নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষ ও পরিবারের সম্পৃক্ততা

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষ ও পরিবারের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

হালিদা হানুম আখতার

সদস্য, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন

সারা জীবন নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেছি। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলোও ঠিকভাবে চলতে হবে। পরিবারেই নারীর প্রতি বৈষম্য শুরু হয়। আমাদের দেশে ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। আর মেয়েদের বাড়ির পাশের স্কুলে পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ নারীর পেছনে বিনিয়োগের কোনো ইচ্ছা দেখা যায় না।

মায়েরা পরিবারের ছেলেসন্তানকে ডিম খেতে দেন, মাংসের বড় টুকরাটা দেবেন। আর কন্যাসন্তানকে নিজের সঙ্গে বসিয়ে পাতিলে লেগে থাকা তরকারি খাওয়াবেন। এভাবেই তো আমাদের সমাজ চলছে। তাই পরিবার থেকে এসব পরিবর্তন শুরু করতে হবে।

বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধে পুরুষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এমন বাবা ঘরে ঘরে হোক, যিনি কন্যাকে পড়াবেন, পড়তে উৎসাহ দেবেন। আমরা নারীকে যৌনসামগ্রী হিসেবে দেখতে চাই না। নারী তার অধিকার নিয়ে চিৎকার করতে থাকবে। সে কথা বলতে থাকবে। নারীকে দুর্বল হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাকে সেবাদানকারী কিংবা শ্রমিক হিসেবে দেখা চলবে না। তাকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, যেভাবে একজন পুরুষকে দেখা হয়।

শাশুড়িদের কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনতে হবে। ছেলে বিয়ে দেওয়ার পর বেশির ভাগ নারীর আচরণ বদলে যায়। তখন অনেকেই পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করতে থাকে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কিংবা হাসপাতালের পরিবর্তে ধাত্রী দিয়ে প্রসব করানোর মতো কাজগুলো শাশুড়িরাই করে থাকেন। তাই তাঁদের নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। তাঁদের সচেতন করতে হবে।

হকোন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন

রাষ্ট্রদূত, নরওয়ে দূতাবাস

বাংলাদেশ জেন্ডার সমতা অর্জনের দিকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করছে। যদিও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আজ ভবিষ্যতের কথা শুনে, বিভিন্ন খাতের সঙ্গে সরকারের সমন্বয় দেখে আনন্দিত। সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও একাডেমি থেকে শুরু করে সমাজের সবাই এই সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিশ্বজুড়ে জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা অনেক জীবন ও কমিউনিটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই সহিংসতার অবসান ঘটাতে আমাদের অবশ্যই মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে হবে। জেন্ডার বৈষম্য, নেতিবাচক সামাজিক আচার ও অবিচারের কারণে এ ধরনের সহিংসতা হয়ে থাকে। পরিবার সবার মন ও আচরণ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবারের মধ্যে জেন্ডার-সমতাপূর্ণ সচেতনতা বিকাশ করতে পারলে আমরা সহিংসতার চক্র ভেঙে দিতে পারব। তাই এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধি পাবে। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের সমতার মূল্য শেখাতে হবে। ক্ষতিকর কুসংস্কার প্রত্যাখ্যান করতে শেখাতে হবে। এসবের সব কিছু পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর প্রথা বন্ধ করতে নরওয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নরওয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিজ দেশ ও বিশ্বব্যাপী জেন্ডার সমতার পক্ষে প্রচার ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমানে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা কমানোর লক্ষ্যে নোরাড-অর্থায়নে ‘গার্লস গেট ইকুয়াল প্রকল্প’ ও  নরওয়েজিয়ান স্টেট ব্রডকাস্ট কোঅপারেশনের (এনআরকে টেলিথন/টিভি-আকসজনেন) অর্থায়নে ‘চাইল্ড নট ব্রাইড প্রোগ্রাম’ বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশে জেন্ডার–সমতা অর্জনে নরওয়ে দূতাবাস এমন সহায়তা করতে সব সময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

শবনম মোস্তারী

যুগ্ম সচিব, মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। এ জন্য আমাদের কাছে অনেকগুলো আইনও আছে। কিন্তু তারপরও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে। সহিংসতা ব্যাপারটি আমরা কেবল নারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে মনে করছি, এটা একটা সমস্যা। অথচ পুরুষদেরও এখানে যুক্ত করা দরকার। কারণ, নারী মূলত পুরুষদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়।

