গোলটেবিল বৈঠক
খোলা ভোজ্যতেল, সুস্বাস্থ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘খোলা ভোজ্যতেল, সুস্বাস্থ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ২১ আগস্ট ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।
আলোচনা
মোহাম্মদ আলীম আখতার খান
মহাপরিচালক (গ্রেড ১), ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সরকারের একটা নীতি বাস্তবায়নমূলক সংগঠন, যার দায়িত্ব হলো আইন বাস্তবায়ন এবং নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা করা। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্যের বাইরে পণ্য বিক্রি, নকল বা ভেজাল, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য বাজারজাতকরণ—সবই অপরাধ। দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে আরও কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আমরা দেখেছি, প্রায় ৭০ শতাংশ ভোজ্যতেল এখনো খোলা অবস্থায় বিক্রি হয় এবং মাত্র ৩০ শতাংশ বোতলজাত। হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেট বা কুমিল্লা—যেখানেই গেছি, খোলা তেলের কনটেইনারের অবস্থা ভয়াবহ। এগুলো কোনোভাবেই ফুড গ্রেড নয়। সেখান থেকে তেল নামানোর সময় কীটনাশক, ময়লা কিংবা ইঁদুর–বিড়ালের স্পর্শ এড়ানো যায় না। অথচ এই তেলই অহরহ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও শতাধিক ড্রাম মজুত অবস্থায় দেখেছি। এতে ভোক্তা যে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে, তা অস্বীকারের সুযোগ নেই।
আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনাতেও দুর্বলতা আছে। আমরা চাইলে কয়েকটি বড় সরবরাহকারীকে সহজেই মনিটর করতে পারি। কিন্তু ভোক্তা তখন জিম্মি হয়ে পড়ছে কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে সেই প্রভাব পড়তে দেরি হয়। যেমন সম্প্রতি পাম অয়েলের দাম ১৯ টাকা কমলেও বাজারে এখনো সে অনুযায়ী দাম সমন্বয় হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তার স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষায় ঘাটতি আছে।
নিরাপদ তেল মানে নিরাপদ খাদ্য, আর সেটাই আমাদের সবার চূড়ান্ত লক্ষ্য। আমি মনে করি, রাষ্ট্র প্রথমে জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেবে। কারণ, নাগরিকেরা কর দেয়, সেই অর্থেই রাষ্ট্র আমাদের বেতন দেয়।
আজকে প্রায়শই আমরা ‘ভোক্তা’ শব্দ ব্যবহার করছি, কিন্তু আসলে তারা নাগরিক। নাগরিককে বাদ দিয়ে শুধু ভোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে চলবে না। খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ শুধু হোটেল–রেস্তোরাঁয় নয়, শিল্প পর্যায়েও তদারকি জোরদার করতে হবে। উৎপাদনেই যদি মান নিশ্চিত হয়, তাহলে খোলা বা প্যাকেটজাত—দুটি ক্ষেত্রেই নিরাপদ ভোজ্যতেল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
নাজমা শাহীন
অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খোলা তেলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এর শনাক্তকরণ–সুবিধা না থাকা। অর্থাৎ ভোক্তা কখনোই জানেন না তিনি যে তেল কিনছেন, সেটা কোন কোম্পানি উৎপাদন করেছে, কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে বা এর ভেতরে কী ধরনের রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ আছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশে সংগৃহীত ১ হাজার ৫০০ স্যাম্পলের মধ্যে খোলা তেলের মানে বড় ধরনের তারতম্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তেল রাখা হয়েছে রাসায়নিক কনটেইনারে, যেগুলো আগে কেমিক্যাল আমদানি ও পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে তেলে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশে যাচ্ছে, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
