গণমাধ্যম ও যুব নীতিমালা: জেন্ডার লেন্স পরিপ্রেক্ষিত
ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহযোগিতায় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট পরিচালিত ‘সমতায় তারুণ্য’ প্রকল্প এবং প্রথম আলো ‘গণমাধ্যম ও যুব নীতিমালা: জেন্ডার লেন্স পরিপ্রক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুন ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।
আলোচনা
নিশাত সুলতানা
ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস),প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল একটি আন্তর্জাতিক মানবিক ও উন্নয়ন সংস্থা, যা বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে কাজ করছে। সংস্থাটি বাংলাদেশে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শিশু, বিশেষত কন্যাশিশু, কিশোরী ও যুব নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁদের জন্য শিক্ষা, প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং তাঁদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের বিকাশে কাজ করছে। আমাদের এই প্রচেষ্টার পেছনে মূলত নারী ও পুরুষের মধ্যকার দৃশ্যমান দূরত্বকে কমিয়ে আনা এবং তাঁদের জন্য একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী নির্মাণ করা লক্ষ্য। প্রথাগত নেতিবাচক জেন্ডার ধারণা সমতা ও ন্যায়ের সমাজ তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা, যে কারণে বেড়ে চলেছে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা।
প্ল্যান সব সময়ই আস্থা রাখে তরুণদের যোগ্যতা আর নেতৃত্বের প্রতি। তাই তাঁদের সঙ্গে নিয়েই প্রথাগত নেতিবাচক জেন্ডার ধারণার পরিবর্তনে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘সমতায় তারুণ্য’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পটির বাস্তবায়নে প্ল্যানের পাশাপাশি কাজ করছে জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট। প্রকল্পটি নারী ও পুরুষের সম–অধিকারের যাত্রাকে এগিয়ে নিতে যুব সংগঠনগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। এ ছাড়া প্রকল্পটি বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সংবাদকর্মী, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের নিয়ে কাজ করছে, যেন তাঁদের কাজের মাধ্যমে ইতিবাচক জেন্ডার ধারণার প্রসার ঘটতে পারে। শুধু তা–ই নয়, সমাজে জেন্ডার–বিষয়ক ক্ষতিকর চর্চার প্রতিরোধে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছে প্রকল্পটি। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জেন্ডার লেন্সে বেশ কিছু যুব ও গণমাধ্যমবিষয়ক নীতিমালা পর্যালোচনা করা হয়েছে।
আমরা আশা করছি, আমাদের গবেষণায় উঠে আসা পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট নীতিমালা সংস্কারের ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে এবং গণমাধ্যমকে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, যেকোনো নীতি কিংবা আইন রচনার শুরু থেকেই জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ, একবার কোনো নীতি কিংবা আইন চূড়ান্ত হয়ে গেলে পরবর্তী সময় তা সংশোধন করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
গাজী মো. সাইফুজ্জামান
মহাপরিচালক (গ্রেড ১), যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
২০১৭ সালের যুব নীতিতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত বয়সের মানুষকে যুবক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে যুব বলা হয়, নারীদের ক্ষেত্রে যুব নারী বলা হয়। এ নীতিমালায় অনেকগুলো বিষয় সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যুব নীতিমালায় যুবদের মানুষ হিসেবে দেখা হয়েছে। এখানে লিঙ্গভেদে সব মানুষের সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, বেকার যুবক, যুব নারী ও যুব উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার বিশেষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে যুব নারীদের মূল্যায়ন করা হবে।
