টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ: চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও আগামীর কর্মপন্থা

প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ: চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও আগামীর কর্মপন্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২ ডিসেম্বর ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।

‘টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ: চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও আগামীর কর্মপন্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরাছবি: প্রথম আলো

অংশগ্রহণকারী

এরাদুল হক

সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা

কাজী গোলাম নাসির

সাবেক প্রধান স্থপতি, স্থাপত্য বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

ইকবাল হাবিব

সহসভাপতি, সেফটি অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন 

আবু সাঈদ আহমেদ

সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট 

লিয়াকত আলী ভূঁইয়া

জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, রিহ্যাব 

আব্দুল আওয়াল

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স 

মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ভলিউম জিরো লিমিটেড 

তৌফিক উৎপল

সাবেক পরিচালক, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর 

আব্দুল লতিফ

সহসভাপতি, রিহ্যাব 

জাহাঙ্গীর আলম খান

গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ 

গোপেন কুমার কুন্ডু

অধ্যাপক ও শিশু স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় 

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

এরাদুল হক

সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা

ঢাকা শুধু একটি শহর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অবকাঠামোগত চাপ, যানজট, জলাবদ্ধতা, দূষণ, আবাসনসংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির কারণে ঢাকার বাসযোগ্যতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের ২০২৪ ও ২০২৫ সালের বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকার অবস্থান নিচের দিকেই রয়েছে, যা আমাদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। এই সূচকে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো—এই পাঁচটি বিষয়ে মূল্যায়ন করা হয়। ফলে শুধু অবকাঠামো নয়, সব খাতকে সমন্বিতভাবে বিবেচনায় আনাই টেকসই নগরায়ণের মূল চ্যালেঞ্জ। এই বাস্তবতা থেকে সরকার সমন্বিত নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার নির্দেশনা দিয়েছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা নিজ নিজ দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করবে। রাজউক সেই পরিকল্পনা প্রণয়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

পরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রে রাজউক কিছু বাস্তব উদ্যোগ নিয়েছে। ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিট সিস্টেমের মাধ্যমে এখন অনলাইনে ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় স্থাপত্য নকশার পাশাপাশি স্ট্রাকচারাল, ইলেকট্রিক ও প্লাম্বিং ডিজাইন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি নকশা প্রণয়নকারী পেশাজীবীদের পরিচয় ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে জবাবদিহি করা যায়। অনিয়ম রোধে আইনি সংস্কার ও বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের প্রক্রিয়াও এগোচ্ছে।

পুরান ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্লক ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে রাস্তা প্রশস্ত করা, উন্মুক্ত স্থান সৃষ্টি এবং নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। একই সঙ্গে মেট্রোরেলকেন্দ্রিক টিওডি বাস্তবায়ন শহরের চাপ কমাতে সহায়ক হবে। ঢাকায় উন্মুক্ত স্থান, মাঠ ও জলাশয় রক্ষায় অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি। পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ও ছাদকৃষির মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। সব মিলিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা, জবাবদিহি ও সহযোগিতাই আগামীর টেকসই নগরের পথ দেখাতে পারে।

কাজী গোলাম নাসির

সাবেক প্রধান স্থপতি, স্থাপত্য বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণের সংজ্ঞা ও মানদণ্ড বদলে যায়। টেকনিক্যাল দিক থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট। ১৯৯৬ সালের বিএনবিসি অনুযায়ী যে ভবনগুলোর নকশা ও নির্মাণ করা হয়েছে, ২০২০ সালের কঠোরতর বিএনবিসির আলোকে সেগুলো আজ কতটা টেকসই—এই প্রশ্ন থেকেই যায়। অর্থাৎ টেকসইতার ব্যাপ্তিকাল ও মাত্রা বদলায়, আর সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ।