বোতলজাত তেলের তুলনায় খোলা তেলে পারক্সাইড ভ্যালু অনেক বেশি। এই প্রক্রিয়ায় তেলের প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড নষ্ট হয়ে যায় এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকর যৌগ তৈরি হয়। অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পাম অয়েল ও ডালডার ব্যবহার বন্ধ হওয়ার পেছনে এই স্বাস্থ্যঝুঁকিই প্রধান কারণ ছিল।
খোলা তেলের বাজারে আরেকটি জটিলতা রয়েছে। বাংলাদেশে মোট আমদানির প্রায় ৭০ শতাংশ পাম অয়েল অথচ খুচরা বাজারে পাওয়া যায় প্রায় ৭০ শতাংশ সয়াবিন তেল। এর মানে, তেলে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ভোক্তারা যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়ছেন। যেসব দেশে খোলা তেলের প্রচলন নেই, সেখানে উৎপাদন পর্যায়েই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে খোলা বাজারে কোটি মানুষের কাছে তেলের মান নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। ফলে সমাধান খুঁজতে হলে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়েই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমি মনে করি, খোলা তেলের সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—সবার সম্মিলিত সদিচ্ছা প্রয়োজন।
দরিদ্র মানুষের জন্য কস্ট ইফেকটিভ সমাধান আনতে হবে, যাতে তাঁরা নিরাপদ তেল সাশ্রয়ী দামে পান। সঠিক উদ্যোগ নিলে আমরা এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্তি পেতে পারব।
মোহাম্মদ শোয়েব
সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
আমাদের মনিটরিং টিম নিয়মিত কাজ করছে। ঢাকাসহ ৬৪ জেলা ও ৮ বিভাগীয় শহরে আমরা হোটেল, রেস্তোরাঁ, বেকারি ও বিভিন্ন খাদ্যশিল্পে গিয়ে পরিদর্শন করি। শুধু খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে কি না, তা নয়—সেগুলো কীভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে, স্বাস্থ্যসম্মত কি না, সেই বিষয়গুলোও দেখা হয়। প্রয়োজন হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একইভাবে বড় তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেও আমরা গিয়ে দেখি ভিটামিন এ–এর মাত্রা সঠিক আছে কি না এবং ফর্টিফিকেশন–প্রক্রিয়া যথাযথভাবে হচ্ছে কি না।
শিল্পমালিকদের আমরা পরামর্শ দিচ্ছি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে। পাশাপাশি বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও বাজার থেকে নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ করে দেখা হচ্ছে, পুনর্ব্যবহৃত তেলের অবস্থা ও ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা কতটুকু সহনীয় পর্যায়ে আছে।
সম্প্রতি ৬৪ জেলা থেকে ১৯৪টি নমুনা সংগ্রহের পর দেখা গেছে—খোলা তেলের ৫২ শতাংশেই ভিটামিন এ প্রয়োজনীয় মাত্রার নিচে, আর কিছু তেলে একেবারেই অনুপস্থিত। অক্সিডেশন বা দীর্ঘদিন মজুত থাকার কারণে এ ঘাটতি তৈরি হয়।
আমার মতে, সমস্যার সমাধানে শিল্প, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মধ্যে সমন্বয় জরুরি। বড় কোম্পানির তেলে ভিটামিন এ যথেষ্ট থাকলেও ছোট কোম্পানির তেলে ঘাটতি স্পষ্ট। শুধু তেল নয়, সব ধরনের খাদ্যপণ্য প্যাকেজিংয়ে ফুড গ্রেড কনটেইনার ব্যবহার করা উচিত।
হবিগঞ্জের একটি ছোট রিফাইনারি ভিজিটে আমি দেখেছি—অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, পুরোনো ও নিম্নমানের কনটেইনারে তেল ভরা হচ্ছে। এ দৃশ্য আমাদের আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে।
তাই আমার জোরালো বক্তব্য হলো—তেল অবশ্যই ফুড গ্রেড কনটেইনারে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন কোনো উদ্ভাবনী সমাধান বের করতে হবে, যাতে ভোক্তারা সহজে ও নিরাপদে ভোজ্যতেল পান।
এস এম আবু সাঈদ
উপপরিচালক (সিএম), বিএসটিআই