আমাদের আইন ও আয়োজনগুলো তেমন একটা অনুভূতির সৃষ্টি করে না, যার মধ্য দিয়ে বার্তা দেওয়া যাবে। আমরা ‘নারীর প্রতি সহিংস আচরণকারীদের ধিক্কার’ ধরনের কোনো আয়োজন করি না। আমাদের আয়োজনগুলো কেবল ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে করণীয়’ ধরনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

শিশুদের একদম শুরু থেকেই এসব ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। এখানে বিনিয়োগ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের একটি সংবেদনশীল মনন দিয়ে গড়ে তোলা প্রয়োজন। স্কুলের কারিকুলামে এসব বিষয়ে পাঠ থাকতে হবে। যৌন হয়রানি কিংবা যৌনশিক্ষা সম্বন্ধে শিশুদের ভালোভাবে জানাতে হবে।

নারীর প্রতি নারীও সহিংস আচরণ করে। কেবল পুরুষই নারীর সঙ্গে সহিংস হয়—বিষয়টি এমন নয়। সহিংসতার প্রতিদিনের তথ্য একত্র করা প্রয়োজন। এই তথ্যগুলো একসঙ্গে করা গেলে সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজ করতে পারে। পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বউ-শাশুড়ির বিবাদে স্বামীর চুপ থাকা চলবে না। দোষটা কার, তা খুঁজে বের করতে হবে। বৈজ্ঞানিক তথ্যের নিরিখে পরিবারে আচরণ বজায় রাখতে হবে। কারণ, পরিবারের শিশুরা মূলত সেটাই করে, যা তারা বড়দের করতে দেখে।

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি

আমি ‘সহিংসতা’ শব্দটির পরিবর্তন চাই। কারণ, সহিংসতা ছাড়াও নারীর প্রতি অন্যায়, অবিচার, উদাসীনতা কিংবা বঞ্চনা হয়ে থাকে। সাধারণত নারী–পুরুষের সম্পর্ক মোটাদাগে চার ধরনের হয়। বাবা, ভাই, স্বামী ও সন্তানকেন্দ্রিক সম্পর্ক। নারীরা একেকজনের কাছে একেক ধরনের বঞ্চনা কিংবা উদাসীনতার শিকার হন।

কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসায় ৩০০ বছর ধরে শরহে বেকায়া নামে একটি বই পড়ানো হয়। সেই বইয়ে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর স্পষ্ট তিনটি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, স্ত্রীকে প্রস্তুতকৃত খাদ্য দিতে হবে। খাওয়ার আগে প্লেট পরিষ্কারের দায়িত্বও স্বামীর। দ্বিতীয়ত, স্ত্রীকে কাপড় দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে থান কাপড় নয়; বরং প্রস্তুতকৃত কাপড় দিতে হবে। তৃতীয়ত, স্ত্রীর জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে ধার্মিক-অধার্মিক কেউই এই অধিকারগুলো স্ত্রীকে পুরোপুরিভাবে প্রদান করেন না। নারীরাই জানেন না যে তাঁদের এ অধিকারগুলো পাওয়ার কথা। যুগ পরিবর্তন হচ্ছে। আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল ১১ বছর বয়সে। দাদি কিংবা নানির আরও অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। আমার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি ২০ ও ২৪ বছর বয়সে।

ছেলে সন্তান না থাকলে সমাজে মানুষ এখনো নানা প্রশ্ন করে । সবাই ছেলে সন্তানের কথা জানতে চায়। এ হলো আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি। ইসলামকে সঠিকভাবে মানুষের সামনে নিয়ে আসতে হবে। বদরের যুদ্ধে রাসুল (সা.)–এর নিরাপত্তার জন্য নুসাইবা নামের একজন নারী সৈনিক ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করেছেন। সুতরাং নারীদের পিছিয়ে রাখার কোনো সু্যোগ নেই।

তাহেরুল হক চৌহান

যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম), ডিএমপি

 ২২ বছর ধরে পুলিশে কাজ করার সুবাদে অনেকগুলো তদন্তের কাজ করার সুযোগ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতার মতো বিষয়গুলো ছিল।

কোনো নারীর স্বামী মারা গেলে তাঁদের ওই ঘরেই রেখে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অর্থাৎ স্বামীর ভাই কিংবা পরিবারের অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা দেখা যায়। আবার তাঁকে সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বঞ্চনার শিকার হতে দেখা যায়।

নারীকে সহিংসতা থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু পুলিশের দুর্নীতির কারণে সেটি ঠিকভাবে হয় না। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত উপায়ে কাজ করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

