প্রযুক্তি শিক্ষায় নারীর অগ্রাধিকার চাই

‘প্রযুক্তি শিক্ষায় নারীর সমতা অর্জনে অন্তরায় ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জিআইজেড বাংলাদেশ ও প্রথম আলো।

চার্লস হোয়াইটলি, রাশেদা কে চৌধূরী, রুবানা হক, ফ্র্যাঙ্ক ফেচার, তাহমিনা ইয়াসমিন ও লাফিফা জামাল

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা কঠিন—এ ধরনের পুরোনো ধারণা পোষণ করে নারীকে এসব শিক্ষায় নিরুৎসাহিত করা হয়। সামাজিক অনেক দায়িত্বের ভার দিয়ে নারীকে প্রযুক্তিবিষয়ক চাকরিতে যুক্ত হতেও বাধা দেওয়া হয় পরিবার থেকে। তাই প্রযুক্তিতে সমতা অর্জনে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার জিআইজেড বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত উঠে আসে। প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে বিদ্যালয় থেকেই মেয়েদের প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘প্রযুক্তি শিক্ষায় নারীর সমতা অর্জনে অন্তরায় ও উত্তরণের পথ’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এ আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউএন উইমেন ও ডেভটেল পার্টনার্স।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, বিশ্বজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক শিক্ষায় নারীরা এখনো পিছিয়ে। বাংলাদেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (সংক্ষেপে স্টেম) শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেন্ডার (লিঙ্গ) সমতাকে অগ্রাধিকার দেয় বলে সবুজ জ্বালানি খাতে নারীদের আরও সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে, নারীদের ওপর শিশু পালনের দায়িত্ব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীর হাতে অর্থ না থাকা। প্রযুক্তি শিক্ষায় মেয়েদের সম্পৃক্ত করা, সচেতনতা সৃষ্টি ও ঋণসহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।

স্টেম শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পঞ্চম শ্রেণি থেকে এ বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, স্টেম শিক্ষায় মেয়েদের অবস্থান কী এবং সমস্যা সমাধানে কী ধরনের পরিকল্পনা করতে হবে, সেটি বুঝতে বিজ্ঞানভিত্তিক উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন। গণমাধ্যমকেও এখানে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) উপাচার্য রুবানা হক বলেন, প্রযুক্তিতে সমতার জন্য শিক্ষাকার্যক্রমে আমূল সংস্কার আনতে হবে। কর্মসংস্থানের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রমের সমন্বয় করতে হবে। বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পর্যায় থেকে স্টেম শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, যতক্ষণ না নারী নারীর কথা বলবে, নারীর পাশে দাঁড়াবে, জোরগলায় বলবে যে এ জায়গাটা আমার, ততক্ষণ পর্যন্ত নারীর জায়গা কেউ ঠিক করে দিতে পারবে না।

স্টেম প্রথাগতভাবে পুরুষপ্রধান উল্লেখ করে জিআইজেড বাংলাদেশের সমম্বয়কারী (জ্বালানি কর্মসূচি) ফ্র্যাঙ্ক ফেচার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে স্টেম শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সমদর্শিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসছে। এ যুগেও স্টেম শিক্ষা ও প্রযুক্তি–সম্পর্কিত চাকরিতে নারীরা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।

সরকার বাজেট পরিকল্পনায় জেন্ডার সমতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব তাহমিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, নারীদের নিজেদের দাবি আদায় করে নেওয়ার জন্য দর–কষাকষি করতে হবে। সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ওপর জোর দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। তিনি বলেন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে যা কিছু কঠিন তা মেয়েদের জন্য নয়। এ ছাড়া খরচ কমাতে বিজ্ঞানে মেয়েকে না দিয়ে ছেলেসন্তানকে পড়ায় অনেক পরিবার। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের স্টেম শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।

ইউএন উইমেনের কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ দিলরুবা হায়দার বলেন, প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জায়গাটিতে আঘাত করতে হবে। এখনো নিজস্ব মুঠোফোন নেই অনেক মেয়ের। এ ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য ২৯ শতাংশ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রযুক্তিতে নারীদের পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন স্টার্টআপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি আহমেদ। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যাবে না বলে মত দেন তিনি।

বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডব্লিউআইটি) পরিচালক কানিজ ফাতেমা বলেন, কোভিড–পরবর্তী পরিস্থিতি বলছে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের অনেক সুযোগ আছে। প্রযুক্তিতে সেই মানের দক্ষতা গড়ে তুলতে পারলে একজন নারী ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আয় করতে পারবেন।

সরকারের অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) কর্মসূচির জেন্ডার–বিশেষজ্ঞ নাহিদ শারমিন বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ চাকরি ডিজিটালের ওপর নির্ভর করবে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে নারীদের প্রযুক্তিতে যুক্ত হতেই হবে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, ‘প্রথম আলোর একটি লিখিত নারীনীতি আছে, আমরা তা মেনে চলি।’

সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যত বেশি জনসংখ্যাকে অংশগ্রহণ করানো যাবে, দেশের উন্নয়ন তত সহজ হবে।

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বাংলাদেশের জ্বালানিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ তনুজা ভট্টাচার্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারজানা রহমান, ডেভটেল পার্টনার্সের চিফ ইমপ্যাক্ট অফিসার আরিফ রায়হান এবং জিআইজেড বাংলাদেশের উপদেষ্টা অনন্যা রুবাইয়াত।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।