গোলটেবিল বৈঠক
ঘরের পরিবেশ হোক শিশুস্বাস্থ্যবান্ধব
বাড়ি নির্মাণের সময় প্লাস্টার এবং রং করার সময় তদারক করলে আবদ্ধ ও ড্যাম্প পরিবেশের ঝুঁকি অনেকখানি এড়ানো সম্ভব।
ঘরের দেয়াল ড্যাম্প বা স্যাঁতসেঁতে দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে কমবেশি সবার। অনেকের বাড়িতে সূর্যের আলো ও বাতাস চলাচল ঠিকভাবে হয় না। অনেকে পুড়ে যাওয়ার ভয়ে রোদ তত পছন্দও করেন না। তবে এ ধরনের আবদ্ধ ও ড্যাম্প পরিবেশে বসবাস করার স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং শিশুদের ওপর এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন। কী করলে ঘরের দেয়াল ড্যাম্প হবে না এবং ঘরে আলো-বাতাস চলাচল করবে, সে সম্পর্কেও সচেতনতার অভাব রয়েছে।
গতকাল শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ নিয়ে সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্য, স্থাপত্য ও ঘরসজ্জাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। ‘আবদ্ধ ও ড্যাম্প পরিবেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শিরোনামের এ আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল বার্জার মি. এক্সপার্ট ড্যাম্প গার্ড।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনে প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাড়ি নির্মাণের সময় নির্মাণ, পানি ও সুয়ারেজের পাইপ স্থাপন, প্লাস্টার ও রং করার সময় তদারক করলে আবদ্ধ ও ড্যাম্প পরিবেশের ঝুঁকি অনেকখানি এড়ানো সম্ভব।
বক্ষব্যাধিবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইন্টারভেনশনাল পালমনোলজি ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড স্লিপ সোসাইটির (বিপস) সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেন সরকার বলেন, আবদ্ধ ও ড্যাম্প পরিবেশে বাস করলে হাঁপানি (অ্যাজমা), চুলকানি (অ্যালার্জি), অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, মনোযোগ কমে যাওয়া, ভুলে যাওয়া (ডিমেনশিয়া) রোগ হতে পারে এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত জটিল রোগগুলোর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের জন্য এ পরিবেশ বেশি ক্ষতিকর। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে রোগটি কেন হয়, সে বিষয়ে জানতে হবে ও সচেতন হতে হবে।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, আবদ্ধ পরিবেশে রোগজীবাণু জন্মায়। সবচেয়ে বেশি হয় ফাঙ্গাস বা ছত্রাক। এ ধরনের পরিবেশের স্বাস্থ্যঝুঁকি শিশুদের বেশি। এ ধরনের পরিবেশে থাকা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের মনোযোগ কমে যায় এবং কোনো কিছু শেখার গতি কমে যায়। তিনি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন ডি পেতে সূর্যের আলো গায়ে লাগানোর ওপরও জোর দেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ইউরোপের আটটি শহরের ওপর পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, সেখানে ড্যাম্প পরিবেশে থাকা ব্যক্তিদের ১৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা পাওয়া গিয়েছিল, যা ওই ধরনের পরিবেশে বাস করে না, এমন ব্যক্তিদের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। ফলে এ ধরনের পরিবেশে বসবাস করলে ভুলে যাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ হওয়া ও দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ড্যাম্প দেয়াল প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মাত্রিকের প্রধান স্থপতি সাঈদা আক্তার বলেন, নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে বাড়ির ‘স্বাস্থ্য’ নিয়ে মনোযোগী হতে হবে। পানি ও সুয়ারেজের পাইপ যেখানে বাঁকা করা হয়, সেখানের ফুটো থেকে পানি বেরিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেয়ালে, বিশেষ করে শৌচাগার ও রান্নাঘরের দেয়ালে ড্যাম্প ভাব দেখা যায়। এ ছাড়া নির্মাণের সময় ইটের গাঁথুনি দেওয়ার পর যথেষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এতে ইট থেকে প্রাকৃতিক পানি বের হয়ে যায় এবং গাঁথুনির সময় যে পানি ব্যবহার করা হয়, তা–ও শুকিয়ে যায়। তাই নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে তদারক করা জরুরি। বাড়ি বানানোর পরও ড্যাম্পপ্রুফ মিটার দিয়ে দেয়ালে আর্দ্রতার মাত্রা পরীক্ষা করা সম্ভব।
অন্দরসজ্জাবিদ (ইন্টেরিয়র ডিজাইনার) গুলশান নাসরীন চৌধুরী বলেন, এমনভাবে বাড়ি তৈরি করতে হবে, যেন দরজা ও জানালা দিয়ে বায়ু চলাচল করতে পারে ও ঘরে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করতে পারে। সম্পূর্ণ সুতি ও ভারী সুতি কাপড়ের পর্দা, বিছানার চাদর ব্যবহার, কার্পেটের বদলে শতরঞ্জি ব্যবহার, দেয়ালে মানসম্মত রং ব্যবহারে ঘরের ড্যাম্প দূর হয়। রান্নাঘর ও শৌচাগারের নকশা এমনভাবে করতে হবে, যেন পানি জমে না থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবল স্টাডিজের পরিচালক দিলারা জাহিদ বলেন, ইমারত নির্মাণবিধি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে ড্যাম্প ও আবদ্ধ পরিবেশ কীভাবে দূর করতে হবে, সেটা নিয়ে কথা কম হয়। এ নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা শুরু হওয়া দরকার। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর শারমীন বলেন, ছত্রাক থেকে সংক্রমণ বেশি হলে তা সারিয়ে তোলা সময়সাধ্য বিষয় এবং চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। ফলে প্রতিরোধে মনোযোগ বেশি দিতে হবে। যাতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের বোঝা কমে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে রোদে পুড়ে যাওয়ার ভয় না করে রোদ থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহেদ পারভেজ বলেন, ছত্রাকজনিত রোগ (চুলকানি) এখন তীব্রভাবে বেড়েছে। ওষুধের কার্যকারিতাও কমে যাচ্ছে। যিনি আক্রান্ত হন, তাঁকে আশপাশের লোকজনও ভালোভাবে গ্রহণ করেন না।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা এ এস এম ওবায়দুল্লাহ মাহমুদ বলেন, ঘরের দেয়ালের ড্যাম্প ভাব দূর করতে ৫ থেকে ১২ বছর মেয়াদি ড্যামগার্ড রয়েছে বার্জার পেইন্টের। বিভিন্ন মৌসুমে এটা দেয়ালকে ড্যাম্প থেকে সুরক্ষা দেয়। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে ২০০৬ সাল থেকে বার্জারের রং সিসামুক্ত। পরিবেশের ঝুঁকি এড়াতে বার্জার রঙে ভারী ধাতু ব্যবহার করে না।
সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ড্যাম্প পরিবেশের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে অনেকে জানলেও এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে সেভাবে চিন্তা করেন না। এ আলোচনার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ, নীতিনির্ধারক ও পরিবেশবিদেরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা তানজীন ফেরদৌস আলম ও প্রতিষ্ঠানের ওয়াটার বেজ কোটিং বিভাগের প্রধান সাইফুল আশরাফ।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।