‘পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন’ নামে বাংলাদেশে একটি আইন রয়েছে। এটি চমৎকার একটি আইন। এই আইনে পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পরিবারকে রক্ষা করা জরুরি। যদিও আমরা যৌথ পরিবার প্রথা থেকে দূরে সরে এসেছি। তবুও পরিবার ব্যাপারটি এখনো টিকে আছে। নানান সমস্যা সমাজে আছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবার টিকে আছে।

আইনের প্রয়োগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আইন তৈরি করার সময় মাঠপর্যায়ের সব অংশীজনের কথা কিংবা পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এটি নেওয়া হয় না বলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়। সংস্কার কমিশনের উচিত এগুলো নিয়ে কাজ করা। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করাও জরুরি। এটি নিশ্চিত করা গেলে সহিংসতা বহুলাংশে কমে আসবে।

শাহীন আনাম

প্রধান নির্বাহী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজিএফ)

নারীর প্রতি সহিংসতা অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। তাই এটির সমাধানে বহুমুখী কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। এই তিন প্রতিষ্ঠান সচেতনভাবে কাজ করলেই নারীর প্রতি সহিংসতা থামানো সম্ভব। পরিবারের মধ্যে নারীর সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রথা প্রভৃতির অপব্যাখ্যা করে নারীদের দমিয়ে রাখা হয়। এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

কোনো মেয়ে স্কুলে যৌন হয়রানির শিকার হলে তাকে পরিবার থেকে সহায়তা করতে হবে। তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা চলবে না। কারণ, এখানে তার দোষ নেই। আমাদের দেশে ভুক্তভোগীকে অপবাদ দেওয়ার সংস্কৃতি খুব ভালোভাবে প্রচলিত। হয়রানির শিকার নারীর পোশাক থেকে শুরু করে সে কোথায় কখন গেল—এসব নিয়েও অপবাদ দেওয়া হয়। অথচ দোষীকে শাস্তির আওতায় আনার কথা হয় খুব কম।

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সমাজের বড় ভূমিকা রাখতে হবে। যাঁরা বাল্যবিবাহ দেন কিংবা এ কাজ করা কাজিদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে। পুরুষত্বের প্রচলিত সংজ্ঞাকে বাদ দিয়ে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা জরুরি। প্রচলিত সংজ্ঞায় পুরুষের ওপর অধিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে হর্তাকর্তার ভূমিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। যে কারণে পুরুষেরা একধরনের আধিপত্য চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন।

যেসব অল্প বয়স্ক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নারীবান্ধব সমাজ ও পরিবেশ গড়ে তোলা। আইনের উপযুক্ত ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য সব অংশীজনকে আন্তরিক করে গড়ে তুলতে হবে।

সানজিদা আখতার

অধ্যাপক, জেন্ডার ও উইমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জেন্ডার–সংক্রান্ত আলোচনা বলতে কেবল নারীবিষয়ক আলোচনাকে বোঝার প্রবণতা এখনো রয়েছে। জেন্ডার নিয়ে আলোচনা উঠলেই পুরুষেরা এটিকে কেবল নারীর বিষয় বলে গণ্য করেন। তবে বিষয়গুলো পরিবর্তনের মুখ দেখছে। পুরুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রচুর পরিমাণ কাজ হচ্ছে। আমাদের পরিবার ও সমাজকাঠামোতে পুরুষকে অবশ্যই সক্রিয় কর্তা হিসেবে কাজ করতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক বাবা তাঁর কন্যাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেন। এখানে আমাদের ব্যর্থতা আছে। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র একজন পিতাকে সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তার উপযুক্ত ধরনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। একজন পিতা এবং একই সঙ্গে সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সমন্বয় থাকা জরুরি। নারীর প্রতি সাইবার আক্রমণ বন্ধ করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে কাজ করতে হবে।

কবিতা বোস

কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

আজকের আলোচনায় আসা মত ও পরামর্শগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বাস করে এসব আলোচনার মাধ্যমেই আমরা সমাধানের পথে এগোতে পারব।

আমাদের সমাজের বৈষম্য থেকে শিশু, কন্যাশিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতাগুলো হচ্ছে। বৈষম্য ও সহিংসতা পাশাপাশি হাঁটে। দুর্বল ও পিছিয়ে থাকা মানুষের প্রতিই সহিংসতা হয়। তাই এ বৈষম্য দূর করতে পারলে নারীর প্রতি সহিংসতাও দূর হবে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সারা দেশে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য এবং অধিকার নিয়ে কাজ করে। আমরা শূন্য থেকে ১৮ বছরের কন্যাশিশু ও যুব নারীদের নিয়ে সরাসরি কাজ করি। বৈষম্য পরিবার থেকেই শুরু হয়। তাই আমাদের কাজগুলোও পরিবার থেকেই শুরু হয়।

তাহেরা জাবিন

সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার, ব্রিটিশ হাইকমিশন ঢাকা

যুক্তরাজ্য নারীর সম–অধিকার নিশ্চিত করতে সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সরকারগুলোর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক উন্নয়নসংক্রান্ত কার্যকলাপে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথমত, নারীর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা।

বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজন নারীর একজন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এটি একধরনের পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘন। এতে শুধু নারীই নন, নারীর পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৮৫ শতাংশ নারী অনলাইনে সহিংসতার শিকার। জলবায়ু পরিবর্তন এটিকে আরও ত্বরান্বিত করছে। প্রতি এক ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধি ৭ শতাংশ শারীরিক সহিংসতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোগ থাকার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

সায়কা সিরাজ

কান্ট্রি ডিরেক্টর, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল

আমরা পুষ্টি নিয়ে কাজ করি। পুষ্টির সঙ্গে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার যোগসূত্র আছে। এখানে যোগসূত্র খুঁজে সহিংসতা নিরসনে কাজ করার চেষ্টা করছি। এখন খুব স্পষ্টভাবেই পুরুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এ কারণে পূর্বের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের কার্যপরিকল্পনার মধ্যে পুরুষকে তার ভূমিকার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। কারণ, এর সঙ্গে কেবল নারীর বা শিশুর স্বাস্থ্য নয়; বরং শিশুর ভবিষ্যৎও যুক্ত থাকে।

পরিবারে মায়ের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, শিশু বড়দের আচরণে প্রভাবিত হয়। মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হলে কন্যাশিশু এটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে গড়ে উঠবে। আর ছেলেশিশু নারীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে খারাপ আচরণ করাকেই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেবে। আমরা এই জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি।

মাহমুদুর রহমান খান

টেকনিক্যাল কো–অর্ডিনেটর, অপরাজিতা প্রকল্প, কেয়ার বাংলাদেশ

শিশু যা শেখে, তা-ই ভবিষ্যতে তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। এ কারণে যেসব প্রথা নারীর সহিংসতার জন্য দায়ী, সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি এগুলোকে ছুড়ে ফেলতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা নারীর ক্ষমতায়ন–সংক্রান্ত প্রশ্নে আমরা কেবল নারী নিয়েই চিন্তা করি। কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের নামমাত্র অন্তর্ভুক্তি দেখা যায়। এভাবে কাজ করলে চলবে না। পুরুষকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন নারী সাইবার পরিসরে নিপীড়নের শিকার হন। আমাদের মোট জনশক্তির ৪০ শতাংশ নারী। এঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশই মনে করেন, কর্মস্থলে নিপীড়নের শিকার হওয়া স্বাভাবিক। এগুলো খুবই ভয়ংকর ব্যাপার।

শবনম মোস্তারী

ডিজিটাল হেলথ প্রধান, এসপায়ার টু ইনোভেশন (এটুআই), তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ

বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী সাইবার আক্রমণের হার ১ দশনিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের একটি জরিপ বলছে, বাংলাদেশে সাইবার আক্রমণের ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। বিগত কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে নারী ও পুরুষ উভয়েই বিভিন্ন ধরনের সেবা নিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে নারীরা যদি আক্রমণের শিকার হন, তাহলে সার্বিকভাবে এগোনো সম্ভব হবে না। কারণ, মূল ভোক্তার ৫০ শতাংশই নারী।

নারীকে সাইবার আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে সম্মিলিত পদক্ষেপ জরুরি। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে কাজ করছে। সবার কাছেই আলাদা তথ্য রয়েছে। আমাদের প্রয়োজন তথ্যগত সমন্বয় এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ। সব অংশীজনের মধ্যে তথ্য ও সেবাগত সংযুক্ততা নিশ্চিত করা জরুরি।

নিশাত সুলতানা

ডিরেক্টর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ১৯৩৭ সালে যাত্রা শুরু করেছিল। স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনটি জন্ম নেয়। সংগঠনটি ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের কন্যাশিশু এবং যুব নারীদের শিক্ষা ও যৌন প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ২০২১ সালে ‘ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ নারী ডিজিটাল মাধ্যমগুলোতে আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হন। ৯ দশমিক ৪ শতাংশ নারী আপত্তিকর বার্তা পান। মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন ৭৮ দশনিক ৩ শতাংশ নারী।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল নারীর সমতা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে পুরুষের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। আমরা বিভিন্ন কার্যক্রমে পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত করছি। তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক পরিবর্তনে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় করা। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের সম্পৃক্তকরণ অত্যন্ত জরুরি।

