বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: ৫০ বছরের পথচলা

‘বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: ৫০ বছরের পথচলা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩। প্রচার সহযোগী হিসেবে প্রথম আলো ঢাকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে। আলোচকদের বক্তব্যের সারকথা এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

অংশগ্রহণকারী

ডা. আ ফ ম রুহুল হক

সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ডা. বর্ধন জং রানা

প্রতিনিধি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ

সাবেক মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান

সাবেক পরিচালক, আইডিসিআর

অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর

অধ্যাপক ডা.মো. নাজমুল ইসলাম

পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা) এবং লাইন ডিরেক্টর (সিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন

লাইন ডিরেক্টর (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডা. মুশতাক হোসেন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা, আইইডিসিআর

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

ডা. নাহিতুন নাহার

সহকারী পরিচালক, জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

শিশির মোড়ল

বিশেষ প্রতিনিধি, প্রথম আলো

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

কারিগরী সহযোগিতা ও সমন্বয়:

সালমা সুলতানা

ন্যাশনাল প্রোফেশনাল অফিসার- কমিউনিকেশন ও মিডিয়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ

আলোচনা

ডা. আ ফ ম রুহুল হক

বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। এ সংস্থার সঙ্গে আমার একটি ভালো সময় কেটেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ সব দেশের মানুষের জন্য এ সংস্থা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে বিভিন্নভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা পেয়েছি। তখন এ সংস্থার প্রধানের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে সাতক্ষীরার আশাশুনিতে এনেছিলাম।

কোভিডের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। কোভিড বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করেছিল। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনায় বিশ্বে আমার সফলভাবে কোভিড মোকাবিলা করেছি। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা আমি সব সময় স্মরণ করি। এ সংস্থার ঢাকা অফিসে যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া অনেকবার আমার ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।

আমাদের সৌভাগ্য যে এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। আমি মনে করি, তাঁর সহযোগিতায় এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আরও উন্নতি হবে। আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব সদস্যকে অভিনন্দন জানাই। এ সংস্থার আরও সাফল্য কামনা করি। (ভিডিও বার্তায় দেওয়া বক্তৃতা)

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। এফসিপিএস ডিজারটেশন তৈরির সময় ৭০টির মতো আর্টিকেল রিপ্রিন্টের জন্য ১৯৮১-৮২ সালে এ সংস্থার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। ১৯৮৩ সালে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে কাজ করার সময় ম্যালেরিয়ার নতুন ওষুধ SP (ফেনসিডার)-এর গবেষণার সূত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিওলজিস্ট ডা. আবে সুন্দরির সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন থেকে এ সংস্থার বাংলাদেশ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অফিস ও জেনেভা হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশের জন্য ১৯৯৪ সালে প্রণীত সংশোধিত ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কৌশল বাস্তবায়নে নির্দেশিকা একটি অন্যতম মাইলফলক। তিনটি সংজ্ঞা ও ক্লিনিক্যাল কেসের চিকিৎসার নীতি নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল জটিলতাবিহীন ম্যালেরিয়া, চিকিৎসা-ব্যর্থ ম্যালেরিয়া, মারাত্মক ম্যালেরিয়া।

এ সংস্থায় কখনো চাকরি করিনি, তবে বিভিন্ন সময় টেকনিক্যাল সহায়তা প্রদান কিংবা বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নিয়েছি। এর মধ্যে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার গাইডলাইন কমিটির সদস্য; সদস্য, যৌথ সমন্বয় বোর্ড, ট্রপিক্যাল ডিজিজেস রিসার্চ (টিডিআর), জেনেভা, সুইজারল্যান্ড; কো-চেয়ার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্নেক বাইট এনভেনমিং গ্রুপ; সর্পদংশন ব্যবস্থাপনার নির্দেশিকাসহ বিভিন্নভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ট্রপিক্যাল ডিজিজেস রিসার্চ সেন্টারের কোর ফান্ড প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের রোডম্যাপ তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করেছি। ম্যালেরিয়া রিসার্চ গ্রুপ (চট্টগ্রাম) কর্তৃক মারাত্মক ম্যালেরিয়ার ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে বিভিন্ন কলাবোরেশন গবেষণা, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিয়া চিকিৎসা নীতিমালা পরিবর্তনে সহায়ক হয়ে ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে ম্যালেরিয়া, কোভিড-১৯, যক্ষ্মা, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া, ইমার্জিং রোগ, নিপাহ, বার্ড ফ্লু, অসংক্রামক ব্যাধি, মাতৃস্বাস্থ্য-শিশুস্বাস্থ্য, পয়জনিং মেডিকেল এডুকেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে অব্যাহতভাবে টেকনিক্যাল সহায়তা প্রদান করে আসছে।

অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘বিশ্বকে স্বর্গ বানানোর জন্য নয়, বরং বিশ্বকে নরক হওয়া থেকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’ যেসব বিষয় মানবসভ্যতাকে নরকে পরিণত করতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রোগব্যাধি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। আমরা বাংলাদেশেসহ বিশ্বব্যাপী গুটিবসন্ত নির্মূলের কথা জানি। আমার পোলিও, নবজাতকের টিটেনাস ও কালাজ্বর প্রতিরোধে সক্ষমতা অর্জন করেছি। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাফল্যের কথা বিবেচনা করলে মাইলফলক হিসেবে এ বিষয়গুলোই আসবে।

সায়মা ওয়াজেদ ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এটি বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাফল্যগাথার একটা অনিবার্য অংশ। তারপরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব অনেক কম।

আমাদের দেশের পটভূমিতে স্বাস্থ্য নীতিনির্ধারক যাঁরা আছেন, তাঁদের মানসিকতা এখনো অনেকটাই কিউরেটিভ, ক্লিনিক্যাল ওরিয়েন্টেড বা চিকিৎসাকেন্দ্রিক। অবশ্যই রোগের চিকিৎসা করাটাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। কিন্তু আমরা একটা বড় জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করছি। তাদের জন্য ক্রমাগত স্বাস্থ্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা কত অবকাঠামো নির্মাণ করব—এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করছে।

আমি সব সময় বলি, ‘শুধু ওষুধ স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান নয়।’ আমাদের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, ওষুধই স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব সময়ই বলার চেষ্টা করেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা জোরদার করা ছাড়া ওষুধের সরবরাহ বাড়িয়ে বা অবকাঠামোর বাড়িয়ে জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কৃতিত্ব হচ্ছে তারা সরকারের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারছে। তারা কখনোই বলে না যে কাজটি আমি করেছি। তারা বলে এ কাজে আমি সরকারকে সাহায্য করেছি। এটাই তাদের মানসিকতা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিপুল জ্ঞানের ভান্ডার আছে। আমরা তাকে কীভাবে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে ব্যবহার করতে পারি, তা ভাবতে হবে। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আরও কাজ করতে চাই।

ডা. মুশতাক হোসেন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ১৯৯৩ সালে আইইডিসিআরে যোগদানের পর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি বড় অবদান। নিপাহ ভাইরাসের গাইডলাইন তৈরি, ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সেন্টার তৈরি, ল্যাবরেটরি উন্নত করে বিশ্বমানের করার ক্ষেত্রে তাদের মৌলিক অবদান রয়েছে। এসব কারণে করোনা মহামারির সময় আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।

রোহিঙ্গা সংকটেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করেছে। সেখানে প্রথম দিন থেকেই কলেরা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দিয়েছে। এ সংস্থার সহায়তায় কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে একটা রিজিওনাল ল্যাবরেটরি করা হয়েছে। রোহিঙ্গা এলাকায় কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণে ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এটি অনেক কাজে লেগেছে।

বাংলাদেশে করোনা মহামারির সময় জনবল ও আরটি–পিসিআর ল্যাব স্থাপনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক ভূমিকা রেখেছে। মহামারির সময় আমাদের সফলতার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

টিকা আনার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য অর্থ খরচ করতে আমরা দ্বিধাবোধ করিনি। এক জায়গায় না পেলে অন্য জায়গা থেকে কিনেছি। এ মানসিকতা ধারাবাহিক থাকবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আমরা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করব যে যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিরাপদ না।

ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ যদি আমরা সম্পূর্ণ করতে না পারি, তাহলে স্বাস্থ্য খাত টেকসই হবে না। ২০৩০-৩২ সাল নাগাদ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের কাছে ইমার্জেন্সি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, টাকার অভাবে কেউ যেন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। এটি না করে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে হবে না। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ নিশ্চিতের পাশাপাশি আমরা মহামারি প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও সাড়াদান নিশ্চিত করতে পারি।

একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন সংস্কার করা। কোনো দেশে যদি সংক্রমণ হয়, আর তারা যদি সেটা প্রকাশ করে তাহলে তাদের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ, রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এটা কেমন রেগুলেশন! দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার বিটা ভেরিয়েন্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। অথচ এটা প্রকাশের জন্য তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা কার্যকর উদে্যাগ নিতে পারে, যেন কোনো দেশ সংক্রমণের বিষয় প্রকাশ করলে সে দেশটি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ

১৯৭২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আলোকপাত করে। এ সংস্থা যখন বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে, তখন ওটিএমএইচ (অর্গানাইজেশনাল ট্রেনিং অন মেন্টাল হেলথ) নামে একটি কার্যক্রম ছিল। কারণ, তখন বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ছিল না। মনস্তত্ত্ববিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তখন থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পথচলা শুরু। সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ, তিনি যখন থেকে বাংলাদেশ অফিসের নেতৃত্বে এসেছেন, তখন থেকেই বিগত কয়েক বছরে মানসিক স্বাস্থ্যে আমাদের অনেক অর্জন হয়েছে।

এর মধ্যে প্রথম অর্জন হচ্ছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর অল্প কয়েকটি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যারা মানসিক স্বাস্থ্যের সব কটি প্যানেল (পলিসি, প্রোগ্রাম, অ্যাক্ট, স্ট্র্যাটেজি) চেকলিস্ট পূরণ করতে পেরেছে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যনীতি সর্বশেষ সংশোধিত হয়েছিল ২০১১ সালে। কিন্তু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য স্বতন্ত্র একটি স্বাস্থ্যনীতি আছে।

আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি জাতীয় পর্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ হয়েছে। সুইসাইড রিস্ক ফ্যাক্টর জরিপে আমি নিজেই দায়িত্বে ছিলাম। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট আরও দুটি জরিপ করেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর করা এই তিন জাতীয় জরিপে আমাদের কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের সহায়তা আমাদের গবেষণার মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আমরা বলি, স্বাস্থ্য মানে কেবল শরীর নয়, এর বাইরেও স্বাস্থ্য রয়েছে। আমরা স্বাস্থ্যের বাইরের কিছু বিষয়কেও মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছি।

স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও বিদ্যালয় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। এ বিষয়গুলো সরাসরি স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশ কিছু গাইডলাইন তৈরি করেছে।

বিশ্বজুড়েই মানসিক স্বাস্থ্যের একটা গ্যাপ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জন মানসিক রোগীর ৯২ জন চিকিৎসার বাইরে থাকেন। একে বলা হয় ট্রিটমেন্ট গ্যাপ। উন্নত দেশগুলোতে এ হার ৭০ শতাংশের বেশি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় দেশেই ৯০ শতাংশের ওপরে ট্রিটমেন্ট গ্যাপ রয়েছে। এটিকে কমিয়ে আনার জন্য আমরা যদি রাতারাতি মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ তৈরির পরিকল্পনা করি, তাহলে ভুল হবে। কারণ, গত ৫০ বছরে আমরা মাত্র ৩৫০ জন সাইকিয়াট্রিস্ট ও ৫০০ জন সাইকোলজিস্ট তৈরি করতে পেরেছি।

মানসিক স্বাস্থ্যের এই গ্যাপ নিরসনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ট্রেনিং ম্যানুয়াল রয়েছে। আমরা একে নিজেদের দেশের মতো করে গ্রহণ করেছি, এটি আমাদের একটি অর্জন। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের আইন, নীতি, কর্মকৌশল, ইনস্টিটিউট, গাইডলাইন, ট্রেনিং ম্যানুয়াল আছে। এখন শুধু বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। এ বিষয়ে আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাদের কারিগরি সহায়তায় আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যসহ মানসিক স্বাস্থ্য কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।

ডা. নাহিতুন নাহার

আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন ফেলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম আছে, যা হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল মেডিসিন বিভাগ থেকে দেওয়া হয়। হেলথ কেয়ার কোয়ালিটি ইমপ্রুভ অ্যান্ড লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের একজন ফেলো আমি। জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ স্কুলে কাজ করছি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ‘জেমস পি গ্রান্ট (জেপিজি) স্কুল অব পাবলিক হেলথ’ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর পর থেকেই এটি জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও অ্যাডভোকেসির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করে আসছে।

৫০ বছরের পথচলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একদম শুরু থেকেই আমাদের অন্যতম প্রধান অংশীদার হিসেবে এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা আমাদের দিয়ে আসছে। আমাদের স্কুলে পাঁচটি গবেষণাকেন্দ্র আছে, যার মধ্যে হেলথ সিস্টেম, ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ, যৌনতা এবং প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার (এসআরএইচআর) গবেষণার জন্য একটি সেন্টার আছে। এ ছাড়া নন–কমিউনিকেবল ডিজিজ ও ক্লাইমেট আরবান হেলথ এবং ইমপ্লিমেন্ট সায়েন্সের সেন্টার আছে। এসব সেন্টারে এক দশক ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ হয়েছে।

আমরা ২০০৭ সালে হেলথ অ্যাপ্রোচ অ্যান্ড হেলথ ওয়ার্ক লোড অ্যানালাইসিস নিয়ে গবেষণা করেছি। এসআরএইচআর নিয়ে গবেষণা ও রোহিঙ্গা কমিউনিটির জন্য নবজাতক শিশু স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত গবেষণাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে করেছি। টিবি গবেষণায় আমাদের সঙ্গে তাদের পেয়েছি।

সম্প্রতি প্রাইমারি হেলথ কেয়ার আরও শক্তিশালী করার জন্য কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকাকে কীভাবে আরও ইতিবাচক করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেছি। আমরা সব সময়ই চেষ্টা করি, বিভিন্ন গবেষণায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক ও রেফারেন্স ব্যবহার করতে। গবেষণার পাশাপাশি আমরা স্কুল থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করি। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অ্যাডভোকেসিতেও আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পাশে পেয়েছি।

বাংলাদেশে গবেষণা ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটি শক্তিশালীকরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আশা করছি, আমাদের পথচলায় সামনের দিনগুলোতেও তাদের পাশে পাব।

শিশির মোড়ল

সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলতে চাই। জাতিসংঘের সব প্রতিষ্ঠানের মধে্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটু আলাদা। আমার ধারণা, এ সংস্থা নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন সাংবাদিকদের সঙ্গে অনেকটা খোলামেলা আলোচনা করে, সে ক্ষেত্রে এ সংস্থা একটু রক্ষণশীল। এটি আমার ভালো লাগে। অন্যরা অনেক বেশি বলতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল করে। যেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম। এটা আমার পর্যবেক্ষণ।

সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন কোনো প্রতিবেদন লিখতে যাই, তখন দেখি, এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো প্রতিবেদন বা মন্তব্য আছে কি না। আমি তাদের ডকুমেন্ট খোঁজ করি। বিষয়টি সব সময় মেনে চলি। আমার সহকর্মীরাও এটা মেনে চলার চেষ্টা করেন।

আমি একবারই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিয়েছিলাম। সেটা ছিল ২০১১ সাল। তখন অনেকগুলো সেশনে উপস্থিত থেকে মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুনেছি। আমার মনে হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মধ্যে অনেক বেশি রাজনীতি রয়েছে। এ রাজনীতি একটা যুদ্ধের মতো। একটা বিষয় ছিল যে গুটিবসন্তের জীবাণু ধ্বংস করা হবে কি হবে না। এ ইস্যুতে দেশগুলো দুই ভাগ হয়েছিল।

এ বছরের মার্চ-এপ্রিলে একটা প্রভাবশালী দেশের দূতাবাস থেকে আমাকে ফোন করা হলো। তারা আমাকে বলল, এ বছর আঞ্চলিক পরিচালক নিয়ে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আমাদের (বাংলাদেশের) তো বড় কোনো জায়গায় কেউ নেই। সুতরাং আমাদের একজন আঞ্চলিক পরিচালক প্রয়োজন। আমি যেন বিষয়টি দেখি।

কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি ডকুমেন্ট তৈরি করেছিল। যিনি এটি তৈরি করেছিলেন, তিনি শুরুতে অনেক পুরোনো ডকুমেন্ট খুঁজছিলেন। তারপর তিনি আমার কাছে এলেন। আমি তাঁকে কমিউনিটি ক্লিনিকের শুরুর দিকের অনেকগুলো ডকুমেন্ট দিয়েছিলাম।

পরবর্তী সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চমৎকার একটি ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। ওই পুরো রিপোর্টের মধ্যে আমি যেটি দিতে পারিনি, তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর একটি সাক্ষাৎকার। অন্যথায় ডকুমেন্টে যা আছে, সব আমার কাছ থেকেই নেওয়া ছিল।

অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এর মধ্যে গুটিবসন্ত নির্মূল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ সরকারকে কারিগরি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পোলিও, ফাইলেরিয়া ও কালাজ্বর নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য রোগ যেমন হাম, কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য টিকাদান কর্মসূচি বিস্তারে ধারাবাহিকভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেশে টিবি প্রিভ্যালেন্স সার্ভে এবং মিজেলস্ কেস ফ্যাটালিটি স্টাডিতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া কালাজ্বর নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য মুখে খাওয়া ওষুধ মিলটেফোসিনের ফেজ ফোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং কালাজ্বরেরই অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ লাইপোজোমাল অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি–এর ফেজ থ্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে করার জন্য সহায়তা প্রদান করেছে।

১৯৫১ সালে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল স্যানিটারি রেগুলেশন গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৯ ও ২০০৫ সালে এটা সংশোধিত হয়, যা ২০০৭ সালের জুনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় প্রথম বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। এই বিধিমালায় জরুরি রোগতাত্ত্বিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সংক্রামক রোগ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়া বিষয়ে স্বাক্ষরিত দেশের মধ্যে একটি আইনগত কাঠামো তৈরি করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সাড়া দান এবং পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি অব ইন্টারন্যাশনাল কনসার্নের (পিএইচইআইসি) জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আইএইচআর ২০০৫–এর মাধ্যমে মহামারি ঘোষণার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে কোভিড-১৯–এর ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছে। মহামারিতে সাড়াদানের জন্য এ সংস্থা বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা প্রস্তুতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারি ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল, যা পরবর্তীকালে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে সাড়াদানে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

একজন বাংলাদেশি হিসেবে এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ৩৭ বছরের কর্মকালে আমাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুযোগ দিয়েছে সাম্প্রতিক একটি কমিটিতে চেয়ারম্যান এবং আটটি বিভিন্ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকার। অতীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের জন্য গঠিত মহামারি ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রিপেয়ার্ডনেসের (পিআইপি) অ্যাডভাইজারি প্যানেলে সভাপতিত্ব করার সুযোগ হয় এবং ১২টি বিভিন্ন ধরনের কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকি।

আমি আশা রাখি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশকে ক্রমাগত সাহায্য করে যাবে।

অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম

ঐতিহাসিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্ব ও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই এ সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশীয় পটভূমিতে বিবেচনা করে এ সংস্থা তার ভূমিকা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হীরকজয়ন্তীতে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।

বাংলাদেশে এ সংস্থার পথচলা ৫০ বছর পেরিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শরণার্থীদের চিকিৎসায় সাহায্য করেছে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে এ সংস্থার আনুষ্ঠানিক পথচলা। সে সময় থেকেই আমাদের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে গুরুত্ব দেয়। এ সংস্থা যেসব বিষয় সমর্থন ও অনুসমর্থন করে, সেসব আমরা মেনে চলার চেষ্টা করি।

আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখায় কাজ করি। এ ছাড়া কমিউনিকেবল ডিজিজ (সিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন অপারেশনাল প্ল্যান ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে এ সংস্থার অংশগ্রহণ রয়েছে। স্ট্র্যাটেজি ও পলিসি ডেভেলপমেন্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

আমাদের গাইডলাইন, বিভিন্ন রকমের টুলস, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান, ন্যাশনাল পলিসি ইত্যাদিতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ অফিস ও হেডকোয়ার্টারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ফাইলেরিয়াসিস ও কালাজ্বর বাংলাদেশ থেকে দূর হয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের সনদ দিয়েছে। বিশ্বে আমরাই প্রথম কালাজ্বর নির্মূল করতে পেরেছি। স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ প্রতিষ্ঠান বরাবরই আমাদের সাহায্য করেছে।

কেস ম্যানেজমেন্ট, মরবিডিটি ম্যানেজমেন্ট, ডিজঅ্যাবিলিটি প্রিভেনশন, ক্যাজুয়াল্টি অ্যাসেসমেন্ট ডেথ রিভিউসহ যা-ই বলি না কেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের পাশে রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এত কাজ করে কিন্তু ঘটা করে এ সংস্থা সম্পর্কে কিছু বলা হয় না। সেভাবে এর কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতের প্রায় সব বিষয়ের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্পৃক্ততা রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ পর্যন্ত যেভাবে আমাদের সঙ্গে ছিল, ভবিষ্যতেও সেভাবে থাকবে বলে আশা করি। আশা করি, এ সংস্থা যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এভাবে অবদান রেখে যেতে পারে।

অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭৫ বছরে একটা স্লোগান ছিল ‘হেলথ ফর অল’। ১৯৪৬ সালে এ সংস্থা তার কনস্টিটিউশন তৈরি করে। ৭৫ বছরে ৬৫টি মাইলফলক অর্জিত হয়। ১৯৪৮ সালে তারা একটা বিবৃতি দেয়, যেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, কেউ পেছনে থাকবে না, সম্পদ, সমতা সবকিছু বলেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই চল্লিশের দশকে যেটা বলেছে, আমরা এত বছর পরও সে কথাই বলছি। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা অনন্য সংস্থা।

১৯৫২ সালে পোলিও ইন্ট্রোডাকশন হয়। ১৯৬৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম আইএইচআর (ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন) ঘোষণা করে। ২০০৫ সালে এটা রিভাইজ হয়। ১৯৬৯ সালে আমাদের এটা শুরু করার কথা ছিল। আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু পেছায়নি।

১৯৭২ সালে এ সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্যের রিসার্চ ট্রেনিং ডেভেলপমেন্টের কাজ করে। এভাবে দেখা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ শুরু করেছে। ১৯৭৪ সালে তারা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) শুরু করে। পরে এ ক্ষেত্রে আমরা সফলতা অর্জন করি।

১৯৭৫ সালে ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা ঘোষণা দেয়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের অংশ হয়। কারণ, ট্রপিক্যাল মেডিসিন বলতে আমাদের মতো দেশকে বোঝায়। তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঠিক করেছিল যে আমাদের মতো দেশের জন্য পৃথক কৌশল ঠিক করতে হবে।

১৯৭৭ সালে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের তালিকা তৈরি করে। ১৯৭৮ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক শুরু হয় কাজাখস্তান থেকে। সেখানেই প্রথম ঘোষণা হয় ‘হেলথ ফর অল’। ২০২৩ সালে আমরা আবার বলছি ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’।

কাজাখস্তানের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, প্রতিটি জাতির প্রত্যেক রোগীর জন্য এখন থেকেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব দিতে হবে। তখন যদি আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব দিতে পারতাম, তাহলে আজ আমাদের অনেক অগ্রগতি হতো।

ডা. বর্ধন জং রানা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ৫০ বছর বাংলাদেশে অত্যন্ত বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এ দেশে আমাদের ৫০ বছরের পথচলায় আপনাদের মূল্যবান মতামত ও অভিজ্ঞতা আমাদের ভবিষ্যতের পথচলাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

বাংলাদেশ টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব সময় বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।

বাংলাদেশ সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করে সফলতা দেখিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সফলভাবে পলিও, কালাজ্বর ও ফাইলেরিয়া নির্মূল করতে পেরেছে। কালাজ্বর ও ফাইলেরিয়া নির্মূলের জন্য গত মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সনদ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে আরও অনেক ধরনের সফলতা বাংলাদেশের আছে। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের পাশে থেকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

আপনারা প্রত্যেকে আজকের আলোচনা সমৃদ্ধ করেছেন। প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আপনারা নিজেরা কীভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কীভাবে আপনাদের পাশে ছিল, এসব বিষয় আজকের আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছে।

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কষ্ট করে আমাদের কার্যালয়ে এসেছেন, এ জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। শুধু গোলটেবিল আলোচনার জন্য নয়, যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে আমাদের অফিসে আপনাদের স্বাগত জানাই।

উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে ভবিষ্যতেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে যাবে। এ দেশের মানুষের পাশে থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭৫ বছর পূর্তি ও বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫০ বছরের পথচলা নিয়ে এই বিশেষ গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজনের জন্য প্রচার সহযোগী প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাই।

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচকদের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম ও অর্জন নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হলো। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ।

সুপারিশ

  • বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি।

  • কেবল ওষুধই স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান নয়, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদারকরণ।

  • স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরী সহযোগিতা নিশ্চিতকরণ।

  • দেশের আপাময় জনসাধারণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনয়ন।

  • ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশনের সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ।

  • মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার ঘাটতি পূরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা বৃদ্ধি।

  • চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক ও রেফারেন্স ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।

  • ট্রপিক্যাল মেডিসিন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারে উদে্যাগ বৃদ্ধি।