কিশোর–কিশোরীদের যত্ন নিন

জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলপত্র বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) মো. মনজুর হোসেন, কাজী সুরাইয়া সুলতানা, নুরুন নাহার বেগম ও মাশফিকা জামান সাটিয়ার। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সিসিএসডি) নুরুন নাহার বেগম বলেছেন, সরকার ‘জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলপত্র প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা (২০২০-৩০) তৈরি করেছে। এখন মধ্যবর্তী একটি মূল্যায়ন করে কাজের অগ্রগতি চিহ্নিত করতে হবে। এ ছাড়া এ কৌশলপত্র বাস্তবায়নে কত বছরে কত খরচ হবে, কোন খাতে খরচ হবে সে ধরনের পরিকল্পনা করে সামনের দিকে এগোতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলপত্র (২০১৭-৩০): বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।

নুরুন নাহার বেগম বলেন, কৌশলপত্রে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সটাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে ৫ থেকে ১০ বা অন্য বয়সী শিশুদের দিকে গুরুত্ব না বাড়ালে কোনো কাজে লাগবে না। আর শিশুকিশোরদের যাঁরা সেবা দেবেন, তাঁদের নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। কোনো বিষয়ে শুধু উপদেশ দিলে এই বয়সীরা তা মানবে না বা মানতে চাইবে না। তাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। তাদের চাহিদা বুঝতে হবে।

এনজিও রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সার্ভিসেস ট্রেনিং অ্যান্ড এডুকেশন প্রোগ্রাম (আরএইচস্টেপ) ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

বৈঠকের আলোচকেরা বলেছেন, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে আরও অগ্রসর হতে এই কিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য দিতে হবে। কাউন্সেলিং করতে হবে। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে হবে।

শিশুকিশোরদের চাহিদা অনুযায়ী কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে কিশোর-কিশোরীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই বয়সীদের দিকে নজর না দিলে তারা মাদকসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, কিশোরী মাতৃত্ব প্রতিরোধসহ নানান সামাজিক সূচকে পিছিয়ে পড়বে যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা দেবে।

গোলটেবিল বৈঠকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মনজুর হোসেন দেশের কিশোর–কিশোরীদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তিনি জানান, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩ কোটি কিশোর–কিশোরীকে নিয়ে ১৭টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলপত্রে প্রজননস্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, সহিংসতা প্রতিরোধ এবং পুষ্টির বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশে ১ হাজার ২৫৩টি কৈশোরবান্ধব সেবাকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সরকারের একার পক্ষে সেবা দেওয়া সম্ভব না। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

সুইডেন দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগী শাখার স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ মোহম্মদ জহিরুল ইসলামও জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলপত্র বাস্তবায়ন কোন পর্যায়ে আছে তা দেখার জন্য মূল্যায়ন করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা (এসআরএইচআর ও জেন্ডার) মাশফিকা জামান সাটিয়ার কিশোর– কিশোরীদের কাছে তথ্য পৌঁছানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আছে সে তথ্য না জানানো না হলে কোনো লাভ হবে না।

জাতীয় পুষ্টিসেবার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নন্দলাল সূত্রধর বলেন, কিশোর–কিশোরীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও পুষ্টির বিষয়টি নজর এড়িয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারিহা হাসিন কিশোর–কিশোরীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি ঘর থেকে শুরু করার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, কার্যক্রমে মা–বাবাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তখন কিশোর –কিশোরীরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বিবাহিত কিশোর কিশোরীরা কার্যক্রম থেকে যাতে বাদ না পড়ে, সে বিষয়টিতেও তিনি গুরুত্ব দেন।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট (অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথ) মুহম্মদ মুনির হোসেন বলেন, বর্তমানে অবিবাহিত কিশোর–কিশোরীদের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। তিনি বলেন, এনজিওগুলো যেসব কাজ করছে, প্রকল্প শেষে কাজগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা সরকার সেভাবে সব কাজকে এগিয়ে নিতে পারছে না। ফলে অনেক কাজ টেকসই হচ্ছে না। কার্যক্রম থেকে প্রতিবন্ধী, ট্রান্সজেন্ডারসহ কোনো কিশোর–কিশোরী যাতে বাদ না পড়ে সে দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের ‘ইউএসএআইডি সুখীজীবন’ প্রকল্পের কৈশোর ও যুব বিশেষজ্ঞ ফাতেমা শবনম বলেন, অনেক সময় সমন্বয়ের অভাবে দেখা যায় বিভিন্ন সংগঠন বা সংস্থা কিশোর–কিশোরীদের প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে একই কাজ করছে।

ব্র্যাকের জাতীয় সমন্বয়ক (আরএইচআরএন-২) মো. মাসুদুর রহমান সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোকে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি জানান, তাঁদের কার্যক্রমটি বিশ্বের ১০টি দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং তা ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলবে।

আরএইচস্টেপের উপপরিচালক (প্রোগ্রাম) এলভিনা মোস্তারী বলেন, প্রশিক্ষণ দিতে গেলে দেখা যায়, নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সেবাদানকারীদের বেশির ভাগ কিশোর–কিশোরীদের প্রজনন, যৌনস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা ধারণা রাখেন না। তিনি কিশোর–কিশোরীদের কাউন্সেলিংসহ সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীবান্ধব অবকাঠামো থাকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। কেননা, যেকোনো পরিবেশে তারা তাদের মনের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারে না বা প্রকাশ করতে চায় না।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সেল্প প্রকল্পের প্রোগ্রাম হেড শাশ্বতী বিপ্লব, ইউনিসেফের সাবেক পরামর্শক শামীমা চৌধুরী, অবয়বের নির্বাহী পরিচালক নাজিয়া জেবিন, ঋতুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন কবির, আরএইচআরএন–২, ওয়াইপিএফ–এর প্রজেক্ট লিড শামায়লা মাহবুব, নাগরিক উদ্যোগের আরএইচআরএন–২–এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর জয়িতা হোসেন।

এ বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আরএইচস্টেপের নির্বাহী পরিচালক কাজী সুরাইয়া সুলতানা অতিথিদের ধন্যবাদ দেন। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।