টেকসই নগরায়ণের পথে মূল বৈরিতা আসে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ঘাটতি থেকে। কোড না মানা, নিরাপদ নির্মাণ উপকরণের অভাব, আইন অনুসরণ না করা—সবকিছুর কেন্দ্রে আছে মানুষ। যদি আমরা সত্যিই টিকতে চাই, তাহলে মানুষের নিরাপদ জীবনযাপন, কাজের সুযোগ, সুষ্ঠু বসবাস, শিক্ষা ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা—এই সবকিছু মিলিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা দরকার। আমার কাছে পরিকল্পনা মানে শুধু নকশা নয়, বরং মানুষের জন্য ভালো কিছু গড়ার চিন্তা।

চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গেলে সুশাসনের ঘাটতিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভূমিকম্প ও অগ্নিদুর্যোগ মোকাবিলা, আইন প্রয়োগ, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন—সবখানেই দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতাই আইন অমান্যকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। যারা নিয়ম মানে, তাদের ওপর চাপ বাড়ছে; আর যারা মানে না, তারা সুবিধা পাচ্ছে। এখানেই টেকসই নগরায়ণের বড় সংকট।

আগামীর কর্মপন্থা ঠিক করতে গেলে আমাকে প্রথমে ভাবতে হয়—মানুষ কি দেশের জন্য সম্পদ, না বোঝা? সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০৩৫ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী ধারণক্ষমতা প্রায় তিন কোটি, অথচ এখনই জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ। কাগজে-কলমে মানুষ কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবে অসম্ভব। তাই মানুষকে লায়াবিলিটি ধরে পরিকল্পনা করলে ব্যর্থতা আসবেই। মানুষ যদি সম্পদ হয়, তাহলে বর্তমান ড্যাপ নতুন করে ভাবতে হবে—পুঁথিগত নয়, বাস্তব ও মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।

টেকসই নগর গড়তে হলে নগরের ঐতিহ্য ভালোবাসতে হবে, শিশু থেকে প্রতিবন্ধী—সব মানুষের কথা ভাবতে হবে, পরিবেশ ও সবুজ নিশ্চিত করতে হবে। এখান থেকেই টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণের পথ তৈরি হতে পারে।

ইকবাল হাবিব

সহসভাপতি, সেফটি অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন

টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ চাইলে তিন ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে—চ্যালেঞ্জ, সুযোগ ও আগামীর কর্মপন্থা। ঢাকার নগরায়ণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাগত শ্লথতা ও অবহেলা। ১৯১৭ সালে প্রথম পরিকল্পনার উদ্যোগ নেওয়ার পর বহু দশক ধরে আমরা কার্যকর পরিকল্পনা করিনি। স্বাধীনতার পর শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে, কিন্তু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সেই গতিতে এগোয়নি। ফলে বন্যাপ্রবণ এলাকা ও কৃষিজমি অরক্ষিত থেকে গেছে এবং ভূমি ব্যবসায়ের চাপে শহর ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। আমরা উঁচু–নিচু ভবন নিয়ে বিতর্কে সময় নষ্ট করেছি, কিন্তু নগরের মৌলিক নিরাপত্তা ও পরিবেশগত প্রশ্ন উপেক্ষিত থেকেছে।

এর ফল হিসেবে নগর অভিঘাত ও দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। নগরদর্শনের অভাবেই আমরা একটি অসুস্থ নগর গড়ে তুলছি—এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ।

সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ঢাকায় একতলা ও দোতলা ভবনের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি, যা নতুন করে গড়ার সুযোগ আছে। ঢাকার এখন নতুন করে প্রসারণ না করে, প্রয়োজন রিডেভেলপমেন্ট। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের নগরকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে কেন্দ্র করে ভাবতে হবে এবং ভয়ের বদলে আস্থা তৈরি করতে হবে।

টেকসই নগরায়ণের আগামীর কর্মপন্থা হতে হবে স্পষ্ট ও কার্যকর। নগরকে বিকেন্দ্রীকরণ না করে কেন্দ্রীভূত রেখে আমরা চাপ বাড়িয়েছি; অথচ যোগাযোগব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে বিচ্ছুরিত নগরায়ণের সুযোগ ছিল। একই সঙ্গে আইন প্রয়োগ, নগর নিরাপত্তা, অগ্নি ও ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। পরিকল্পনা মানে মানুষকে সরিয়ে দেওয়া নয়; মানুষকে নিয়ে নিরাপদ, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যেই আমাদের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে এবং বাস্তবমুখী কর্মপন্থায় এগোতে হবে—এখনই।