ভোজ্যতেলের মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালে ভোজ্যতেলে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধকরণ আইন পাস হয় এবং ২০১৫ সালে এর বিধিমালা প্রণয়ন হয়। তখন থেকেই সয়াবিন, পাম ওলিন, পাম অয়েল, রাইস ব্র্যান ও সানফ্লাওয়ার তেলকে বাধ্যতামূলকভাবে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ করা হয়। তবে শর্ষের তেল, নারকেল তেল ও অলিভ অয়েল এই তালিকার বাইরে থাকে। এই আইন বাস্তবায়নে বিএসটিআই বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়।
আমাদের কাজ হচ্ছে মনিটরিং, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ও আইন প্রয়োগ। প্রতি মাসে বাজার থেকে তেল সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয় এবং ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গত কয়েক মাসে আমরা ১২টি মোবাইল কোর্ট করেছি, প্রায় ৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছি, পাঁচটি কারখানা সিলগালা ও দুটি লাইসেন্স বাতিল করেছি। তবু উৎপাদন ও সরবরাহকারীরা আইন এড়িয়ে নিম্নমানের তেল বাজারে ছাড়ছে। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা ড্রামের ভেতরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তেল মিশিয়ে দেয়, এমনকি ডিটারজেন্ট ও পানি ব্যবহার করে ড্রাম পরিষ্কার করে আবার তেল ভরে দেয়। এতে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, ২০৪টি ড্রামের মধ্যে মাত্র ৫১ শতাংশ পাস করেছে, বাকিগুলো ফেল। বিপরীতে বোতল বা প্যাকেটজাত তেলের মান ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত ভালো। এখনো ৭০-৮০ শতাংশ তেল ড্রামের মাধ্যমে খোলা অবস্থায় বিক্রি ও বাজারজাত হচ্ছে। ছয়টি বড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বোতলজাতকরণের জন্য শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ভিটামিন–এ সমৃদ্ধ মানসম্মত ভোজ্যতেল নিশ্চিত করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আমরা আয়োডিনযুক্ত লবণের ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে গলগণ্ড রোগ দূর করতে পারি, তবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খোলা তেলও বন্ধ করা সম্ভব। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য সবার সহযোগিতা দরকার।
খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী
সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
আমরা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে হৃদ্রোগের পাশাপাশি সব ধরনের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ নিয়ে কাজ করি। তবু হৃদ্রোগ আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মৃত্যুর প্রধান কারণ। আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন এত রোগী আসে যে দাঁড়ানোরও জায়গা থাকে না। আশঙ্কার বিষয় হলো, ৩০ বছরের নিচের তরুণেরাও এখন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে মারা যায়, আবার যারা বেঁচে থাকে, তারা কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরিবার ও সমাজের ওপর বোঝা হয়ে থাকে।
হৃদ্রোগের চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে—বিশেষ করে খাদ্যাভ্যাসে। তেলের ব্যবহার নিয়ে সচেতন হতে হবে। আগে আমরা খোলা ঘানির শর্ষের তেল খেতাম, তখন কোনো ক্ষতির কথা ভাবিনি। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় খোলা ভোজ্যতেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, এগুলো রাখা হয় বিষাক্ত কনটেইনারে, সহজেই ভেজাল মেশানো যায় এবং নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলো সরাসরি হৃদ্রোগের কারণ হতে পারে। অথচ বোতলজাত, বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তেল বাজারজাতকরণ সম্ভব। তাই খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ করা জরুরি।
আসলে এখন খোলা তেল বিক্রি করার কোনো প্রয়োজন নেই। বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে বোতলজাত তেল উৎপাদন ও বিপণন সম্ভব। তাই আমি আহ্বান জানাই, খোলা ভোজ্যতেলের বিক্রি বন্ধ করতে হবে। প্রস্তুতকারকদের ফুড-গ্রেড কনটেইনার ব্যবহার করতে হবে, ভেজাল বন্ধ করতে হবে, এক্সপায়ারি ডেট উল্লেখ করতে হবে। একই সঙ্গে ভোক্তা ও কর্তৃপক্ষকেও সচেতন হতে হবে। সিলেটের মানুষ যেমন খোলা তেল কেনা অনেকাংশে কমিয়েছে। সারা দেশেই তেমন সচেতনতা তৈরি হলে আমরা খোলা তেলের ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে পারব। এভাবেই মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারব।
রীনা রানী পাল
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সংযোজন বাধ্যতামূলক। বিশ্বে অন্তত ৪৩টি দেশে এই ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে তা বাধ্যতামূলক, ভারতে ঐচ্ছিক। অনেক দেশে ভিটামিন ডি এবং ই–ও যোগ করা হয়। অর্থাৎ ভোজ্যতেলে ভিটামিন সংযোজন এখন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত ও কার্যকর পদ্ধতি।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে বাজারজাত ভোজ্যতেলের মাত্র ২৫–৩০ শতাংশ আসে প্যাকেটজাত অবস্থায়। বাকি তেল বিক্রি হয় খোলা ড্রামে, যেগুলোর অনেক আগে রাসায়নিক আমদানির কাজে ব্যবহার হয়েছে। এসব ড্রামে তেল রাখার ফলে বৈজ্ঞানিকভাবে কোনো সুরক্ষা থাকে না। আলো, অক্সিজেন ও আর্দ্রতার সংস্পর্শে খোলা তেল দ্রুত অক্সিডেশনের শিকার হয়ে মান হারায়। গবেষণায় দেখা গেছে, পরীক্ষিত খোলা তেলের প্রায় ৯৩ শতাংশ নমুনায় ভিটামিন এ অনুপস্থিত। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষ, যাঁরা খোলা তেল কিনতে বাধ্য, তাঁরা সরকারের ফর্টিফিকেশন উদ্যোগ থেকে কোনো সুফল পাচ্ছেন না।
আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো, খোলা তেলের নিরাপত্তা। ড্রামগুলোতে আগে কী সংরক্ষণ করা হয়েছিল বা কোনো ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। এতে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। অথচ প্যাকেটজাত তেলে মান নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন এ সংযোজন নিশ্চিত থাকে।
আইন বলছে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ ১৫ থেকে ৩০ পিপিএম মাত্রায় থাকতে হবে এবং সব প্যাকেজিং ফুড গ্রেড হতে হবে। অর্থাৎ প্যাকেটজাত তেলেই প্রকৃত সুরক্ষা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ খোলা তেল কিনতেই বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তাঁরাই ভিটামিন এ ঘাটতিতে ভুগছেন। তাই এখন জরুরি প্রশ্ন—খোলা ভোজ্যতেলের এই প্রবণতা আমরা কত দ্রুত বন্ধ করতে পারব?
মুশতাক হাসান মুহা. ইফতিখার
কনসালট্যান্ট (অ্যাডভোকেসি), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
ড্রামে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাত করায় বাংলাদেশ সরকারের অন্তত ছয়টি আইন ও প্রবিধানমালার সরাসরি লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি গঠনের পর খাদ্য স্পর্শক প্রবিধানমালা, ২০১৯ জারি হয়েছে। সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে ফুড গ্রেড ম্যাটেরিয়াল কখন বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে উক্ত প্রবিধানমালায় কোডেক্স বা ইউএসএফডিএ বা এফসা অনুসরণ করার নির্দেশ আছে। অর্থাৎ বিভিন্ন মনোমার্স, স্টার্টিং সাবস্টেন্স, এডিটিভস, পলিমার প্রোডাকশন এইডস ইত্যাদে কেমিকেল/দ্রব্য প্রায় এক হাজারের বেশি পদার্থ/কেমিকেলস এবং সেগুলোর মাত্রা নির্ধারণ করা আছে। এই নিয়ম বাস্তবায়ন করতে গেলে খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সার্বিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে হবে। বেশির ভাগ প্লাস্টিক পণ্যের নিচে ‘ফুড গ্রেড’ লিখছেন এবং ‘প্রতীক’ ব্যবহার করছে, কিন্তু পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
এখন বড় প্রশ্ন খোলা ভোজ্যতেল বন্ধ করতে হলে প্রান্তিক মানুষের কাছে এই নিরাপদ প্যাকেজিং কীভাবে পৌঁছানো যাবে অর্থাৎ বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন। আমার সহকর্মীরা বলেছেন, দরিদ্ররা অল্প পরিমাণ ভোজ্যতেল ক্রয় করে থাকেন, তাই তাঁদের জন্য ছোট আকারের প্যাকেজিং জরুরি। আমরা রিফাইনারিদের অনুরোধ করেছি যেন ছোট পাউচে, বিশেষ করে ২৫০ গ্রাম বা তার নিচে প্যাকেজিং করে। তবে এতে খরচ বেড়ে যেতে পারে। তাই বিকল্প নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আপাতত ছোট পাউচ ছাড়া অন্য কোনো কার্যকর বিকল্প নেই বলেই মনে করি।
মলয় কান্তি মৃধা
ডেপুটি ডিন ও ডিরেক্টর (সিএনডিএন), ব্র্যাক জেপিজি স্কুল অব পাবলিক হেলথ
আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে ৬৭ শতাংশ মানুষ খোলা তেল ব্যবহার করলেও ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে ৪৮ শতাংশে।
দেশে সয়াবিন তেলের ব্যবহার সর্বাধিক। ২০১৮ সালে ৮৯ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ৮৮ শতাংশ। শর্ষের তেলের ব্যবহার ৮ শতাংশ থেকে কমে ৭ শতাংশ হয়েছে। তবে চিন্তার বিষয় হলো, পাম অয়েলের ব্যবহার ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ শতাংশ হয়েছে।
বিভাগভিত্তিক চিত্রও ভিন্ন। সিলেটে খোলা তেলের ব্যবহার সব সময়ই কম—২০১৮ সালে ১৬ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে তা ১১ শতাংশে নেমেছে। এখানে ৮৯ শতাংশ মানুষ এখন প্যাকেটজাত তেল ব্যবহার করে। অন্যদিকে ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহীতে খোলা তেলের ব্যবহার এখনো তুলনামূলক বেশি হলেও তা দ্রুত কমছে। ময়মনসিংহে ৯০ শতাংশ থেকে কমে ৭৬ শতাংশ, রংপুরে ৮২ শতাংশ থেকে ৫৪ শতাংশ এবং রাজশাহীতে ৭৯ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে নেমেছে। চট্টগ্রামে এখনো ৩৩ শতাংশ পরিবার খোলা তেল ব্যবহার করে।
মো. শাহিনুর ইসলাম
অধ্যাপক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট
খোলা তেল যেসব ড্রামে রাখা হয়, সেগুলো সাধারণত হাই ডেন্সিটি পলিইথিলিন বা এইচডিপিই দিয়ে তৈরি। বিশ্বব্যাপী এইচডিপিই মূলত কেমিক্যাল ও তেল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার হয়। এ ছাড়া পলিপ্রোপাইলিনও কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যা অনেক সময় অ্যাসিড বা অন্যান্য কেমিক্যাল রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খোলা তেল যেসব ড্রামে রাখা হয়, সেগুলো আসলেই কি ফুড গ্রেড, নাকি আগে কেমিক্যাল সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে? এই বিষয়ে একটি বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
এ ছাড়া খোলা তেল সূর্যের আলোতে থাকলে এর গুণগত মান নষ্ট হয় এবং স্বাস্থ্যকর থাকে না। তাই আমি মনে করি, শুধু ড্রামের কারণে তেল ক্ষতিকর হচ্ছে বলা যথেষ্ট নয়। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা করতে হবে—ড্রাম থেকে আসলেই কোনো টক্সিক উপাদান তেলে আসছে কি না, নাকি অন্য কারণগুলো মিলেই তেল অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে।
আবু আহমেদ শামীম
সহযোগী বিজ্ঞানী, ব্র্যাক জেপিজি এসপিএইচ
সার্কভুক্ত দেশ ভারত, পাকিস্তানে ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ এবং ডি ফর্টিফিকেশন যথেষ্ট ভালো। অথচ আমরা ২০১৩ সাল থেকে শুরু করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাইনি। এখন বাজারের খোলা তেলে ভিটামিন এ যথেষ্ট নয়। এর অন্যতম কারণ, আমাদের মনিটরিং সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তেল মনিটর করা তুলনামূলক সহজ। কারণ, এটি অল্প কিছু রিফাইনারি থেকে আসে। বোতলজাত তেলের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড লয়ালিটির কারণে কোম্পানিগুলো কোয়ালিটি নিয়ে সচেতন থাকে। কিন্তু খোলা তেল একবার ফ্যাক্টরি গেট থেকে বের হলে আর বলা যায় না সেটি কার। ফলে এর মান নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
