ভূমিকম্প প্রতিরোধী স্থাপনায় গুরুত্ব দিন 

‘বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করে জিপিএইচ ইস্পাত।

গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) রাকিব আহসান, ফখরুল আমীন, সেখ ফরিদ আহমেদ ও ইশরাত ইসলাম। গতকাল রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

ভূমিকম্প প্রতিরোধে গুণগত মানসম্পন্ন ইস্পাতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি ইস্পাতের পরিবর্তে নিম্নমানের ইস্পাত ব্যবহার করলে ভূমিকম্পের সময় ভবন ধসে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

গতকাল রোববার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করতে গেলে ম্যাটেরিয়াল (উপাদান) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে ভূমিকম্পের সময় নির্মাণাধীন একটি ভবন ধসে পড়েছে, সেখানে নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন এসেছে।

রাকিব আহসান মানসম্পন্ন ইস্পাতের ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো ভালো মানের রড তৈরি করছে। বিএসটিআই প্রণীত যে স্ট্যান্ডার্ড আর আমাদের ডিজাইন কোডের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা আছে। বিএসটিআই যে নতুন স্ট্রেংথ গ্রেডের রডের স্পেসিফিকেশন দিয়েছে, তা আমাদের বিল্ডিং কোডে এখনো অন্তর্ভুক্ত বা রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ নেই। এ জন্য বিল্ডিং কোডের হালনাগাদকরণ দরকার।’

আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যে রি–বারগুলো এসেছে, সেগুলো অন্যান্য দেশের আপডেটেড বিল্ডিং কোডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে রাকিব আহসান বলেন, ভূমিকম্পের সময় ইস্পাতের ডাক্টিলিটি (নমনীয়তা) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পের সময় ইস্পাত যত বেশি সম্প্রসারিত হতে পারে, তত ভালো। ভবনের যে অংশগুলো আর্থকোয়াক ফোর্সটা নেয় (ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি যে অংশে বেশি পড়ে) সেগুলো হলো কলাম, বিম। এখানে ব্যবহৃত রডের শ্রেণি হতে হবে ডাক্টিলিটি–ডি। এ ক্লাসটা সবচেয়ে বেশি আর্থকোয়াক ফোর্স নিতে পারে।

বুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘ভবন নির্মাণ করার সময় খরচ বাঁচানোর চেষ্টায় নির্মাণসামগ্রীর মান নিম্নগামী হয়। ময়মনসিংহ শহরে আমরা ১২টি ভবন স্টাডি করে দেখেছি, তার মধ্যে ১১টি ভবন মান যাচাইয়ে ব্যর্থ। প্রচুর ভবন ওখানে ঝুঁকির মধ্যে আছে।’

বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন করার মতো কোনো মেকানিজম আমাদের এখনো তৈরি হয়নি জানিয়ে ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘এটা যত দিন না তৈরি হবে, তত দিন আমরা মানসম্পন্ন ভবন নিশ্চিত করতে পারব না।’

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ফখরুল আমিন বলেন, যাঁর ভবন তাঁর দায়িত্ব বেশি। তাঁকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারের পরিকল্পনা ও জনগণের ধারণার মধ্যে যে দূরত্ব আছে, সেটি কমাতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সেখ ফরিদ আহমেদ বলেন, অন্যান্য সংকট মোকাবিলায় সরকার যে ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও একই প্রস্তুতি সরকার নিয়েছে। ভবন নির্মাণ বিধিমালা ও অন্যান্য যেসব নীতি রয়েছে, তা সবাইকে মেনে চলার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।

'বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা
ছবি: প্রথম আলো

বুয়েটের বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা গুলশান বলেন, ‘আমাদের দেশে হাই-স্ট্রেংথ রিবার ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে যথেষ্ট স্টাডি হয়নি। একজন ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রথমে বলতে চাই, স্টিলের মান পুরোপুরি নির্ভর করে স্টিল তৈরির প্রযুক্তির ওপর। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের ভূমিকম্পে দেখা গেছে, কিছু নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়েছে, কিন্তু ঠিক পাশের উঁচু ভবনগুলো অক্ষত ছিল। তদন্তে উঠে আসে—ধসে পড়া ভবনগুলোতে নিম্নমানের স্টিল ব্যবহৃত হয়েছিল।’

নিম্নমানের ইস্পাতে রাসায়নিক সংমিশ্রণ রয়ে যায় জানিয়ে ফাহমিদা গুলশান বলেন, ‘বিশ্বে স্টিল সাধারণত তিন–চারটি প্রযুক্তিতে তৈরি হয়: বেসিক অক্সিজেন ফার্নেস, ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস, ওপেন হার্ট ফার্নেস ও ইন্ডাকশন ফার্নেস। আমাদের দেশে বেশির ভাগ কারখানা ইন্ডাকশন ফার্নেস রুটে স্টিল বানায়, যেখানে স্টিলের মধ্যে সালফার, ফসফরাস, অক্সিজেন-নাইট্রোজেনের মতো অপদ্রব্য পুরোপুরি সরানো কঠিন।’

এগুলো ইস্পাতের শক্তি ও নমনীয়তা কমিয়ে দেয় উল্লেখ করে বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, ডাক্টিলিটি ও টাফনেস কমে যাওয়া ভূমিকম্প–সহনশীল স্থাপনা নির্মাণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বড় সমস্যা হলো এই রুটে পরিশোধনের (রিফাইনিং) সুযোগ প্রায় নেই, ফলে এক ব্যাচে ভালো রেজাল্ট মিললেও পরের ব্যাচে মান থাকে না; অর্থাৎ ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা যায় না।

ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে বস্তিতে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের অনেকের ধারণা, ভূমিকম্প হলে শুধু ঢাকার বড় বড় ভবন ভেঙে পড়বে। সেটা তো পড়বেই। কিন্তু ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে বস্তিতে। বস্তিতে যেভাবে নন–ইঞ্জিনিয়ার্ড স্ট্রাকচার (অপ্রকৌশলগত অবকাঠামো) গড়ে উঠেছে, এগুলো সবার আগে ভেঙে পড়বে। এখানে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন গেছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে।’

সম্প্রতি আফগানিস্তানে হওয়া ভূমিকম্পের উদাহরণ দিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আফগানিস্তানে গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আমাদের গ্রামেও সমান ক্ষয়ক্ষতি হবে। নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতির কথা এলে ঢাকাকেন্দ্রিক প্রস্তুতির কথাই আলাপ করা হয়। ঢাকার অপরিকল্পিত নগর চরিত্র এখন সারা দেশের জেলা–উপজেলার বাস্তবতা।

সরকার বিল্ডিং কোড তৈরিতে এক দশক সময় নিয়েছে জানিয়ে আখতার মাহমুদ বলেন, অনেক সময় নিয়ে বিল্ডিং কোড অনুমোদন করা হয়েছে ২০২১ সালে। গত পাঁচ বছরেও সরকার ভবন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে পারেনি। নব্বইয়ের দশক থেকে নিম্নাঞ্চলে নগরায়ণ হয়েছে। এতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেড়েছে।

সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক বলেন, সরকার ঝুঁকি প্রশমনে টাকা খরচ করতে চায় না। দুর্যোগ–পরবর্তী খাতে টাকা খরচ করতে চায়। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্সের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘কখন কোন সময় বড় ভূমিকম্প হয়ে যাবে, সেটা আমরা জানি না। ভয়ের পরিবর্তে বাস্তব ও গবেষণাসম্মত প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর পর ব্যবস্থা নিয়ে লাভ নাই। মানুষকে মৃত্যুর আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটিজ স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক বিভূতি শিকদার ও প্রভাষক রাইসা ইমরান চৌধুরী।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।