শাশ্বতী বিপ্লব

অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর, ব্র্যাক

ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেন্ডার সমতা অর্জনে আমাদেরও ৩০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো আরও বেশি সময় লাগবে। গণপরিবহন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে। অর্থাৎ যেখানে কর্মজীবী নারীর পদচারণ আছে, সেখানেই সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনেক প্রতিষ্ঠান নারীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করছে। কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পরিসরে সুরক্ষিত থাকা যায়, সে ব্যাপারে নারীদের সচেতন করার চেষ্টা করছে। তবে এর বাইরেও অনেককিছু করার আছে। সেগুলোতে হয়তো আমাদের মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আমি অনেক ইসলামিক স্কলারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা প্রচলিত নারীবিদ্বেষী ওয়াজগুলোর ঘোরবিরোধী৷

নীলিমা ইয়াসমীন

ডেপুটি ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ

আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মেয়েদের, যুব নারীদের ক্ষমতায়ন করা। যেন তাঁরা তাঁদের অধিকারের জন্য সরব হতে পারেন এবং সহিংসতার ভয় থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধাবিপত্তি আছে। এখানে কেবল নারী একা যুক্ত নন; সঙ্গে পরিবারসহ অনেক অংশীজন আছেন। সে ক্ষেত্রে নারীর পথচলা সহজ করতে আমরা কাজ করি।

শিশুর লালনপালনে জেন্ডার সংবেদনশীল–পদ্ধতি নিয়ে কাজ করি। এ জন্য আমরা ‘ফাদারস ক্লাব এবং গ্র্যান্ডফাদারস ক্যাফে’ চালু করেছি। শিশুদের জন্য মানসম্মত ও জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে শিক্ষা নিশ্চিত করতে অভিভাবক, শিক্ষক ও কমিউনিটি নেতাদের সম্পৃক্ত করি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মেয়েদের নিরাপত্তা এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করি। আমাদের লক্ষ্য—সামাজিক নীতিগুলো পরিবর্তন করা এবং একটি ন্যায্য ও জেন্ডার সমতাপূর্ণ সমাজ তৈরি করা।

ইভা আকতার

শিক্ষার্থী, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ

যৌন হয়রানি ও বাল্যবিবাহের মতো জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা কমাতে বয়োজ্যেষ্ঠ, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা রয়েছে। পরিবারের বাইরে আমরা স্কুল–কলেজের বন্ধু ও শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় শিখি। তাই বাল্যবিবাহের ফলে নারীদের কী সমস্যা হতে পারে, তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জানাতে হবে। বাল্যবিবাহের ঝুঁকি সম্পর্কে শিক্ষকেরা অভিভাবকদের জানাতে পারেন।

ডালিয়া আকতার

শিক্ষার্থী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ

পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ সমতা ও পারস্পরিক সম্মানের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে পারিবারিক সহিংসতা কমিয়ে আনা যাবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষদের উৎসাহিত করতে হবে। নারীদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে ক্ষমতায়ন করলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে।

মীম আকতার

শিক্ষার্থী, সিটি করপোরেশন আদর্শ বিদ্যালয়

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রথমেই নারী কে, তা পুরুষদের জানাতে হবে। নারী হচ্ছে মায়ের জাত। পুরুষ যদি জানেন নারী তাঁর মা বা বোন, তাহলে নারীর ক্ষতি করার পরিবর্তে তিনি নারীর সুরক্ষার কথাই ভাববেন।

বিভিন্ন পরিবারে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে। এসব থামাতে পরিবারগুলোকে বোঝাতে হবে যে নারীরা চাইলে সবকিছুই করতে পারে।

সুপারিশ

  • জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধে পুরুষদের কার্যকর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা জরুরি।

  • নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সমাজে নারীদের অবস্থানকে সমুন্নত করতে হবে।

  • জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

  • ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

  • জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে কর্মক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক, স্কুল–কলেজের শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা ও কমিউনিটি পর্যায়ে পুরুষদের যুক্ত করে বৈষম্য ও সহিংসতাবিরোধী প্রচারণা চালানো প্রয়োজন

এ ছাড়া গণমাধ্যম প্রতিনিধি হিসেবে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন সোহরাব হাসান, যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো। মাহফুজ মিশু, সাংবাদিক, যমুনা টেলিভিশন।

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো