মেয়েদের শিক্ষায় বাড়াতে হবে বিনিয়োগ 

বৈঠকে বক্তারা বলেন, সরকারি পরিকল্পনায় বেসরকারি সংস্থাগুলোকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

উপরের বাঁদিক থেকে রাশেদা কে চৌধূরী ,লুৎফুন নেসা খান, দিলারা জাহিদ ,মোশাররফ তানসেন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মেয়েদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া ঠেকাতে অঞ্চলভিত্তিক আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে। মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে কার্যকর করতে হবে আলাদা শিক্ষাপঞ্জিকা। চর, হাওর, উপকূল ও পাহাড়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘মেয়েদের শিক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও আমাদের করণীয়’ শিরোনামে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা।

মালালা ফান্ডের সহযোগিতায় যৌথভাবে বৈঠকের আয়োজন করে ডিজঅ্যাবল, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ), পিপলস্‌ ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (পপি) ও প্রথম আলো

গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মেয়েদের শিক্ষা ও প্রজননস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নারী ও মেয়েশিশুদের কর্মোদ্যোগকে সংকুচিত করছে। যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকার পৌঁছাতে পারছে না, সেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এখন পরিকল্পনায় কথা বলা ও অংশ নেওয়ার সুযোগ কমেছে এনজিওগুলোর, তাদের শুধু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাখে সরকার। যেকোনো পরিকল্পনায় সেসব এলাকার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় সংসদীয় ককাস তৈরির আহ্বান জানান। 

মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লুৎফুন নেসা খান বলেন, মেয়েদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার বিভিন্নভাবে প্রচার চালাচ্ছে। সরকারের ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে সুফল পাওয়া যাবে। উপযোগিতা যাচাই ছাড়া পরিকল্পনা নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, সরকারের নীতি, পরিকল্পনা ও বরাদ্দে কোনো সমস্যা নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন না, এটাই সমস্যা।

গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক দিলারা জাহিদ বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, দুর্যোগের কারণে ৩০ দিন স্কুল বন্ধ থাকে। তবে গত বছর সুনামগঞ্জে বন্যার সময়ে দেখা গেছে, ১৫–২০ দিন পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে থাকা, পানি সরে যাওয়ার পর স্কুল পরিষ্কার করা, বই নষ্ট হওয়া, রাস্তা ঠিক না হওয়ার কারণে যাতায়াতের সমস্যায় স্কুলে দীর্ঘদিন উপস্থিত হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এসব বিবেচনায় নিয়ে ওই সব অঞ্চলে বন্যার পানি যেন না ওঠে, এমন স্কুল ভবন তৈরি, পাঠ্যক্রম তৈরি ও জরুরি শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা দরকার।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনতে মেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ওপর জোর দিয়েছেন মালালা ফান্ডের কান্ট্রি ডিরেক্টর মোশাররফ তানসেন। তিনি বলেন, নিরাপদভাবে প্রতিটি মেয়েশিশু যেন অবৈতনিকভাবে ১২ বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারে, সে লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে কাজ করছে মালালা ফান্ড। দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেশি। তবে মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি মেয়ে। উপকূল, চর ও হাওর অঞ্চলে ঝরে পড়ার হার আরও বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, যেকোনো দুর্যোগে নারী ও মেয়েশিশুর ওপর প্রভাব বেশি পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সঙ্গে সামাজিক ক্ষতিও ব্যাপক। আর্থিক সংকট ও নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানের সহজ উপায় হিসেবে পরিবারের মেয়েটিকে বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়। কন্যাসন্তানের শিক্ষা যেন মা–বাবা বিসর্জন না দেন এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া ঠেকাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বৃত্তির ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি।

ডিআরআরএর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, মেয়েশিশুর ওপর পরিবারগুলো বিনিয়োগ করতে চায় না। প্রতিবন্ধী মেয়েশিশুরা
আরও বেশি শিক্ষাঝুঁকিতে পড়ে। দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণির পর তাদের পড়া কঠিন হয়ে যায়। কারণ, যাতায়াতে তাদের কারও সহায়তা নিতে হয়। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় চর, হাওর, উপকূল ও পাহাড়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ কাজগুলোতে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের উদ্যোগ নিতে হবে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান বলেন, সমতল, হাওর আর চরের উন্নয়নে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা পাহাড়ের জন্য কাজে লাগবে না। তাই একটি অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়ার আগে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা জেনে নেওয়া উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে যেসব এলাকায়, সেখানে আলাদা শিক্ষাপঞ্জিকা থাকা দরকার বলে মতপ্রকাশ করেন পপির নির্বাহী পরিচালক মোরশেদ আলম সরকার। তিনি বলেন, হাওর এলাকায় ফসল কাটার সময় মাঠে কাজ করে বলে কোনো শিশুর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না। হাওর এলাকায় তাঁর সংস্থা ১৩টি ভাসমান স্কুল চালায়। সেখানে ভাসমান স্কুলের সংখ্যা আরও বাড়াতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ভাসমান স্বাস্থ্য ক্লিনিকও দরকার।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েন্সিং অ্যান্ড ক্যাম্পেইন) নিশাত সুলতানা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মেয়েশিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, বাল্যবিবাহ হচ্ছে, স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে, নারীদের অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ হচ্ছে এবং তাঁরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। দারিদ্র্যের আঘাতে সংসারের ব্যয় কমাতে পরিবারের মেয়েটিকে স্কুল থেকে সরিয়ে আনা হয়। স্কুলে মেয়েদের ধরে রাখতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিক্ষাবিশেষজ্ঞ শামীমা সিদ্দিকী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কথা মাথায় রেখে বিকল্প পাঠের উদ্যোগ নিয়েছে ইউনিসেফ। এর মাধ্যমে স্কুলে থাকা মেয়েদের স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য বিষয়ের ওপর দক্ষতা বাড়ানো এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বনির্ভর বা শোভন কাজে যুক্ত হওয়ার দক্ষতা তৈরি করা হবে।

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ডিআরআরএর উপদেষ্টা স্বপ্না রেজা, ঋতুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন কবির।

সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পানির কারণে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয় নারীদের। এটা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।