এ ছাড়া ৮.১.১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নারী ও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অনুজের প্রতি স্নেহশীল এবং শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গনির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি সংবেদনশীল মানুষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের স্নেহপূর্ণ ও সংবেদনশীল আচরণ নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে উদ্বুদ্ধ করা। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য এবং অধিকার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে। এমনকি হিজড়া ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যুবদের জন্য ক্রীড়ার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো যুব নীতিতে এসেছে।
গণমাধ্যমের কথা যুব নীতিতে সেভাবে উল্লেখ নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, গণমাধ্যমে যুবরা কীভাবে উপস্থাপিত হবেন, এ বিষয়টি যুব নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অনেকে প্রাপ্তির সঙ্গে প্রত্যাশার সংগতি করতে পারেন না। ফলে নানা রকম ঘটনা ঘটে যায়। আমরা যখন বিবেকবান মানুষ হিসেবে এসব ঘটনা গণমাধ্যমে তুলে ধরব, তখন যেন নারীকে হেয় না করা হয়, মানুষের মানবিক মর্যাদা ক্ষুন্ন না হয়—এ প্রসঙ্গগুলো আমরা এখানে আনতে পারি।
মাশফিকা জামান সাটিয়ার
সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার, জেন্ডার অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি, নেদারল্যান্ডস দূতাবাস ঢাকা
বাংলাদেশে নীতিমালা প্রণয়নের সময় আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে স্থানীয় প্রেক্ষাপটের সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বে স্বীকৃত আইন ও নীতিমালা থাকলেও, সেগুলো বিশ্লেষণ করে স্থানীয় বাস্তবতায় মানিয়ে নেওয়া দরকার। এতে নীতিমালাগুলো আরও কার্যকর হয়।
মিডিয়া, বিশেষ করে ভিজ্যুয়াল ও সোশ্যাল মিডিয়া ইদানীং তরুণদের শিক্ষার বড় উৎস হয়ে উঠছে, যা ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা অনেকেই সমতা ও ন্যায়বিচারের কথা বলি, কিন্তু এর গভীরতা শৈশব থেকেই শেখানো জরুরি। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র—সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেক সময় পূর্বনির্ধারিত ধারণা প্রাধান্য পায়, ফলে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা গুরুত্ব পায় না। অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতাই সঠিক দিক নির্দেশ করতে পারে।
নেদারল্যান্ডসে ‘ইয়ুথ অ্যাট হার্ট’ নামে একটি কৌশল রয়েছে, যেখানে যুব উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে যেকোনো নীতিমালা প্রণয়নে তরুণদের মতামত নেওয়া হয়। এটি শুধু যুব-সম্পর্কিত বিষয়ে নয়, সব ধরনের নীতিমালায় প্রযোজ্য। তারা শুধু নেদারল্যান্ডসের তরুণদের নয়, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণদের সঙ্গে পরামর্শ করে। বাংলাদেশ এ অভিজ্ঞতা সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
আমাদের অনুরোধ থাকবে, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, জাগো ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট অংশীদারেরা যেন এ প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বাস্তবায়ন হয়তো এ প্রকল্পে সম্ভব না, তবে আমরা চাই অন্য প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে এ উদ্যোগ এগিয়ে যাক।
মাহিন চৌধুরী
ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
আজকের আলোচনা এখানেই শেষ নয়, বরং এখান থেকেই নতুন ভাবনার জন্ম, নতুন কর্মযাত্রার সূচনা। অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা, মতামত ও বাস্তবতার সরাসরি প্রতিফলন থেকে আমরা আরও একবার উপলব্ধি করলাম, জেন্ডার বৈষম্য, সামাজিক বাধা ও প্রাতিষ্ঠানিক গঠনগত সীমাবদ্ধতা এখনো আমাদের সমাজে গেড়ে বসে আছে। পরিস্থিতি কঠিন ও হতাশাজনক হলেও আজকের আলোচনায় উঠে আসা তরুণদের সরব অংশগ্রহণ, বিশেষজ্ঞদের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা এবং নীতিনির্ধারকদের আন্তরিক অবস্থান আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে।
আমরা এমন এক জটিল চক্রে আটকে আছি, যেখানে শুধু জেন্ডার নয়, সামগ্রিক সংবেদনশীলতার ঘাটতি আমাদের এগিয়ে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এ চক্র ভাঙতে হলে ব্যক্তি, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান—তিনটি স্তরেই মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির একটি মৌলিক রূপান্তর জরুরি। বিশেষ করে গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত, সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টাই এ রূপান্তরের চালিকাশক্তি হতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করলে এ বাধার চক্র অতিক্রম করা সম্ভব। আজকের আলোচনায় যে ধারণা, প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতিগুলোর জন্ম হয়েছে, সেগুলো বাস্তবে রূপ দিতে হলে আমাদের প্রত্যেককে দায়িত্ব নিতে হবে।