খোলা তেলের সমস্যা আরও বাড়ে দোকানে খোলা টিনে রাখার কারণে। সূর্যের আলো, বাতাস আর ধুলাবালুর সংস্পর্শে এসে এটি দ্রুত মান হারায়। মনিটরিংয়ের জন্য উন্নত ল্যাব টেস্ট, যেমন এইচপিএলসি দরকার হয়। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে শুধু ভিটামিন এ নয়, ভিটামিন ডি ফর্টিফিকেশনও জরুরি হবে।
নন্দিনী চৌধুরী
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, গেইন
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ২০১৭ সালের গেজেট অনুযায়ী, ভোজ্যখাদ্যের ক্ষেত্রে শনাক্তকরণ বাধ্যতামূলক। এ জন্য আমরা ডিজিটাল ট্রেসেবিলিটি সলিউশন নিয়ে কাজ করছি, যা ভিটামিন–এ ক্রয় থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে।
মান যাচাইয়ের জন্য টেস্ট কিট আছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা যাচাই করতে হবে। আফ্রিকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। আরেকটি সমাধান হলো, অলটারনেটিভ প্যাকেজিং। ড্রামে খোলা তেল বন্ধের লক্ষ্যে আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ফুড গ্রেড ড্রাম পরীক্ষা করছি। এতে ভেজাল ও দূষণের ঝুঁকি কমবে। তবে এর জন্য প্রথমে কিছু বিনিয়োগ লাগলেও দীর্ঘ মেয়াদে রিটার্ন বেশি হবে এবং ভোক্তার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে না।
এসব সমাধান বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন অংশীদারদের সমন্বয় অপরিহার্য। কারণ, দিন শেষে আমরা সবাই ভোক্তা এবং কেউই অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে চাই না।
সেলিম রেজা হাসান
কান্ট্রি ম্যানেজার, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক
ভোজ্যতেল শুধু খাবার নয়, এটি পুষ্টির অন্যতম উৎস। এর ব্যবহার, প্যাকেজিং ও বাজারব্যবস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি জড়িত। ছোটবেলায় দেখেছি শর্ষের তেল সপ্তাহে কিনতে হতো এবং নষ্ট হলে তা ফেলে দেওয়া হতো। তখনো একধরনের ফুড সেফটির সচেতনতা ছিল। আজ বাজারব্যবস্থা বদলেছে, কিন্তু এখানেই প্রশ্ন—এখনকার বাজারব্যবস্থাকে আমরা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব? আমি মনে করি, প্যাকেজিং ও প্রাইসিং নিয়ে সব সময় একটি মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
আমাদের ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিদেশে মানুষ শনাক্তকরণ ছাড়া কিছু কেনে না। বাংলাদেশেও ভোক্তাদের জানতে হবে কোন তেল স্বাস্থ্যকর এবং কোন তেল কীভাবে ব্যবহার করলে স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।
আমি বিশ্বাস করি, তেলের উৎপাদন, বাজারব্যবস্থাপনা ও ভোক্তার আচরণ—সবকিছুতেই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। না হলে খোলা তেলের ঝুঁকি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব না।
হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া
সাধারণ সম্পাদক, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব)
দরিদ্র ও আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষরাই বেশি খোলা তেল কিনতে বাধ্য হন, আর তাঁরাই ভিটামিন এ থেকে বঞ্চিত হন। যদি আমরা দুই টাকার শ্যাম্পুর প্যাকেট তৈরি করতে পারি, তাহলে ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ছোট প্যাকেটে নিরাপদ তেল সরবরাহ করা সম্ভব।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষ থেকে আমরা বারবার বলেছি, সরকারের আইন থাকলেও সেটার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বহু আগেই ফর্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা ছিল। এমনকি শিল্প মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছিল যে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে খোলা তেল বাজারে আসবে না। কিন্তু এখনো বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, আইনের বাস্তবায়নে বড় ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে।
আমাদের নিরাপদ ভোজ্যতেলের প্রয়োজন অপরিহার্য। যদি ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত না হয়, তবে অসংখ্য মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তেই থাকবেন।
ইমরান হাসান
মহাসচিব, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি
আমরা রেস্তোরাঁ খাতে ২০ শতাংশ তেল ব্যবহার করি। আমাদের প্যাকেটজাত তেল কিনতে বলা অবাস্তব ব্যাপার। আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী বড় পরিমাণ তেল দরকার। ২০ টন তেল যদি ছোট বোতলে বা জারে প্যাক করতে হয়, তাহলে সেটার রিসাইকেলিং, কস্ট ও পরিবেশগত প্রভাব বেড়ে যাবে।
আমরা যে তেল কিনি, তাতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, অথচ আমাদের ওপর মামলা আর জরিমানা চাপানো হচ্ছে।
আমি মনে করি, খোলা ভোজ্যতেল দরকার আছে, তবে ভিটামিন এ এবং ডি রাখতে হবে। আমি রাখার পক্ষে, কিন্তু সেটি নিশ্চিত করতে হবে কারখানা থেকে মিলগেট পর্যায়ে। খোলা তেলের ক্ষেত্রে মিলগেট থেকে নিশ্চিত করা দরকার। খোলা তেলের জন্য ফুড গ্রেড কনটেইনার নিশ্চিত করা উচিত, যেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবহারযোগ্য এবং পরিষ্কার রাখা সম্ভব। আমাদের দেশে মাত্র কয়েকটি মিল আছে এবং তেল উৎপাদন ও আমদানির নিয়ন্ত্রণ মূলত চার-পাঁচজনের হাতে। আমাদের উচিত সমস্যার মূলে হাত দেওয়া।
মো. শফিউর রহমান
অ্যাডভাইজর, মেঘনা গ্রুপ
আমাদের মিলগুলো সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে থাকে—বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরসহ অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মনিটরিং করে। তাই এখানে নিম্নমানের পণ্য বাজারজাত করার কোনো সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিদর্শকের মাধ্যমে মানসম্পন্ন পণ্যই এখানে প্রসেস করা হয়।
আমরাও চাই, খোলা তেল নয়, মানসম্মত বোতলজাত তেল বাজারে আসুক। আমাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই যে ভিটামিনহীন বা নিম্নমানের তেল বাজারজাত করা হবে। চাহিদা না থাকায় বর্তমানে বোতলজাত সাপ্লাই ৩০ শতাংশের মতো। যদি চাহিদা তৈরি হয় আমরা শতভাগ পর্যন্ত বোতলজাত তেল বাজারজাত করতে সক্ষম। বোতলজাত বা বাল্ক—প্রতিটিতেই ভিটামিনের পরিমাণ সঠিকভাবে দেওয়া হয়। মানসম্মত, নিরাপদ ও ভিটামিনযুক্ত তেল নিশ্চিত করতে আমরা প্রস্তুত এবং মিলগুলো নিয়মিত তদারকির আওতায় থাকায় সাধারণ ভোক্তা নিরাপদ পণ্য পেয়ে থাকে।
মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান
মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন), বিইওএল
আমাদের দেশে তেলের চাহিদা প্রায় ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন, আর আমাদের মিলগুলোতে মোট প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি প্রায় ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা প্রয়োজনের প্রায় দ্বিগুণ। তাই যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করার, মিলগুলো প্রস্তুত এবং মার্কেট রেডি।
তবে দেশের চাহিদা অনুযায়ী এখনো ২০-৩০ শতাংশ তেল খোলা বা বাল্ক আকারে যাবে, যা প্রধানত হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ব্যবহৃত হয়। সেখানে বিকল্প ব্যবহারের উপায় আছে, যা কস্ট অ্যাফেকটিভ নয়। আমরা চাই, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য টিসিবি বা অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে সাবসিডাইজ প্রাইসে ছোট প্যাকের তেল সরবরাহ করা হোক। এতে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী সুবিধা পাবে।
২ লিটার প্যাকের পাশাপাশি ২৫০ মিলি বা ছোট প্যাক সাইজ অন্তর্ভুক্ত করলে যেকোনো কনজিউমারের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। আমরা প্রায় শতভাগ প্যাকেজিং করতে সক্ষম এবং অবকাঠামো প্রস্তুত রয়েছে।
কুতুবুল আলম
সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক, মেঘনা গ্রুপ
