চট্টগ্রামে গোলটেবিল বৈঠক
সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের প্রত্যাশা
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নয়, সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে। একই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকেও সুযোগ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ নির্বাচনী মহাসড়কে উঠে গেছে। সবাই আগামী দিনে একটি উৎসবমুখর, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান। অর্থ, পেশিশক্তি ও কারসাজি যাতে এ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক করতে হলে জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নয়, সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে। একই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকেও সুযোগ করে দিতে হবে।
‘জেলা পর্যায়ের সংলাপ: অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা উঠে আসে। গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন সড়কের একটি হোটেলের মিলনায়তনে এ গোলটেবিল বৈঠক হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় একশনএইডের নেতৃত্বে সুশীল প্রকল্পের অধীন ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরাম এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই গোলটেবিল বৈঠকের প্রচার সহযোগী হিসেবে রয়েছে প্রথম আলো।
চট্টগ্রামের জেলা সংলাপ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের মতো উৎসবমুখর ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান সবাই। এই নির্বাচনগুলো অগ্রহণযোগ্য কেউ বলতে পারবেন না। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে এসব নির্বাচন হয়েছে।
নির্বাচনের সময় সবাইকে সহাবস্থানে থাকতে হবে জানিয়ে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘হারজিত বড় কথা নয়। নির্বাচন করব এবং জনগণ যাঁকে যোগ্য মনে করবে তাঁকে নির্বাচিত করবে। পরাজিত হলে স্যালুট দিয়ে চলে আসব—এ ধরনের একটা চিন্তা নিয়ে যদি সবাই এগিয়ে আসে তাহলে নির্বাচন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক। তবে নির্বাচনে যাতে ঋণখেলাপিরা সুযোগ না পায়, সে জন্য সোচ্চার হতে হবে। তারা সুযোগ পেলে আবার টাকা আত্মসাৎ করবে, টাকা পাচার করবে। দেশের সম্পদ লোপাট করবে।’
জাতীয় সংসদের আসন ৩০০ থেকে ৪০০–তে উন্নীত করার প্রস্তাব দেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। এর মধ্যে ১০০ আসনে নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন মেয়র। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্ক ছাড়া গাড়ি আনার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।
আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে ঠিক থাকে, তা নিশ্চিত করার দাবি জানান জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম নগর সেক্রেটারি মুহাম্মদ নুরুল আমিন। তিনি বলেন, এখন তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভেঙে পড়েছে। পুলিশের সদস্যরা এখনো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তাঁরা সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে আসলে নির্বাচনের যে বিশাল কাজ, এটা কতটুকু সম্ভব?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীর বিষয়ে এই জামায়াত নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যেতে চায়। এ জন্য এমন প্রার্থী দেয়, যাতে জিতে আসতে পারেন। এখন জিতে আসার মতো না হলে তো প্রার্থী করবে না। তবে জাতীয় সংসদে যাতে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় সে জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাতে শুধু নারীরা অংশ নেবেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চান বলে বৈঠকে জানান জামায়াত নেতা নুরুল আমিন। তাঁর মতে, এতে রাজনীতিতে বিত্তবানদের দাপট কমবে। সংসদ সদস্যের পদ বেচাকেনা বন্ধ হবে।
তবে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চান না বলে জানান চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এই পদ্ধতি সম্পর্কে যতটুকু বুঝি, এতে কোনো প্রার্থী থাকবে না। ভোট দেওয়ার পরে এখানে কে এমপি হবেন, তা জানি না। এই চিন্তা আপাতত বাদ দিতে হবে।’
নারীরা কেন রাজনীতিতে আসতে চান না, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে উল্লেখ করে নাজিমুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিজেরা চেষ্টা করছি কি না তাঁদের আনার জন্য। তাঁরাও যাতে সমানতালে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জাতীয় সংসদে ৩০০ আসন রয়েছে। এর মধ্যে প্রতি তিন আসনের অনুপাতে যদি একজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা হয়, তাহলেই তো ১০০ নারী সংসদ সদস্য পাওয়া যাবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক জোবাইরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের যে দলগত পজিশন অথবা আপনারা জানেন গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা একধরনের নির্বাচনের কথা বলছি। যে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের যে সংবিধান তা পরিবর্তন করা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে চাই।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রামের সভাপতি অশোক সাহা বলেন, দেশের নির্বাচনে তিনটি ‘এম’–এর ভীষণ প্রভাব রয়েছে। মানি (অর্থ), মাসল (পেশিশক্তি) ও ম্যানিপুলেশন (কারসাজি)। এই প্রভাব বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিতে সুস্থ, যোগ্য ও সৎ নীতিনিষ্ঠ মানুষের আগমনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের চট্টগ্রাম নগর সভাপতি নাসির গণি চৌধুরী বলেন, বর্তমান অবস্থায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই।
গণসংহতির যুগ্ম নির্বাহী সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন তালুকদার বলে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তমূলক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী হওয়ার পরেও নারীর প্রতিনিধিত্ব নেই বলে উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনমুন নেছা চৌধুরী। তিনি বলেন, শুধু অলংকার হিসেবে তাঁদের জন্য কয়েকটি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। নারীদের অলংকার করে রাখার মতো সময় এখন নেই। অবশ্যই প্রতিটি দল থেকে নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে। যাতে দেশের মানুষ সরাসরি তাঁদের নির্বাচিত করতে পারেন।
আলোচনা পর্বের সূচনায় ‘চট্টগ্রাম জেলা ম্যানিফেস্টো: অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতকরণে নাগরিক প্রত্যাশা ও দাবিসমূহ’ শীর্ষক সুপারিশপত্র উপস্থাপন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি জাবির বিন সোলাইমান।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একশনএইডের উইমেন রাইটস লিড মরিয়ম নেছা। জেলা সংলাপে আরও বক্তব৵ দেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবির চট্টগ্রামের সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, ইলমার সভাপতি কামরুন নাহার, ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরামের নির্বাহী প্রধান উৎপল বড়ুয়া। শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।