পরিবর্তন সম্ভব, শুধু প্রয়োজন সম্মিলিত অঙ্গীকার, নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্তরিক সহযোগিতা। গণমাধ্যম ও যুব নীতিমালাবিষয়ক আজকের এ আলোচনায় প্রাপ্ত প্রস্তাব ও ভাবনাগুলো বাস্তবায়নে আমরা সবাই যদি দায়িত্বশীল হই, তবে একসঙ্গে গড়ে তুলতে পারব একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মর্যাদাপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ
মূল প্রবন্ধ
মোখলেসুর রহমান
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি)
আলোচ্য গবেষণায় আমরা যে ছয়টি নীতি নিয়ে গবেষণা করেছি, তা হলো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি–২০১১, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন–২০০০, জাতীয় যুবনীতি–২০১৭, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা–২০১৪, সাইবার নিরাপত্তা আইন–২০২৩, ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বিটিআরসি বিধিমালা–২০২১।
এসব আইন ও নীতিমালায় জেন্ডার সমতা, তারুণ্যের অংশগ্রহণ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা কীভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সারা দেশে ৮টি বিভাগে যুব ও মিডিয়া পেশাজীবীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনদের সঙ্গে ৩৪টি অংশগ্রহণমূলক পরামর্শমূলক আলোচনা করা হয়েছে।
গবেষণার আলোকে পর্যবেক্ষণের সারাংশ এখানে তুলে ধরা হলো। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি–২০১১ অগ্রগামী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নীতি হলেও গণমাধ্যমে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। নীতিটি নারীদের নির্দিষ্ট জেন্ডারভিত্তিক ভূমিকায় সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও জেন্ডারভিত্তিক ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে জেন্ডার-নিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে কমিউনিটিভিত্তিক কার্যকর হস্তক্ষেপের অভাব রয়েছে। এ নীতিতে অবৈতনিক যত্নমূলক কাজ এবং অনানুষ্ঠানিক ডিজিটাল পরিসরে নারীদের ভূমিকা উপেক্ষিত রয়েছে। জেন্ডার সমতা প্রচারে বা ‘ক্ষতিকর পৌরুষ’ চ্যালেঞ্জ করতে পুরুষ ও কিশোরদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন–২০০০ মূলত শারীরিক ও যৌন সহিংসতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে; কিন্তু মানসিক, ডিজিটাল ও অর্থনৈতিক সহিংসতার রূপগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। সাইবার হয়রানি, ছবি বা ভিডিওভিত্তিক নির্যাতন ও অনলাইন শোষণের বিষয়গুলো এই আইনে অন্তর্ভুক্ত নয়। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই আইনের বাস্তবায়ন দুর্বল।
জাতীয় যুব নীতি–২০১৭ যুব ক্ষমতায়নের পক্ষে কথা বলে ঠিকই; কিন্তু জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো এখানে উপেক্ষিত রয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ১২ শতাংশ যুব নেতৃত্বাধীন সংগঠনের (YLOs) নিজস্ব জেন্ডারভিত্তিক নীতি রয়েছে। নীতিতে আন্তসংযোগমূলক (Intersectionality) দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক যুবকদের বাস্তবতা এতে উপেক্ষিত। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সীমিত।
জাতীয় সম্প্রচার নীতি–২০১৪: নীতিতে জেন্ডার-সমতা নিশ্চিত করার কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা বা প্রয়োগযোগ্য নির্দেশনা নেই। নারীবিরোধী স্টেরিওটাইপ বা পক্ষপাতদুষ্ট উপস্থাপনা পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। নতুন মিডিয়া (যেমন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতি) এই নীতির আওতার বাইরে রয়ে গেছে।
সাইবার সিকিউরিটি আইন–২০২৩: এই আইন ঘৃণামূলক বক্তব্য রোধে দৃঢ় অবস্থান নেয়, কিন্তু অনলাইনে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। ডিজিটাল পরিসরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য ও অতিরিক্ত ঝুঁকির বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। দ্রুত বিচার বা অভিযোগ জানানোর সহজ ও কার্যকর কোনো পদ্ধতি নেই।