আবু সাঈদ আহমেদ

সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট

ঢাকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পেশাজীবীদের কার্যকর সম্পৃক্ততার অভাব। বাস্তবতা হলো ঢাকায় বিপুলসংখ্যক ভবন অবৈধ বা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ নকশা ও নির্মাণে প্রকৌশলী, স্থপতি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। একজন পেশাদার যখন নিজে ডিজাইন করা ভবনের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, তখনই নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। অথচ আমাদের ব্যবস্থায় পেশাজীবীদের কাজ করার সুযোগ, স্বাধীনতা ও স্বীকৃতি ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষ প্রকৌশলী ও স্থপতি বের হলেও তাঁরা বাস্তবে দায়িত্ব নিতে পারছেন না।

টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ হতে হবে একযোগে জনবান্ধব, পথচারীবান্ধব, শিশু ও নারীবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব, নিরাপদ এবং ঐতিহ্য–সংবেদনশীল। এই সবকিছু একসঙ্গে না হলে নগর কখনোই টেকসই হয় না। তাই আমার প্রথম প্রশ্ন—আমরা কি সত্যিই জনবান্ধব শহর তৈরি করছি, নাকি জনবান্ধবহীন নগরের দিকেই এগোচ্ছি? এখানে মূল সমস্যা আইন ও তার বাস্তবায়ন। যে আইনগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবে জনবান্ধব কি না—সেই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয়।

একধরনের একক ও সাধারণীকৃত পরিকল্পনা আমাদের নগরকে আরও সংকটে ফেলছে। পুরান ঢাকা, গুলশান বা অন্যান্য এলাকার বাস্তবতা এক নয়, অথচ ড্যাপে সব এলাকায় প্রায় একই নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘনত্ব কমানোই যেন একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে, কিন্তু পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সামাজিক বাস্তবতা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এতে বিশেষ করে নিরাপদ নগর গঠনের প্রশ্নে আমরা বড় ঝুঁকির মুখে পড়ছি।

যদি পেশাজীবীদের প্রকৃত দায়িত্ব ও জবাবদিহির সঙ্গে কাজ করতে দেওয়া হয়, তাহলে আলাদা করে কঠোর আইন নয়, স্বাভাবিকভাবেই সুশাসন আসতে পারে। নগরের বিভিন্ন স্তরে—ভূমি ব্যবহার, নগর নকশা ও ভবন নকশায়—যথাযথ পেশাজীবী সমন্বয় জরুরি।

লিয়াকত আলী ভূঁইয়া

জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, রিহ্যাব

ড্যাপ ছাড়া টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণের আলোচনা শুরুই করা যায় না। দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের পর ড্যাপ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এসেছে। বাস্তবতা হলো, ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর আবাসন খাত বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। সাম্প্রতিক আলোচনায় উঠে এসেছে—ড্যাপের কারণে এ পর্যন্ত এই খাতে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আবাসন খাত শুধু নিজেই নয়, এর সঙ্গে জড়িত অসংখ্য শিল্পের কারণে জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খাত স্থবির হয়ে পড়লে সামগ্রিক অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

ড্যাপ নিয়ে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবায়নের ঘাটতি। পরিকল্পনায় স্কুল, খেলার মাঠ, নৌপথসহ নানা অবকাঠামোর কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলোর খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে। বছরের পর বছর নৌরুট চালুর ঘোষণা শোনা গেলেও স্থায়ীভাবে তা চালু করা যায়নি। অথচ এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকার চাপ অনেকটাই কমত এবং টেকসই নগরায়ণের পথ সুগম হতো।

সুযোগের জায়গাটি হলো ঢাকা শহরের বাইরের বিকল্প নগর বা স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলা। বহুদিন ধরেই এ দাবি ওঠে—ঢাকার আশপাশে কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে পারলে মানুষ কম খরচে আবাসন পেত এবং রাজধানীর ওপর চাপ কমত। পার্শ্ববর্তী শহরে বসবাস করে মানুষ কর্মস্থলে যাতায়াত করবে—এমন মডেল বিশ্বের অনেক শহরেই সফল। কিন্তু আমরা সে পথে এখনো এগোতে পারিনি।

