শিশুবান্ধব নগরের রূপরেখা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে কর্মকৌশল নির্ধারণ

ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অন সিটিজ ফর চিলড্রেন ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘শিশুবান্ধব নগরের রূপরেখা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে কর্মকৌশল নির্ধারণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৭ আগস্ট ২০২৩। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

মো. আতিকুল ইসলাম

মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

সেলিনা হায়াৎ আইভী

মেয়র, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন

মো. আশরাফুল ইসলাম

নগর–পরিকল্পনাবিদ ও প্রকল্প পরিচালক, ড্যাপ, রাজউক

আকতার মাহমুদ

অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মো. শফিকুল আলম

ওয়াশ স্পেশালিস্ট, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

এস এম মনজুর রশীদ

কর্মসূচি প্রধান, অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ, ব্র্যাক

নিশাত সুলতানা

ডিরেক্টর, পলিসি অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েন্সিং অ্যান্ড ক্যাম্পেইন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

ইকবাল হাবিব

 স্থপতি; সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স

মো. মঈনুল ইসলাম

নগর পরিকল্পনাবিদ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন

রিফাত বিন সাত্তার

ডিরেক্টর, প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ

খোন্দকার রেবেকা সান-ইয়াত

নির্বাহী পরিচালক, কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর

আহসান রনি

প্রতিষ্ঠাতা গ্রিন সেভার্স

ঐশী কবিরাজ

কিশোর-কিশোরী প্রতিনিধি, সেভ দ্য চিলড্রেন অ্যালায়েন্স

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আব্দুল কাইয়ুম

আমরা দেখছি নগরে আবাসিক এলাকা বাড়ছে। শিশুদের খেলাধুলা, বিনোদনের জায়গা কমে যাচ্ছে। এরা ঘরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ শিশুদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এটা তাদের মানসিক বিকাশে বাধা।

একদিকে শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ নেই, অন্যদিকে স্কুলে লেখাপড়ার চাপ। বিভিন্ন মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়ে। শিশুরা যেন একটি সুন্দর পরিবেশে বড় হতে পারে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

রিফাত বিন সাত্তার

আমরা শিশুদের নিয়ে কাজ করি। আমরা চাই  নগর যেন শিশুবান্ধব হয়। রাজউক, সিটি করপোরেশন, পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নগর-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন। প্রতিনিয়ত শিশুরা আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। তারা প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি।

জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ বিভিন্ন কারণে শিশুর জন্য যে ধরনের নগরায়ণ দরকার, সেটা হচ্ছে না। আমরা কেউ কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চাই না। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে শিশুদের জন্য আমরা সুন্দর নগর গড়তে পারব।

আমরা ভবিষ্যতে করব। পরে করব। এভাবে ভাবলে হবে না। এখনই কাজ শুরু করতে হবে। ভবিষ্যৎ করে সময় চলে যায়, কাজ তেমন হয় না। কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে। এর সঙ্গে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জও বাড়ছে।

নগরায়ণও একটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতা মেনেই আমাদের এগোতে হবে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ জরুরি। পার্ক, খেলা ও বিনোদনের জায়গা যেমন তাদের শারীরিক বিকাশে সহায়তা করবে, তেমনি তাদের মানসিক বিকাশও অত্যন্ত প্রয়োজন।

শিশুদের নিরাপত্তা আরও একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। এটা অনেক ক্ষেত্রে আলোচনায় আসে না। আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। বিভিন্ন বয়সে শিশুর চাহিদা ও প্রয়োজন ভিন্ন হয়। নগরের ব্যবস্থাপনা গ্রামীণ ব্যবস্থাপনা থেকে জটিল। নগরে জন্য একটা শিশুবান্ধব নীতিমালা প্রয়োজন; কিন্তু সেটা নেই। শিশুবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে শিশুদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শিশুদের কাছ থেকেই তাদের সমস্যা শুনতে হবে। সেভাবে নগর-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

