যুব সম্মেলন সৈয়দপুর
প্রান্তিক তরুণদের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ২৪ মে ২০২৫ সৈয়দপুরে শতাধিক তরুণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় যুব সম্মেলন-সৈয়দপুর ২০২৫।
কবিতা বোস
কান্ট্রি ডিরেক্টর,
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
রংপুর বিভাগীয় যুব সম্মেলন এবার আমরা নীলফামারীর উপজেলা শহর সৈয়দপুরে আয়োজন করেছি। সৈয়দপুরে অনুষ্ঠিত এই যুব সম্মেলনে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলা থেকে শতাধিক তরুণ অংশ নেয়। এ অনুষ্ঠানের সাফল্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।
আমরা আশা করব, ঢাকার বাইরের প্রান্তিক তরুণেরা একইভাবে এগিয়ে যাবে এবং তারাও একই ধরন ও মানের সেবা ও দক্ষতা অর্জন করার মতো সুযোগ পাবে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এমনটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা হওয়া উচিত। আমরা বিশ্বাস করি, শহরের তরুণদের তুলনায় মফস্সল বা গ্রামের তরুণদের মধ্যে সম্ভাবনা কোনো অংশে কম নয়, বরং তারা অনেক বিষয়ে এগিয়ে আছে—নতুন নতুন ধারণা বা মডেল তৈরির ক্ষেত্রে তারা মানুষের সমস্যার অনেক কাছাকাছি থাকে, তাই বাস্তবমুখী সমাধানও তারা অনেক ভালোভাবে নিয়ে আসে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে যুব ও তরুণেরা। তারাই আমাদের প্রাণশক্তি ও আশার আলো। তাই নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি—প্রতিটি কাজে তরুণদের সম্পৃক্ত করি।
আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে যুবসমাজের ওপর। আমি মনে করি, তারুণ্যই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি—তারা আমাদের আশা, আমাদের কণ্ঠস্বর। তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন দূরদর্শী হয়, শুধু দর্শক বা অংশগ্রহণকারী না থেকে নেতৃত্ব দেয়। সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে যেন তারা সামনে থেকে কাজ করে।
আমরা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বিশ্বাস করি যুবনেতৃত্বে। আমাদের ‘ইয়ুথ অ্যাডভাইজরি প্যানেল’–এর সদস্যরা ম্যানেজমেন্টকে পরামর্শ দেয়, দেশের ভেতরে ও বাইরেও প্রতিনিধিত্ব করে এবং আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরে।
আমরা যে সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও সমতা চাই, সেখানে তরুণদের নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। তরুণদের ভাবনা, সাহস আর অঙ্গীকার আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। তরুণদের উচিত হতাশ না হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। কারণ, ভবিষ্যৎ তাদের অপেক্ষায় আছে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সমাজের নারী–পুরুষসহ সব শ্রেণি, ধর্ম, ভাষা, পরিচয়ের মানুষের জন্য কাজ করা আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা যেন সেই সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে কেউ পিছিয়ে না পড়ে, কেউ বাদ না পড়ে।
তরুণদের বলব, নিজের মূল্য বোঝো, প্রশ্ন করো এবং নিজের স্বপ্নকে ছোট ভেবো না। তোমরা ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর এবং তোমাদের হাতেই সমাজ পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। প্ল্যান তোমাদের সঙ্গে আছে, কিন্তু নেতৃত্ব তোমাদেরই নিতে হবে।
নিশাত সুলতানা
ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন)
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
কবি হেলাল হাফিজ তাঁর বিখ্যাত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শেষ্ঠ সময়’। আমার মতে তরুণদের এই যুদ্ধ হলো সত্য, ন্যায় আর সুন্দরের জন্য যুদ্ধ। আমি বিশ্বাস করি, এখানে উপস্থিত তরুণেরা নিশ্চয়ই সত্য, ন্যায় আর সুন্দরের সেই যুদ্ধে শামিল হবে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সব সময় তরুণদের পাশে আছে। তরুণেরাই আমাদের প্রাণশক্তি ও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তাই নীতিনির্ধারণ থেকে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রমের বাস্তবায়নসহ প্রতিটি কাজে আমরা যুব ও তরুণদের সম্পৃক্ত করি। এ ছাড়া তাদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের বিকাশে আমরা যুবদের, বিশেষ করে যুব নারীদের নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করি। তাদের নেতৃত্বে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনতে, ক্ষতিকর সামাজিক প্রথা রুখে দিতে ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করি।
আমরা বিশ্বাস করি, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর যৌথ আয়োজনে আজকের এই যুব সম্মেলন এই অঞ্চলের যুবদের ইতিবাচক সমাজ গঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। দেশের মোট জনসংখ্যার মোট ২৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ তরুণ; যা প্রায় ৪৬ মিলিয়ন। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের বিকাশ ও দক্ষতার উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সময়টা এখন তারুণ্যের। সবাই এখন তারুণ্যের ইতিবাচক শক্তির দিকে তাকিয়ে আছে। এই সুযোগ বিরল। তাই এই সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে নিজের ও সমাজের স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। জ্ঞানে–বিজ্ঞানে এগিয়ে যেতে হবে, মেধায়–যোগ্যতায় আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে হবে, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করে যেতে হবে। তারুণ্য চিরস্থায়ী নয়। সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের জন্য অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। তাই তরুণদের কাছে প্রত্যাশা যে তারা নিজেরা সঠিকভাবে তৈরি হবে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটা বাংলাদেশ রেখে যাবে। তবেই বিজয়ী হবে তরুণেরা। আর তরুণদের বিজয়ের অর্থ নতুন বাংলাদেশের বিজয়।
সৈয়দপুরে যুব সম্মেলন
প্রথম আলো প্রতিবেদক
২৪ মে সৈয়দপুরের ড্রিম প্লাস কমিউনিটি সেন্টারে দিনব্যাপী যুব সম্মেলনে অংশ নেন রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শতাধিক তরুণ-তরুণী। যৌথভাবে এ আয়োজন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলো। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল সৈয়দপুর বন্ধুসভা।
সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন) নিশাত সুলতানা। তিনি বলেন, তরুণেরাই ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এখন সময় তারুণ্যের। যদি তরুণদের ইতিবাচক শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে বদলে যাবে বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সুরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রেজানুল হক অনুষ্ঠানে আসা তরুণদের ‘সুরক্ষা নীতিমালা’ বিষয়ে ধারণা দিয়ে বলেন, ‘দিনব্যাপী প্রশিক্ষণে ধর্ম–বর্ণ-জেন্ডারনির্বিশেষ সবার সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করব এবং তা হবে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ।’
সম্মেলনে ‘তরুণ নেতৃত্ব’ বিষয়ে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ পর্ব পরিচালনা করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি কো–অর্ডিনেটর জাফর সাদিক।
সৈয়দপুর যুব সম্মেলনে প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণ সেশন পরিচালনা করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের পরামর্শক সৈয়দ মো. নূরউদ্দিন।
মফস্সল ও গ্রামে বাল্যবিবাহের প্রভাব এবং এ থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে আয়োজন করা হয় আলাদা সেশন। সেশনটি পরিচালনা করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন ম্যানেজার জারফিশা আলম।
সংগীত পর্ব পরিচালনা করেন প্রথম আলো স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রদায়ক গিয়াস উদ্দিন। সংগীত পরিবেশন করেন সৈয়দপুর বন্ধুসভার তাপস, সৃষ্টি ও লাবিব। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যান্ড ‘টংয়ের গান’–এর সংগীত পরিবেশনা তরুণদের উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখে।
যুব সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সৈয়দপুর প্রতিনিধি এম আর আলম।
সম্মেলনে সমাপনী বক্তব্য ও অংশগ্রহণকারী তরুণদের ধন্যবাদ দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
সুপারিশ
রংপুর অঞ্চল ও অন্যান্য প্রান্তিক পর্যায়ের তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্ভব, যা রংপুর ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তরুণ নারীদের আয় বৃদ্ধির জন্য দক্ষতা উন্নয়ন, শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করে তাদের টেকসই আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ
করা জরুরি।
কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে সঠিক জ্ঞানলাভের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।
বাল্যবিবাহ এমন একটি সামাজিক রীতি, যা সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে এবং এই রীতি সমাজের সকল আয় শ্রেণির মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। ফলে এই ক্ষতিকর প্রথা পরিবর্তনে তরুণ ও যুবসমাজকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি।
পরিবেশ রক্ষায় স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন রকম কর্মশালা আয়োজন করা জরুরি।
তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত করতে প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক কাজে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
অনগ্রসর তরুণদের আয়বর্ধক খাতে যুক্ত করতে কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।