আগামীর কর্মপন্থা হিসেবে আমি মনে করি, ড্যাপ দ্রুত গেজেট করে বাস্তবায়নে যেতে হবে এবং আবাসন খাতকে অচল না করে পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। একই সঙ্গে রাজউকের ভূমিকা স্পষ্ট করা জরুরি—নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে তদারকি ও পরিকল্পনায় মনোযোগ দিতে হবে, সরাসরি ব্যবসায় জড়ানো কমাতে হবে।

আব্দুল আওয়াল

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স

ঢাকা শহর বসবাসে অনুপযোগী নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং এর মূল কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত না করা হলে সমাধানও সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিকল্পনার অভাব, শহরের স্থল ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং অবৈধ নির্মাণ এই সংকটকে তীব্র করেছে। ঢাকার ৯৫-৯৬ শতাংশ বিল্ডিং অনুমোদনবিহীন, যার কারণে নিরাপদ ও টেকসই নগরায়ণ কঠিন হয়েছে।

শিক্ষা ও পেশাদার ব্যবস্থার ঘাটতি সমস্যার একটি বড় অংশ। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও নগর–পরিকল্পনাবিদ যথাযথভাবে তৈরি হয় না, ফলে বিল্ডিং ডিজাইন ও বাস্তবায়নে ঘাটতি থাকে। বিএনবিসি আইন থাকলেও তা কার্যকর হয়নি, যা আইন এবং বাস্তবায়নের মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি করেছে। দূষিত, ভরাট ও সংকীর্ণ রাস্তা, অযোগ্য নির্মাণ এবং জলাবদ্ধতা শহরের ক্রমবর্ধমান অযোগ্যতার প্রতিফলন।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দুটি মূল কর্মপন্থা প্রয়োজন। প্রথমত, অবিলম্বে ড্যাপ বাস্তবায়ন ও শহরের পুরোনো এলাকা সংস্কারে মনোযোগ দিতে হবে। রাস্তা প্রশস্ত করা, খেলার মাঠ ও স্কুল তৈরি এবং বহুতল বিল্ডিংয়ে প্রফেশনাল তদারকি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলা—ঢাকার বাইরের অঞ্চলে পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলা, যাতে জনসংখ্যা চাপ কমে এবং আবাসনের খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

দ্বিতীয়ত, প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ও স্বচ্ছভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। রাজউক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণে স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে অবৈধ নির্মাণ বন্ধ হয়। আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকলে সমস্যা সমাধান অসম্ভব।

টেকসই নগরায়ণ অর্জন করতে হলে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় রেখে, প্রফেশনালদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে, অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্যাটেলাইট সিটি বিকল্প নিয়ে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আইন, নীতি ও বাস্তবায়নের সমন্বয় ঘটলেই ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান অযোগ্যতা কমানো সম্ভব হবে।

মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ভলিউম জিরো লিমিটেড

ঢাকার টেকসই এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ে তিনটি মূল চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট। প্রথমত, নগর-পরিকল্পনায় কোনো সুসংহত স্থানিক ভিশন নেই। ড্যাপ বা মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও স্থানীয় ও নগর স্কেলের স্পষ্ট নির্দেশনা, জোনিং নীতি বা কোহেরেন্ট ভিশন পুরোপুরি অনুপস্থিত। ফলে নগরায়ণ হয়ে ওঠে উদ্দেশ্যহীন, যেখানে শহরের অভিজ্ঞতা, মানসিক আর দৈনন্দিন স্বাচ্ছন্দ্য—সবকিছুই পেছনে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, নগরায়ণ এখনো সম্পূর্ণ কোয়ান্টিটি-ভিত্তিক। প্লট ও সেটব্যাকের সংখ্যা, বিল্ডিং উচ্চতা বা সংখ্যাগত রুলসের ওপর নির্ভরতা বেশি, কিন্তু কোয়ালিটেটিভ মানদণ্ড—যেমন মানুষের লিভেবিলিটি, খোলা জায়গা, প্রকৃতি ও শহরের সৌন্দর্য—সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ফলে টেকনিক্যালি নির্মিত ভবনগুলো গুণগতভাবে নগর পরিবেশে মিলছে না। পর্যবেক্ষণ করা হয় না যে ভবনের ভেন্টিলেশন, প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ, ছাদের ব্যবহার এবং মুক্ত স্থান সম্পূর্ণ সঠিক কি না।

তৃতীয়ত, এর ফলে শহরে গুণগত মানহীন, শুধু সংখ্যাগত দিক থেকে তৈরি ভবন দেখা যায়। যদিও রাজউক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ টেকনিক্যালি অনুমোদন দেয়, বাস্তবিকভাবে বিল্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা এবং নগরের ব্যবহারকারীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা তেমন মনোযোগের আওতায় আসে না। স্থপতি, যিনি নগরকে বৃহৎ ও মাইক্রো স্কেলে—রাস্তা, মাঠ, বিল্ডিং এবং দৈনন্দিন জীবন—একসঙ্গে দেখেন, তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী নগরায়ণকে টেকসই বা ক্ষয়িষ্ণু করা সম্ভব।

টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হলে স্থপতিদের সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য। স্থানিক ভিশন এবং কোয়ালিটেটিভ মানদণ্ডসহ নগরের প্রতিটি স্তরে নকশা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু সংখ্যাগত নিয়ম এবং টেকনিক্যালি অনুমোদনের ওপর নির্ভর করে নগরায়ণকে টেকসই করা যায় না। স্থপতিদের দৃষ্টিকোণ, যা নগরকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেখার ক্ষমতা দেয়, সেই অভিজ্ঞতাকে পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে হবে, যাতে নগর মানুষবান্ধব, বাসযোগ্য ও টেকসই হয়।

তৌফিক উৎপল

সাবেক পরিচালক, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর

ঢাকা ভৌগোলিকভাবে দেশের কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে এবং নদীপথের কারণে এটিকে একটি চমৎকার নগর হিসেবে পরিকল্পনা করা সম্ভব। তবে বর্তমান নগরায়ণে নদী, জলাবদ্ধতা ও মাটির প্রকৃতিকে পুরোপুরি বিবেচনা করা হয়নি। শহরের বিস্তৃতি বাড়াতে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদান ধ্বংস করা হয়েছে, যা টেকসই নগরায়ণের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ঢাকা এখনো গ্রামপ্রধান দেশের শহর হিসেবেই পরিচালিত হচ্ছে। নগর-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যাগত এবং ইউনিটভিত্তিক বিশ্লেষণই প্রাধান্য পাচ্ছে; গুণগত দিক, মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, খোলা স্থান, বায়ু চলাচল এবং সুবিধাজনক জীবনযাত্রার দিক বিবেচনা করা হয় না। ফলে নগরের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং বাসযোগ্যতার মান হ্রাস পাচ্ছে।

আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানিং এবং অন্যান্য অধ্যাদেশ থাকলেও কার্যক্রম প্রায় অরূপায়িত। রাজউক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিল্ডিং অনুমোদন দিয়ে থাকলেও ইমপ্লিমেন্টেশনে ঘাটতি রয়েছে। রিহাউজিং, স্ট্রিট সংস্কার, ওপেন স্পেসের জন্য জমি সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য সুসংগঠিত, প্রায়োগিক এবং ধারাবাহিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। নগরায়ণকে ধাপে ধাপে উন্নত করতে হবে—প্রতি পাঁচ বছরে বিল্ডিং ও ল্যান্ড ব্যবহার পর্যবেক্ষণ, ডিটেইল প্ল্যান অনুযায়ী সংস্কার এবং প্রশাসনিক ও কারিগরি ক্ষমতার সমন্বয়। স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে নগরকে শুধু সংখ্যাগতভাবে নয়, গুণগত দিক থেকেও উন্নত করতে হবে।

ফলে টেকসই নগরায়ণের জন্য তিনটি মূল পদক্ষেপ অপরিহার্য, প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানিক ও ভৌগোলিক উপাদান সংরক্ষণ, গুণগত দিকসহ পরিকল্পনা এবং আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামোর কার্যকর বাস্তবায়ন। এই তিনটি উপাদান একত্র হলে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য, টেকসই এবং পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

আব্দুল লতিফ

সহসভাপতি, রিহ্যাব

নগরায়ণ শুধু সংখ্যাগত এবং বিল্ডিং হাইট বা ডেনসিটির মাধ্যমে হবে না। প্রথমত, ঢাকা শহরের অবকাঠামো ও ভূগোলগত প্রকৃতি বিবেচনা না করে অতীতের অর্ধপলাকা পরিকল্পনাগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি ভিশন ছিল না। এতে একতলা ও দোতলা বিল্ডিংয়ের অনিয়মিত বৃদ্ধি, রোড ও ভবনের অমিল এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে পরিকল্পনার অভাব দেখা গেছে। টেকসই নগরায়ণের জন্য এখনই প্রয়োজন ৫০ বা ১০০ বছরের ফোকাস নিয়ে পরিকল্পনা, যাতে ভবিষ্যতের জনসংখ্যা, অবকাঠামো চাহিদা ও সিটি স্কেলের পরিবর্তন পূর্বানুমান করা যায়।

বর্তমান বাস্তবায়ন ব্যবস্থায় সমস্যা রয়েছে। রাজউক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিল্ডিং অনুমোদন দেয়, কিন্তু আইন ও বিধিমালার সমন্বয় ঠিকভাবে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী রিহাউজিং, রাস্তা প্রশস্তকরণ ও ওপেন স্পেস সংরক্ষণ প্রায় অরূপায়িত। এ ছাড়া বিধিমালার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রেগুলেটরি বডির মধ্যে মিসম্যাচ এবং কার্যকর সমন্বয়ের অভাব নগরায়ণের সমস্যাকে জটিল করে তোলে।

টেকসই নগরায়ণের জন্য স্টেকহোল্ডারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। পরিকল্পনাকারী, স্থপতি, প্রকৌশলী, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিরা একসঙ্গে কাজ করে প্রতিটি মহল্লা ও ব্লকের সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং সমাধানের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তকরণ, রাস্তা প্রশস্তকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং অবকাঠামোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ অপরিহার্য।

টেকসই নগরায়ণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এই তিন উপাদান মিলিয়ে নগরকে বাসযোগ্য, নিরাপদ এবং টেকসই করা সম্ভব, যাতে ঢাকা শহরকে শুধু বর্তমানের চাহিদা মেটানোর জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও প্রস্তুত রাখা যায়।

জাহাঙ্গীর আলম খান

গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ

টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হলে শুধু শহরের নয়, গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে। ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে শহরে চাপ বেড়েছে। কিন্তু গ্রামে এখনো অনেক জমি এবং বসতি রয়েছে, যা পরিকল্পনামূলকভাবে ব্যবহৃত না হলে শহরের জনসংখ্যা আরও বাড়বে। অতীতে গ্রামে একতলা বা দোতলা ঘরই সাধারণ ছিল, কিন্তু এখন দোতলা-তিনতলা বিল্ডিং বাড়ছে, যেখানে কোনো নিয়ম, স্থপতি বা প্রকৌশলীর তদারকি নেই। ফলে ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকি কিন্তু সবার অগোচরে মারাত্মক হয়ে উঠছে।

৩০ বছর আগে কৃষিজমি জনপ্রতি প্রায় ১৭ শতক ছিল, যা এখন কমে প্রায় ১১ শতক। জমির ঘাটতি, বাড়ির চাপ এবং নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনার অভাব একসঙ্গে শহর ও গ্রামের সঠিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। এ জন্য জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ২০০১-এ কৃষি, আবাসন, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা আলাদা চিহ্নিত করে পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে বাস্তবায়নে অনুমোদন এবং নিয়মকানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।