আকতার মাহমুদ

নিরাপদ নগরী বলতে এমন একটি নগর বুঝি, যেখানে ফুটপাত ধরে ছোট ভাইবোন হেঁটে স্কুলে যাবে। স্কুলে গিয়ে তারা মাঠে ছোটাছুটি করবে। একজন নগর-পরিকল্পনাবিদ  হিসেবে এমনভাবে এলাকার নকশা দেখতে চাই যেন একজন শিশুকে স্কুলে যেতে কোনো বড় রাস্তা পার না হতে হয়।

গতবার সিটি করপোরেশনের ইলেকশনের সময় আমরা ওয়ার্ডকেন্দ্রিক পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম। উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র তাঁর মেনিফেস্টোতে সেটি গ্রহণ করেছিলেন। আমি মনে করি, এটা একধরনের অগ্রগতি। নগর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা ওয়ার্ডকেন্দ্রিক করা গেলে সেবার মান উন্নত হবে। যদিও বাস্তবে নগরশাসন ও ব্যবস্থাপনা এখনো মেয়র অফিসকেন্দ্রিক।

প্রতিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরও সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব নিলে এলাকার বর্জ্যব্যবস্থা, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা কিংবা ফুটপাত দখলের মতো ঘটনা কমে যেত। কাউন্সিলররা নিজ নিজ ওয়ার্ডে উদ্যোগ নিলে মেয়রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। নগর সেবার মান উন্নত হতো।

একটি শহর কতটা শিশুবান্ধব, সেটা বুঝতে বছর শেষে হিসাব করে দেখতে হবে যে আগের বছরের তুলনায় নতুন কতটুকু পার্ক, মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান বেড়েছে। গণপরিসর কতটা সব শ্রেণির মানুষের ব্যবহারের উপযোগী হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী একটি নগরীতে প্রতিটি মানুষের জন্য ৯ বর্গমিটার উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর কতটা অগ্রগতি হয়েছে, সেটা দেখতে হবে। সিটি করপোরেশন, রাজউক, ন্যাশনাল হাউজিং অথরিটি তাদের বার্ষিক বাজেটের কত শতাংশ অর্থ শিশুবান্ধব নগরীর জন্য ব্যয় করছে।

শহরের মোট ভূমির কত অংশ ভূমি গণপরিসর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—এসবই হলো শিশুবান্ধব নগরীর বিবেচ্য বিষয়।

অনেকে বলেন, এই শহরে গণপরিসর সৃষ্টির জায়গা কোথায়? আমি মনে করি, আমাদের নদীর পাড়, খালের পাড়, পুকুর, জলাশয় সংরক্ষণ করে সেগুলো গণপরিসরে রূপান্তর করা যায়। সরকারি খাসজমি এই কাজে ব্যবহার করতে হবে। যেখানে জায়গা পাওয়া যাবে না, সেখানে জমি কিনে হলেও খেলার মাঠ ও পার্ক বানানো যায়।

একজন কাউন্সিলর তাঁর পাঁচ বছরে যদি একটি করে খেলার মাঠ অথবা পার্ক সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে ঢাকা শহর পাঁচ বছরে ১২৯টি নতুন খেলার জায়গা পাবে। এটা বিরাট সাফল্য হতে পারে।

শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান

২০১৮ সালের সরকারি তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে কৃষিজমি ৬০ ভাগ। বনভূমি ১৭ ভাগ আর ২০ ভাগ জলাভূমি। অবশিষ্ট থাকে ৩ ভাগ বা এর কিছু বেশি জমি। এর ওপরই আমাদের শিশু, নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য রূপরেখা তৈরি করতে হবে। এ রূপরেখায় থাকতে হবে কোথায় নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও যোগাযোগব্যবস্থা কেমন হবে, আবাসিক এলাকা পরিষেবা কেমন হবে। পার্ক, খেলার মাঠ লাগবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি লাগবে। এসব ঠিক করে নগরের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে।

