করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য কিনতে হবে

নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দক্ষতার সঙ্গে মানসম্মত পণ্য তৈরির পরিমাণও বাড়ছে। তবে এখনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পণ্য বিক্রিতে পিছিয়ে আছেন নারী উদ্যোক্তারা। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরজুড়েই নানা পণ্যের চাহিদা থাকলেও যোগাযোগ দক্ষতা গড়ে না ওঠায় পণ্য সরবরাহের কাজ পান না নারীরা।

তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না পণ্য বিপণনের জন্য কোথায় কীভাবে যোগাযোগ করবেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সরকারি সংস্থা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনের প্ল্যাটফর্ম।

গতকাল সোমবার বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য উইমেন আন্ট্রাপ্রেনিউয়ার্স ফাইন্যান্স ইনিশিয়েটিভ (উই-ফাই)’ প্রকল্পের সহযোগিতায় এসএমই ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এই প্ল্যাটফর্মের তথ্য তুলে ধরা হয়। গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘smef’ নামের অ্যাপ মুঠোফোনে ইনস্টল করে অথবা এসএমই ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে http://wsmesuppliersplatform.smef.gov.bd/ প্রবেশ করে উদ্যোক্তাদের নিবন্ধিত হয়ে পণ্য প্রদর্শন করা এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য কেনার আহ্বান জানানো হয়। ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নারীদের জন্য ঋণ দেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বাজার সংযোগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, সামনে ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো উপহারসামগ্রী নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কিনতে পারে।

বৈঠকে জানানো হয়, ২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে এ বছরের শেষ প্রান্তে। এখন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় চলছে। প্রকল্পের আওতায় সচেতনতা সৃষ্টি ও প্ল্যাটফর্মে উদ্যোক্তা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, পণ্য বিক্রির জায়গা তৈরি (মার্কেট প্লেস) এবং ব্যবসাসহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৭৮টি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ও ২৯টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান এই প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করেছে। নিবন্ধনের জন্য ফি নেই। তবে উদ্যোক্তাদের ব্যবসার কাগজপত্র, অন্তত তিন বছরের কাজের অভিজ্ঞতা, কমপক্ষে তিনজন পূর্ণকালীন কর্মী রাখার শর্ত পালন করতে হবে।

বৈঠকে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের বড় স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে এসএমই ফাউন্ডেশন। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের সংযোগ স্থাপন করে দিতে চাইছে; যাতে দুটি পক্ষ একে অপরের চাহিদা ও পণ্য সম্পর্কে জানতে পারে। দেশের ভেতরে পণ্য বাজারজাতকরণে সক্ষমতা তৈরি করা গেলে নারীরা আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্য বিক্রির সক্ষমতা অর্জন করবেন।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ বেসরকারি খাত বিশেষজ্ঞ হুসনা ফেরদৌস বলেন, ২০১৫-১৬ সালে বৈশ্বিক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ফরচুন ফাইভ হান্ড্রেড কোম্পানিগুলো বছরে এক লাখ কোটি ডলার পণ্য কেনে। এসব পণ্যের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ সরবরাহ করেছেন নারী উদ্যোক্তারা। দেশে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশে আরও বেশিসংখ্যক নারী উদ্যোক্তা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে আনার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নারীকে ঋণ দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

ঋণ প্রসঙ্গে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজম বলেন, এসএমই খাতে মোট ঋণের ২৫ শতাংশ নারীদের দিতে হবে। এখন ঋণের প্রক্রিয়াকে সহজ করতে এসএমই ফাউন্ডেশন কীভাবে ঋণ নিতে হবে, সে বিষয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে এবং ফাউন্ডেশন নিজেও নারী উদ্যোক্তাদের তালিকা ব্যাংকে পাঠিয়ে ঋণ পাইয়ে দিতে উদ্যোগ নিতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, অনলাইনে নারী পণ্য নিয়ে হাজির হলে নেতিবাচক সব মন্তব্য করা হয়। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করে নারী উদ্যোক্তার পণ্য কেনার জন্য উন্নত মানসিকতার ক্রেতাও তৈরি হতে হবে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত) সালাহউদ্দিন মাহমুদ বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ প্রক্রিয়ায় নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়াতে ফাউন্ডেশনের প্ল্যাটফর্মটি নিয়ে প্রচার বাড়াতে হবে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক ফারজানা খান বলেন, সারা বছর পণ্য কেনার পাশাপাশি আসছে ঈদ ও পয়লা বৈশাখে উপহার দেওয়ার জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য কিনতে পারে।

সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি স্বর্ণলতা রায় বলেন, প্ল্যাটফর্মটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য ভালো সুযোগ তৈরি করতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মে গুণগত মান বজায় রাখতে পণ্যের মানের ওপর ভিত্তি করে একেক ধাপে একেক ধরনের উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ইনোভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সদরুদ্দিন ইমরান বলেন, ১২০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের এই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে। তবে প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করা মাত্রই অর্ডার না পেলে হতাশ হওয়া যাবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে অর্ডার পেতে অপেক্ষা করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উদ্যোগ ইউ ওয়াই সিস্টেমস লিমিটেডের সিইও ফারহানা এ রহমান নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, ২০০৭ সালের শুরুতে নারী হওয়ার কারণে তাঁর দুটি অর্ডার বাতিল হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিনি শখের বশে ব্যবসায় নেমেছেন, দুই বছর পর প্রতিষ্ঠান থাকবে না। তিনি বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে এ ধরনের ভয়াবহ মনোভাব পরিবর্তনে কাজ করা দরকার।

বিক্রয় ডটকমের সিইও ঈশিতা শারমিন বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় হতে হবে।

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান, আড়ংয়ের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ফাহাদ রহমান এবং বেনে বউ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা ফারহানা মুনমুন।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।