টেকসই নগরায়ণের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: প্রথম, গ্রামের উন্নয়ন। গ্রামগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সাজানো হলে মানুষ শহরে চলে আসার চাপ কমবে। দ্বিতীয়, শহরের পরিবেশ ও অবকাঠামো। শহরে হাইরাইজ বিল্ডিং, ছাদকৃষি, সৌরবিদ্যুৎ এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার টেকসই নগরায়ণ নিশ্চিত করতে পারে। তবে এসব প্রযুক্তি স্থায়ীভাবে পরিচালিত হতে হবে, না হলে প্রকল্পগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। পরিকল্পনাকারীরা শুধু শহরের ফিজিক্যাল অবকাঠামো নয়, জনসংখ্যার প্রবাহ, পরিবেশ, কৃষিজমির ব্যবহার এবং গ্রামীণ উন্নয়নকে সমন্বিতভাবে দেখতে হবে। শহরকে বাসযোগ্য রাখতে হলে শহর ও গ্রাম উভয়কেই টেকসই করা অপরিহার্য। একত্রে কাজ করে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জমি সংরক্ষণ, খোলা স্থান, কৃষি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শুধু এভাবে ঢাকাসহ বাংলাদেশের নগর ও গ্রামাঞ্চল টেকসই ও সাসটেইনেবলভাবে বিকাশ লাভ করতে পারবে।

গোপেন কুমার কুন্ডু

অধ্যাপক ও শিশু স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ণ কেবল অবকাঠামো নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, এটি শিশুবান্ধব ও মানসিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর বিকাশ জীবনের প্রথম আট বছরেই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই শিশুই আগামী দিনের সমাজ ও জাতির ভিত্তি। তাই নগরায়ণের পরিকল্পনায় আবাসিক ভবন, খোলা মাঠ, সুস্থ বিনোদন এবং মুক্ত বাতাসের যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে।

শিশুর শারীরিক সুস্থতার জন্য পরিষ্কার বাতাস, পর্যাপ্ত খোলা স্থান এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী ঢাকার বাতাসে ফাইন পার্টিকেলের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, যা শ্বাসকষ্ট, পেটের সমস্যা এবং শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। মানসিক বিকাশও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটতে হলে তাকে ঘরের বাইরে খেলাধুলা ও প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্য শিশুদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার সুযোগ থাকতে হবে। নেচার ও নার্চারের সংযোগের মাধ্যমে শিশুর সামাজিক ও মানসিক দক্ষতা বিকশিত হয়।

আজকের ডিজিটাল যুগে শিশুদের অধিকাংশ সময় মুঠোফোন বা টিভির সঙ্গে কাটছে, যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করছে। এ জন্য নগর-পরিকল্পনায় শিশুদের ঘরের বাইরে আসার সুযোগ, খোলা খেলার মাঠ এবং সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা অপরিহার্য। এ ছাড়া শহরের পরিবেশগত মানও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুবান্ধব নগরায়ণে দূষণমুক্ত বাতাস, খোলা সবুজ স্থান এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

টেকসই নগরায়ণ শুধু ভবন বা রাস্তার পরিকল্পনা নয়, বরং শিশুবান্ধব, স্বাস্থ্যকর ও বিনোদনমুখী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, খোলা মাঠ, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে ইন্টারেকশন—এসবের সমন্বয়েই নগরায়ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মাধ্যমে একটি বাসযোগ্য, টেকসই এবং ভবিষ্যৎমুখী নগর গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যেখানে শিশুদের বিকাশ হবে সুষ্ঠুভাবে এবং তারা দেশের জন্য যোগ্য নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হবে।

সুপারিশ

  • দ্রুত নগরায়ণ ও দূষণ মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি।

  • ব্লক ডেভেলপমেন্ট ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ করতে হবে।

  • ড্যাপ বাস্তবায়ন ও স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তুলতে হবে।

  • শহরের চাপ কমাতে গ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়ন ঘটাতে হবে

  • শিশুবান্ধব নগরায়ণ গড়তে খোলা মাঠ, বিনোদন ও দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

  • আইন, নীতি ও বাস্তবায়ন মিলিয়ে নগরায়ণ টেকসই ও মানবকেন্দ্রিক করতে হবে।