বিটিআরসি প্রবিধান (ডিজিটাল, সামাজিক মাধ্যম ও ওটিটি)–২০২১ অশ্লীলতার ওপর নজর দিয়েছে; কিন্তু নারীবিদ্বেষ, অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত অথবা জেন্ডারভিত্তিক ঘৃণার বিষয়গুলো এখানে উপেক্ষিত থেকে গেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে জেন্ডারভিত্তিক কনটেন্ট মডারেশনের পরিসংখ্যান প্রকাশে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যবহারকারীদের জন্য বাংলা ভাষায় বা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে উপযোগী রিপোর্টিং টুলের অভাব রয়েছে।
উপরিউক্ত নীতিমালাগুলো পর্যবেক্ষণের আলোকে কিছু সুপারিশ পাশের সারিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাহেরুল হক চৌহান
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ
অনেকেই মনে করেন, সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক আইন পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি এটা রাখা প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে সাইবার জগতে সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। কীভাবে এ আইন জনগণের সেবায় সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, নীতিনির্ধারকদের সেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বিগত সময়ে যখন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানে পুলিশের লোকদের দীর্ঘদিন ধরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। আইনের বাস্তবায়ন তো পুলিশ করবে। তার বাস্তবিক কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সুবিধা-অসুবিধাগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
কাজ করার ক্ষেত্রে বাস্তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক সময় কিছু অভিযোগকারী তথ্য বাড়িয়ে বলেন, যা তদন্তে ভিন্ন চিত্র তুলে আনতে পারে। নারীদের অভিযোগের ক্ষেত্রে এটি আরও সংবেদনশীল বিষয়। এ ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।
অনেকেই জিডি করতে গিয়ে নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হন। এ সমস্যা সমাধানে আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে জিডি এবং এফআইআরকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার কাজ চলছে। জিডিকে অনলাইনে নিয়ে আসার কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন এফআইআর বা মামলাকেও কীভাবে অনলাইনে নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়েও কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যায় খুব কম সময়ের মধ্যেই দারুণ একটা সেবা সামনে নিয়ে আসতে পারবে
ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যেসব নারী অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করছেন, সামনে আনছেন, যাঁরা ক্ষমতাবান ও সমাজে ভালো অবস্থান আছেন, তাঁরাই হেনস্তার, বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
আমি মনে করি, পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামো থেকে গণমাধ্যমকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমের একটি ভূমিকা থাকা উচিত, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, গণমাধ্যমের উচিত হবে একটি সংবেদনশীল ন্যারেটিভ তৈরি করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমরা দেখেছি, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক চলচ্চিত্রকে পুরস্কৃত হতে।
আমাদের দেশে নারীকেন্দ্রিক মুভি কয়টা হয়? একটার কথা আমরা মনে করতে পারি—রেহানা মারিয়াম নূর। যদিও এটি মূলধারার চলচ্চিত্র নয়। এটি ছাড়া গত পাঁচ বছরে নারীপ্রধান চরিত্রের একটি মুভির নাম বলুন তো? কেউ পারবেন না। পারলেন না—এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। নারীপ্রধান মূলধারার একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়নি।
আমাদের দেশে এবং পার্শ্ববর্তী দেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আমরা যেসব মুভি দেখি, সেখানে হরহামেশা নারীর প্রতি সহিংসতা ও অমর্যাদা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বাইরের দেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার কিছু বিষয় মেনে চলে। যেমন নেটফ্লিক্সে কখনোই ‘পুরুষ কর্তৃক নারীকে আঘাত’ করার দৃশ্য দেখতে পাবেন না। বাংলাদেশের ওটিটির জন্য প্রণীত নীতিমালায় এই বিধান যুক্ত করা দরকার।