খোলা তেল নিয়ে একটা বিষয় আমি পরিষ্কার করতে চাই। প্রথমে, কেন খোলা তেল বন্ধ হচ্ছে না? কারণ, বাল্ক তেলের চাহিদা এখনো ইন্ডাস্ট্রি ও রেস্টুরেন্টে রয়েছে। যদি মার্কেটে প্যাকেট তেলের বেশি চাহিদা তৈরি না হয়, কনজিউমারের চাহিদা তৈরি না হয়, খোলা তেল বিক্রি হবে। তাই বাজার তৈরি হওয়া জরুরি, তখন বাল্ক চাহিদা কমে বোতলজাত প্যাক বৃদ্ধি পাবে। আমরা সেই চাহিদা পূরণে সম্পূর্ণ প্রস্তুত, বিপুল বিনিয়োগ করে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে আছি।
আমরা যারা উৎপাদনের সঙ্গে আছি, তাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই খারাপ কোয়ালিটির তেল বাজারজাত করার। সুতরাং আমার দৃষ্টিতে, খোলা তেল পুরোপুরি বন্ধ করার আগে বাজার তৈরি ও ভোক্তার চাহিদা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া তেলের মান বজায় রাখতে এফএফএ নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য, যাতে ভোক্তা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে। এসব বিষয় মিলিয়ে দেখা ছাড়া খোলা তেল নিয়ে কোনো কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়।
সুপারিশ
খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি ধাপে ধাপে বন্ধ করা।
সব ভোজ্যতেলের জন্য ভোক্তা শ্রেণি বিবেচনা করে বিভিন্ন আয়তনের ফুড গ্রেড কনটেইনার বা প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা।
ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ (ভবিষ্যতে ভিটামিন ডি) সমৃদ্ধকরণ নিশ্চিত করা।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ২৫০ মিলি বা ছোট আকারে সাশ্রয়ী দামে প্যাকেটজাত তেল সরবরাহ করা।
বিএসটিআই ও খাদ্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মনিটরিং ও আধুনিক ল্যাব টেস্ট বাড়ানো।
উৎপাদন পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণ ও ফর্টিফিকেশন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।
ডিজিটাল ট্রেসেবিলিটি প্রয়োগ করে কোন তেল কোন কোম্পানি উৎপাদন করছে, তা ভোক্তাকে শনাক্তকরণ সুবিধা দেওয়া।
হোটেল–রেস্তোরাঁ ও শিল্প খাতে ফুড গ্রেড বাল্ক কনটেইনারে শনাক্তকরণ সিল বাধ্যতামূলক করা।
খোলা তেলের ক্ষতি ও বোতলজাত তেলের উপকারিতা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচারণা চালানো।
অংশগ্রহণকারী: মোহাম্মদ আলীম আখতার খান, মহাপরিচালক (গ্রেড ১), ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। নাজমা শাহীন, অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । মোহাম্মদ শোয়েব,সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এস এম আবু সাঈদ, উপপরিচালক (সিএম), বিএসটিআই । খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী, সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। রীনা রানী পাল, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। মুশতাক হাসান মুহা. ইফতিখার, কনসালট্যান্ট (অ্যাডভোকেসি), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। মলয় কান্তি মৃধা, ডেপুটি ডিন ও ডিরেক্টর (সিএনডিএন), ব্র্যাক জেপিজি স্কুল অব পাবলিক হেলথ। মো. শাহিনুর ইসলাম, অধ্যাপক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট। সেলিম রেজা হাসান, কান্ট্রি ম্যানেজার, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক। নন্দিনী চৌধুরী, প্রকল্প ব্যবস্থাপক, গেইন। আবু আহমেদ শামীম, সহযোগী বিজ্ঞানী, ব্র্যাক জেপিজি এসপিএইচ। হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক, ক্যাব। ইমরান হাসান, মহাসচিব, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। মো. শফিউর রহমান, অ্যাডভাইজর, মেঘনা গ্রুপ। মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান, মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন), বিইওএল। কুতুবুল আলম, সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক, মেঘনা গ্রুপ। সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো