বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রচারে চাই ভিন্নতা

‘কোভিডের প্রকোপ কমেছে, বাল্যবিবাহ কি কমবে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ওয়ার্ল্ডভিশন ও প্রথম আলো

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার কার্যক্রমে ভিন্নতা আনতে হবে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্রধান লক্ষ্যে রেখে প্রচার-প্রচারণাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বাল্যবিবাহ কতটা ক্ষতি ডেকে আনে, তা যথাযথভাবে বোঝানো গেলে পরিবারগুলো সেই বার্তা গ্রহণ করবে।

গতকাল রোববার ওয়ার্ল্ডভিশন ও প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই পরামর্শ দেন। তাঁদের মতে, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রচলিত পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি গণমাধ্যমকে যুক্ত করে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে পরিবারগুলোর কাছে বার্তা পৌঁছানোর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ রাখতে পারে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘কোভিডের প্রকোপ কমেছে, বাল্যবিবাহ কি কমবে’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বক্তারা বাল্যবিবাহকে জাতীয় সংকট উল্লেখ করে তা মোকাবিলায় পর্যবেক্ষণব্যবস্থা জোরদার; ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটিকে সক্রিয় করা ও বাজেট বাড়ানো এবং সঠিক পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য বাল্যবিবাহের প্রকৃত তথ্য তুলে আনার ওপর জোর দেন।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশের উপপরিচালক (অ্যাডভোকেসি) নিশাত সুলতানা। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। দেশের প্রায় ৫২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। কোভিডে বাল্যবিবাহের হার কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলে সরকারের যে লক্ষ্য রয়েছে, তা অর্জন করতে হলে বাল্যবিবাহ বন্ধে বর্তমান প্রচেষ্টাকে কমপক্ষে ৮ গুণ বাড়াতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেশের সম্পদ বেড়েছে, সচেতনতাও আগের চেয়ে বেড়েছে। এসবের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে জাতীয়ভাবে মোকাবিলা করা গেলে সাফল্যের সম্ভাবনা আছে। সরকার একা এটা মোকাবিলা করতে পারবে না। সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। বাল্যবিবাহের পক্ষে যাঁরা, তাঁদেরও বুঝিয়ে-শুনিয়ে এ উদ্যোগে রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন তিনজন সংসদ সদস্য। তাঁদের মধ্যে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী মেয়েদের জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করার প্রস্তাব করেন। তবে ১৮-এর পর থেকে ২১ বছরের আগপর্যন্ত কোনো মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলে আদালতের অনুমতি নেওয়ার ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করে তিনি বলেন, এই মেয়েদের গর্ভধারণের সময়টাকে পিছিয়ে দেওয়া গেলে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে এখন যে ব্যয় করতে হয়, তা অনেক কমে আসবে।

বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, এ সরকার বাল্যবিবাহের হার কম দেখানোর জন্য মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করার চেষ্টা করেছিল। নানা মহলের বাধার মুখে সেখান থেকে সরকার সরে আসে। এরপরও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বিশেষ বিধান যুক্ত করায় আইনটিতে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এর ফলে বাল্যবিবাহের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই, এমন দাবি করে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, এ ক্ষেত্রে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসবে না। সবাই মিলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগোতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপ্রধানের বক্তব্যে ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশের পরিচালক (অ্যাডভোকেসি ও এক্সটারনাল এনগেজমেন্ট) টনি মাইকেল গোমেজ প্রচার কার্যক্রমে ভিন্নতা আনার পরামর্শ দিয়ে বলেন, মা ও পরিবারের কিশোরী মেয়েটিকে শুধু সচেতন করে কাজ হবে না, পুরুষদের সচেতন করার ওপর জোর দিতে হবে।

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, এ দেশের মানুষ নতুন চিন্তা খুব সহজে গ্রহণ করেন। তাই বাল্যবিবাহের কারণে একটি পরিবার কতটা ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, তা যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে বোঝানো গেলে মানুষ তা গ্রহণ করবেন। এ বার্তা পৌঁছানোর জন্য গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নতুন নতুন ভিডিও ও চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দিতে হবে।

সচেতনতা সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অঙ্গীকার থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক (গার্লস রাইটস) কাশফিয়া ফিরোজ। তিনি বলেন, সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে কোভিডের মতো যেকোনো দুর্যোগে বাল্যবিবাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়।

ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি বিভাগের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, বাল্যবিবাহ একটি মেয়ের জীবনের সব সুযোগ সম্ভাবনা শেষ করে দেয়। বাল্যবিবাহ নিয়ে পরিসংখ্যানের ঘাটতি রয়েছে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বাল্যবিবাহ কোনো কারণে হয়ে গেলেও মেয়েটিকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মা-বাবার কাছে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বাল্যবিবাহ ঠেকাতে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনিরা হাসান।

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যে কৌশলে প্রচার করলে মানুষ আকৃষ্ট হবে, সে কৌশলগুলো প্রয়োগ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে সংগীতশিল্পী সোমনূর মনির কোনাল বলেন, বাল্যবিবাহ না দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন, এমন মা-বাবাকে উদাহরণ হিসেবে বারবার সামনে আনতে হবে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিবাহ কমিটিগুলো যেন নিয়মিত বৈঠক করে এবং এলাকার বাল্যবিবাহের তথ্য পাঠায়, সেদিকে নজর বাড়াতে হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব মাওলানা মো. ইকবাল হোসেন এবং সংগঠনের ঢাকা জেলার সভাপতি মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ বলেন, কাজিরা বাল্যবিবাহ পড়ান না। অনেক পরিবার ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে ছেলে-মেয়ের বাল্যবিবাহ দেয়। জন্মের পর শিশুর জন্য একক (ইউনিক) নম্বরের ব্যবস্থা করলে এ সুযোগ থাকবে না।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।