নাসরিন আক্তার
সহকারী অধ্যাপক, মিডিয়া অ্যান্ড ম্যাস কমিউনিকেশন,
আমিরেকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নতির ফলে নানা নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ডিপ ফেক প্রযুক্তির কথা বলা যায়। অথচ আমাদের সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক আইনে এ–সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। আইনগুলোতে যদি এই ধরনের প্রযুক্তিগত অপরাধ স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত, তাহলে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ ও মামলার নিষ্পত্তি আরও সহজ হতো। আমাদের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে ঘরের কাজকে নারীর অবৈতনিক গৃহশ্রম হিসেবে অর্থনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন আমাদের করণীয় হলো, এই ধরনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা। এতে করে নীতিনির্ধারকেরা বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা ও প্রয়োগ করতে পারবেন।
গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্টের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত মোট সংবাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ নারীবিষয়ক। এর মধ্যেও বেশির ভাগ সময় নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেই সংবাদ প্রকাশ পায়। একদিকে সংবাদপত্রগুলো নারী উন্নয়নের কথা বলছে, অপর দিকে তারা এমন ফিচার সংবাদ ছাপছে, যেখানে বলা হয় ‘নারী কীভাবে ঘর সাজাবেন’। অথচ ঘর সাজানো কেবল নারীর একার দায়িত্ব নয়, এটি পুরুষেরও সমান অংশগ্রহণের বিষয়। এই ধরনের বার্তা ও প্রচার তরুণদের মনে নারীর ভূমিকা নিয়ে একটি একপক্ষীয় ও নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইন সংবাদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক শিরোনাম করা হলে মানুষ তা বেশি পাঠ করে। অর্থাৎ আমাদের রুচির একটা খরা চলছে। আমাদের রুচি পরিবর্তন করতে হবে।
সাধারণত নারী–পুরুষের সম্পর্ক মোটাদাগে চার ধরনের হয়—বাবা, ভাই, স্বামী ও সন্তানকেন্দ্রিক সম্পর্ক। নারীরা একেকজনের কাছে একেক ধরনের বঞ্চনা কিংবা উদাসীনতার শিকার হন। সহিংসতা, অন্যায়, অবিচারের শিকার হন।
সমাজ পরিবর্তনে যুবসমাজের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সময়োপযোগী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অধিকারভিত্তিক যুব নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। অন্যদিকে ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকে নারীর অধিকার, স্বাস্থ্য ও প্রজননসংক্রান্ত বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে—এগুলোর প্রচারে ইমামদের আরও ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। এগুলো করতে ইমামদের উদ্বুদ্ধ করা গেলে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আমরা যার জন্য কাজ করছি, তার পক্ষ হয়ে কথা বলতে হবে, তাকে যেন আমরা প্রতিপক্ষ না বানাই। সমাজে টেকসই ও অর্থবহ পরিবর্তন আনতে হলে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে বাস্তবভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক কর্মপন্থা নিতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল আমরা একটি অধিক ন্যায্য ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
হুমায়রা আজিজ
জেন্ডার প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, ইউনিসেফ বাংলাদেশ
আমাদের যুব নীতিতে অনেক সুপারিশের কথা বলা হয়েছে। যুব নীতিরও যে জেন্ডার সমতার লক্ষ্যে কাজ করা উচিত, তার একটি স্পষ্ট স্বীকৃতি থাকা উচিত। পাশাপাশি এটি অধিকারভিত্তিক হওয়া উচিত। যুবকদের মতামত বা অংশগ্রহণের যে অধিকার তা আরও সমুন্নত করার মাধ্যমে যুব নীতিকে কীভাবে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করা উচিত। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যুব নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুব নারীদের অংশগ্রহণ কম দেখা যায়। এর একটা কারণ হচ্ছে তার নিরাপত্তার বিষয়। আরেকটি কারণ হচ্ছে তার সুযোগ ও তথ্যের অভাব। সুতরাং যুব নারীদের ক্ষমতায়িত করার যে প্রতিশ্রুতি তা যুব নীতিতে আসতে হবে। গণমাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে চিত্রায়ণ ও বিজ্ঞাপনে যে স্টেরিওটাইপিং হয়, তা দেখার জন্য গণমাধ্যমগুলোরও কিছু দায়িত্ব থাকা উচিত। বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতার পরিবর্তনের গণমাধ্যমও বড় ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোকেও সচেতন হতে হবে। এ জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গণমাধ্যমে নারী ও যুব নারীদের নেতৃত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন
মাহফুজ মিশু
সিনিয়র সাংবাদিক, যমুনা টেলিভিশন
গণমাধ্যম শব্দ থেকেই বোঝা যায়, এটি কোনো ধরনের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে সব মানুষের জন্য হওয়া উচিত; কিন্তু আমাদের গণমাধ্যম কতটা গণমানুষের হয়েছে, তা নিয়ে কথা হতেই পারে। গণমাধ্যম উপস্থাপনের কারণেই আমরা ধর্ষককে চেনার পরিবর্তে ধর্ষণের শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের চিনি। গণমাধ্যমকর্মীদের আদর্শিকভাবে শেখানো হয়, ধর্ষণের শিকার যিনি, তাঁর পরিচয় নানান কারণে গোপন রাখতে হবে; কিন্তু আমরা বাস্তবে সবক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হতে দেখি না। শিশু ও নারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
স্কুল থেকেই ডিজিটাল সাক্ষরতার মৌলিক ও কাঠামোগত বিষয়গুলো শেখাতে হবে। আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা জনপরিসরের অনেক দৃশ্য সম্মতি না নিয়েই ধারণ ও প্রচার করি, যা অনুচিত। এ জায়গায় সহসম্পাদক বা বার্তা সম্পাদকের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।
রেদওয়ান রনি
চলচ্চিত্রকার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, চরকি
বিটিআরসির নীতিমালায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উল্লেখ থাকলেও সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়নি। ওপেন মিডিয়া (যেমন ইউটিউব, ফেসবুক) ও পেইড মিডিয়া (ওটিটি) ভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলে, তাই আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন।
স্কুল থেকেই সচেতনতা গড়ে তুলে এই শক্তিশালী মাধ্যমগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার শেখানো জরুরি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিচ বাড়াতে নারীদের হেয় করে কনটেন্ট ছড়ানো হয়, যা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
আমরা ওটিটি কনটেন্টে নান্দনিকতা বজায় রেখে কাজ করতে চেষ্টা করি। বেশ কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি রয়েছে, কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এ জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা তৈরি করা জরুরি।
আমরা চাই, নারীর ক্ষমতায়ন হোক টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব। এই প্রকল্পের গবেষণার ফল এবং কাজের অভিজ্ঞতা ও সুপারিশগুলো নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
হাওয়া মুস্তাগফিরা
সিনিয়র ম্যানেজার, জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট
যেকোনো নীতি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, যার সফল বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের প্রতি সহিংসতা বা তাঁদের বিদ্রূপ করে প্রচার হয়, ঘৃণা ছড়ানো হয়। এ প্রবণতা দূর করতে শুধু নারীরা বললেই হবে না, পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। জেন্ডার রোল নারীর মতো পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই সমতার জন্য উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
নারী উন্নয়ন নীতিমালায় গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপনের মানদণ্ড প্রণয়নের সুপারিশ আছে, যা উদাহরণসহ প্রয়োগ করলে কার্যকর হবে। দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তাই নীতিমালা পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। শুধু নীতি নয়, বাস্তবায়ন ও সংশোধন জরুরি। যুব নীতি ও সম্প্রচার নীতিমালা আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। সাইবারনিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হবে
মো. শাওন
ওয়াইএপি সদস্য, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
