কপ ২৯ সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু হোক

আইনুন নিশাত, মাহবুবা নাসরীন, শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও মির্জা শওকত আলী

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভিযোজন বা দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের বিকল্প নেই। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় তহবিল আদায়ের কাজও চালিয়ে যেতে হবে।

‘কপ ২৮: অভিজ্ঞতা, ফলাফল ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অক্সফাম ইন বাংলাদেশ ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করে।

আলোচকেরা মনে করেন, পাহাড়, বন, নদীর মতো বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। অকারণে ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে বিপর্যয় ডেকে আনছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনের পাশাপাশি নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ক্ষতিপূরণ আদায়সহ কপ ২৯ সম্মেলনে ভালো করতে হলে বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে বলেও মনে করেন তাঁরা।

জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ ২৮ সম্মেলন গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে আরব আমিরাতে। আগামী নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ ২৯ অনুষ্ঠিত হবে। তার আগেই কপ ২৯ সম্মেলনের অ্যাজেন্ডা বা আলোচ্যসূচি বেরিয়ে আসবে। অ্যাজেন্ডা ধরে প্রস্তুতি নিতে পারলে তা বাংলাদেশের জন্য কাজে আসবে বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভিযোজনের (দুর্যোগ আসার আগের প্রস্তুতি) সঙ্গে সমঝোতা করা যাবে না।

আইনুন নিশাত বলেন, আগামী কপ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসূ করতে হলে অভিযোজন, সক্ষমতা, প্রযুক্তি, ক্ষতিপূরণ, পর্যবেক্ষণের মতো আটটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শত বছরের জন্য প্রস্তুতি নিলেও বাংলাদেশের তা নেই বলেও মনে করেন তিনি। আইনুন নিশাত বলেন, এ বিষয়ে নাগরিক সমাজকে আরও পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বাড়াতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশে অনেক ভালো চর্চা আছে উল্লেখ করে সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আরও ভালো চর্চা দরকার। যাতে সক্ষমতা দেখানো যায় যে টাকা দিলে সেটা আমরা খরচ করতে পারব।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না বলে উল্লেখ করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (জলবায়ু পরিবর্তন) মির্জা শওকত আলী। তিনি বলেন, ‘আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে তেমন ক্ষতিপূরণ পাই না। যদি বলেন, আশপাশের দেশের তুলনায় কী পেয়েছি, তাহলে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দুই–তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। প্রক্রিয়াটাই ভিন্ন। প্রক্রিয়াটা হচ্ছে তারা কারিগরি সহযোগিতা দেবে, বড় বিনিয়োগ সহায়তা দেবে না।’

মির্জা শওকত আলী বলেন, উন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বাধ্য করা যায় না। ফলে সমঝোতা করতে গেলে খুব দুর্বল সিদ্ধান্ত আসে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল তৈরি হয়েছে, তা কার্যকর হতে এখনো সময় লাগবে জানিয়ে মির্জা শওকত আলী বলেন, সেখান থেকে তহবিল পেতে হয়তো আরও এক–দুই বছর লাগবে। ওই তহবিল যেন পাওয়া যায়, সে জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যাতে করে তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম দিকে থাকতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিমা করার ওপর জোর দেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বন্যা–ঘূর্ণিঝড় হলে কৃষক দেউলিয়া হয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন ঝুঁকিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের বিমার আওতায় আনতে হবে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের বিকল্প নেই বলে মনে করেন অক্সফাম ইন বাংলাদেশের ক্লাইমেট জাস্টিস অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস রাইটস বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ ইমরান হাসান। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করছে। এর ফলে যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে। তবে কপ ২৮ থেকে এ বিষয়ে সফলতা আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে সরকারের পক্ষ থেকে যাঁরা যান, তাঁদের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন লেখক ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি মনে করেন, ক্ষতিপূরণ পেতে হলে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি।

বান্দরবান ও সিলেট অঞ্চলে বন্যাসহ পরিবেশ নষ্টে সরকারের অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দায়ী করেন গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারছি না।’

হিল উইমেনস ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ জানেন না কপ কী। কিন্তু তারা জানে, তাদের ওখানে প্রতিবছর খরা হয়, খাদ্যসংকট দেখা দেয়, পানিসংকট দেখা দেয়।

তহবিলের চেয়ে বড় বিষয় পাহাড়, পাথর ও ছড়া রক্ষা করা উল্লেখ করে ইলিরা দেওয়ান বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধ করার জন্য তহবিল দরকার নেই। পাথর তুলে পানির উৎস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে, সেখানে কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করব।

সাতক্ষীরার বিন্দু নারী উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল মাওয়া বলেন, নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার। লবণাক্ততার কারণে সাতক্ষীরা অঞ্চলের নারীরা জরায়ুর নানা ধরনের জটিলতায় ভোগেন।

দেশের প্রান্তিক মানুষেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শিকার বলে মনে করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্যসচিব শরীফ জামিল। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক কৃষিপণ্য হারিয়ে যাচ্ছে। এই চিত্র দেশ–বিদেশে তুলে ধরতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস রিসার্চ ডেটালিংকের (সিপিআরডি) প্রধান নির্বাহী শামসুদ্দোহা, বিএইচআরআরসির ক্লাইমেট অ্যাডভোকেট মো. রাজু আহমেদ, ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশের ক্লাইমেট অ্যাকশনের প্রধান কাজী এমদাদুল হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) ক্যাম্পেইন অ্যান্ড পলিসির সমন্বয়কারী বারিশ হাসান চৌধুরী, শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (এসডিএস) নির্বাহী পরিচালক রাবেয়া বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক বিভূতি সিকদার, ফ্রেন্ডশিপের ডেপুটি ডিরেক্টর তানজিনা শারমিন, কোডেকের ক্লাইমেট জাস্টিস উইংয়ের প্রধান হাসিবুর রহমান, জনস্বাস্থ্য গবেষক জাহিদ হোসাইন খান ও ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সোহানুর রহমান।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।