প্রযুক্তিতে নারীর সুযোগ বাড়াতে হবে

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে ‘নারীর আগামী ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে বৈঠকটি আয়োজন করে প্রথম আলো।

‘নারীর আগামী ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক শেষে (বাঁ থেকে) নাজিফা জাবিন, লাফিফা জামাল, মানসী সাহা, মালিহা কাদির, রাশেদা কে চৌধূরী, রুপালী চৌধুরী, সাদেকা হালিম, মাহফুজা লিজা, ইলিরা দেওয়ান ও সাজেদা আক্তার। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: খালেদ সরকার

প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে নারী–পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই প্রযুক্তিতে নারীর সুযোগ বাড়াতে হবে। নারীর কাছে পৌঁছাতে হবে প্রযুক্তি। সে লক্ষ্যে প্রযুক্তির ভাষা হতে হবে সহজ। বাড়াতে হবে ডিভাইসের সহজলভ্যতা। কমাতে হবে ইন্টারনেটের ব্যয়। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে বাড়তে থাকা অনলাইন সহিংসতা থেকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে নারীকে।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে গতকাল সোমবার প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বিভিন্ন খাতের নারী পেশাজীবীরা। ‘নারীর আগামী ও প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘জেন্ডার সমতার জন্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন’।

বৈঠকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, বাংলাদেশে নারী–পুরুষের নানা অসমতার মধ্যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। প্রযুক্তি নারী–পুরুষ সবার জন্য হতে হবে। সহজভাবে প্রযুক্তির ভাষা সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের একদম প্রান্তে থাকা একজন মেয়েকেও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে হবে।

বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তবে কোনো নারী পেশায় প্রবেশ করতে চাইলে প্রযুক্তির বিষয়ে তাঁর ভাসা–ভাসা জ্ঞান থাকলে হবে না, অন্তত কয়েকটি বিষয়ে ভালো ধারণা থাকতে হবে। প্রযুক্তিভীতি প্রযুক্তি শিখতে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। এই ভীতি কাটাতে স্কুল থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে।

* বাংলাদেশে নারী–পুরুষের নানা অসমতার মধ্যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। প্রযুক্তি নারী–পুরুষ সবার জন্য হতে হবে। * যেসব নারী বাইরে কাজ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন, তাঁরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিকে না ভাঙতে পারলে প্রযুক্তি দিয়ে নারীকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত নারীকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সবাইকে প্রযুক্তির সুফলের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয় থাকতে হবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে ইন্টারনেটের খরচ কমানো উচিত বলে মন্তব্য করেন সহজ ডট কম–এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির। তিনি বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহারের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট। প্রতিবেশী দেশের তুলনায় এখানে ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বেশি হয়। প্রযুক্তি নারীকে আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে। যেসব নারী বাইরে কাজ করতে গিয়ে পরিবারের বাধার মুখে পড়েন, তাঁরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামালের মতে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকাকেও এখন মৌলিক অধিকারের মধ্যে ধরতে হবে। প্রযুক্তিকে হাতের নাগালে নিয়ে আসতে হবে, যেন সবাই তা ব্যবহার করতে পারেন। বাংলাদেশকে উদ্ভাবনের জায়গায় দেখতে চাইলে প্রযুক্তিতে মেয়েদের সুযোগ দিতে হবে। একটু প্ল্যাটফর্মের সুযোগ দিলে নারীরা অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন।

পুলিশের বিশেষ শাখার পুলিশ সুপার মাহফুজা লিজা বলেন, অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৮৮ শতাংশ কোনো আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। পুলিশ সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তত থাকলেও পারিবারিক বাধা ও সামাজিক সংস্কারের কারণে অনেক মেয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে ভয় পান। আইনি সহায়তা নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তিনি অনলাইন ব্যবহারে কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে নারীদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ান বলেন, পাহাড়ের মানুষদের মুঠোফোন ও অন্যান্য প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে দেরিতে। এ ছাড়া দুর্গম এলাকা, ডিভাইস কম থাকা, ইন্টারনেটের দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে পাহাড়ের মানুষেরা প্রযুক্তির বিষয়ে আরও পিছিয়ে। তাই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ নয়, একটু বেশি সুযোগ ও নজর দিতে হবে পাহাড়ের মানুষদের প্রতি।

প্রথম আলোর ইংরেজি ওয়েবের প্রধান আয়েশা কবির পোশাকশিল্প কারখানার উদাহরণ টেনে বলেন, অনেক কারখানায় অটোমেশন হয়েছে, রোবোটিকস চলে এসেছে। ফলে নারীদের কাজের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা থাকায় নারীদের জায়গাগুলো দখল করে নেবেন পুরুষেরা। তাই পোশাক কারখানার নারীদের প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।

ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ–ভ্রমণকন্যার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারি মানসী সাহা জানান, তাঁদের এখন ৭০ হাজার নারী সদস্য রয়েছেন। এই নারী সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হয় প্রযুক্তির মাধ্যমেই। নারীরা কাজে অনেক বেশি নিবেদিতপ্রাণ হলেও প্রযুক্তিতে নারীরা পারবেন না, এমন ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তিনি বলেন, নারীর সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠায় পুরুষদেরও সমানভাবে কথা বলা উচিত।

সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় সাজেদা আক্তার (সাথী) বলেন, ‘আমি কলসিন্দুর গ্রামের মানুষ। খেলতে গিয়ে অনেক বাধা আসত, তারপরও আমরা বিজয়ী হয়েছি। এখনো অনেক সমস্যায় আছি।’

তরুণ প্রজন্মের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাজিফা জাবিন বলেন, ‘পরিচিত কয়েকজনের ক্ষেত্রে দেখেছি, পরিবারও প্রযুক্তি ব্যবহারে ছেলে ও মেয়েসন্তানের মধ্যে বৈষম্য করছে। গ্রামে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও কম।’

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। তিনি বলেন, বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে আগামীর কথা ভাবতে হবে। অগ্রজ প্রজন্ম পথ তৈরি করে দিচ্ছেন বলেই নতুন প্রজন্ম সেই পথে হাঁটতে পারছে। তিনি আরও বলেন, আজ যেটা প্রাসঙ্গিক, কাল সেটা অপ্রাসঙ্গিক। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তির মধ্যে থেকে নারীর নিরাপত্তাহীনতার দিকেও নজর রাখতে হবে।