বর্তমানে তরুণদের পরিচালিত অনেক তৃণমূল সংগঠনে জেন্ডার সংবেদনশীল নীতি থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। এ সংগঠনগুলোর মধ্যে পরিবেশবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ, আমাদের সমাজে রয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও জেন্ডার বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষ করে প্রান্তিক ও জেন্ডার বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জন্য।
শুধু নীতি প্রণয়ন নয়, এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। এ জন্য নিয়মিত জেন্ডার সংবেদনশীলতা–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নারী অধিকারকে শুধু নারীর বিষয় না ভেবে পুরুষদেরও এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। যুবদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই পরিবর্তন সম্ভব নয়। তরুণ নেতৃত্ব ও সংগঠনের মধ্যে এ ধারা গড়ে তোলা জরুরি।
ফারিয়া জাহান
লিড অব প্রোডাকশন, ভৈরবী
আমি ‘ভৈরবী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে কাজ করি যেটি নাচ, গান, অভিনয়ের মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করে।
ইদানীং ফেসবুকে নারীদের ছবি বা ভিডিওতে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে, যা সমাজের একটি অশুভ দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রবণতা দূর করতে নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতীয় সম্প্রচার নীতিতে সংবাদ এবং নাট্য অনুষ্ঠানগুলোর জন্য জেন্ডার প্রতিনিধিত্ব পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা আছে। নারীদের প্রাধান্য দিয়ে যে কনটেন্টগুলো নির্মিত হয়, সেখানে যদি প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে এ ধরনের কনটেন্ট তৈরিতে নতুনেরা আরও উৎসাহিত হবে। গণমাধ্যম নীতিমালায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ ও জেন্ডার স্টেরিওটাইপ দূর করার উদ্যোগ প্রয়োজন। যুব, গণমাধ্যম, লিঙ্গ সমতা ও সংস্কৃতি—এই চারটি খাত একসঙ্গে কাজ করলে সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
সুপারিশ
যুব নীতিমালাকে সময়োপযোগী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অধিকারভিত্তিক করা জরুরি।
যুবনেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলোকে জেন্ডারসংবেদনশীল নীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিতে হবে।
গণমাধ্যমবিষয়ক নীতিমালাগুলোকে জেন্ডার সংবেদনশীল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ধর্ষণের শিকার নারীর ছবি বা পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জেন্ডার সংবেদনশীল কনটেন্ট নির্মাণ, প্রচার ও প্রকাশবিষয়ক নীতিমালা থাকা উচিত।
যুব ও গণমাধ্যমবিষয়ক নীতিমালায় জেন্ডার সমতা (SDG-5) বিষয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা, কৌশল ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যেকোনো নীতিমালা প্রণয়ন ও সংস্কারে স্থানীয়, তৃণমূল ও জাতীয় পর্যায়ের যুব, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুব নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুব ও যুব নারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা, অনলাইনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ভুয়া সংবাদ চিহ্নিতকরণে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ পুরুষেরাও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হন, তা স্বীকৃতি দিতে হবে।
গণমাধ্যমে নারীর সাফল্যের গল্পগুলো তুলে ধরা উচিত, কেবল ভুক্তভোগী বা অপরাধী হিসেবে নয়।
এ ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশগ্রহণ করেন: নীলিমা ইয়াসমিন, ডেপুটি ডিরেক্টর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। জারফিশা আলম, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন ম্যানেজার, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ । হুসেইন শাকির, কনসোর্টিয়াম অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার, সমতায় তারুণ্য প্রকল্প, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। রতন মালো, মিডিয়া স্পেশালিস্ট, সমতায় তারুণ্য প্রকল্প, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। সোহরাব হাসান, যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো। সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো