সে অনুযায়ী আনুমানিক ২৫০-২৮০টি ওষুধের মাধ্যমে বিভিন্ন গাইডলাইন অনুসরণ করে বাংলাদেশের রোগের যে প্রাদুর্ভাব, তার প্রবণতা ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।

আমাদের আনুমানিক স্বাস্থ্য ব্যয় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে ওষুধের ব্যয়। এই ৩৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে রাষ্ট্রের ব্যয় মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা।  ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচের মধ্যে রাষ্ট্রের অবদান হচ্ছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ। বাকি ৯২–৯৩ শতাংশ ওষুধ ব্যয় সেবাগ্রহীতাকেই নির্বাহ করতে হচ্ছে।

অসংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে মেডিসিন কর্নারগুলো একটি ভালো উদাহরণ তৈরি করেছে। প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ সেখান থেকে ডায়াবেটিসসহ তিনটি রোগের ওষুধ গ্রহণ করছেন। বরাদ্দ বাড়ানো ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বাড়ানোর পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ দায়িত্ব সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের রাজনৈতিক মূল্য নেই, তাই জাতীয় বাজেটেও স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মোট বাজেটের ৫ শতাংশের মতো স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা মোটেও যথেষ্ট নয়। স্বাস্থ্যের রাজনৈতিক মূল্য আছে স্থাপনায়, অর্থাৎ মেডিকেল কলেজ ভবন ও হাসপাতাল ভবন নিমাণে। এগুলো করলে জনগণকে দেখানো সহজ হয়। স্বাস্থ্য খাতে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক মূল্য, তা করা হচ্ছে না।

আমরা মনে করি, সব রোগীর জন্য ইউনিক হেলথ আইডি দিতে হবে। এটির প্রচলন শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস থেকে এটি করা হচ্ছে। করোনা মহামারির সময় জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে করা ১৪ কোটি ইউনিক হেলথ আইডি আছে। এসবের সমন্বয়ে সবাইকে ইউনিক হেলথ আইডি দিতে পারলে স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ফিরে আসত। এর পাশাপাশি হাসপাতালগুলোকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্যাকেজ (ইএসপি) চালু করা হয়েছে।

রোগীর তো দূরে থাক, এ খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই এ সম্পর্কে ধারণা নেই। সড়ক দুর্ঘটনা বা যেকোনো দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো প্যাকেজ চালু করা যায় কি না, তা ভাবতে হবে। দেখা গেছে, আহত ব্যক্তির স্বজনেরা তৎক্ষণাৎ পাশে না থাকায় তাঁর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড করতে হবে।

সরকারি হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রগুলোয় সেবার সুযোগ অপ্রতুল। নজরদারি ও জবাবদিহির অভাবে বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অন্যদিকে বিদেশি হাসপাতালের চেইন দেশে চলে এসেছে। মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে ছুটছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালগুলোয় মান ও খরচের বিষয়ে নজরদারির মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে, না হলে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

শেহলীনা আহমেদ

স্বাস্থ্যকে আমরা ওষুধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। অসংক্রামক (এনসিডি) রোগগুলোতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু এর বড় চিকিৎসা হচ্ছে জীবনধারণ–পদ্ধতির পরিবর্তন। সরকারি বিনিয়োগ হিসেবে দেখলে ৩২টি অপারেশনাল প্ল্যানের মধ্যে মাত্র দুটি স্বাস্থ্যশিক্ষা বা আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছে। বাকি প্ল্যানগুলো মেডিকেল অ্যাপ্রোচে এর স্বাস্থ্যরক্ষার কাজ করছে। হেলথ প্রমোশনের দায়িত্ব আমরা দিয়ে দিচ্ছি তিন মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের, অথচ তাঁরা এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়।

অসংক্রামক রোগের ওষুধের বিষয়ে কেবল এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানির ওষুধের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। যদি প্রতিটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ডায়াবেটিস ও রক্তচাপের ওষুধ জেনেটিক্যালি উৎপাদন করে এবং কম দামে সরবরাহ করে, তাহলে রোগীদের সুবিধা হয়। এই দুটি ওষুধ স্বাস্থ্য ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়।

আমরা যখন কমিউনিটি ক্লিনিকের অগ্রগতি মূল্যায়ন করি, তখন আমরা দেখি, কতজন রোগী তারা দেখেছে কিংবা কতটা ওষুধ তারা ব্যয় করেছে। সেখানে কিন্তু আমরা তাকে মূল্যায়ন করতে পারছি না যে হেলথ প্রিভেনশন নিয়ে তারা কয়টা কথা বলেছে, কয়জন রোগীকে ওষুধ ছাড়া বিদায় করতে পেরেছে। প্রতিটি প্রাথমিক অসুস্থতার জন্য ওষুধের প্রয়োজন নেই।

স্বাস্থ্যরক্ষায় সরকার ও জনগণ উভয় পক্ষকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। এটি না হলে অসংক্রামক (এনসিডি) রোগ কিন্তু ওষুধভিত্তিকই থেকে যাবে।

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন একটি বড় জায়গায় এসেছে। একসময় আমাদের জন্মহার ও মৃত্যুহার উচ্চ ছিল। এখন আমরা কম জন্মহার ও কম মৃত্যুহারের যুগে প্রবেশ করেছি। যদিও এখনো আমরা মাতৃমৃত্যুহার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি। আগে কমিউনিকেবল ডিজিজ বা সংক্রামক রোগে মৃত্যু বেশি হলেও এখন তা বেশি হচ্ছে নন–কমিউনিকেবল ডিজিজ বা সংক্রামক রোগের কারণে। এর ফলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে মানুষের আয়ু বেড়েছে। এটি অনেক সময় বেদনার কারণ হয়। কেননা, রোগবালাই নিয়ে বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আমাদের পুরোপুরি ইতিবাচক নগরায়ণ হয়নি, নগরে কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। এখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা জাল গ্রামের তুলনায় কম শক্তিশালী। ফলে এখানে স্বাস্থ্যের একধরনের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে।

মেডিকেল প্রেসক্রিপশন ডিজিটাল করা যেতে পারে। চিকিৎসকের হাতের লেখা না বোঝার কারণে ভুল চিকিৎসায় সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ ও নির্দেশনা প্রয়োজন।

বর্তমানে দেশে নতুন ধরনের সংকট দেখা দিচ্ছে। কম দামি অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিসের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হলে আমরা হয়তো নতুন কোনো মহামারির সম্মুখীন হব। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত স্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণে স্বাস্থ্য খাত নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি বিগত দিনের প্রতিশ্রুতিগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ অর্জন করতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির মাধ্যমে। এ কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

শিশির মোড়ল

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। আগামী সংসদে স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়তো হবে; কিন্তু বিতর্ক হবে কি? আমরা সাংবাদিকেরা দেখি ও বোঝার চেষ্টা করি, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় করে যেসব রিপোর্ট ছাপা হয়, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় কি না। আমার আজকের আলোচনাটি বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচকে উদ্দেশ করে। ধারণা করছি, এ বছর বেশ কয়েকজন চিকিৎসক নির্বাচনে জিতে সংসদে আসবেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসক নেতাও থাকতে পারেন। তাঁদের নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা করা যায় কি না, সে বিষয়ে ভূমিকা রাখা যেতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমি বহুদিন ধরে চেষ্টা করছি বিজ্ঞানীরা কিছু বিষয়ে বিতর্কের অবতারণা করুক। তা সেমিনারে হতে পারে অথবা সংবাদপত্রের পাতায় হতে পারে।

স্বাস্থ্য নিয়ে আসলে বিতর্ক নেই কোথাও। আমাদের স্বাস্থ্যবিমার কিছু হচ্ছে না। এটি নিয়ে কোনো পাবলিক ডিবেট কখনো হয়নি। সংসদে এটা নিয়ে বিতর্ক হলে মানুষ বুঝতে পারত। কারণ, বিমা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধে৵ অনেক ভুল ধারণা আছে। স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে যদি সংসদে লম্বা সময় ধরে বিতর্ক  হতো, তাহলে কাজটা অনেক এগিয়ে যেত। এখন স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সংসদের বাইরে আমরা গণমাধ্যমসহ অন্য জায়গায়ও বিভিন্ন বিতর্ক ও আলোচনা করতে পারি। আমাদের নাটক-সিনেমায় স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো কম আসে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উদ্বুদ্ধ করতে পারি কি না, তা ভাবতে হবে।

আবু জামিল ফয়সাল

আলোচনায় স্বাস্থ্য খাতের অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে। এ সমস্যাগুলো কমিয়ে আনতে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে বাজেট না বাড়িয়েই সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে কমিউনিটি এনগেজমেন্ট অর্থাৎ সমাজকে সম্পৃক্ত করা। আমি ছোট একটি সংগঠনের কথা জানি যারা কমিউনিটি এনগেজমেন্টের সূত্র ধরে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের বাজেট ট্র্যাকিং করে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তাদের এটি করার অনুমতি দিয়েছে। প্রতি মাসে বাজেট ট্র্যাকিংয়ে একটি করে মিটিং হয়, যেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্ণধার ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার বসে একটি–দুটি প্রশ্ন হলেও উত্তর দিতে হয়। কাঠামো বদল না করেও কেবল কমিউনিটি এনগেজমেন্টে বাড়ালেও পরিবর্তন সম্ভব।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আমাদের যোগাযোগ ভালো করতে হবে। আমরা যে কথা বলি, সংবাদপত্রে লিখি ও টেলিভিশনে প্রচার করি, এই যোগাযোগ সব ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না বলেই আমি মনে করি। স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ছয়টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আছে—স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়; শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়গুলো সবাই মিলে নিজস্ব পদ্ধতিতে কার্যকর ও পরিষ্কারভাবে যোগাযোগ করে পরিবর্তন আনতে পারে। তৃতীয়ত, সমন্বয় সাধন—যেটি খুবই কঠিন একটি বিষয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যেও সমন্বয় সাধন করতে হবে। সমন্বয় সাধনের জন্য কোনো কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই, বরাদ্দ বৃদ্ধিরও প্রয়োজন নেই। কোন কোন মন্ত্রণালয় কোন কোন সূচক নিয়ে কাজ করবে, তা নির্ধারণ করে দিলে কাজ সহজ হবে।

হোসেন জিল্লুর রহমান

আলোচনায় বেশ কিছু পরামর্শ এসেছে। এই সব পরামর্শ থেকে কী ঢেউ উঠতে পারে, তা সেই আঙ্গিকে চিন্তা করতে হবে। আলোচনায় সমন্বয় সাধনের কথা এসেছে। সমন্বয় সাধন জটিল একটি কাজ। সমন্বয় না থাকার কারণেই সংস্কার হচ্ছে না। এর জন্য একটা বড় ধাক্কা প্রয়োজন। বড় ধাক্কা বলতে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে কিছুটা ভিন্নতা আনার কথা বোঝানো হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে নাগরিক সক্রিয়তার বিষয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার।

একটা সরকারি কাঠামো তো আছে। সেখানে পরামর্শ উপস্থাপনের কিছু বিষয় থেকে যায়। বেসরকারি খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাক্টর। বিষয়টি এমন নয় যে নগরে স্বাস্থ্যসেবার বিকাশ বেশি হয়েছে। নগরগুলোতে বেসরকারি খাতের যেভাবে বিকাশ হয়েছে, সরকারি খাতে সেভাবে হয়নি। সরকারি স্বাস্থ্য খাত যে নগরে অনুপস্থিত, তা নয়। তবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, সেবার অনুপস্থিতি আছে। সরকার, সমাজ ও বেসরকারি খাতের কথা মাথায় রেখে কিছু পরামর্শের কথা চিন্তা করতে হবে।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের আশপাশের তিনটি দেশের কথা বলতে পারি, যারা স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার করার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বড় ঢেউ তুলতে পেরেছে। এগুলো হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত। তারা কাঠামোগত বিশাল পরিবর্তন করেনি; কিন্তু একটু চিন্তাভাবনা করে সংস্কারমূলক কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে এবং রাজনৈতিক অগ্রাধিকার দিয়ে তারা একটা গতি এনেছে। এর ফলে এসব দেশে যেসব রাজনৈতিক দল এ পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তারা রাজনৈতিকভাবেও লাভবান হয়েছে। আমাদের এ ধরনের একটা চিন্তা করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নাগরিক সমাজকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। চিন্তার সাহস প্রয়োজন। চিন্তার যে কাঠামোর মধ্যে আমরা আটকে আছি, সেগুলো ভেঙে নতুন ধরনের চিন্তা করতে হবে, যা সমাজের মধ্যে ঢেউ তুলবে।

দুঃখজনক হচ্ছে, স্বাস্থ্য এখনো রাজনৈতিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় নয়। কীভাবে স্বাস্থ্যকে রাজনৈতিক বিষয়ে রূপান্তরিত করতে পারি, সেখানে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর পাশাপাশি এতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে একটা পলিসি ডায়ালগ করার প্রস্তাব করছি। স্বাস্থ্য খাতে অ্যাডভোকেসি যাঁরা করেন, তাঁদের একজন প্রতিনিধি সেই ডায়ালগে থাকবেন, যিনি কি-নোট উপস্থাপন করবেন। এর মাধ্যমে বিতর্কের একটা প্রাথমিক জায়গা তো তৈরি হতে পারে।

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে গুরুত্বপূণ কিছু সুপারিশ এসেছে। আশা করি, নীতিনির্ধারকেরা তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

সুপারিশ

  • সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত  করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট  বৃদ্ধি ও  ব্যক্তিগত ব্যয় কমানোর উদ্যোগ জরুরি।

  • স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, যেন প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বাদ না পড়ে।

  • মানসম্পন্ন ওষুধ মানুষের কাছে বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

  • বর্তমানে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। ২০৩০ সালে ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে।  প্রতিটি শহরে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে প্রাথমিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

  • কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন কোনো মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে নীতি তৈরি করতে হবে। অতি অল্প সময়ে সরকার যেন সব ব্যবস্থাকে মহামারির মতো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে পারে, তার জন্য কৌশলপত্র তৈরি করা দরকার।

  • বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা পর্যালোচনা  করে একটি যুগোপযোগী ও জনকল্যাণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন, দক্ষ জনবল সৃষ্টি  ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।