সময়টা এখন তারুণ্যের
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ১৭ মে ২০২৫ রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে দিনব্যাপী শতাধিক তরুণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় যুব সম্মেলন ২০২৫।
কবিতা বোস
কান্ট্রি ডিরেক্টর,
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে যুব ও তরুণেরা। তারাই আমাদের প্রাণশক্তি ও আশার আলো। তাই নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি—প্রতিটি কাজে তরুণদের সম্পৃক্ত করি।
যুবসংগঠনগুলোকে ক্ষমতায়িত করতে এবং মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘ইকুয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড’ নামের ‘ফ্লেক্স ফান্ড’ (নমনীয় তহবিল) প্রতিযোগিতা আয়োজন করে থাকে, যাতে সেরা প্রকল্প পরিকল্পনা বা প্রপোজাল জমা দেওয়া যুবসংগঠনকে স্বীকৃতি ও একই সঙ্গে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়।
আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে যুবসমাজের ওপর। আমি মনে করি, তারুণ্যই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি—তারা আমাদের আশা, আমাদের কণ্ঠস্বর। তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন দূরদর্শী হয়, শুধু দর্শক বা অংশগ্রহণকারী না থেকে নেতৃত্ব দেয়। সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে যেন তারা সামনে থেকে কাজ করে।
আজ যারা পুরস্কার পেয়েছে বা যারা পায়নি, সবার জন্যই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। পুরস্কার না পাওয়া মানেই পিছিয়ে পড়া নয়—এটা হতে পারে শেখার একটা ধাপ। তরুণদের উচিত হতাশ না হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। কারণ, ভবিষ্যৎ তাদের অপেক্ষায় আছে।
আমরা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বাস করি যুবনেতৃত্বে। আমাদের ‘ইয়ুথ অ্যাডভাইজরি প্যানেল’–এর সদস্যরা ম্যানেজমেন্টকে পরামর্শ দেন, দেশের ভেতরে ও বাইরেও প্রতিনিধিত্ব করেন এবং আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরেন।
আমরা যে সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও সমতা চাই, সেখানে তরুণদের নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। তরুণদের ভাবনা, সাহস আর অঙ্গীকার আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। আজকের এই ‘ইকুয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড’ যেন সমাজের নারী–পুরুষসহ সব শ্রেণি, ধর্ম, ভাষা, পরিচয়ের মানুষের জন্য হয়—এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা যেন সেই সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে কেউ পিছিয়ে না পড়ে, কেউ বাদ না পড়ে।
তরুণদের বলব, নিজের মূল্য বোঝো, প্রশ্ন করো এবং নিজের স্বপ্নকে ছোট ভেবো না। তোমরা ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর এবং তোমাদের হাতেই সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি। আমরা আছি পাশে, কিন্তু নেতৃত্ব তোমাদেরই নিতে হবে।
নিশাত সুলতানা
ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইনস এবং কমিউনিকেশনস)
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
যুব ও তরুণেরাই প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। তারাই আমাদের প্রাণশক্তি ও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তাই নীতিনির্ধারণ থেকে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রমের বাস্তবায়নসহ প্রতিটি কাজে আমরা যুব ও তরুণদের সম্পৃক্ত করি। এ ছাড়া তাঁদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের বিকাশে আমরা যুবদের, বিশেষ করে যুব নারীদের নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করি। তাদের নেতৃত্বে সমাজে নারী–পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনতে, ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা রুখে দিতে ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করি।
আমরা বিশ্বাস করি, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে আজকের এই যুব সম্মেলন এই অঞ্চলের যুবদের ইতিবাচক সমাজ গঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী, ১৫–২৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী দেশের মোট জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা প্রায় ৪৬ মিলিয়ন। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের বিকাশ ও দক্ষতার উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সময়টা এখন তারুণ্যের। তবে মনে রাখতে হবে, তারুণ্য চিরস্থায়ী নয়। এই সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশকে অনেক ভালো কিছু উপহার দেওয়া সম্ভব। তাই তরুণদের কাছে প্রত্যাশা, তাঁরা নিজেরা সঠিকভাবে তৈরি হবেন এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটা বাংলাদেশ রেখে যাবেন। এ জন্য প্রয়োজন নিজেকে সঠিকভাবে তৈরি করা। নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করা সহজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা, অধ্যবসায়, দূরদর্শিতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও সময়নিষ্ঠার মতো অনেক গুণাবলি। সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করা।
ব্যক্তিপর্যায়ে বিশ্বাস ও আদর্শের চর্চা না থাকলে অন্যকে প্রভাবিত করা কখনোই সম্ভব নয়। সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে নিজের ও সমাজের স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। জ্ঞান–বিজ্ঞানে এগিয়ে যেতে হবে, মেধায় যোগ্যতায় আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে হবে, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করে যেতে হবে। নিশ্চয়ই আমরা বিজয়ী হব।
তানিয়া খাতুন
উদ্যোক্তা, ভাস্ট যুব ফোরাম, বগুড়া
ভাস্ট যুব ফোরাম একটি যুব নেতৃত্বাধীন সংগঠন, যা কিশোর-কিশোরীদের কাউন্সেলিং ও জীবনদক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে। আমাদের মূল লক্ষ৵ই হচ্ছে জীবনমুখী শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। নেতৃত্বগুণ অর্জনের মাধ্যমেই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব—এই বিশ্বাসে আমরা এগিয়ে চলেছি।
আমাদের প্রকল্পটি ছিল জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার জন্য কম্পোস্ট সার উৎপাদনে নারীর ভূমিকা বিষয়ে। ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং মাটির উর্বরতা শক্তি ধ্বংস করে, এমন গ্যাসের একটি বড় অংশ আসে আমাদের কৃষিতে ব্যবহার করা রাসায়নিক সার থেকে।
এ সমস্যার খুব সহজ একটি সমাধান রয়েছে আমাদের হাতের কাছেই। আমাদের নারীরা গৃহস্থালি বর্জ্য ও গোবর ব্যবহার করে কম খরচে পরিবেশবান্ধব কম্পোস্ট সার উৎপাদন করতে পারেন।
এটি কৃষিতে যেমন উপকারী, তেমনি বাড়তি ফসল বাজারে বিক্রি করে আর্থিক উন্নয়নও সম্ভব। আমাদের প্রকল্পটি তিন মাসব্যাপী নেওয়া হয়েছে। কম্পোস্ট সার উৎপাদনে নিয়ে সময় লাগে দুই মাস। প্রথম ধাপে দুই দিনব্যাপী কর্মশালার মাধ্যমে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর তাঁরা নিজেরাই সার তৈরি ও ব্যবহারে সক্ষম হবেন।
রায়হান নোমান নূরন্নবী
উদ্যোক্তা, সূর্যোদয় ইয়ুথ সোসাইটি, ঢাকা
সূর্যোদয় ইয়ুথ সোসাইটি ২০১৮ সাল থেকে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে জলবায়ু কার্যক্রম ও জেন্ডার জাস্টিস নিয়ে কাজ করছে। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে বর্তমানে অর্ধ সহস্রের বেশি তরুণ স্বেচ্ছাসেবক যুক্ত আছেন। যারা কমিউনিটি পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়েও নিজেদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিতে উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। যারা সমাজ ও পরিবেশকে বদলে দেওয়ার ইতিবাচক স্বপ্ন দেখেন।
আমরা বিশ্বাস করি, দেশের উন্নয়নে তরুণরা অপরিহার্য। কারণ, তারা ভবিষ্যতে সমাজের নেতৃত্ব দেবে। তাই আমরা ইকুয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণদের জলবায়ু সচেতনতা, আলোচনা, অভিযোজন ও গ্রিন বিজনেস সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা স্থানীয় পর্যায়ে পথনাটক আয়োজন করি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী ক্ষতি হচ্ছে, সেটি সবাইকে সহজভাবে উপলব্ধি করাতে সাহায্য করে।
বায়ুদূষণের মতো বড় ইস্যুতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝেছি, সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের লক্ষ্য তরুণদের নেতৃত্বে একটি সবুজ, টেকসই ও ন্যায়সংগত সমাজ গড়ে তোলা।
অনিমা তাবাসসুম তিথি
প্রতিনিধি, কাশফুল ফাউন্ডেশন , ঢাকা
কাশফুল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তরুণদের নিয়ে কাজ করছে। তরুণদের ডিজিটাল রাইটস ও জলবায়ু পরিবর্তনে নারীদের ভূমিকা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা ও সাহস জোগাবে।
আমরা পিছিয়ে থাকা তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি করতে স্বপ্ন দেখি। আমরা চাই নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তরুণেরা যেন নিজেদের কণ্ঠ জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারেন। এই লক্ষে৵ই কাশফুল ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। সমাজে ন্যায্যতা ও সমতার প্রতিষ্ঠা করতে চাই আমরা।
তরুণ নেতৃত্ব বিকাশে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে আমরা নিরলস কাজ করে যেতে চাই। আমাদের দেশের মেয়েরা যেন আরও বেশি অগ্রসর হতে পারে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে। তারা যেন সমাজে আরও বেশি অবদান রাখতে পারে। বুঝে নিতে পারে তার অধিকার সেটি নিয়ে কাজ করতে চাই।
সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের স্বপ্নে, কাশফুল ফাউন্ডেশন আজকের তরুণদের হাত ধরে আগামীর পথে সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আগামীর পৃথিবী হবে সুন্দর তরুণদের হাত ধরেই।
তায়েব মৃধা
প্রতিষ্ঠাতা, অদম্য ১৯ ইয়ুথ ফাউন্ডেশন, ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে শুরু হয়ে আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের সাতটি জেলায় কাজ করছি। ক্লাইমেট চেঞ্জ, মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ও কোয়ালিটি এডুকেশন নিয়ে কাজ করছে আমাদের সংগঠন। মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে আমাদের একটি আইডিয়া ছিল, যেটি দিয়ে আমরা এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। সারা দেশে মাত্র ১৮ শতাংশ নারী পিরিয়ডের সময় প্যাড ব্যবহার করেন। প্রান্তিক পর্যায়ে মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন একটি বড় ট্যাবু হয়ে আছে। আমরা এ বিষয়টি সমাধানে কীভাবে কাজ করা যায়, সেটি ভেবেছিলাম।
আমাদের শ্রীমঙ্গলে একটি কার্যক্রম আছে মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে। সেটির মাঠপর্যায়ের চিত্র পর্যবেক্ষণ করে আমাদের টিম একটি আইডিয়া জমা দেয়। আইডিয়াটা এমন ছিল যে আমরা স্কুলের শিশুদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে সচেতন করে তাদের থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করব, যেটা দিয়ে আমরা পরবর্তী সময়ে অ্যাডভোকেসি করব। পলিসি মেকার বা স্টেকহোল্ডারদের কাছে আমাদের উপাত্তগুলো তুলে ধরব, যেন এগুলো দিয়ে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বেগবান হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে আমাদের পরিকল্পনায় ছিল কমিক বুক তৈরি করা। যেটা তাদের এ বিষয়ে অনেক বেশি জানতে সাহায্য করবে।
সুপারিশ
কিশোর–কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞানলাভের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।
বাল্যবিবাহ রোধে যুবদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন রকম কর্মশালা আয়োজন করা জরুরি।
প্রান্তিক পর্যায়ের তরুণদের দক্ষ করে তুলতে হবে।
তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তরুণদের মানসম্পন্ন শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি।
অনগ্রসর তরুণদের আয়বর্ধক খাতে যুক্ত করতে কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।