শিশুদের স্বাস্থ্যকর নিরাপদ বাসস্থান ও ভালো পরিবহনসেবা দিতে হবে। তা না হলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হবে না। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বাস্তবতা ভিন্ন। আবার অন্য শহরের বাস্তবতা আরও ভিন্ন। বৃষ্টি হলে শিশুরা কীভাবে স্কুলে যাবে, শহরে তাদের হাঁটার সুযোগ আছে কি না, এটা দেখতে হবে।

ঢাকা শহরের মোট দূষণের ১৫ ভাগ হয় পরিবহন খাত থেকে। আজও শহর থেকে পুরোনো গাড়ি তুলতে পারিনি। গাড়ির ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নগরের রূপরেখার মধ্যে এসব বিষয় আসতে হবে।

এই রূপরেখা সারা দেশে বাস্তবায়ন করতে হলে মাননীয় মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

আমরা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স থেকে রূপরেখা তৈরি করেছি। আগামী সেপ্টেম্বরে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আপনারা যখন কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেন, তখন দেখবেন যে প্রকল্পটি শিশু ও নারীবান্ধব কি না।

নিশাত সুলতানা

শিশুদের ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম’ কিংবা ‘আগামী দিনের নাগরিক’ আখ্যা দিয়ে আমরা প্রায়ই তাদের বর্তমানের চাহিদাগুলো এড়িয়ে যাই। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। বর্তমান প্রজন্ম বিবেচনা করেই তাদের প্রয়োজনগুলো পূরণে সবার আগে কাজ করতে হবে। নগরের শিশুরা সার্বিকভাবে ভালো নেই।

ছকে বন্দী নগরজীবনের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বড় হচ্ছে। তাদের জন্য নেই খেলার মাঠ, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার অনুকূল পরিবেশ কিংবা সুযোগ-সুবিধা নেই। মেয়েশিশুদের অবস্থা আরও শোচনীয়।

শিশুর অধিকারের আলোচনাটি বিবর্ণ হয়ে যায়, যখন কন্যাশিশুর নিরাপত্তার প্রশ্নটি সবার আগে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

২০২২ সালে ‘সহিংসতার ভয়’ শিরোনামে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যে গবেষণাটি করেছিল, তাতে দেখা যায়, ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ কন্যাশিশু, কিশোরী এবং তরুণী গণপরিসরে কোনো না কোনো শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে যে শিশুরা বড় হয়, তাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কন্যাশিশুর জন্য ক্ষতিকর ভয়ের এই সংস্কৃতিকে রুখে দিতে ব্যাপকভাবে কাজ করছে।

তবে কাজটি সহজ নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতি, চর্চা আর দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলানো খুব কঠিন, তবে সবার চেষ্টা থাকলে অসম্ভব না।

মো. মঈনুল ইসলাম

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট নগর জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ ৭২ হাজার। যা মূল জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ।  এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরে বসবাসকারী শিশুর সংখ্যা নগর জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।  ২০১৪ সালের বস্তি শুমারি অনুযায়ী নগরে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ  মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। এ ছাড়া নগরের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) শিশুর সংখ্যা ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

শিশুরা নগরের অন্যতম অংশীজন। তাই নগর-পরিকল্পনার মধ্যে এই শিশুদের নিয়ে ভাবনা থাকতে হবে। নগরে শিশুদের বিনোদন ও খেলার মাঠ না থাকায় তারা যতটুকু অবসর পায়, সে সময় বিভিন্ন ডিভাইসে আসক্ত থাকে। এ জন্য তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এখন প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শিশুবান্ধব নগরের জন্য প্রয়োজন সুশাসন। শিশুদের জন্য সিটি করপোরেশনের বাজেটে বরাদ্দ থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে মাননীয় মেয়রদের সঙ্গে শিশুরা যেন অংশগ্রহণ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কোনো মহাপরিকল্পনায় শিশুদের কোনো মতামত দেখতে পাই না। আমরা যখন শিশুদের জন্য পার্ক, খেলার মাঠ ও জলাধার নির্মাণ করি, তখন অবশ্যই তাদের মতামত নেওয়া উচিত। প্রস্তাবিত জাতীয় নগর নীতিমালায় শিশুবান্ধব নগর–পরিকল্পনায়  বিষয়টি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় নগর নীতিমালা চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।

নারায়ণগঞ্জের মাননীয় মেয়র যেভাবে কাজ করছেন, তাতে ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন শিশুসহ সবার জন্য একটি আদর্শ বাসযোগ্য নগর হবে বলে আশা করি।

শফিকুল আলম

আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা সুন্দর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে স্কুলে যাক। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার পর কী হয়। স্কুলে কি পরিচ্ছন্ন টয়লেট ও নিরাপদ পানি আছে? অনিরাপদ পয়োনিষ্কাশনের জন্য শিশুরা স্টান্টিং হয়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তখন অনেক খাওয়াদাওয়া করলেও শিশু লম্বা হবে না। কারণ, শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়।

একজন শিশু যদি বারবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়, তখন তার পুষ্টি গ্রহণের শক্তি কমে যায়। এ জন্য বেশি খাওয়াদাওয়া করলেও শরীর দুর্বল থাকে। তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

আমরা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে পয়োনিষ্কাশনের জন্য কাজ করছি। বনানী, গুলশান, বারিধারা, নিকেতন—এমন সব জায়গায়ও নিরাপদ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা পাইনি। এমন ধনী এলাকায়ও  মাত্র ১ শতাংশ মানুষের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ঠিক আছে। বিশ্বে প্রতিদিন ৭০০ শিশু মারা যায় শুধু নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনের অভাবে। আমার সন্তানেরা স্কুলে টয়লেটে যায় না। মেয়েদের পরিস্থিতি তো আরও খারাপ। অথচ আমাদের ন্যাশনাল ‘মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’ আছে, যা পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। মেয়েরা তিন দিন মেনস্ট্রুয়ালের (মাসিক শারীরিক প্রক্রিয়া) জন্য স্কুলে যেতে পারে না। কেন আমরা মেয়েশিশুবান্ধব টয়লেট ব্যবস্থাপনা করতে পারব না। এটা মেয়েদের প্রতি অন্যায়।

ঐশী কবিরাজ

শিশুদের কথা তেমনভাবে বলা হয় না। শিশুদের কথা শোনা হয় না বলে তাদের সমস্যার সমাধান হয় না। আপনাদের কাছে যে সমস্যা ছোট, শিশুদের কাছে সেটা হয়তো অনেক বড় সমস্যা। বাংলাদেশে শিশুরা সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না। বস্তির শিশুদের সমস্যা আরও অনেক বেশি। এরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বলতে তারা তেমন কিছু বোঝে না। আবার অনেক শিশু জানেই না তাদের সমস্যা কী। এ জন্য তাদের সচেতন করাও প্রয়োজন।

খেলার মাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের যেকোনো আলোচনায় আগেই খেলার মাঠের প্রসঙ্গ আসে। আবার খেলার মাঠ যা আছে, সেটা ছেলেদের জন্য। মেয়েদের জন্য নেই। আমি খেলার মাঠ ছাড়া বড় হলাম। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো খেলা বিষয়টিই ভুলে যাবে। আমাদের এলাকাগুলোয় খেলার মাঠ বলতে স্কুলের মাঠ। কিন্তু স্কুল ছুটির পর মাঠ বন্ধ থাকে। এখন বাসা ও স্কুল দুই জায়গাতেই পড়ার চাপ। আগের দিনে শিশুরা স্বাধীনভাবে চলতে পারত। এখনকার মতো এত বিধিনিষেধ ছিল না।

শিশুরা বায়ু ও শব্দদূষণমুক্ত একটি পরিবেশ চায়। খেলার মাঠ চায়। বিনোদনের সুযোগ চায়। নগরে তাদের নিরাপত্তা চায়। তারা যেন সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে। কর্তৃপক্ষ যেন শিশুদের জন্য এসব বিষয় নিশ্চিত করে।

খন্দকার রেবেকা সান-ইয়াত

এখন পর্যন্ত আমাদের নগর-পরিকল্পনা নেই। ২০১৬ সালে আরবান সেক্টর পলিসি হয়েছে। কিন্তু এটা এখনো স্থানীয় সরকারের টেবিলে পড়ে আছে। এটা পাস হলে মেয়ররা ক্ষমতা পাবেন। তখন শিশুবান্ধব নগর করা তাঁদের জন্য আরও সহজ হবে। প্রতিটি নগরে দরিদ্র মানুষের জন্য পরিকল্পনা থাকতে হবে। নদীভাঙন, দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের খোঁজে শিশুরা শহরে আসে। তাদের কথাও ভাবতে হবে। তাদের থাকা ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এই শিশুদের জীবনে ঝুঁকি তৈরি হবে।

এখনো এই শহরের প্রায় ১৫ হাজার শিশু জন্মনিবন্ধন পায়নি। নগরে দরিদ্র শিশুদের নিরাপত্তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

আহসান রনি

আমি এই শহরে বড় হয়েছি। এই শহরকে ভালোবেসেছি। এমন একটি শহর চাই, যে শহরে আমার সন্তানও বড় হবে এবং শহরকে ভালোবাসবে। আমি ১৩ বছর ধরে স্কুল নিয়ে কাজ করি। বর্ষাকালে স্কুলের মাঠের এমন অবস্থা হয় যে খেলাধুলা ও দৌড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় মাঠে বিভিন্ন মালামাল রাখা হয়। আবার স্কুল ছুটির পর মাঠের গেটে তালা লাগানো হয়। এসব কারণে স্কুলের মাঠ থাকার পরও শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করতে পারে না। ফুটপাতও শিশুরা ব্যবহার করতে পারছে না। এখন ফুটপাতের ওপরও মোটরসাইকেল উঠে যায়।

একসময় আমরা ছাদবাগান নিয়ে কাজ করি। শিশুদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের অভিভাবকদের মাধমে প্রায় ৫ হাজার ছাদ ও বারান্দাবাগান করতে পেরেছিলাম।

আজ কারণে–অকারণে এই শহরের গাছ কাটা হয়েছে। শিশুদের খেলার মাঠ দখল করে গাড়ি রাখা হয়। আবাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। নগরের শিশুদের যদি আমরা সুন্দর পরিবেশ দিতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে তারাও সুন্দর নগরী গড়তে ভূমিকা রাখবে।

ইকবাল হাবিব

দেশের জমির মালিক রাষ্ট্র। কিন্তু  রাষ্ট্রের হাতে জমি নেই। এ জন্য মেয়র বলেন যে তাঁদের জমি নেই। দেশে রূপরেখা, পরিকল্পনার যেন শেষ নেই। কিন্তু এর কার্যকারিতা সেভাবে দেখা যায় না। ঢাকা, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি শহরের কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম এবং এর সফলতা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মেয়র প্রমাণ করেছেন যে মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলে আইনের বেড়াজাল পাত্তা না দিয়ে মানুষের জন্য অনেক কিছু করা যায়।

তিনি আমাকে বলেছিলেন, শেখ রাসেল পার্ক করবেন। এটা তাঁর স্বপ্ন। কিন্তু পয়সা দিতে পারবেন না। এর রূপরেখা তৈরি করে দিতে হবে। তাঁকে বিশ্বাস করে এই অভূতপূর্ব সুন্দর কাজটা আমরা করেছি। রূপরেখা হবে, পরিকল্পনা হবে, সরকার দেবে—এসব বাতিল ভাবনা নিয়ে থাকলে হবে না। যা আছে তা–ই নিয়ে এখনই শুরু করতে হবে। শহরের জায়গা সময়ভিত্তিক, বিকল্প ব্যবহার ও বহুমাত্রিক ব্যবহার করতে হবে। শহরের কোনো জায়গা দীর্ঘ বছর খালি পড়ে আছে। মেয়ররা কয়েক বছরের জন্য সেটা ব্যবহার করেন। মাঠের বিকল্প ব্যবহার করতে হবে।

নগরকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন হাঁটতে হাঁটতে, চলতে চলতে শিশুদের মানসিক বিকাশ হয়। যে নগর ভাসমান শিশুকে অস্বীকার করে, সে নগর কোনো বান্ধবই হতে পারে না। শহর হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক।

মেয়ররা যদি ভালো কাজ করেন, মানুষের সমর্থন পাবেন। আমরা এমন একটা নগরে বাস করি, যেখানে মাঠ উদ্ধার করতে গিয়ে মায়েদেরও মাঠে নামতে হয়। এসব কারণে একদিন আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

এস এম মনজুর রশীদ

শিশু আইনে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুন্দর পারিবারিক জীবন, খেলাধুলা ও বিনোদন এই পাঁচটি অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শিশুরা যেন কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার না হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। স্কুলের, গৃহশিক্ষকের, মা-বাবার যে পড়ার চাপ, সেটা শিশুরা নিতে পারে না। ভীষণ অসুস্থ পরিবেশের মধ্য দিয়ে শিশুরা তাদের শৈশব পার করছে।

নগর–পরিকল্পনায় শিশুদের সুযোগ-সুবিধার প্রতিফলন দেখা যায় না। নীতিনির্ধারণী পর্যায় শিশুদের আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, নীতি প্রণয়নে তাদের মতামত নেওয়া হয় না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন শিশুবান্ধব পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, তেমনি পাড়া, মহল্লায়ও শিশুবান্ধব পরিবেশ থাকা প্রয়োজন।

ঢাকাসহ সারা দেশে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার ও রাজউক এমন সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যেন দেশের সব শিশু সুন্দর পরিবেশ পায়। শিশুরা আকাশ দেখতে চায়। যে উন্নয়ন আকাশ ঢেকে দেয়, সে উন্নয়নের প্রয়োজন নেই।

মো. আশরাফুল ইসলাম

ঢাকা শহরে প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ প্রজন্ম। আমরা মহাপরিকল্পনা তৈরির সময় তাঁদের মতামত নিয়েছি। রাজউক মিলনায়তনে এটা নিয়ে দুই দিন আলোচনা করেছি। সেভ দ্য চিলড্রেন এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করেছে। এবারই প্রথম আমরা স্কুল জোনিং করেছি। রাজধানীতে কয়েকটি রুম ভাড়া করে অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে। যাদের কোনো খেলার মাঠ নেই। মাঠসহ স্কুলের মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকা শহরে যে স্কুল আছে, এর সঙ্গে আরও ৬২৭টি স্কুলের প্রয়োজন।

আমরা উত্তরা তৃতীয় এবং ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে খেলার মাঠসহ শিশুবান্ধব দুটি স্কুল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। পাবলিক গণপরিসরের জন্য এবার নির্দিষ্টভাবে ড্যাপে ৫টি আঞ্চলিক, ৫৫টি জলকেন্দ্রিক ও ১৪টি ইকোপার্কের জন্য নির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব আছে।

আন্তর্জাতিক মান অনুসারে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ গণপরিসর রাখতে হয়। সেখানে আমাদের আছে প্রায় ১৫ শতাংশ। বিশ্বমান থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। শুধু  ভূমি রিকুইজিশন করে এই মান অর্জন করা খুবই কঠিন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবার চারটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা ৪২০ একরের একটি আঞ্চলিক পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকার চারপাশে কতগুলো জলাধার ও দিঘি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি।

বিশ্বের অনেক দেশে অলটারনেটিভ এডুকেশন আছে। এটা হলো মাঠে খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা। একে বলে মাঠপাঠ পড়াশোনা। আমরা কমিউনিটিভিত্তিক এ ধরনের মাঠপাঠের বিষয়ে ভাবছি। রাজউক নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে রাজউকের ছোট জায়গাগুলো আর কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হবে না। এগুলো পার্ক করার জন্য প্রকৌশল শাখাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা সবাই চেষ্টা করলে শিশুদের একটা সুন্দর আগামী দিতে পারব বলে আশা করি।

সেলিনা হায়াৎ আইভী

নারায়ণগঞ্জের শেখ রাসেল পার্ক সারা দেশের জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে। স্থপতি ইকবাল হাবিবের প্রতিষ্ঠান এর নকশা করেছে। আমরা যেভাবে বলেছি, সেভাবেই নকশা করেছে। অল্প জায়গার মধ্যে শিশুদের জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে। সুইমিংপুল, দিঘি, খেলার মাঠ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, স্কেটিং জোন, পদ্মপুকুরসহ নানা বিষয় এখানে আছে। শিশু, নারী ও বয়স্কবান্ধব নগরী করতে প্রথমেই প্রয়োজন জায়গা। জায়গা কোথা থেকে পাওয়া যাবে, সেটি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশুবান্ধব নগরী গড়ার সার্কুলার জারি করেছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জায়গায় জন্য আবেদন করেছি। কেউ জায়গা দেয়নি। রেলের অনুমতি না পেয়ে  উপায়হীন হয়ে একপ্রকার বাদ্য হয়েই রেলওয়ের ১৮ একর জায়গায় শেখ রাসেল পার্ক করেছি। আমার নামে মামলা হয়েছে। আমার ঠিকাদার ধরে নিয়েছে। আমরা  কাজ করে গেছি।

উন্নত দেশে শিশুরা স্কুলেই বেশি খেলাধুলার সুযোগ পায়। নিউজিল্যান্ডে দেখেছি যে শিশুরা দুষ্টুমি করলে বলে যে কাল স্কুলে যেতে পারবা না। স্কুলে না যাওয়াই তাদের শাস্তি। সেখানে স্কুলেই শিশুরা বেশি বিনোদন পায়। আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার সন্তানেরা পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কখনো স্কুলের টয়লেটে যায়নি। কারণ, টয়লেট ময়লা।

ছোটবেলায় আমি যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে অনেক বড় খেলার মাঠ ছিল। সরকার বলল যে স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করতে হবে। কিছুদিন আগে দেখলাম, সেখানে মাঠ দখল করে বড় দুটি ভবন হয়েছে। কলেজ করতে হলে আলাদা জায়গায় কলেজ করা হোক।

প্রায় ১৫ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চোখে পানি এসে গেল। গাছ কেটে ভবন করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে বেশ কটি পুকুর খনন করে বাঁধাই করে দিয়েছি।

একটা নগর ভবন করেছি। নারায়ণগঞ্জের মানুষ বুঝতে পারে যে এখানে একটা নগর ভবন আছে। রাজউক ঢাকা শহর নিয়ে থাকতে পারে। সে নারায়ণগঞ্জে গাজীপুরে কেন যাবে? রাজউকের সহযোগিতা তো পাওয়া যাই না; বরং রাজউকের হস্তক্ষেপের কারণে কাজ করতে সমস্যা হয়। এই দ্বৈত শাসন থেকে মুক্তি না পেলে কোনো দিনও নগরের ঠিক উন্নয়ন হবে না।

রাস্তা সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক কন্ট্রোল করে পুলিশ সুপার। বাস–ট্রাকস্ট্যান্ড সিটি করপোরেশনের, কিন্তু গাড়ির পারমিশন দেন ডিসি। স্থানীয় সরকারের সব বিভাগের বাজেট বেশি। সিটি করপোরেশনের বাজেট কম। নানামুখী সমস্যার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়। টিকে থাকতে হয়। নগরের স্কুলগুলো যেন শিশুদের জন্য খোলা রাখে। টয়লেট, পানির ভালো ব্যবস্থা করে। প্রয়োজনে সিটি করপোরেশন থেকে সহযোগিতা দেব।

আতিকুল ইসলাম

শিশুরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। শিশুদের জন্য সুন্দর পরিবেশ নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে শিশুরা আমাদের দোষারোপ করবে। একদিন না একদিন আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। আমি শিক্ষামন্ত্রী, স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের ২০টি চিঠি দিয়েছি। তাঁদের বলেছি, স্কুল বন্ধের পর মাঠ খোলা রাখুন। তাহলে শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করতে পারবে। আমাদের খাসজমি অনেক আছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের কোনো জমি নেই। নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী শেখ রাসেল পার্ক তৈরি করে সবার জন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন।

খাসজমি দখল হলে কেউ কোনো কথা বলে না। কিন্তু যখন শিশুদের খেলার মাঠ, বিনোদনের জায়গা করতে যাই, তখন সব জায়গার মালিক চলে আসেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে কালশী ব্রিজ উদ্বোধন করলেন। কিন্তু সেখানে বালুর মাঠের ১৬ বিঘা জায়গা আছে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এ জায়গা প্রাইভেট–পাবলিক পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ভবন নির্মাণের জন্য দিয়েছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বললাম। তিনি এটাকে শিশুদের খেলার মাঠ করতে বললেন।

আমি যদি চোখ বন্ধ করে থাকতাম, তাহলে এই ১৬ বিঘা জমি পেতাম না। আমার ওপর অনেক চাপ এসেছে। কিন্তু আমি সরে যাইনি। আরেকটা ঘটনা হলো ৩ নম্বর ওয়ার্ডে হাউজিং সোসাইটি প্যারিস মাঠে ৩২টি প্লট দিয়েছে। কীভাবে তারা মাঠের জায়গা প্লট হিসেবে বরাদ্দ দিল। ন্যাশনাল হাউজিং সোসাইটি কি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য? তারা শিশুদের কথা চিন্তা করছে না। তারা তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বিপর্যয় অনিবার্য।

আমাদের শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য অবশ্যই খেলার মাঠসহ ভালো পরিবেশ দিতে হবে। মিরপুরের জল্লাদখানা একসময় মাদকের আড্ডা ছিল। আমরা এটা পরিচ্ছন্ন করেছি। শিশুরা এখানে দোলনায় দোল খায়। খেলাধুলা করে।

রাজউকের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম আছেন। তিন এই শহরকে ধারণ করেন। এক, দেড় বা দুই কাঠা জমি যেন কোনোভাবেই বরাদ্দ দেওয়া না হয়। এসব জায়গা আমরা শিশুদের জন্য ছোট ছোট খেলা ও বসার জায়গা করে দেব। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সম্পূর্ণ বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। সেখানে একটি খেলার মাঠ নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন শিশুদের জন্য এবার ৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর আগে এত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ইকো হাইডো পার্কের ৫৩ একরের ৫০ একরই দখল হয়েছিল। আমরা এটা উদ্ধার করেছি। এই শহরটা আমাদের। এটা ধারণ করতে হবে। একে সুন্দর রাখার জন্য যা করা দরকার, সেটা করতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ নির্মাণ করবে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করা জরুরি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • শিশুদের জন্য বায়ু ও শব্দদূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

  • শিশুদের জন্য খেলাধুলার মাঠ নিশ্চিত করা জরুরি।

  • শিশুদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে হবে।

  • শিশুরা যেন স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাবার পায়।

  • দ্বৈত শাসনের কবল থেকে সিটি করপোরেশনকে মুক্ত করতে হবে।

  • সিদ্ধান্ত গ্রহণে মেয়রদের সঙ্গে শিশুরা যেন অংশ নিতে পারে, সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

  • সিটি করপোরেশনের বাজেটে শিশুবান্ধব নগর উন্নয়নে নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ দিতে হবে।

  • শিশুর জন্য পার্ক, খেলার মাঠ ও জলাধার নির্মাণের সময় তাদের মতামত নেওয়া জরুরি।

  • জাতীয় নগর নীতিমালায় শিশুবান্ধব নগর–পরিকল্পনার বিষয়টি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় নগর নীতিমালা চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।

  • নগরের ভাসমান শিশুকে অস্বীকার করা যাবে না। শহর হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক।